
১৯৪৯ সালের ১২ আগস্ট; কাজাখস্তানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় শহর সেমিপালাতিনস্ক, বর্তমান সেমেইয়ের বাসিন্দারা হঠাৎ তীব্র ভূমিকম্পের সাথে বিকট এক আওয়াজ শুনতে পায়। মূহুর্তে পশ্চিমাকাশে তারা দেখে দৈত্যাকার মাশরুমসদৃশ এক মেঘ। অন্যদিকে, স্থানীয় বেতার সম্প্রচার কেন্দ্র থেকে একে একাধিক প্রাকৃতিক দুর্যোগের সমারোহ বলে প্রচার করা হয়। একইসাথে শহরবাসীকে বাড়ির বাইরে বের হয়ে রৌদ্রোজ্জ্বল আকাশের সৌন্দর্য উপভোগ করতে আহ্বান করা হয়। অবশ্যই সম্প্রচারটি ছিল মিথ্যা এবং সোভিয়েত সরকারের চাটুকারিতায় ভরা। তবে ঐ মিথ্যার অন্তরালে যে সত্য লুকায়িত ছিল তা পরবর্তী দিনগুলো থেকে আজ পর্যন্ত উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় কাজাখদের নিকট দুঃস্বপ্ন হয়ে রয়েছে।
সেই ঘটনার চার বছর পূর্বে, ১৯৪৫ সালের ১৬ জুলাই, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ মেক্সিকোর মরুভূমিতে একদল পরমাণুবিজ্ঞানী পরীক্ষামূলকভাবে পৃথিবীর প্রথম পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটাযন। ঐদিন পৃথিবীর ইতিহাসে নতুন এক যুগের সূচনা হয়। পরবর্তীতে পৃথিবীব্যাপী এখন পর্যন্ত যতগুলো পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে, এর মধ্যে দুটি ব্যতীত সবগুলোই ছিল পরীক্ষামূলক। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক (প্রায় এক-চতুর্থাংশ) বিস্ফোরণ ঘটানো হয় কাজাখস্তানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত সেমিপালাতিনস্ক টেস্ট সাইটে। স্নায়ুযুদ্ধের যুগে সোভিয়েত ইউনিয়নকে সামরিক শক্তিমত্তার প্রতিযোগিতায় টিকিয়ে রাখতে ঐ পরীক্ষাকেন্দ্রের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। তবে অনেকটা ইচ্ছাকৃতভাবেই ঐ পরীক্ষাকেন্দ্রের আশেপাশে অবস্থানরত জনগণের ক্ষতি বরাবরই এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।

সেমিপালাতিনস্ক টেস্ট সাইট
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্তিম ক্ষণে জাপানের মাটিতে পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ববাসীকে নিজেদের শক্তিমত্তার জানান দেয়। একইসাথে পারমাণবিক অস্ত্রই যে ভবিষ্যতের সামরিক শক্তিমত্তার প্রধান নির্ণায়ক হবে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যুক্তরাষ্ট্রের এই অগ্রযাত্রায় সোভিয়েত ইউনিয়ন বেশ নড়েচড়ে বসে। সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে থাকা জোসেফ স্ট্যালিন যেকোনো মূল্যে এবং দ্রুততম সময়ে পারমাণবিক সক্ষমতা অর্জনের সিদ্ধান্ত নেন। এজন্য তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নবাসীদের গণবলি দিতেও রাজি ছিলেন। আর আসলেই সেই বলিদানের ঘটনা ঘটে কাজাখস্তানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে। তবে তার হয়ে ঐ কাজটি করে তারই ঘনিষ্ঠ সহচর লাভরেন্তি বেরিয়া।

১৯৪৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে সোভিয়েত সরকার পরমাণু বিজ্ঞানী ইগর কুরচাতভের নেতৃত্বে তাদের নিজস্ব পারমাণবিক প্রকল্প শুরু করে। তখন থেকেই প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে ঐ প্রকল্পের দায়িত্বে ছিলেন লাভরেন্তি বেরিয়া। তবে ১৯৪৫ সালের আগস্টে যুক্তরাষ্ট্রের সফলতা দেখে ঐ প্রকল্পের গতি ত্বরান্বিত করা হয়। কিন্তু পারমাণবিক বোমায় ব্যবহৃত ইউরেনিয়াম ও প্লুটোনিয়ামসহ অন্যান্য তেজস্ক্রিয় পদার্থ নিয়ে গবেষণার পাশাপাশি একটি পরীক্ষাকেন্দ্র নির্মাণও আবশ্যক। কারণ যত্রতত্র তো পরীক্ষামূলক পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো সম্ভব নয়। এরই ধারাবাহিকতায় কাজাখস্তানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ১৮,৫০০ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে সেমিপালাতিনস্ক টেস্ট সাইটের যাত্রা শুরু হয়। ঐ পরীক্ষাকেন্দ্রটি পলিগন নামেও পরিচিত। পরের বছরের মধ্যে সোভিয়েত গুলাগগুলো থেকে কয়েদিদের নিয়ে উক্ত পরীক্ষাকেন্দ্রের নির্মাণকাজ সম্পন্ন করা হয়।

পারমাণবিক গবেষণায় গতি বৃদ্ধির চার বছরের মাথায়, ১৯৪৯ সালের ২৯ আগস্ট, সোভিয়েত ইউনিয়ন পারমাণবিক বোমার প্রথম সফল বিস্ফোরণ ঘটায়। পরবর্তী চার দশকে পলিগনে মোট ৪৫৬টি পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এর মধ্যে ১৯৪৯-৬৩ সাল পর্যন্ত পলিগনে পরীক্ষাকৃত ১১৬টি বোমার সবগুলোর বিস্ফোরণ ঘটানো হয় মাটির উপরিভাগে। ফলে বায়ুমণ্ডলে বোমার তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ার মাত্রা ছিল অত্যাধিক। তবে পরবর্তীতে ১৯৬৩ সালের ৫ আগস্ট মস্কোতে স্বাক্ষরিত আংশিক পরীক্ষা নিষিদ্ধকরণ চুক্তির অংশ হিসেবে পারমাণবিক পরীক্ষা ভূগর্ভে স্থানান্তর করা হয়। স্বাভাবিকভাবেই ভূগর্ভস্থ টানেলে পরীক্ষার কারণে পারমাণবিক বোমার তেজস্ক্রিয়তা নিঃসরণের মাত্রা কমে গিয়েছিল। তবে তা কখনোই শূন্যের কোঠায় যায়নি।

সেমিপালাতিনস্ক টেস্ট সাইট সোভিয়েতদের বিশ্বে সামরিক পরাশক্তি হিসেবে টিকে থাকতে সাহায্য করেছিল ঠিকই, কিন্তু সেই সফলতার চরম মূল্য দিতে হয়েছে কাজাখস্তানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় বাসিন্দাদের। পারমাণবিক বোমার পরীক্ষাকেন্দ্র স্থাপনের ক্ষেত্রে অবশ্যই একটি জনমানবশূন্য অঞ্চল নির্ধারণ করতে হয়। কারণ বিস্ফোরিত বোমার তেজস্ক্রিয়তা আসলে কতদূর যেতে পারে তা অনুমান করা অধিকাংশ সময় অসম্ভব। বেরিয়া ক্রেমলিনে রিপোর্ট পাঠান- পরীক্ষাকেন্দ্র হিসেবে নির্বাচিত এলাকা ও এর আশপাশ একেবারেই জনমানবশূন্য। কিন্তু তিনি মিথ্যা রিপোর্ট দিয়েছিলেন। কারণ ঐ পরীক্ষাকেন্দ্রের নিকটবর্তী এলাকায় কাজাখস্তানের স্তেপে বিচরণ করা যাযাবরদের বেশ কয়েকটি গ্রাম ছিল। এছাড়া সেমিপালাতিনস্ক শহর, যার নামানুসারে সেমিপালাতিনস্ক টেস্ট সাইটের নামকরণ করা হয়, উক্ত পরীক্ষাকেন্দ্র থেকে মাত্র ১৫০ কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত। আর ঐ শহরে বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে লক্ষাধিক মানুষ বসবাস করত। হয় সোভিয়েত সরকার ঐ এলাকাবাসীদের ব্যাপারে ভ্রক্ষেপ করেনি অথবা মানবদেহে বোমার প্রভাব পরীক্ষার অসৎ উদ্দেশ্যে তাদেরকে সেখান থেকে স্থানান্তর করেনি।

সর্বনাশা সংস্পর্শ
সেমিপালাতিনস্ক শহরের বাসিন্দা ভ্যালেন্টিনা নিকনচিকের এখনো মনে পড়ে ১৯৫৩ সালের ১২ আগস্টের কথা। সেদিন তিনি বাড়ির বাইরের মাঠে খেলা করছিলেন, ঠিক তখনই এক গগনবিদারী শব্দ তার কানে আসে এবং তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। ছোট্ট ভ্যালেন্টিনার হিতাহিতজ্ঞান শূন্যকারী ঐ শব্দের উৎপত্তিস্থল ছিল সেমিপালাতিনস্ক টেস্ট সাইট। তবে পলিগনে সেদিন বিস্ফোরিত বোমাটি আসলে কোনো সাধারণ পারমাণবিক বোমা ছিল না। বরং সেটি ছিল সোভিয়েত পরমাণু বিজ্ঞানীদের হাতে বিস্ফোরিত প্রথম তাপীয়-পারমাণবিক বোমা, যা ছিল দ্বিতীয় প্রজন্মের। ৪০০ কিলোটনেরও বেশি টিনটির সমতুল্য সেই বোমা হিরোশিমায় নিক্ষিপ্ত ‘লিটল বয়’ থেকে প্রায় ২৫ গুণ বেশি ক্ষমতা সম্পন্ন। ক্ষমতার পাশাপাশি মানবদেহে এই বোমার তেজস্ক্রিয়তার ক্ষতিকারক প্রভাব ছিল সবচেয়ে বেশি।

পারমাণবিক বোমার তেজস্ক্রিয়তা যে শুধু নির্দিষ্ট সীমার মধ্যেই ছড়ায় এমনটি নয়। বরং বাতাসের মাধ্যমেও সেই তেজস্ক্রিয়তা দূরবর্তী অঞ্চলগুলোতে পৌঁছে যেতে পারে। এমনই একটি ঘটনা ঘটে ১৯৫৬ সালের আগস্টে যখন বিস্ফোরিত বোমার বিষক্রিয়া পলিগন থেকে ৪০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত উস্ট-কামেনোগর্স্ক শহর পর্যন্ত পৌঁছে যায়। সেদিন ঐ শহরের প্রায় ৬০০ জন বাসিন্দাকে তেজস্ক্রিয়তাজনিত অসুস্থতায় হাসপাতালে ভর্তি হয়। তবে তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত কোনো তথ্য সোভিয়েত সরকার প্রকাশ করতে দেয়নি। এমনকি পরবর্তীতে ঐ বিষয়ে যত নথিপত্র ছিল তা সোভিয়েতরা হয় নষ্ট করেছে, নাহয় মস্কো নিয়ে গেছে।

দ্রুত ক্রমবর্ধমান কোষের উপর তেজস্ক্রিয়তার প্রভাব অত্যন্ত মারাত্মক। যেমন ধরুন, মাতৃগর্ভের ভ্রুণ। পলিগনের আশেপাশের গর্ভবতী মায়েদের মাঝে যারা তেজস্ক্রিয়তার সংস্পর্শে এসেছিল তাদের বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী কিংবা বিকলাঙ্গ শিশু জন্ম দেওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। এমনকি তাদের ক্ষেত্রে গর্ভপাতের পরিমাণও আশংকাজনক। তবে গর্ভবতী মাসহ অন্য যারা তেজস্ক্রিয়তার সংস্পর্শে এসেছিল তাদের অনেকের ক্ষেত্রে তেজস্ক্রিয়তার প্রভাব তৎক্ষণাৎ দেখা যায় না।
সোভিয়েত সরকার কাজাখস্তানে পারমাণবিক বোমার তেজস্ক্রিয়তার সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিল ঠিকই। কিন্তু তাদের অসুস্থতার আসল কারণ কখনোই তাদের জানানো হয়নি। বরং বলা হয়েছিল, কোনো এক গবাদিপশুর রোগের জন্য তাদের চিকিৎসাসেবা দেয়া হচ্ছে। অন্যদিকে সেমিপালাতিনস্ক টেস্ট সাইটের নিকটবর্তী এলাকায় বসবাসরত কাজাখদের অন্যত্র স্থানান্তরের বদলে সোভিয়েত সরকার পারমাণবিক বোমার তেজস্ক্রিয়তা তাদের শরীরকে কীভাবে প্রভাবিত করে তা নিয়ে তারা বেশি আগ্রহী ছিল। সত্যি বলতে, সোভিয়েত পারমাণবিক প্রকল্প যখন লাভরেন্তি বেরিয়ার মতো নরপিশাচের অধীনে, তখন মানুষের শরীরে বোমার তেজস্ক্রিয়তার প্রভাব পরীক্ষা করা কোনো অবাস্তব কল্পনা নয়।

পারমাণবিক হ্রদ
পারমাণবিক বোমার তেজস্ক্রিয়তার ফলে পলিগনের পারিপার্শ্বিক প্রাকৃতিক পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিষয়টি সহজে অনুমেয়। কিন্তু সোভিয়েত সরকার ঐ বোমার নেশায় এতটাই বুঁদ হয়ে ছিল যে তারা তা দিয়ে সরাসরি প্রাকৃতিক পরিবেশের উপরই পরীক্ষা চালিয়েছে। যদিও এই জাতীয় পরীক্ষার উদ্দেশ্য ছিল অর্থনৈতিক উন্নয়নে পারমাণবিক বোমার শান্তিপূর্ণ ব্যবহার। খনিজ সম্পদ উত্তোলন, খাল ও জলাধার খনন, বাঁধ নির্মাণসহ নানাবিধ কর্মকাণ্ডে পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারের লক্ষ্যে সোভিয়েতরা ১৯৬৫-৮৮ সাল পর্যন্ত মোট ১২৪টি পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য চাগান হ্রদ খনন প্রক্রিয়া। পারমাণবিক হ্রদ নামেও পরিচিত ঐ জলাধারটি ১৯৬৫ সালের ১৫ জানুয়ারিতে ইরতিশ নদীর অববাহিকায় ১৭৮ মিটার মাটির নিচে স্থাপিত বোমার বিস্ফোরণের মাধ্যমে তৈরি করা হয়। ১০০ মিটার গভীর এই হ্রদ প্রস্থের দিক দিয়ে ৪০০ মিটার। পরবর্তীতে খাল খনন করে ইরতিশ নদীর সাথে এর সংযোগ স্থাপন করা হয়।

পারমাণবিক হৃদ নিয়ে সোভিয়েত সরকার বেশ গর্বিত ছিল। কিন্তু আসলে এটা ছিল তাদের অদূরদর্শিতা ও হঠকারিতার পরিচায়ক। কারণ অদ্যবধি ওই হৃদে তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে একশো গুণ বেশি। এর পানিতে কোনো মাছের উপস্থিতি নেই। এছাড়া পলিগনের অভ্যন্তরে ও এর আশেপাশের এলাকায় প্রায় সর্বত্র অস্বাভাবিক মাত্রায় তেজস্ক্রিয়তা বিদ্যমান। যদিও গত তিন দশকে প্রকৃতি ঘাস আর লতাপাতা দিয়ে অতীতের ভয়াবহতা অনেকটা ঢেকে দিয়েছে। তবে বারংবার বিস্ফোরিত বোমার আঘাতে সৃষ্ট বৃহদাকার গর্তগুলো কাজাখস্তানের বুকে সোভিয়েত ইউনিয়নের অপকর্মের ক্ষতচিহ্ন হয়ে রয়ে গেছে। তাই দেখে মনেই হয় না এই অঞ্চলটি একসময় সুবিস্তৃত কাজাখ স্তেপের অন্তর্ভুক্ত ছিল।

পরীক্ষার পরিসমাপ্তি
কাজাখস্তানের পলিগনে সম্পন্ন পারমাণবিক পরীক্ষার সমাপ্তির সূচনা হয় ১৯৮৬ সালের ২৬ এপ্রিল, যেদিন প্রায় চার হাজার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ইউক্রেনের একটি শহরের পারমাণবিক বিপর্যয় গোটা সোভিয়েত ইউনিয়নের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল। চেরনোবিল ঘটা সেই বিপর্যয়ের কারণে সোভিয়েত সরকার তাদের পারমাণবিক প্রকল্পসমূহের নীতিমালা ঢেলে সাজাতে বাধ্য হয়। অন্যদিকে রাজনৈতিকভাবে দুর্বল সোভিয়েত সরকারের বিরুদ্ধে কাজাখরা নিজেদের বাড়ির পাশের পারমাণবিক পরীক্ষাকেন্দ্রের বিপক্ষে সোচ্চার অবস্থান গ্রহণ করে। তবে পলিগনে তখনো পারমাণবিক পরীক্ষার ইতি টানা হয়নি। বরং সেখানে পরীক্ষামূলক সর্বশেষ বিস্ফোরণ ঘটানো হয় ১৯৮৯ সালের ১৯ অক্টোবরে। পরবর্তীতে ১৯৯১ সালে নুরসুলতান নজরবায়েভের নেতৃত্বে কাজাখস্তান স্বাধীনতা লাভ করলে সেমিপালাতিনস্ক টেস্ট সাইট চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া হয়।

বিভীষিকাময় বর্তমান
বর্তমানে সেমেই শহরে অবস্থিত আঞ্চলিক মেডিকেল ইনস্টিটিউটে পারমাণবিক বোমার ভয়াবহতার স্মরণে মিউটেশন মিউজিয়াম স্থাপন করা হয়েছে। মাত্র একটি কক্ষ নিয়ে গঠিত সেই যাদুঘরে অস্বাভাবিক আকৃতির ভ্রুণ, শিশুদের বিকৃত মৃতদেহ ও প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের শরীরের অংশ সংগ্রহ করে রাখা হয়েছে। যেগুলোর আকৃতি ও অবয়ব কোনোভাবেই মানুষের শরীর বলে মনে করা কষ্টসাধ্য। তবে সেমিপালাতিনস্ক টেস্ট সাইট পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা বন্ধ হওয়ার তিন দশক পূর্ণ হলেও এখনো অঙ্গবিকৃতি নিয়ে জন্মগ্রহণ করা শিশুদের সংখ্যা নেহাত কম নয়। তাদের মধ্যে অনেকে মস্তিষ্কে বিশেষ ধরনের তরল পদার্থ জমার ফলে সৃষ্ট হাইড্রোসেফালাস (Hydrocephalus) রোগ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। এর ফলে শরীরের অনুপাতে মাথার আকৃতি কয়েক গুণ বড় হয়ে যায়। এছাড়া অন্যান্য অঙ্গবিকৃতি নিয়ে জন্মগ্রহণ করার নজির অপ্রতুল নয়। অন্যদিকে যারা কোনো ধরনের বিকলাঙ্গতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেনি তাদেরও আজীবন ক্যান্সার, হৃদরোগের মতো মরণব্যাধির ঝুঁকি নিয়ে বাঁচতে হচ্ছে।

তেজস্ক্রিয়তার ফলে বিকলাঙ্গ শিশুদের অনেকেই প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই মৃত্যুবরণ করে। আর যারা বেঁচে থাকে তাদের ও তাদের প্রিয়জনদের জন্য অপেক্ষা ভয়ানক জীবনযুদ্ধ। এমনই জীবনযুদ্ধের এক সৈনিক সেমেই শহরের বাসিন্দা জাহান্নুর জুমাগেলদিনা ও তার মা মায়রা জুমাগেলদিনা। জাহান্নুর ১৯৯২ সালের পলিগন বন্ধ হওয়ার এক বছর পর জন্ম গ্রহণ করে। সে জন্ম থেকেই একইসাথে মস্তিষ্কের বিকাশ রোধকারী মাইক্রোসেফালি (Microcephaly) ও মেরুদন্ড বক্রকারী কাইফোস্কোলিওসিস (Kyphoscoliosis) রোগে আক্রান্ত। ফলশ্রুতিতে সে কথা বলা থেকে শুরু করে দৈনন্দিন কোনো কাজ করতে পারে না। তার শরীরে যখন এই সকল রোগ ধরা পড়ে তখন পর্যন্ত তার মা মায়রা পলিগনের পারমাণবিক পরীক্ষা সম্পর্কে কিছুই জানতো না। “চিকিৎসাকরা থেকে শুরু করে আমার স্বামী, শাশুড়িসহ প্রায় প্রত্যেকেই আমাকে বলেছে ওকে ছেড়ে যেতে। কিন্তু আমি তাদেরকে না বলে দিয়েছি, আমিই ওর দেখাশোনা করবো।”, বলছিলেন জাহান্নুরের মা মায়রা। বর্তমানে সেমেই শহরে সরকারি ভর্তুকিপ্রাপ্ত ছোট্ট ফ্লাটে বসবাসরত মায়রা গত তিন দশক ধরে একাই তার মেয়ের দেখাশোনা করে যাচ্ছেন।

অন্যদিকে পারমাণবিক বোমার তেজস্ক্রিয়তার প্রভাব শুধুমাত্র বাহ্যিকভাবে বিভিন্ন রোগের মাধ্যমে পরিলক্ষিত হয় তা নয়। বরং বোমার সংস্পর্শে আসা প্রত্যেক ব্যক্তির ডিএনএ-তে ঐ তেজস্ক্রিয়তার উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। ফলাফলস্বরূপ, পলিগনে পারমাণবিক বোমা পরীক্ষার উক্ত চার দশক ছাড়াও পরবর্তীতে যত মানুষ ঐ অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেছে বা করবে সকলেরই তেজস্ক্রিয়তাজনিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা আশংকাজনক হারে বেশি। এছাড়া পলিগনে তেজস্ক্রিয়তার পরিমাণ চেরনোবিলের সমপর্যায় কিংবা কোনো স্থানে এর থেকেও বেশি বলে মত দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।

দায়িত্বহীন সরকার
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে ১৫ রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার পর তিন দশক পার হয়ে গেছে। বর্তমানে এ ১৫ রাষ্ট্রের প্রতিটিই একেকটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। তাদের রয়েছে নিজস্ব ভূখণ্ড, জনগণ, সরকার ও সংবিধান। সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে নিজেদের সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে কাজ করার অধিকার তাদের রয়েছে। এটা তাদের দায়িত্বও বটে। সেই হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নের পারমাণবিক পরীক্ষার কারণে ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসাসহ যাবতীয় ব্যয়ভার বহনের দায় বর্তায় কাজাখস্তানের সরকারের উপর। তবে কাজাখ সরকার তাদেরকে ক্ষতিপূরণ বাবদ সামান্য কিছু অর্থ ব্যতীত তেমন কিছুই প্রদান করেনি।
ভ্লাদিমির সুলিম সেমিপালাতিনস্ক টেস্ট সাইটের একজন সাবেক কর্মকর্তা। তিনি বলেন, “ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নামে আমাকে আমার পেনশনের সামান্য কিছু অর্থ দিয়ে অবসরে যেতে বাধ্য করা হয় এবং এককালীন আর্থিক সহায়তা হিসেবে মাত্র ৬০০ ডলার প্রদান করা হয়।” বর্তমানে সত্তরোর্ধ্ব সুলিম কর্মক্ষেত্রে পারমাণবিক তেজস্ক্রিয়তার সংস্পর্শে আসার দরুণ একাধিক রোগে আক্রান্ত, যেগুলোর চিকিৎসা করানোর অর্থনৈতিক সক্ষমতা তার নেই।
শেষকথা
মানুষ নিজেদের শক্তিমত্তা প্রদর্শন করতে গিয়ে কত দূর অব্দি যেতে পারে তার সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পারমাণবিক বোমার ব্যবহার। তবে সৌভাগ্যক্রমে বিশ্ববাসীকে আর কখনো সেই বোমার বিধ্বংসী রূপ দেখতে হয়নি। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত কাজাখস্তানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বসবাসরত কাজাখদের জন্য বিষয়টি সম্পূর্ণ বিপরীত। তারা এমন এক জনগোষ্ঠী যাদের সরকার তাদের বাড়ির পাশে এসে, তাদের মতামতের তোয়াক্কা না করে, তাদেরই এলাকায় অনবরত পারমাণবিক শক্তির পরীক্ষা চালিয়ে গেছে। অথচ বর্তমানে সোভিয়েত সরকারের অস্তিত্ব নেই, কিন্তু কাজাখদের শরীরে সেই পরীক্ষার তেজস্ক্রিয়তা স্থায়ী রূপ লাভ করেছে। বিজ্ঞানীরাও নিশ্চিত নন কত প্রজন্ম ধরে তারা এই অভিশাপ বয়ে বেড়াবে। তাই বিশ্ববাসীকে এ থেকে শিক্ষা নিতে হবে। যাতে আমাদেরকে এবং আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে পারমাণবিক শক্তির বিভীষিকার সম্মুখীন হতে না হয়।