সিল্ক রোড হলো প্রাচীন বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় লম্বা দূরত্বের বাণিজ্যপথ। পাশ্চাত্যের ইউরোপ আর প্রাচ্যের চীন, এ দুয়ের সংযোগ ঘটানো এই সিল্ক রোডের মাধ্যমেই তৎকালীন সময়ে এই দুই ভিন্ন সভ্যতার মধ্যে প্রথম পণ্যসামগ্রী, প্রযুক্তি ও নানা চিন্তাধারার আদানপ্রদান শুরু হয়। তবে এই বাণিজ্যপথের সবচেয়ে জনপ্রিয় পণ্যসামগ্রী ছিল রেশম, যা চীন থেকে পশ্চিমের দেশগুলোতে রপ্তানি করা হতো। আর এজন্যই এই বাণিজ্যপথের নামকরণ করা হয়েছিল ‘সিল্ক রোড’।
একজন ব্যবসায়ী দীর্ঘ এই পথ পাড়ি দিয়ে তার পণ্য বিক্রি করতে পারলেই পেত বিশাল অঙ্কের মুনাফা। তবে মুনাফার পাশাপাশি এই বাণিজ্যপথের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিল নানা বিপদ, যা সিল্ক রোডকে করেছিল যেমন বিপদজনক তেমনি রোমাঞ্চকর। চলুন আজকে জেনে নিই এই প্রাচীন সিল্ক রোড সম্পর্কে আর ঘুরে আসি সেই রোমাঞ্চকর বাণিজ্যপথ থেকে।
কী এই সিল্ক রোড?
নাম সিল্ক রোড বা রেশম পথ হলেও এটি কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট একটি পথ বা রাস্তা নয়। সিল্ক রোড হলো পূর্ব থেকে পশ্চিমে যাওয়ার বহু রাস্তা নিয়ে বিশাল এক জালের মতো নেটওয়ার্ক। সিল্ক রোড যতটা প্রাচীন, এর নামকরণের ইতিহাস কিন্তু ততটা পুরানো নয়। ১৮৭৭ সালে জার্মান ইতিহাসবিদ ও ভূগোলবিদ ফার্ডিন্যান্ড ভন রিকথোফেন প্রথম এই নামকরণ করেন। ১৩০ খ্রিস্টপূর্বে যখন চীনের হান রাজবংশ পশ্চিমের দেশগুলোতে বাণিজ্য শুরু করে তখনই এই বাণিজ্যপথের উদ্ভব ঘটে। ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চালু ছিল এই বাণিজ্যপথ। ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে অটোমান সাম্রাজ্য কনস্টান্টিনোপল জয় করে ও পশ্চিমের সাথে সকল ব্যবসায়িক লেনদেন বন্ধ করে দেয়। ফলে বন্ধ হয়ে যায় এই সিল্ক রোড।
প্রাচ্যে সিল্ক রোডের সূচনা হয় হান রাজবংশের রাজধানী চাং’আনে, যা বর্তমানে জি’আন নামে পরিচিত। ব্যবসায়ী, তীর্থযাত্রী কিংবা দূত সহ এ পথের যাত্রীরা প্রথমে এই শহর থেকেই তাদের যাত্রা শুরু করতো। এখান থেকে তারা চীনের উত্তর প্রদেশের যাত্রাপথ দিয়ে এগিয়ে গিয়ে গোবি মরুভূমিতে এসে পৌঁছত, যা ছিল তৎকালীন সময়ে সিল্ক রোডের সবচেয়ে বিপদজনক স্থান।
সিল্ক রোডের বিপদজনক দিকগুলো
গোবি মরুভূমি হলো এশিয়ার সবচেয়ে বড় মরুভূমি। এটি বর্তমান চীন ও মঙ্গোলিয়া জুড়ে বিস্তৃত। এই মরুভূমির ভৌগলিক পরিবেশ একেক স্থানে একেক রকম হলেও গোটা মরুভূমির বেশিরভাগ স্থান জুড়েই এটি মূলত পাথুরে ও রুক্ষ। আর এই পাথুরে ভূখণ্ডের ফলেই এটি ছিল ব্যবসায়ী কাফেলাগুলোর কাছে অপেক্ষাকৃত সহজ ও দ্রুত একটি যাত্রাপথ। কারণ বালির উপরে যাত্রা করার থেকে পাথুরে স্থানে যাত্রা করা তুলনামূলকভাবে সহজ। কিন্তু এই যাত্রাপথ যারা বেছে নিতেন তাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল এই উত্তপ্ত ধু ধু প্রান্তরে পানীয়জল খুঁজে বের করা। আর এ পানীয়জল জল কিন্তু শুধু নিজেদের এজন্য নয়। তাদের বাহন উটগুলোকেও পান করাতে হতো পানি।
পানির এ সমস্যা দূর করার জন্য এই যাত্রাপথের বিভিন্ন স্থানে স্থাপন করা হয়েছিল বিভিন্ন সরাইখানা। এসব সরাইখানায় যাত্রীরা বিশ্রাম নিতে পারতেন। নানা রকম খাদ্য ও পানীয়ের ব্যবস্থাও থাকতো এখানে। এখান থেকে প্রয়োজনীয় খাবার ও পানীয় সংগ্রহ করে যাত্রার বাকি রাস্তার জন্য প্রস্তুতি নিতেন তারা। এসব সরাইখানায় নানা পণ্যের বিনিময়ও হতো ব্যবসায়ীদের মধ্যে। সরাইখানাগুলো এমনভাবে স্থাপন করা হতো যাতে একটি সরাইখানা থেকে আরেকটির মধ্যবর্তী দূরত্ব একদিনের যাত্রাপথের সমান হয়। আর এর ফলে যাত্রীদের লম্বা সময় ধরে মরুভূমিতে থাকা লাগতো না কিংবা অচেনা স্থানে রাত কাটানো লাগতো না, যা তৎকালীন সময়ে খুবই বিপদজনক ছিল। কারণ ক্লান্ত ব্যবসায়ীর পিছু নিত ডাকাতদল। আর ডাকাতদলের হাতে পড়লেই সমস্ত মালামালের সাথে নিজের প্রাণটাও হারাতে হতো অনেককেই।
এই বিপদজনক গোবি মরুভূমি পার হওয়ার পর যাত্রীরা যাত্রা করতেন ইরানের উদ্দেশ্যে। সেখান থেকে তুর্কি হয়ে সবশেষে তারা পৌঁছতেন ইউরোপে। মরুভূমির পার হওয়ার পর এই বাকি পথটুকু তুলনা মূলকভাবে কম বিপদজনক হলেও একেবারেই যে আরামের ছিল তা কিন্তু নয়। এই বাকি যাত্রাটি কেমন হবে তা নির্ভর করতো এসব এলাকার রাজনৈতিক অবস্থার উপর। যেমন, অটোম্যানরা যখন কনস্টান্টিনোপল জয় করে নিলো তখন তারা পশ্চিমের সাথে সকল ব্যবসা বন্ধ ঘোষণা করলো। ফলে সিল্ক রোডে যাতায়াত হয়ে গেলো প্রায় অসম্ভব। আবার মঙ্গোলরা যখন চীন ও মধ্য এশিয়া জুড়ে তাদের সাম্রাজ্য স্থাপন করলো তখন এসব স্থানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি শান্ত হলো। ফলে সিল্ক রোডের যাতায়াত হয়ে গেলো সহজ।
সিল্ক রোডের সামুদ্রিক যাত্রাপথ
বিভিন্ন স্থলপথ ছাড়াও কিন্তু সিল্ক রোডের একটি সমুদ্রপথ ছিল, যা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ভারত এবং আরবীয় উপদ্বীপ হয়ে চীনকে ইউরোপের সাথে যুক্ত করেছিল। স্থলপথে যারা যাত্রা করতেন ঠিক তাদের মতোই এ পথের যাত্রীদেরও নানা বিপদের মুখোমুখি হতে হতো। নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বিশেষ করে সামুদ্রিক ঝড়ে ব্যবসায়ীদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হতো। আর মরুভূমির ডাকাতদের মতো এই সমুদ্রপথেও ছিল জলদস্যুদের ভয়। এরা যাত্রীদের জাহাজ দখল করে নিয়ে সব মালামাল কেড়ে নিতো।
যে যে পণ্যের লেনদেন হতো সিল্ক রোডে
সিল্ক রোডের প্রধান পণ্য ছিল রেশম, যা পূর্ব থেকে পশ্চিমে রপ্তানি হতো। তবে রেশমের পাশাপাশি আরো বিভিন্ন পণ্যের লেনদেন হতো এই পথে, যার তালিকা কিন্তু বিশাল! বিশেষ করে নানা রকম ফল, সবজি, গবাদি পশু, নানা শস্য, চামড়া, বিভিন্ন যন্ত্রপাতি, ধর্মীয় সরঞ্জাম, চিত্রকর্ম, মূল্যবান পাথর, বিভিন্ন ধাতু ইত্যাদি লেনদেন হতো এ পথ দিয়ে। তবে সবচেয়ে গুরুত্ব যে জিনিসগুলো লেনদেন এ পথে হতো তা হলো দু’স্থানের সংস্কৃতি, ভাষা, ধর্মীয় বিশ্বাস, দর্শন, জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা তথ্য ও আবিষ্কার।
পণ্যদ্রব্যের মধ্যে কাগজ ও বারূদ এ দুটিই আবিষ্কৃত হয় চীনে, হান সাম্রাজ্য চলাকালীন সময়ে। এ দুটি পণ্যেরই সবচেয়ে ব্যপক ও দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব লক্ষ করা যায় পাশ্চাত্য সংস্কৃতি ও ইতিহাসে। তৎকালীন সময়ে সিল্ক রোডের অন্যতম বেশি লেনদেনকৃত পণ্য ছিল এ দুটি।
সিল্ক রোড কেন গুরুত্বপূর্ণ ছিল?
খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দে যখন চীনে কাগজ আবিষ্কৃত হয় তখন তার ব্যবহার সিল্ক রোডের মাধ্যমে প্রথমে ৭০০ খ্রিস্টাব্দে সমরকন্দে এসে পৌঁছায়। এরপর তা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। আর এই কাগজের ব্যবহারের ফলে বদলে যায় পৃথিবীর অবস্থা। কাগজ ব্যবহারের ফলে তথ্য সংরক্ষণ করা হয় সহজ।
কাগজের পাশাপাশি বারুদের ব্যবহার যখন সিল্ক রোডের মাধ্যমে পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে পৌঁছায় তখনও এর ব্যবহার ছড়িয়ে পড়ে গোটা বিশ্বে। বিশ্বের ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি বস্তু কিন্তু এই বারুদ। বারুদের ব্যবহার বদলে দিতে পারে একটি যুদ্ধের ফলাফলকে।
এছাড়া সিল্ক রোডের মাধ্যমে শিল্প-সংস্কৃতি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের যে প্রসার ঘটে তা গোটা বিশ্বকে আরো কয়েক বছর এগিয়ে নিয়ে যায়। তাই বর্তমানে আমরা পৃথিবীকে যে অবস্থায় দেখছি তার পেছনে কিন্তু সিল্ক রোড আর এই রোডের সেই সাহসী অভিযাত্রীদের অবদান অস্বীকার করা যায় না কোনোভাবেই।
ফিচার ইমেজ – tokkoro.com