অ্যানাদার সীড ফর দ্য ফিউচার
অক্টোবর ১৯৪৮
১৯৪৮ সালের শরৎকালের কথা। দৈনিক পত্রিকায় ছাপা এক খবরের সূত্র ধরে পুরো নাগাসাকি শহরের জনগণের মাঝেই উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লো। অক্টোবরের ১৬ তারিখ শহরটিতে রেলযোগে বেশ গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তির আসবার কথা ছিলো। বাবা অবশ্যই জানতেন তিনি কে। কিন্তু সাচিকো সিদ্ধান্ত নিলো, সে নিজে নিজেই খুঁজে বের করবে।
স্কুলের পর বাসা থেকে অনুমতি নিয়েই বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে সাচিকো নাগাসাকি স্টেশনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো। ততক্ষণে অনেকেই চলে এসেছিলো, আরো অনেক মানুষজন আসছিলো। একসময় জমায়েত হওয়া মানুষের সংখ্যা কয়েক হাজারে গিয়ে ঠেকলো। চিপাচাপা দিয়ে কোনোমতে একটু একটু করে প্লাটফর্মের দিকে এগোতে থাকলো সাচিকো, যেন সবকিছু আরো ভালোভাবে দেখা যায়।
কিছুক্ষণ পর ট্রেনটি স্টেশনে এসে থামলো। সাচিকো তখনও ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলো।
অতিথিকে অভ্যর্থনা জানাতে কয়েকটি শিশু এবং কয়েকজন কর্মকর্তাকে নিয়ে শহরের মেয়রও স্টেশনে অপেক্ষা করছিলেন। ট্রেন আসার সাথে সাথে তারাও মাথা ঝুঁকিয়ে দেখতে লাগলেন।
হঠাৎ করেই উপস্থিত সবাই হর্ষধ্বনিতে ফেটে পড়লো। ধূসর চুল এবং মুখে মিষ্টি হাসি নিয়ে লম্বা এক নারী ট্রেন থেকে নামলেন। তার পরনে ছিলো পশ্চিমা ধাঁচে বানানো একটি পোশাক, পায়ে স্যান্ডেল এবং মাথায় হ্যাট। সাচিকো তার দিকে তাকিয়েই থাকলো। মহিলাটি দেখতে বেশ সুন্দরীই ছিলেন। প্লাটফর্ম ধরে বেশ লম্বা পদক্ষেপ ফেলতে ফেলতেই তিনি এগিয়ে গেলেন। তার গোল গোল চোখগুলো দেখতে ঠিক আমেরিকান সৈন্যদের চোখের মতোই লাগছিলো।
হাসতে থাকা সেই নারীর সাথে একইরকম পোশাক পরা, গোল চোখের আরেকজন মহিলাও ছিলেন। তাদের দুজনকে দেখে বান্ধবী বলেই মনে হচ্ছিলো। একজন আরেকজনের হাতে হাত রেখে হাঁটছিলেন তারা।
প্রথমোক্ত সেই নারী যেন আরেকটু বেশিই হাসছিলেন। উপস্থিত জনতা আবারও হর্ষধ্বনি করে উঠলো। এরপরই তারা একটি গান গাইতে শুরু করলো, যা সাচিকো আগে কখনো শোনেনি।
Happy little bluebird.
Flew to Japan…
All the way from a foreign country
To this country. To this town.
The bird flew to Japan, over the sea.
The little bird always stays on Helen Keller’s shoulder.
হেলেন কেলার? ট্রেন থেকে নামা সেই মহিলা হেলেন কেলার?
সমবেত জনতার দিকে তাকিয়ে হাসি দিলেন হেলেন কেলার; কোনো নির্দিষ্ট দিকে তাকিয়ে ছিলেন না তিনি, তার মুখ জুড়ে ছিলো প্রশান্তির ছোঁয়া। জনতার সাথে সাথে তিনিও গুন গুন করে গাইতে লাগলেন। সুরের তালে তালে মেলাতে লাগলেন আঙুলগুলো।
সাচিকো অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। গান শেষ হলে হেলেন মাইক্রোফোনের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালেন। হেলেনের সাথে থাকা অন্য নারী, যার নাম পলি থমসন, তিনিও তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। গলাটা পরিষ্কার করে সামনে দাঁড়ানো হাজার হাজার মানুষের উদ্দেশ্যে কথা বলতে শুরু করলেন হেলেন কেলার। স্পষ্ট কণ্ঠে, ধীরে ধীরে, একই লয়ে কথা বলে যাচ্ছিলেন তিনি। মাঝে মাঝে মাঝেই কথার মাঝে খেই হারিয়ে ফেলছিলেন তিনি। তবে এরপরও যে তার বক্তব্যের মাঝে স্পষ্ট দৃঢ়তা মিশে ছিল, তা সাচিকো খুব সহজেই বুঝতে পারছিলো।
হেলেনের সঙ্গী সেই কথাগুলোই সকলের উদ্দেশ্যে আরো উচ্চস্বরে বললেন। এরপর সরকারী এক কর্মকর্তা সেগুলো জনসাধারণের জন্য জাপানী ভাষায় অনুবাদ করে শোনালো।
“চমৎকার সমুদ্রবেষ্টিত এই নাগাসাকি শহরটি আগের চেয়েও আরও অনেক সুন্দর একটি শহর হিসেবে পুনর্জন্ম লাভ করুক, আমি সেই কামনাই করবো।”
শহরের মূক ও বধিরদের স্কুল থেকে দুজন শিক্ষার্থীকে আনা হয়েছিল হেলেন কেলারকে অভিবাদন জানাতে আনা সেই দলে। তারা তাকে ফুলের তোড়া দিয়ে বরণ করে নেয়। তাদের চুমু দিয়ে হেলেন বলে উঠলেন, “আরিগাতো।”
“আরিগাতো?”শব্দটি শুনেই চমকে গেলো সাচিকো। তার মানে হেলেন কেলার “আপনাকে ধন্যবাদ” এর জাপানী শব্দ জানেন?
প্লাটফর্ম দিয়ে হেঁটে হেঁটে বাইরে অপেক্ষমাণ একটি গাড়িয়ে গিয়ে উঠলেন তারা। যাবার আগে সবার উদ্দেশ্যে হাত নেড়ে হেলেন বললেন, “সায়োনারা (বিদায়)।”
হেলেন কেলারের ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়ে গেলো সাচিকো। আরও জানতে বাবার কাছে জিজ্ঞাসা করতে হবে তার।
বাবাও হেলেন কেলার সম্পর্কে জানতেন। জাপানে আসার আগেই তিনি পুরো দেশ জুড়ে খুব বিখ্যাত ছিলেন। তার আত্মজীবনী, ‘দ্য স্টোরি অফ মাই লাইফ’, জাপানী ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছিলো। একাধারে লেখিকা, শান্তিকর্মী এবং বিকলাঙ্গদের জন্য নিরলস পরিশ্রম করে যাওয়া হেলেন এবার দ্বিতীয়বারের মতো জাপানে এসেছিলেন। এবার তার আগমনের মূল লক্ষ্য ছিলো তারই দৃষ্টিশক্তিহীন বন্ধু তাকিও ইওয়াহাশিকে মূক ও বধিরদের জন্য অনুদান সংগ্রহে সাহায্য করা। এখানে জানিয়ে রাখা ভালো, হেলেন কেলার নিজেও কিন্তু মূক ও বধির ছিলেন।
“হেলেন কেলার দেখতে কিংবা শুনতে পান না!” সাচিকোর বিস্ময়ের সীমা রইলো না। সেদিন বিকালেই সে হেলেনকে হাসতে, গাইতে এবং হাজার হাজার মানুষের সামনে মাইক্রোফোনে বক্তৃতা দিতে শুনেছে। তার উদ্যম আর মাথায় হ্যাটটা যেভাবে বেঁকে ছিল, সেগুলো সাচিকোর কাছে বেশ ভালো লেগেছিল। তিনিই প্রথম আমেরিকান নারী, যাকে কি না সাচিকো নিজ চোখে দেখেছিল। তিনি মূক ও বধির হলেন কীভাবে?
হেলেন কেলারের শৈশবকে কিংবদন্তির সাথে তুলনা করা যায় সহজেই। খুব ছোটবেলায় তিনি ভয়াবহ এক অসুখে আক্রান্ত হন, সম্ভবত স্কারলেট ফিভারে, যা তার দৃষ্টি ও শ্রবণশক্তি চিরতরে কেড়ে নেয়, তাকে ছুঁড়ে ফেলে আলোহীন, শব্দহীন এক জগতে। এমনই পরিস্থিতিতে অ্যান সুলিভানের (হেলেন কেলারের শিক্ষিকা) আগমন হেলেনের জীবনে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। শুরুতেই অ্যানকে বেশ বেগ পেতে হয় তার এই নবীন শিক্ষার্থীর রাগ ও ভয় নিয়ন্ত্রণে এনে তার হাতে শব্দ বুননের জাদু তুলে দিতে। তিনি হেলেনকে সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যবহার করে যোগাযোগের পদ্ধতি শেখালেন, যা মেয়েটিকে অন্ধকার থেকে আলোর সন্ধান দিলো। কিন্তু, দশ বছর বয়সে হেলেন চাইলো তার নিজের কণ্ঠস্বর ব্যবহার করেই কথা বলতে।
অ্যানই তখন হেলেনের জন্য একজন স্পিচ টিচারের ব্যবস্থা করে দেন। আঙুলের সংবেদনশীল শীর্ষভাগ দিয়ে হেলেন তখন শব্দের প্রকৃতি বোঝার চর্চা চালিয়ে যেতে লাগলো- কীভাবে জিহ্বা ও গলা নড়াচড়া করে, শ্বাসপ্রশ্বাসে নাকের ভূমিকা, ঠোঁটের কম্পন ইত্যাদি। হেলেন প্রথমে শব্দ করা, এরপর মুখ থেকে কোনো ধ্বনি বের করা, শব্দ, বাক্য, এবং শেষপর্যন্ত মনের পুরো ভাবই প্রকাশ করা শিখে যান। হেলেন কি পুরোপুরি ঠিকভাবে কথাবার্তা বলছিলেন কি না সেটা মোটেও গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয় ছিলো না। আসল কথা হলো, তার মতো একজন ব্যক্তি সকল বাঁধা অতিক্রম করে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারছিলো।
১৯৪৮ সালের শরতকালে হেলেন কেলার নিজেই হিরোশিমা ও নাগাসাকির জনগণের সাথে কথাবার্তা বলেছিলেন। আহতদের ক্ষতস্থানে হাত বুলিয়ে একদিকে যেমন তিনি বেশ কষ্ট পেলেন, তেমনই মনের ভেতর প্রবল এক ঘৃণামিশ্রিত ক্রোধ জেগে উঠেছিল তার। হিরোশিমা ও নাগাসাকি সেবারের যাত্রা তার মনে বেশ বড় দাগ কেটে গিয়েছিল। পরবর্তীকালে তিনি লিখেছিলেন,
“আমি নিশ্চিত যে, দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা নাগাসাকির ধ্বংসস্তূপের গন্ধ আমার নাকে এসেছিল, এসেছিল মৃত্যুর গন্ধও।”
চলে যাবার আগে তিনি পারমাণবিক বোমার বিরুদ্ধে আজীবন লড়ে যাবার এবং শান্তির জন্য কাজ করার প্রতিজ্ঞাও ব্যক্ত করেন।
হেলেন কেলার যেদিন নাগাসাকিতে এসেছিলেন, সেই দিনটির কথা সাচিকো কোনোদিনই ভুলতে পারবেন না। তিনি সাচিকোকে সেই কর্পূর গাছগুলোর কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, যেগুলো শত আঘাত সহ্য করেও দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে ছিল। তিনি এমনই এক নারী, যিনি নিজ প্রতিবন্ধকতাসমূহ জয় করেছিলেন; আঁধারের মাঝেও আলো খুঁজে পেয়েছিলেন, হতাশার মাঝেও আশার বাণী শুনতে পেয়েছিলেন। বাড়িয়ে দেয়া হাতের মাধ্যমে তিনি যেন এটাই বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, চাইলে পুরো মানবজাতিকেই ভালোবাসা সম্ভব।
হেলেন কেলারের ছবি নিজের মনে গেঁথে নিলো সাচিকো, তাকে স্থান দিলো গান্ধীজির স্মৃতির পাশেই।
জীবনের একটা সময়ে গিয়ে এই দুজনকেই দরকার পড়বে তার।
এই সিরিজের পূর্ববর্তী পর্বসমূহ
১) পর্ব – ১ || ২) পর্ব – ২ || ৩) পর্ব – ৩ || ৪) পর্ব – ৪ || ৫) পর্ব – ৫ || ৬) পর্ব – ৬ || ৭) পর্ব ৭ || ৮) পর্ব ৮ || ৯) পর্ব ৯ || পর্ব ১০ || পর্ব ১১ || পর্ব ১২