পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত স্থান কিংবা গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক স্থাপনা নিয়ে সপ্তাশ্চর্য নামে প্রায় সময় তালিকা করা হয়। সে তালিকায় পৃথিবীর সেরা সেরা স্থান, স্থাপনা ইত্যাদি বিষয়গুলো স্থান পায়। প্রাচীনকাল থেকেই ৭ সংখ্যাটিকে শুভ ও সুন্দর বলে বিবেচনা করা হতো। প্রাচীন যুগে বিবেচিত সপ্তাশ্চর্যগুলো কী ছিল? চলুন জেনে নেওয়া যাক।
গিজার মহা পিরামিড
এর অবস্থান মিশরের গিজা শহরে, নীল নদের পশ্চিম পাড়ে। খ্রিস্টপূর্ব ২৫৮৪ থেকে ২৪৬৫ অব্দের মাঝামাঝি সময়ে এটি বানানো হয়েছিল। এর গোরস্তানের তিনটি পিরামিডের মধ্যে সবচেয়ে পুরাতন এবং সবচেয়ে বড় এটি। এটিকে গ্রেট পিরামিড বা মহা পিরামিড বলা হয় কারণ এটি মূলত তৈরি করা হয়েছিল মিশরের ফারাও খুফু’র সমাধি হিসেবে।
সে সময় মিশরের মানুষেরা বিশ্বাস করতো পৃথিবীতে মানুষের বাস খুব স্বল্প সময়ের জন্য। মৃত্যুর পরবর্তী জীবনই হলো অনন্ত জীবন। তাদের বিশ্বাস ছিল—মৃত্যুর পর দেহ যদি অক্ষত অবস্থায় সংরক্ষণ করা হয়, তাহলে তারা পরলোকে অনন্ত শান্তির জীবন যাপন করতে পারবে। তাই সম্রাট (ফারাও)-দের দেহকে ভালোভাবে সংরক্ষণ ও কবর দেবার জন্য ২০ লক্ষ ৩০ হাজার চুনাপাথরের ইট দিয়ে তৈরি করা হয় এই পিরামিড। এই পিরামিডই প্রাচীন সপ্তাশ্চর্যের একমাত্র নিদর্শন, যা আজও টিকে আছে।
ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান
প্রাচীন যুগের আকর্ষণীয় সপ্তাশ্চর্যের মধ্যে এটি একটি। কিন্তু আসলেই কি এমন কোনো উদ্যান ছিল যা সত্যিই ঝুলে থাকতো? ভূমির সংস্পর্শ ছাড়া বাগান করা আর যা-ই হোক অন্তত সে কালে সম্ভব ছিল না। আসলে সে সময় বিশাল পরিসরে চমৎকার একটা বাগান করা হয়েছিল। শ্রেষ্ঠত্বের দিক থেকে এটি অনেক বেশি সমাদৃত হওয়ায় বিশেষণ হিসেবে ঝুলন্ত উদ্যান নামে মানুষের মধ্যে প্রচলিতে হয়ে পড়ে।
এর অবস্থান ছিল ইরাকের ইউফ্রেটিস নদীর তীরে। ব্যাবিলনীয় সভ্যতার অন্যতম দৃষ্টান্ত এই উদ্যান। এর নির্মাণের জন্য স্থাপন করা হয় হয় বিশাল এক ভিত, যার আয়তন ছিল ৮০০ বর্গফুট। ভিতের অবস্থান ছিল তৎকালীন সম্রাটের খাস উপাসনালয়ের বিস্তৃত ছাদে। স্থাপনের পর ভূমি থেকে এর উচ্চতা দাড়িয়েছিল ৮০ ফুট। এই উচ্চতা থেকেই হয়তো ঝুলন্ত তকমাটি লেগে গিয়েছিল।
বিশাল এই স্থাপনার ছিল অনেকগুলো তলা, ছিল বারান্দার মতো স্থান, সেসব স্থানে ছিল ফুল, ছিল গাছপালা। ৪ হাজার শ্রমিক রাতদিন পরিশ্রম করে তৈরি করেছিল এই বাগান। এর পরিচর্যার কাজে নিয়োজিত ছিল ১০৫০ জন মালী। ৫ থেকে ৬ হাজার প্রজাতির ফুলের চারা রোপণ করা হয়েছিল এখানে। ৮০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত বাগানের সুউচ্চ ধাপগুলোতে নদী থেকে পানি উঠানো হত মোটা পেঁচানো নলের সাহায্যে।
সম্রাট নেবুচাদনেজার II-এর শাসনকালে এটি নির্মাণ করা হয়। এই বাগান গড়ে তোলার পেছনে তাকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল তার প্রিয়তমা সম্রাজ্ঞী। স্ত্রীর উদ্দেশ্যে প্রাসাদের সামনে এই উদ্যানটি নির্মাণ করেন সম্রাট। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ৫১৪ খ্রিস্টাব্দে পার্শ্ববর্তী পারস্য রাজ্যের সাথে এক ভয়াবহ যুদ্ধে এই উদ্যানটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়।
অলিম্পিয়ায় জিউসের মূর্তি
খ্রিস্টপূর্ব ৪৩২ অব্দে জিউসের এই মূর্তিটি নির্মাণ করেছিলেন গ্রিক ভাস্কর ফিডিয়াস। গ্রিক পুরাণে জিউস হলেন দেবতাদের রাজা। দেবাধিরাজের মূর্তি ছিল প্রায় ৪২ ফুট লম্বা এবং ৬ ফুট বেধ সম্পন্ন। সাতজন মিস্ত্রী আড়াই বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে এটি তৈরি করেন। সোনা, মূল্যবান পাথর এবং হাতির দাঁতে তৈরি মূর্তিটি একটি কাঠের কাঠামোর উপর ছিল বলে কথিত আছে।
এতে দেবতা জিউস একটি কাঠের আসনের উপর উপবিষ্ট হয়ে আছেন এবং সেখানে তার ডান হাতে আছে একটি ছোট মূর্তি যা জয় এবং জৌলুসকে নির্দেশ করছে। বাম দিকে আছে একটি ঈগল যা নির্দেশ করছে জিউসের শক্তি ও তার প্রতি আনুগত্য। কিন্তু কোনো একভাবে ভাস্কর্যটি ধ্বংস হয়ে যায়। কীভাবে এবং ঠিক কেন এমনটা হয়েছিল তা নিয়ে বেশ বিতর্ক আছে। ধারণা করা হয়, খ্রিস্ট ধর্মের প্রসারের সময় খ্রিষ্টীয় ৫ম শতাব্দীতে একে ধ্বংস করে ফেলা হয়। কারো কারো মতে, এটি সেখান থেকে কনস্টান্টিনোপল (বর্তমান তুরস্কের ইস্তাম্বুল)-এ নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, যা পরবর্তীতে অগ্নিকাণ্ডে পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।
আর্টেমিসের মন্দির
ফসলের দেবী আর্টেমিসকে উৎসর্গ করে খ্রিস্টপূর্ব ৫৫০ অব্দে ইফেসাস অঞ্চলে এটি নির্মাণ করা হয়েছিল। নির্মাণে সময় লেগেছিল ১২০ বছর। ৩৭৭ ফুট লম্বা ও ১৮০ ফুট চওড়া মন্দিরটির পুরোটাই মার্বেল পাথরে তৈরি। এতে ১২৭ টি স্তম্ভ আছে, যার প্রত্যেকটি ৬০ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট। এর প্রতিটি দেয়াল জুড়ে বসানো ছিল মণি, মুক্তা, রুবি, পান্না আর হীরক খণ্ডের মতো মহামূল্যবান রত্নরাজি। এই মন্দির ছিল প্রার্থনার ঘর। ৩৫৬ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দে ‘গথা’ জাতি (পূর্ব জার্মানের বাসিন্দা) এটি ধ্বংস করে ফেলে। পুরাতাত্ত্বিকদের গবেষণা মতে এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে এটি ধ্বংস হয়ে যায়।
এর ধ্বংসাবশেষ এখনো তুরস্কে পাওয়া যায়। দীর্ঘ ৬০ বছর ধরে গবেষকরা খুঁজে বেড়িয়েছেন এই মন্দিরটির অবস্থান। ১৮৬৯ সালে জন টার্টল ঊড ও তার অনুসন্ধানী দল মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পান। মন্দিরের ঐ এলাকা থেকে প্রাপ্ত কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে।
রোডস এর মূর্তি
মহাবীর আলেকজান্ডারের কথা সকলেই জানে। তিনি বেঁচেছিলেন মাত্র ২৩ বছর। এই সময়েই তিনি পৃথিবীর অনেক অংশজুড়ে তার রাজ্য বিস্তার করেছিলেন। এর মধ্যে আটলান্টিক সাগরের মেডিটেরিয়ান অঞ্চলের রোডস দ্বিপটিও ছিল। সেখানে নির্মাণ করা হয় এক বিশাল মূর্তি। এটি লম্বায় ছিল ১০৫ ফুট এবং তৈরিতে সময় লেগেছিল ১২ বছর।
প্রাচীন যুগের সবচেয়ে উঁচু ভাস্কর্য হিসেবে পরিচিত ছিল এই মূর্তি। এটি দুই স্তরে বিভক্ত। প্রথম স্তরটি ছিল ৪০ মেট্রিক টনের পাথরের ভিত্তি। এই ভিত্তির উপর তৈরি হয়েছে মূর্তির মূল কাঠামো। মূর্তিটি তৈরি করা হয়েছিল তামা দিয়ে, প্রয়োজন সাপেক্ষে কিছু লোহাও ব্যবহার করা হয়েছিল। ব্যবহৃত তামার ভর ছিল ২৫০ মেট্রিক টন। খ্রিস্টপূর্ব ২২৮ অব্দে এক প্রলংকরী ভূমিকম্পে এর এক পা ভেঙ্গে যায়। ষষ্ঠ শতাব্দীর মাঝামাঝি সারাসিন জাতি রোডস দ্বীপ দখল করে মূর্তিটি পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়।
আলেকজান্দ্রিয়ার বাতিঘর
বাংলায় বাতিঘর, তবে লাইটহাউজ বললে সহজেই অনেকে চেনে। খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতাব্দীতে মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ায় দ্বিতীয় টলেমির রাজত্বকালীন সময়ে এটি তৈরি করা হয়। এটি নির্মাণের উদ্দেশ্য ছিল নাবিকদেরকে সমুদ্র বন্দরের ভেতরে দিক-নির্দেশনা দেওয়া।
এর মূল ভিত্তি-ভূমির ক্ষেত্রফল ছিল ১১০ বর্গফুট। উচ্চতা ছিল ৪৫০ ফুট (একটি ৪০ তলা বিল্ডিংয়ের সমান)। এই বাতিঘর তৈরির পর ৪৫০ ফুট উঁচুতে যে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল, ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সেটিকে কেউ নিভতে দেখেনি। ৫০ মাইল দূর থেকেও দেখা যেত একে। আর ১৪শ শতাব্দীর কোনো এক সময় ভয়াবহ এক ভূমিকম্পে এটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়। এর ধ্বংসাবশেষ এখনও আছে ভূমধ্যসাগরের তলদেশে।
হ্যালিকারনেসাসের সমাধি মন্দির
খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০ অব্দে তুরস্কের কারিয়া রাজ্যে নির্মিত হয়েছিল। রাজা মোসোলাসের মৃত্যুর পর তার স্মরণে রানী আর্তেমিসিয়া এটি বানিয়েছিলেন। সেই সময়কার সেরা ভাস্কররা কাজ করেছিল এর পেছনে। সম্পূর্ণ মার্বেলে তৈরি এই সমাধিটির উচ্চতা ১৩৫ ফুট। তিন স্তরে বিভক্ত এই মন্দিরের প্রথম স্তরে ছিল বিশাল এক প্রস্তর ভিত্তি। দ্বিতীয় স্তরে ৩৮টি থাম, যার প্রতিটির উচ্চতা ৫৬ ফুট। তৃতীয় স্তরটি ছিল সোজা ঊর্ধ্বাকাশে উঠে যাওয়া বিশালাকৃতির গম্বুজ। গম্বুজের উচ্চতা ছিল ৫০ ফুট। সম্ভবত কোনো এক ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল এটি, আর এর ধ্বংসাবশেষ লোকজন বাড়ি-ঘর বানাতে কাজে লাগিয়ে ফেলেছিল।
প্রাচীন যুগের এই সপ্তাশ্চর্যগুলোর বেশিরভাগই কালের বিবর্তনে বিলুপ্ত হয়ে গেছে কিন্তু প্রতিটি নিদর্শনই পৃথিবীর বুকে প্রাচীন যুগের মানুষের ভাবধারা ও অস্তিত্বের পরিচয় জানান দেয়। তারা লুপ্ত হয়ে গেলেও তাদের ঐতিহাসিক মূল্য প্রচুর।