মার্চ, ১৯১৮; কানসাস, আমেরিকা। উপনিবেশ আর জাত্যাভিমানের কলঙ্ক মাথায় নিয়ে শুরু হওয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষ সময়গুলো পার করছে আমেরিকান সৈন্যরা। জার্মানির নের্তৃত্বে অক্ষশক্তির পরাজয় একরকম নিশ্চিত– এরকম গুঞ্জন বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। ট্রেঞ্চে অবসর সময় পার করছে সৈন্যরা। কেউ সিগারেট ফুঁকছে, কেউ বা গল্প করছে আরেক সৈন্যের সাথে।
এরই মধ্যে কানসাসের ফোর্ট রিলের সামরিক হাসপাতালে এক সৈন্য এসে রিপোর্ট করলো। তার ঠোঁট নীলচে। জ্বর আর মাথাব্যথায় বেচারার অবস্থা কাহিল। ওষুধপাতি খাইয়ে তাকে হাসপাতালে রাখা হলো।
কিন্তু কয়েক ঘন্টা পরই অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে শুরু করে। দুপুরের দিকে শতাধিক সৈন্যকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। সবার উপসর্গ এক– মুখ নীলচে, জ্বর, মাথাব্যথা। কে জানতো সেদিনকার সেই সৈন্যের কাছ ছড়িয়ে যাওয়া স্প্যানিশ ফ্লু আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকরতম ‘প্যানডেমিক’ হয়ে উঠবে?
‘স্প্যানিশ ফ্লু’ শব্দজোড়া শুনে হয়তো আপনি ধরেই নিয়েছেন এই সংক্রামক ভাইরাসের উৎপত্তি স্পেনে। যদি ধরে নিয়ে থাকেন, তবে আপনি ভুল করছেন। এই ফ্লু এর ভাইরাসের উৎপত্তির সাথে কোনোভাবেই স্পেন জড়িত নয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউরোপের যে অল্প কয়েকটি দেশ একদম নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করেছিল, তার মধ্যে স্পেন একটি। নিরপেক্ষ থাকায় এই দেশটির গণমাধ্যম বেশ স্বাধীনভাবেই সংবাদ প্রকাশ করতে পারছিল। কিন্তু ইউরোপের বাকি বিবদমান দেশগুলোর সংবাদপত্রের উপর সরকার কঠোর সেন্সরশিপ আরোপ করে। সরকারের ভয় ছিল, মহামারির কথা জানাজানি হলে শত্রুপক্ষের চোখে তারা দুর্বল প্রতিপন্ন হবে। তাই যুদ্ধরত দেশগুলো কোনোভাবেই যেন রোগের খবর প্রকাশিত না হয়, সেদিকে সতর্ক ছিল।
স্পেনের পত্রিকাগুলো গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সুযোগ নিয়ে ফলাও করে স্প্যানিশ ফ্লুর খবর প্রচার করে। এমনকি তাদের রাজা ত্রয়োদশ আলফোনসোও এই ভাইরাসে আক্রান্ত হন। এরপর পত্রিকাগুলো আরও বেশি করে সংবাদ প্রকাশ করতে শুরু করে।
যেহেতু ইউরোপের বাকি দেশগুলো নিজেদের সংবাদপত্রের মাধ্যমে স্প্যানিশ ফ্লুর খবর জানতে পারছিল না, তাই তারা স্পেনের পত্রিকাগুলো পড়তে শুরু করে। পড়তে পড়তে একসময় তাদের মধ্যে ধারণা হয়ে যায়, স্পেনেই এই ভাইরাসের উৎপত্তি। তারা এর নামকরণ করে ‘স্প্যানিশ ফ্লু’। এভাবেই ভুল বোঝাবুঝির কারণে আমেরিকায় উৎপত্তি হওয়া একটি ভাইরাসের নামের সাথে স্পেনের নাম সংযুক্ত হয়ে যায়।
স্প্যানিশ ফ্লুর ভাইরাসের নাম ছিল H1N1। এটি একটি মারাত্মক ভাইরাস ছিল। ধরুন, একজন ভাইরাস আক্রান্ত রোগী আরেকজন সুস্থ মানুষের সাথে কথা বলছেন। রোগীর শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে সাথে সেই ভাইরাস বাতাসে বেরিয়ে আসতো। আর সুস্থ রোগীর নিঃশ্বাসের মাধ্যমে প্রবেশ করে আবার সুস্থ ব্যক্তিকে আক্রান্ত করে ফেলতো। এভাবে খুব দ্রুততার সাথে অল্প সময়েই অসংখ্য ব্যক্তি এই ভাইরাসের সংক্রমণের শিকার হতো।
এই ভাইরাস সংক্রমণের প্রাথমিক উপসর্গগুলো ছিল শুষ্ক কাশি, ক্ষুধা হারানো ও মাথায় ক্ষত হওয়া। এরপর দ্বিতীয় দিনে রোগী খুব বেশি ঘামতো। আর শেষ পর্যায়ে এসে ভাইরাস রোগীর শ্বাসতন্ত্রে আক্রমণ করতো। এর ফলশ্রুতিতে রোগীর নিউমোনিয়া হতো এবং মারা যেতো।
অনেক সময় ভাইরাস সংক্রমিত হওয়া ব্যক্তি আরও দ্রুত মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তো। আমেরিকার স্প্যানিশ ফ্লুতে মারা যাওয়া বেশিরভাগ ব্যক্তির গল্প এরকম, “ব্যক্তিটি ঘুম থেকে উঠলো এবং তাকে বেশ অসুস্থ দেখাচ্ছিল। কাজে যাওয়ার পথে সে মারা গেল।”
ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়ার পর্যায়গুলোকে মহামারী বিশেষজ্ঞরা তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন। এই তিনটি ভাগকে একেকটি ‘ওয়েভ’ বলা হয়।
প্রথম ওয়েভে স্প্যানিশ ফ্লু তেমন ভয়ংকর ছিল না। আক্রান্ত সৈন্যদের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় স্থানান্তরের ফলে ভাইরাসও স্থানান্তরিত হয়। তাই প্রথম ওয়েভে বলতে গেলে ভাইরাসের সংক্রমণ সৈন্যদের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু ভাইরাসের স্থানান্তর মোটেও কোনো ভালো বিষয় ছিল না।
১৯১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এই বৈশ্বিক মহামারি সবচেয়ে ভয়ংকর পর্যায়, দ্বিতীয় ওয়েভে প্রবেশ করে। সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তেরো সপ্তাহে সবচেয়ে বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়, মারা যায়। একটি পরিসংখ্যান দিলে হয়তো এই সময়ের তীব্রতা বোঝা যাবে। শুধু অক্টোবর মাসেই আমেরিকায় প্রায় দুই লাখ মানুষ মারা যায় এই ভাইরাসের কারণে। আর পুরো প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ১ লাখ ১৬ হাজার মার্কিন সেনা মারা যায়। অর্থাৎ, বিশ্বযুদ্ধের পুরো চার বছরে যে পরিমাণ আমেরিকান মারা গিয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ এক মাসে এই ভাইরাসের কারণে পৃথিবী ত্যাগ করেছে!
সুইজারল্যান্ডের জেনিথে এই ভাইরাসের তান্ডবে এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছিল যে, মানুষের মৃত্যুতে চারদিক সয়লাব হয়ে গিয়েছিল। কবরস্থানগুলো সব ভর্তি হয়ে গিয়েছিল। নতুন করে যারা মৃত্যুবরণ করছিল, তাদের কবর দেয়ার জায়গা পাওয়া যাচ্ছিল না। ফলে একটা সময়ে গিয়ে এককভাবে আর কাউকে কবর দেয়া সম্ভব হয়নি। কোনো উপায় না পেয়ে গণহারে লাশগুলোকে মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়।
১৯১৯ সালের জানুয়ারিতে তৃতীয় ওয়েভ শুরু হয়। তৃতীয় ওয়েভে এসে এই ভাইরাসে মৃত্যুর হার কমে আসে। তাই আগের ওয়েভের মতো এই ওয়েভ তেমন ভয়ংকর ছিল না। তবে তৃতীয় ওয়েভে একদমই যে ভাইরাস সংক্রমিত হয়নি কিংবা মারা যায়নি– বিষয়টি সেরকম নয়। কিন্তু আগের ওয়েভের মতো গণহারে মানুষ আক্রান্ত হয়নি কিংবা মারা যায়নি।
আগে থেকেই ব্যবস্থা গ্রহণ করায় আমেরিকা দ্বিতীয় ওয়েভের করাল গ্রাস থেকে কোনোমতে নিজেকে রক্ষা করে। কিন্তু তৃতীয় ওয়েভে এসে এই ভাইরাস কয়েক হাজার অস্ট্রেলীয় নাগরিকের প্রাণ কেড়ে নেয়।
ভারতবর্ষও এই ভাইরাসের কালো থাবা থেকে রক্ষা পায়নি। মুম্বাইয়ে (তৎকালীন বোম্বাই) একটি জাহাজে একজন যুদ্ধফেরত সৈন্য আসেন যিনি ভাইরাস আক্রান্ত ছিলেন। তার কাছ থেকে মুম্বাইয়ের উপকূলে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। তারপর পুরো দেশে।
মহাত্মা গান্ধী নিজেও এই ভাইরাসের হাত থেকে ছাড়া পাননি। কিন্তু ভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছিলেন। তার ভাষ্যমতে, উপনিবেশগুলোতে শোষণের কারণে এই ভাইরাস ছিল পশ্চিমা সভ্যতার উপর সৃষ্টিকর্তাপ্রদত্ত শাস্তি। ভারতবর্ষে প্রায় সতের লাখ মানুষ এই ভাইরাসের কবলে পড়ে মারা যায়, যেটি ছিল ভারতের মূল জনসংখ্যার প্রায় ৭%।
পৃথিবীর সবগুলো মহাদেশেই এই ভাইরাস তার কালো থাবা বিস্তার করে। ব্রাজিলের একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ, মারাজোতে শুধু এই ভাইরাস সংক্রমণের কোনো কেসের রেকর্ড পাওয়া যায়নি।
পুরো পৃথিবীর তিন ভাগের এক ভাগ অর্থাৎ প্রায় ৫০ কোটি মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। আর এই ভাইরাসে ঠিক কতজন মারা গিয়েছিল, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তবে অধিকাংশের মতে, ৫ কোটি থেকে দশ কোটি মানুষ এই ভাইরাসে মারা গিয়েছিল।
সমাজে এই ভাইরাসের ফলে মৃত্যুর প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। অসংখ্য পরিবার তাদের কর্মক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যায়। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো শ্রমিকের অভাবে বন্ধ হয়ে যায়। ইংল্যান্ডে পোশাকশিল্পের জন্য বিখ্যাত ম্যানচেস্টারের কারখানাগুলো শ্রমিকের অভাবে বন্ধ হয়ে যায়। চিঠি আদানপ্রদান কিংবা ময়লা সংগ্রহের মতো কাজগুলো মানুষের অভাবে বন্ধ হয়ে যায়। অনেক দেশে শস্য উৎপাদন একদম কমে যায়। কারণ উৎপাদন করার মতো লোক বেঁচে ছিল না।
স্প্যানিশ ফ্লুর ভয়াবহতা আজও মানুষকে বিহ্বল করে তোলে। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া– এর চেয়ে ভয়াবহ ঘটনা খুব কমই আছে। মানবজাতির শিক্ষা নেয়ার একটি বড় জায়গা স্প্যানিশ ফ্লু।