জলদস্যুরা এমনই এক অপরাধী গোত্রের সদস্য, যাদের নিয়ে মানুষের আগ্রহের কোনো কমতি নেই। হোক না তারা লুটেরা, হোক না মানুষ হত্যাকারী, তবুও তারা বরাবরই সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করেছে। এ যে অজানাকে জানার আকর্ষণ, ভয়ঙ্করকে জানার দুর্দমনীয় এক স্পৃহা!
ভয়ঙ্কর জলদস্যুদের অমীমাংসিত সাতটি রহস্য দিয়েই তাই সাজানো হলো আজকের এ লেখা। চাইলে আপনিও নেমে পড়তে পারেন সেসব রহস্যের মূলোৎপাটনে!
১. টপসেইল দ্বীপের ভূতুড়ে জাহাজ
যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলাইনায় অবস্থিত টপসেইল দ্বীপ নিয়ে রয়েছে কয়েক শতাব্দী প্রাচীন এক অমীমাংসিত রহস্য। সেখানকার জলদস্যুরা কোনো জাহাজে আক্রমণ চালানোর জন্য এক অদ্ভুত কৌশল অবলম্বন করতো। প্রথমে তারা কোনো জাহাজ দিগন্তরেখায় মিলিয়ে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতো। এরপর দ্রুতবেগে সেটিকে ধাওয়া করে সর্বস্ব লুট করে নিতো জলদস্যুরা। আঠারো শতকের শুরুর দিকে এদিক দিয়ে অনেক জাহাজ যাতায়াত করায় জলদস্যুদেরও এ নিয়ে কোনো চিন্তা করতে হতো না।
এ কৌশল যেসব জলদস্যু অবলম্বন করতো তাদের মাঝে অত্যন্ত বিখ্যাত ছিলো এডওয়ার্ড টিচ, ‘ব্ল্যাকবিয়ার্ড’ হিসেবেই যে জনগণের কাছে বেশি পরিচিত। শত্রুপক্ষকে শারীরিক ও মানসিকভাবে কাবু করে দিতে দীর্ঘকায় এ দস্যুর কৌশলের জুড়ি মেলা ছিলো ভার।
গুজব রয়েছে যে, টপসেইল দ্বীপে নাকি গুপ্তধন লুকনো রয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় রহস্যটি ব্ল্যাকবিয়ার্ডের জাহাজকে ঘিরেই। শোনা যায়, এখনও নাকি মাঝে মাঝেই সাগরের বুকে ভেসে ওঠে ব্ল্যাকবিয়ার্ডের সেই জাহাজ। কেউ কেউ বলেন, যখন আপনি জাহাজ নিয়ে রিচের খাঁড়ি পার হবেন, তখন হঠাৎ করেই জাহাজে থাকা রাডারে একটি আলো জ্বলতে-নিভতে দেখা যাবে। বিভিন্ন সময় অনুসন্ধান চালিয়েও সেই আলোক বিন্দুর উৎস খুঁজে পাওয়া যায় নি। তবে যখনই আপনি জাহাজ নিয়ে যেতে থাকবেন, ততই সেই বিন্দুটি আপনার জাহাজের দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করবে, গতিও বাড়তে থাকবে ধীরে ধীরে। ঠিক যেমন ব্ল্যাকবিয়ার্ডের জাহাজটি করতো শত শত বছর আগে!
২. ওক দ্বীপের গুপ্তধন
কানাডার নোভা স্কটিয়া প্রদেশের লুনেনবার্গ কাউন্টিতে ১৪০ একর এলাকা জুড়ে অবস্থিত ছোট একটি দ্বীপের নাম ওক। ১৭৯৫ সালের কথা। ড্যানিস ম্যাকগিনিস নামে এক ব্যক্তি দ্বীপটি দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ করেই মাটিতে বড় ধরনের একটি গর্ত দেখতে পেলেন। চারপাশে সমতল ভূমির মাঝে এমন গর্ত তার কাছে বেশ অস্বাভাবিক ঠেকলো। তাই তিনি সেটি আরো খুঁড়তে শুরু করলেন। আশ্চর্যজনকভাবে প্রতিবারই আনুমানিক ১০ ফুট গর্ত খননের পর তিনি ওক গাছের তক্তা পেতে থাকলেন। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ খননকার্য চালিয়ে যাবার পর তিনি একটি পাথর খুঁজে পেলেন যেটির গায়ে বেশ কিছু প্রতীক খোঁদাই করে রাখা ছিলো।
ধারণা করা হয়, গর্তের আরো গভীরে লুকনো কোনো গুপ্তধনের কথাই সেই পাথরে লেখা ছিলো। ফলে ধনরত্নের আশায় গর্তটি আরো খনন করা হতে থাকে। তবে একসময় সেই কাঠের তক্তাগুলো ভেঙে গেলে গর্তটি পানি দিয়ে ভরে যায়। তারপরেও মানুষজনের আগ্রহ এতে বিন্দুমাত্র কমে নি। বরং এরপর থেকে নিয়মিতভাবেই গুপ্তধনের সন্ধানে এখানে এসেছে মানুষ, করতে চেয়েছে গর্তের একেবারে তলায় লুকনো রহস্যের মূলোৎপাটন। তবে দুঃখজনকভাবে তাদের প্রতিটি প্রচেষ্টাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। এমনকি এখন পর্যন্ত সাতজন মারাও গিয়েছে সেই গুপ্তধনের সন্ধান করতে গিয়ে। ফলে অনেকে এখন এ জায়গাটিকে অভিশপ্ত হিসেবেও মনে করে থাকে।
অনেকেই মনে করেন, তৎকালে এখানে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা জলদস্যু ক্যাপ্টেন কিডই এই গুপ্তধনের মালিক। গুপ্তধনের প্রকৃত অবস্থান সম্পর্কে সে বলেছিল, এটি কেবলমাত্র শয়তান ও সে ছাড়া আর কেউই জানে না!
৩. অলিভিয়ার লেভাসিউরের গোপন সংকেত
আঠারো শতকে ভারতীয় মহাসাগরে ত্রাসের রাজত্ব কায়েমকারী জলদস্যুদের মাঝে অলিভিয়ার লেভাসিউরের নাম শীর্ষস্থানীয়। অগণিত সম্পদ লুট করে অজ্ঞাত এক স্থানে জমা করে রেখেছিল লেভাসিউর। তবে একসময় ঠিকই ধরা পড়ে যায় সে। ফাঁসির মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় তার। মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আগে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা জনতার উদ্দেশ্যে তার বক্তব্য ছিলো, “আমার গুপ্তধন খুঁজে বের কর, যদি কেউ এটা বুঝতে পার”। এই বলে জনতার উদ্দেশ্যে গোপন সংকেত লেখা একটি কাগজ ছুঁড়ে দেয় সে।
এরপর থেকে আজ পর্যন্ত অসংখ্য মানুষ লেভাসিউরের সেই গোপন সংকেতের রহস্যভেদ করে তার রেখে যাওয়া গুপ্তধন খুঁজে বের করতে চেষ্টা করেছে। কেউ কেউ ‘আঙুর ফল টক’ জাতীয় মন্তব্য করে বলেছে, “এটা একেবারেই ভুয়া জিনিস”, কেউ আবার অধ্যবসায়ের চরম নমুনা দেখিয়ে জীবনের অনেকটা সময় এর পেছনে ব্যয় করেছে। ব্যর্থ হয়েছে উভয় পক্ষই।
এর মাঝেও সবচেয়ে উজ্জ্বল হয়ে আছে রেজিনাল্ড হার্বার্ট ক্রুজ-উইল্কিন্স নামক এক ইংরেজ। বিংশ শতকের মাঝামাঝির দিকে অনেক বছরের অনুসন্ধান শেষে তিনি লেভাসিউরের সেই গোপন সংকেতের রহস্যভেদের দাবি জানান। রেজিনাল্ডের মতে, লেভাসিউরের রেখে যাওয়া ধন-সম্পদের বাজারমূল্য ১ বিলিয়ন পাউন্ডের সমতুল্য আর তা ভারতীয় মহাসাগরের দ্বীপ মাহে (Mahe)-এর কোনো এক জায়গায় লুকিয়ে রাখা আছে।
অবশেষে তিনি সেই দ্বীপে একটি গুহার সন্ধান পান, যাকে তিনি লেভাসিউরের সেই গুপ্তধনের সঞ্চয়স্থান বলে চিহ্নিত করেন। তবে সেখানে সম্পদ খুঁজতে গিয়ে তাকে বেশ সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। কারণ একটু এদিক-সেদিক হলেই গুহাটি ভেঙে যাবার ভয় ছিলো। দুর্ভাগ্যবশত একবার তিনি পাথরধসের শিকারও হন। বেরিয়ে আসার আগে একটি ফ্লিনটক পিস্তল, ক্ষুদ্র প্রস্তরমূর্তি, সতের শতকের একটি মদ্যপানের জগ ও কিছু মুদ্রা নিয়ে আসতে সক্ষম হন তিনি। সেখানে যে গুপ্তধন আসলেই লুকনো আছে, সেটা বোঝাতে এ প্রমাণগুলোই ছিলো যথেষ্ট। কিন্তু তারপরও ব্যর্থতার খাতায়ই নাম লেখাতে হয় রেজিনাল্ডকে। কারণ নতুন করে অভিযান পরিচালনা করার মতো অর্থ তার ছিলো না। আর অনিশ্চিত সেই অভিযানে অর্থ বিনিয়োগ করার মতো মানুষও খুঁজে পান নি তিনি।
৪. সবুজ আলোর ঝলকানি
শত শত বছরের পুরনো এ বিচিত্র ঘটনা দেখার দাবীদার মূলত সাগরের বুকে জীবিকা নির্বাহ করা মানুষজন, বিশেষত জলদস্যুরা। সপ্তদশ শতাব্দী থেকেই এর কথা প্রথম শোনা যায়। সূর্য ডোবার সময় যখন আকাশ ও দিগন্ত একেবারেই পরিষ্কার থাকে, তখন হঠাৎ করেই পান্নার মতো সবুজ আলোর ঝলকানি দেখার দাবি করেছে বেশ কিছু জলদস্যু। এমনকি তারা এটাও দাবি করতো যে, কেউ যদি সেই আলোটি স্বচক্ষে দেখে, তবে সে অন্যের মনের কথা বুঝতে পারার সক্ষমতা অর্জন করে!
৫. পাইরেট টানেল
জর্জিয়ার সাভান্নাহ শহরের তলদেশ দিয়ে চলে গেছে বিশাল বিশাল সব টানেল। ধারণা করা হয় এককালে জলদস্যুরা এসব টানেল ব্যবহার করেই চলে যেত তাদের নৌকোয়, সাথে নিয়ে যেত তাদের লুট করা সম্পত্তি আর বন্দী নাবিকদের। কথিত আছে, শহরটিতে থাকা ‘পাইরেটস হাউস’ নামক বাড়িটি থেকে একটি গোপন সুড়ঙ্গ গিয়ে শেষ হয়েছিলো এক নদীর তীরে, যেখানে জলদস্যুদের ব্যবহারের জন্য রাখা হতো বিভিন্ন নৌকা। তবে পাথর ধসে রাস্তাটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন আর তা ব্যবহার করা যায় না। অনেকে আবার মনে করে বিভিন্ন গুপ্ত সংঘের সদস্যরা এসব টানেল দিয়ে যাতায়াত করতো তাদের মিটিংয়ের স্থানগুলোতে।
৬. হাড়ের লেক
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লং আইল্যান্ডের রনকনকোমা লেক নিয়ে গুজব আর কিংবদন্তীর কোনো শেষ নেই। এসবের মাঝে জলদস্যুদের সাথে সংশ্লিষ্ট কিংবদন্তীও বেশ জনপ্রিয়। কেউ কেউ বলেন, এককালে এ লেকটি একটি খাঁড়ির মাধ্যমে সমুদ্রের সাথে যুক্ত ছিলো। এ খাঁড়ি দিয়ে জলদস্যুরা লেকে চলে আসতো, সাথে থাকতো লুট করে আনা ধনরত্ন আর বন্দীরা। লেকের নিচে বিভিন্ন গুহাতেই সেসব ধনরত্ন তারা জমা করে রাখতো বলে মনে করেন অনেকে। আর দুর্ভাগা সেই বন্দীদের খুন করে লাশ গুম করতে ফেলে দেয়া হতো লেকের পানিতে। এমনকি লেকের তলা থেকে কিছু কঙ্কাল পাওয়ার দাবিও করা হয়েছে মাঝে মাঝে, যদিও এর সপক্ষে তেমন কোনো জোরালো প্রমাণ নেই।
তবে সত্যিই যদি লেকের তলদেশে কঙ্কাল খুঁজে পাওয়া যায়, তাহলে যে সেখানে লুকনো ধনরত্নও পাওয়া যেতে পারে, তা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
৭. জলদস্যুদের রাজ্য
জলদস্যুদের নিয়ে অমীমাংসিত রহস্যের ইতি টানা যাক তাদের এক রাজ্যের গল্প দিয়েই। তবে সেটার বাস্তব অস্তিত্ব নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। মাদাগাস্কার থেকে কিছু দূরে অবস্থিত এ দ্বীপরাজ্যের নাম ছিলো ‘লিবার্টালিয়া’। অনেকে একে জলদস্যুদের স্বর্গরাজ্যও বলে থাকেন। সতের শতকে জলদস্যু ক্যাপ্টেন জেমস মিশন এটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার সাথে সহ-প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে ছিলেন বিখ্যাত জলদস্যু হেনরি অ্যাভেরি ও থমাস টিউ। এর মাঝে টিউ ছিলেন লিবার্টালিয়ার নৌ বাহিনীর প্রধান।
রাজ্যের পরিচালনা পদ্ধতি ছিলো বেশ চমৎকার। যাবতীয় খাদ্য ও সম্পত্তি সেখানকার অধিবাসীদের মাঝে সমানভাবে ভাগ করে দেয়া হতো। শাসনকার্য পরিচালনার জন্য প্রত্যেক নাগরিকের মতামতই বিবেচনায় আনা হতো। রাষ্ট্রের পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় আইন তৈরিও করতো জনগণ। তাদের মূলনীতি ছিলো ‘ঈশ্বর ও মুক্তির জন্য’। দাসপ্রথা তারা একেবারেই সহ্য করতে পারতো না। যদি কোনো ক্রীতদাসের দেখা তারা পেত, তাহলে সাথে সাথেই তার মুক্তির ব্যবস্থা করতো। পরবর্তীতে সেই ক্রীতদাসকে তাদের নিজেদের একজন হিসেবেই মনে করতো জলদস্যুরা। চাইলে মুক্তি পাওয়া সেই সাবেক ক্রীতদাস যোগ দিতে পারতো দস্যুদলেও!
পুরো লিবার্টালিয়া রাজ্যটি ছিলো বেশ সমৃদ্ধ। সেখানে গড়ে উঠেছিলো অসংখ্য বাসভবন, বড় হল, মন্দির ও সরাইখানা। এছাড়া বাসিন্দাদের বাজার-সদাইয়ের জন্য একটি মার্কেট এবং বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে প্রতিরক্ষার জন্য একটি দুর্গও সেখানে ছিলো। সেখানকার জনগণকে বলা হতো ‘লাইবেরি’।
ফিচার ইমেজ- wallpapersshock.com