বাঙালি নারীর জীবনে শাড়ি চিরকালই একটা আলাদা ভূমিকা রেখে এসেছে। বাঙালিয়ানার সাথে নারীর পোশাক হিসেবে শাড়ি আর পুরুষের পোশাক হিসেবে লুঙ্গি উভয়ই ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকলেও কালের বিবর্তনে লুঙ্গি যতটা ব্রাত্যজনের পোশাকে পরিণত হয়েছে, সে তুলনায় শাড়ি তার আভিজাত্য, মর্যাদা, গাম্ভীর্য, আবেদন তীব্রভাবে ধরে রেখেছে। পোশাকের সাথে অনুভূতির এতটা সুগভীর মেলবন্ধন সচরাচর দেখা যায় না। শাড়ির ইতিহাস খেয়াল করলেও দেখা যাবে, তার রয়েছে এক অসম্ভব সমৃদ্ধ পথচলা; যা কিনা নকশার বৈচিত্র্যে, কাপড়ের বুননে, আবহাওয়ার তারতম্যে, কারিগরির নৈপুণ্যে টইটুম্বুর।
ধারণা করা হয়ে থাকে, বাংলা ‘শাড়ি’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত শব্দ ‘শাটী’ থেকে। তবে ইতিহাসবিদরা শব্দের এ আগমন নিয়ে একেবারে নিশ্চিত নন। কেননা, এর বিপরীতে মতবাদ প্রচলিত যে, ‘শাটী’ শব্দটি নিজেও সংস্কৃত ভাষার মৌলিক সম্পদ নয়। ভারতবর্ষে আর্যদের আগমনের আগেও সম্ভবত ‘শাটী’ শব্দের প্রচলন ছিল। আর মধ্যভারতীয় আর্য ভাষায় শাড়ির সমার্থক হিসেবে ‘সাটক’ বা ‘সাটিকা’ ইত্যাদি শব্দের প্রমাণ মেলে। মহাভারতে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের যে ঘটনা উল্লিখিত, সেটি শাড়ি বলেই সবক্ষেত্রে ধরে নেওয়া হয়।
ঋগ্বেদের দিকে নজর দিলে বলতে হয়, তাতে পোশাক হিসেবে শাড়ির উল্লেখ ছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ বছরের দিকে। ঋগ্বেদানুসারে, বিভিন্ন ভারতীয় মূর্তির গায়ে পোশাক হিসেবে শাড়ি জড়ানো ছিল। তখনকার সময়ে শাড়ি তার আক্ষরিক অর্থেই পরিধেয় বস্ত্র ছিল। অর্থাৎ এক টুকরো দীঘল কাপড়, যা নারীরা তাদের সর্বাঙ্গে জড়িয়ে নিত। ভারতবর্ষের আবহাওয়া এবং রক্ষণশীল পরিমণ্ডলে হিন্দু, মুসলমান উভয় সম্প্রদায়েই নারীর পোশাক হিসেবে শাড়ি বহুকাল ধরে এক বিশেষ অবস্থান দখল করে এসেছে।
গুপ্ত যুগের (আনুমানিক ৩০০ থেকে ৫০০ সাল পর্যন্ত) কবি কালিদাসের এক অনবদ্য রচনা ‘কুমারসম্ভব’, যেখানে শাড়ির উল্লেখ পাওয়া যায়। গুপ্ত আমলেরই ইলোরা অজন্তা গুহার প্রাচীন চিত্রাবলী থেকে শাড়ির অস্তিত্বের নিদর্শন মেলে। আবার পাহাড়পুর ও ময়নামতির পোড়ামাটির ফলক থেকে তথ্য মেলে, শাড়ির প্রচলন পূর্ববঙ্গেও ছিল। তবে যখনকার কথা বলা হচ্ছে, সেই প্রাচীনামলে শাড়ি এখনকার মতো করে পরা হতো না। ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায়ের মতে, পূর্ব-দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতে মূলত এক খণ্ড কাপড় গায়ে জড়িয়ে নিয়ে নিজেকে আবৃত করাই চল ছিল। এ কাপড় পুরুষের গায়ে ধুতি, আর নারীর গায়ে শাড়ি নামে পরিচিত ছিল।
বাঙালি সমাজে দীর্ঘদিন পর্যন্ত শাড়ি পরা হতো শুধু শাড়ি হিসেবেই। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবী যখন ইংরেজদের ক্লাবে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিতে গেলেন, তখন ব্রিটিশরা বাদ সেঁধে বসল। উন্মুক্ত বক্ষ নিয়ে কোনো নারীকে তারা পার্টিতে প্রবেশ করতে অসম্মতি জানায়। তখন থেকেই জ্ঞানদানন্দিনী দেবী অন্তর্বাস এবং ব্লাউজ পরা শুরু করেন এবং তারই হাত ধরে বাঙালি নারীর পোশাকের ইতিহাস আমূল বদলে যায়। মজার বিষয় হচ্ছে, ব্লাউজ ও পেটিকোট দু’টি শব্দ ইংরেজি হলেও এগুলো ভারতীয় ইতিহাসের প্রায় নিজস্ব সম্পদ বনে যায় ভ্যাটিকান আমলে।
ভারতীয় সংস্কৃতিকে মোটা দাগে তিন ভাগ করা যায়। হিন্দুস্তানি (বর্তমান পাকিস্তান ও উত্তর ভারত), কর্ণাটী (দক্ষিণ ভারত) এবং পূর্বভারতীয় (বাংলা, আসাম, উড়িষ্যা)। এর মাঝে পূর্বভারতীয় সংস্কৃতি প্রকৃতপক্ষে হিন্দুস্তান (আর্য) এবং কর্ণাটী (অনার্য) সংস্কৃতির মিশেলে গড়ে ওঠা। এসব কারণেই ভারতীয় নারীদের একটা সুবিশাল অংশ তাদের প্রধানতম পোশাক হিসেবে শাড়ি পরলেও পরনের শৈলীর ক্ষেত্রে আকাশ-পাতাল তারতম্য সুস্পষ্ট। বাঙালি নারীদের কেউ এক প্যাঁচে শাড়ি পরেন, আবার কেউ পরেন আঁচল দিয়ে। মারাঠিদের মাঝে শাড়িকে ধুতির আদলে পরার চল বিদ্যমান, রাজপুতানীরা শাড়িকেই ঘাগড়ার মতো করে পরে থাকেন আর কেরালার নারীরা শাড়ি পরার ক্ষেত্রে কখনও কোমরের বিছা, আবার কখনও শাড়ির আঁচলকে বিশেষ ঢঙে শরীরের সামনের দিকে গুঁজে থাকেন।
‘শাড়িস অভ ইন্ডিয়া: ট্র্যাডিশন অ্যান্ড বিয়োন্ড’ বইয়ের লেখক কাপুর চিশতীর গবেষণামতে, ভারতবর্ষে শাড়ি পরার শতাধিক উপায় আছে। অঞ্চল, কাপড়ের ধরন, বুনন শৈলী, শাড়ির দৈর্ঘ্য ইত্যাদির উপর নির্ভর করে নারীরা এই ভিন্ন ভিন্ন উপায় অবলম্বন করে শাড়ি পরেন। তিনি শাড়ি পরার এসব উপায়ের উপর একটি সিরিজ নির্মাণ করেছেন।
শাড়ির রকমফেরের কথা বলতে গেলে সে গল্প শেষ হওয়ার নয়। গঙ্গা নদীর পাশেই অবস্থিত বানারস শহরের মৌলিক সৃষ্টি বেনারসি শাড়ি। বেনারসি সিল্ক এই শাড়িগুলো সাধারণত খুব উজ্জ্বল রঙের হয় এবং বিভিন্ন উৎসবের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে পরা হয়ে থাকে। কেরালার নারীরা সাধারণত যেসব শাড়ি পরেন, সেগুলো ঊনিশ শতকের আগে, অর্থাৎ শিল্পায়ন পূর্ববর্তী ঐতিহ্যকে ধারণ করে চলেছে। আবার পশ্চিমবঙ্গে বালুচরি শাড়ি অসম্ভব জনপ্রিয়। শাড়ি, তা সে যে অঞ্চলেরই হোক না কেন, রঙে, ঢঙে, নকশায়, বুননের কারুকার্যে সবসময়ই একটা সময়ের গল্প বলে, যেটি অন্যান্য পোশাকের ক্ষেত্রে সম্ভবত একেবারেই দুর্লভ।
সেলাই বা সিয়ান শিল্পের বহুল প্রসার শাড়ি পরিধানের চলকে আমূল বদলে দেয়। সিয়ান শিল্প আসার আগে অর্থাৎ শাড়ি যখন আক্ষরিক অর্থেই সেলাইবিহীন একটি পোশাক ছিল, তখন শরীর আবৃত করার পর অবশিষ্ট অংশটুকু নারীদের গায়ের সামনে বা পেছন দিকে ঝুলে থাকত। সেলাইয়ের বদৌলতে ব্লাউজ, সায়া ইত্যাদি যখন শাড়ির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেল, তখন শাড়ির অত্যন্ত জনপ্রিয় ধারা ছিল ‘এক প্যাঁচে’ পরা। ব্লাউজ, পেটিকোট সহযোগে এক প্যাঁচে শাড়ি পরার মাধ্যমে নারীদের পর্দা রক্ষার কাজটি বেশ সুবিধার হয়ে এসেছিল। সাংসারিক কাজেও নারীরা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন এভাবে শাড়ি পরে।
একটা সময় পর এক প্যাঁচে শাড়ি পরার ধরনেও এল পরিবর্তন। নারীরা কুঁচি দিয়ে শাড়ি পরতে আরম্ভ করলেন। এভাবে শাড়ি পরলে বাম কাঁধের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া আঁচল দিয়ে নারীদের অবগুণ্ঠনের কাজটি দিব্যি হয়ে যেত। এখানে একটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, কুঁচি দিয়ে শাড়ি পরার ধারণা এসেছিল মূলত অবাঙালিদের কাছ থেকে। ঘাগড়ার ঘেরাও কুঁচিই সামান্য পরিবর্তিত হয়ে ভারতীয় নারীর শাড়িতে স্থান করে নিয়েছে।
পোশাক হিসেবে শাড়ি যখন বাঙালিদের পাশাপাশি অবাঙালিদের মাঝেও জনপ্রিয়তা অর্জন করল, তখন তারা তাদের ঘাগড়া পরার ধরনকে নতুন উপায়ে উপস্থাপন করলেন শাড়িতেও। সেখান থেকেই ধীরে ধীরে কুঁচি দিয়ে শাড়ি পরতে শুরু করলেন অনেকেই আর কালক্রমে এটিই মূলধারা হয়ে যায়। কুঁচি দিয়ে শাড়ি পরার আগে শাড়ি আক্ষরিক অর্থেই একটি ঢিলেঢালা পোশাক হিসেবে প্রচলিত ছিল, তবে কুঁচির প্রবর্তনের মাধ্যমেই শাড়িকে গায়ে জড়ানো শুরু হলো একেবারে টানটান করে। শাড়ির ঢিলেঢালা কায়দাটি ধীরে ধীরে লুপ্ত হয়ে যেতে লাগল, আর নারীরা শাড়িকে পরতে শুরু করলেন একেবারে গায়ের সাথে টেনে; কোমর, বুক, পিঠ সর্বাঙ্গে শাড়ি আগের চেয়ে হয়ে উঠল অনেক বেশি সুবিন্যস্ত ও পরিপাটি।