Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

রাজা রমেন্দ্রনারায়ণ: মৃত রাজা নাকি জীবিত সন্ন্যাসী?

রহস্য ও রোমাঞ্চকর গল্প যে শুধু বই আর চলচ্চিত্রেই পাওয়া যায় তেমনটা নয়। মাঝে মাঝে বাস্তবেও এমন গল্পের খোঁজ পাওয়া আশ্চর্যের কিছু নয়। তেমনই এক গল্প ভাওয়াল রাজা রমেন্দ্রনারায়ণকে নিয়ে, যা ছিল অবিভক্ত বাংলায় ইংরেজ শাসনামলের অন্যতম চাঞ্চল্যকর ও আলোচিত ঘটনা।

ঢাকার অদূরে গাজীপুরের জয়দেবপুর সদরে রানী বিলাসমনি সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশে একটি রাজপ্রাসাদ রয়েছে। বর্তমানে এটি পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে বেশ প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। শান্ত, নিরিবিলি ও ছিমছাম পরিবেশের জন্যে অনেকের মন কেড়ে নিয়েছে এই স্থান। আর এই রাজবাড়ির মানুষগুলোকে নিয়েই মূলত গল্পের গোড়াপত্তন। সন্ন্যাসী বেশে মৃত রাজার ফিরে আসার এক অদ্ভুত ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছে এই রাজবাড়ি।

ভাওয়াল রাজবাড়ির পেছনের অংশ; Source: bokaporjotok.blogspot.com

ভাওয়াল রাজ্যের জমিদারি ছিল পূর্ববঙ্গের মধ্যে সবচাইতে বৃহৎ ও প্রাচীন। সতেরো শতকের শেষ দিকে এই রাজ্যে জমিদারি প্রথা শুরু হয়। ১৮৭৮ সালের দিকে এখানকার রাজপরিবার ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে রায় ও রাজা উপাধি লাভ করে। সেসময় ভাওয়ালের রাজা ছিলেন কালীনারায়ণ। তার পরে জমিদারির দায়িত্ব পান তার একমাত্র পুত্র রাজেন্দ্রনারায়ণ। তিনিও খুব বেশিদিন জমিদারি ভোগ করতে পারেননি। তার মৃত্যুর পর তিন পুত্রকে জমিদারির বিভিন্ন অংশের দায়িত্ব বুঝিতে দেওয়া হয়। এই তিন ভাইয়ের মধ্যে দ্বিতীয়জন, অর্থাৎ রমেন্দ্রনারায়ণকেই মূলত ভাওয়াল রাজা বলা হয়।

রাজা হিসেবে রমেন্দ্রনারায়ণ বেশ প্রজাবৎসল হলেও, তার পছন্দের কাজ ছিল নারীসঙ্গে থেকে আনন্দ-ফুর্তি করা। তার স্ত্রী বিভাবতী দেবী ছিলেন স্বামীসঙ্গ বঞ্ছিত। রাজার আবার শিকারের প্রবল নেশা ছিল। একবার নাকি তিনি বন্দুকের এক গুলিতেই বিশাল এক বাঘ ঘায়েল করে ফেলেছিলেন। তবে অতিরিক্ত মদ্যপান ও নারী সংসর্গের কারণে রাজা ‘সিফিলিস’ রোগে আক্রান্ত হন। তখন রাজার চিকিৎসা করছিলেন পারিবারিক চিকিৎসক আশুতোষ দাসগুপ্ত। ১৯০৯ সালের ১৮ এপ্রিল ডাক্তারের পরামর্শে রাজাকে সস্ত্রীক দার্জিলিংয়ে পাঠানো হয়। সাথে অবশ্য চিকিৎসক, রাজার শ্যালক সত্যেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী ও রাজার আরও কিছু কাছের লোকও যান। কিন্তু দার্জিলিংয়ে গিয়ে রাজার অবস্থা হিতে বিপরীত হলো। তার অসুখ ক্রমেই বেড়ে যেতে লাগল। অনেক চেষ্টা করেও আর বাঁচিয়ে তোলা যায়নি রমেন্দ্রনারায়ণকে।

রাজা রমেন্দ্রনারায়ণ বাঘ শিকারের পরের ছবি; Source: kishorgonj.com

মে মাসের ৭ তারিখে রাজার মৃত্যু হয়। চিকিৎসকের প্রতিবেদনে লেখা হয় যে, গলব্লাডারে পাথর হওয়ার কারণেই তার মৃত্যু হয়েছিল। দার্জিলিংয়েই রাজার শবদেহ পোড়ানো হয় এবং মে মাসের ১৮ তারিখ শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান পালিত হয়। রমেন্দ্রনারায়ণের জীবনাবসানের প্রথম পর্বের গল্পটা মোটামুটি এখানেই শেষ।

রাজার মৃত্যুর প্রায় দশ বছর কেটে গেছে, তখন রাজ্যের দায়িত্ব পালন করছেন রাণী বিভাবতী দেবী। ১৯২০-২১ সালের দিকে ঢাকার বাকল্যান্ড বাঁধের কাছে গেরুয়া পোশাক পরিহিত অত্যন্ত সুদর্শন এক জটাধারী সন্ন্যাসীর আগমন ঘটে। রাজ্যের অনেকেই অপরিচিত সন্ন্যাসীকে দেখতে এবং তার কথা শুনতে যান। সন্ন্যাসীর কথা বলার ধরন এবং মুখাবয়ব দেখে অনেকেরই একটি ব্যাপারে সন্দেহ হতে থাকে। একদিন রাজা রমেন্দ্রনারায়ণের এক বিশ্বস্ত দেহরক্ষী সন্ন্যাসীকে চিনে ফেলে। সে তখন ‘রাজা এসেছে রাজা এসেছে’ বলে চিৎকার করতে থাকে। ফলে অল্প সময়ের মধ্যেই রাজ্যের চারিদিকে শোরগোল ওঠে। সন্ন্যাসীকে দেখার জন্যে তখন বিশাল ভিড় জমে যায়। তখন সন্ন্যাসী নিজ মুখে স্বীকার করেন যে, তিনিই রাজা রমেন্দ্রনারায়ণ!

রাজা রমেন্দ্রনারায়ণের সন্ন্যাসী বেশ; Source: digitalgazipur.com

খবর শুনে রমেন্দ্রনারায়ণের বোন জ্যোতির্ময় দেবী সন্ন্যাসীকে নিজের প্রাসাদে আনতে লোক পাঠালেন। জ্যোতির্ময় দেবী খুব ভালোভাবে সন্ন্যাসীকে পরীক্ষা করলেন এবং ছোটবেলার অনেক ঘটনা জিজ্ঞেস করলেন। সন্ন্যাসীর উত্তরে জ্যোতির্ময় দেবী খুব অবাক হয়ে যান। কেননা তিনি এমন সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলেন, যা ছিল দুই ভাই-বোনের নিজেদের ছোটবেলার স্মৃতি সম্পর্কিত।

তবে সকলের মনে সন্ন্যাসীকে রাজা হিসেবে মেনে নেওয়ার পেছনে আরেকটা কারণ অবশ্য ছিল। রাজা যখন মারা যান, তখন তাকে পোড়ানোর জন্য শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু ঝুম বৃষ্টি নামার ফলে ডোমরা শ্মশানে রাজাকে ফেলে রেখে চলে যায়। বৃষ্টি কমে এলে ডোমেরা শ্মশানে গিয়ে নাকি দেখে, সেখানে কোনো মৃতদেহ নেই। রাজার সাথে যারা দার্জিলিং গিয়েছিলেন, তাদের মুখেই এই ঘটনা সকলের শোনা ছিল। আর তখন থেকেই অনেকের মনে আশা ছিল যে, রাজা নিশ্চয় একদিন ফিরে আসবেন।

ভাওয়াল সন্ন্যাসীকে নিয়ে লেখা পার্থ চ্যাটার্জীর বইয়ের প্রচ্ছদ; Source: goodreads.com

কিন্তু সকলে সেদিনের ঘটনা জানার জন্যে রাজার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। তখন রাজা সকলকে সেদিনের কথা খুলে বললেন, যদিও তিনি তা সুস্থ হওয়ার পরে জেনেছিলেন। সেই রাতে কিছু নাগসাধু শ্মশানের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলেন। পথে একটি লোককে পড়ে থাকতে দেখে তার গায়ে হাত দিয়ে তারা দেখেন যে, লোকটি বেঁচে আছেন। তখন সাধুগুলো লোকটিকে সাথে করে নিয়ে যান তাদের আস্তানায়। সন্ন্যাসীদের সেবা শুশ্রূষায় রাজা সুস্থ হয়ে ওঠেন আর সন্ন্যাস ধর্মে দীক্ষা নেন। এদিকে রাজার স্মৃতিও লোপ পায়। ফলে রাজ্যের কথা বেমালুম ভুলে বসেন রাজা। এভাবে অনেক বছর কাটার পর যখন সন্ন্যাসীরা বিভিন্ন জায়গা ঘুরে বেড়াচ্ছেন, তখন রাজার ধীরে ধীরে মনে পড়তে থাকে হারানো অতীতের কথা; তার রাজ্যের কথা, প্রজাদের কথা। আর দেরি না করে তিনি ছুটে আসেন জয়দেবপুরের চেনা ঘাঁটিতে। কিন্তু প্রথমেই কিছু বলে উঠতে পারেননি। কয়েকটা দিন চারিদিক পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। পরবর্তীতে স্থানীয়রাই তাকে চিনে নেন।

রাজাকে যখন পাওয়া গেল, তখন রাজাকে রাজ্যও বুঝিয়ে দেওয়া চাই। কিন্তু বাধ সাধেন রাণী বিভাবতী দেবী। তিনি সন্ন্যাসীকে রাজা রমেন্দ্রনারায়ণ বলে মানতে রাজি ছিলেন না। উপায়ন্তর না দেখে সন্ন্যাসী সকলের পরামর্শে আদালতের শরণাপন্ন হলেন।

রাণী বিভাবতী দেবী; Source: amar-kotha.com

১৯৩০ সালের ২৪ এপ্রিল সন্ন্যাসীর পক্ষের আইনজীবীরা বিভাবতী দেবী ও অন্যান্য মালিকদের বিরুদ্ধে ভাওয়াল রাজ্যের সম্পত্তির অধিকার চেয়ে মামলা করেন। তখন আদালত থেকে বিচারপতি পান্নালাল বসুকে এই মামলার বিচারক নিয়োগ করা হয়। সন্ন্যাসীর পক্ষে প্রধান উকিল ছিলেন বিজয় চন্দ্র চক্রবর্তী এবং বিবাদীপক্ষের উকিল ছিলেন অমিয় নাথ চৌধুরী। আনুষ্ঠানিকভাবে বিচার কাজ শুরু হয় ১৯৩৩ সালের ৩০ নভেম্বর।

প্রথমেই বিবাদীপক্ষের উকিল সন্ন্যাসীর পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। উকিলের যুক্তিতে, ভাওয়াল রাজ্যের সম্পত্তির লোভেই রাজা সে সন্ন্যাসী ঠগবাজি করছে। উকিল আরও বলেন, সন্ন্যাসীর সাথে রাজার চেহারার কিছুটা সাদৃশ্য থাকলেও, অমিল রয়েছে প্রচুর। কিন্তু বাদীপক্ষের উকিলের একের পর এক সাক্ষী ও প্রমাণের জোরে বিবাদীপক্ষের সকল যুক্তি খন্ডন হতে থাকে। মামলা সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ মোড় নেয় তখন, যখন সন্ন্যাসী রাজ্যের সকল ঘটনা, রাজবাড়ির সকল সদস্যের গল্প, বিভিন্ন মূল্যবান আসবাব ও ধনরত্নের কথা একের পর এক বলে যেতে লাগলেন। বাদী-বিবাদী মিলে প্রায় কয়েকশ’ সাক্ষী উপস্থিত করা হয় আদালতে। রাজ্যের জনগণেরও ছিল এই মামলা নিয়ে ব্যাপক কৌতূহল।

সন্ন্যাসী দাবী করেন, তাকে ষড়যন্ত্র করে দার্জিলিংয়ে নিয়ে গিয়ে কৌশলে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলার চেষ্টা করা হয়। সন্ন্যাসী তার এই দুর্দশার জন্যে রাণী, রাণীর ভাই সত্যেন্দ্রনাথ এবং পারিবারিক চিকিৎসক আশুতোষকে দায়ী করেন।

এভাবে দু’পক্ষের প্রায় দু’মাসের মতো শুনানি চলে। মামলার পক্ষে-বিপক্ষে অনেক ধরনের প্রমাণ ও মতামত উঠে আসে। ১৯৩৬ সালের ২৪ আগস্ট বিচারক পান্নালাল বসু বিস্তারিত ব্যাখ্যা সহ সন্ন্যাসীর পক্ষে রায় দেন। এদিকে জনগণের মনে এই রায় জানার জন্য ছিল অনেক উৎকণ্ঠা। পত্র-পত্রিকাতেও এই মামলার উপর অনেক ধারাবাহিক প্রতিবেদন ছাপানো হয়।

রাজবাড়ির সামনে কিছু ইংরেজ অফিসিয়াল; Source: wn.com

তবে এই রায়ের পরেও বিভাবতী দেবী কিন্তু থেমে থাকেননি। ১৯৪৩ সালে বিভাবতী দেবীর আইনজীবীরা হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে লন্ডনের প্রিভি কাউন্সিলে আপিল করেন। ১৯৪৫ সালে আবার এর শুনানি শুরু হয়। ২৮ দিন ধরে চলা শুনানি শেষে  ১৯৪৬ সালের ৩০ জুলাই বিচারকেরা সন্ন্যাসীর পক্ষে রায় দেন এবং আপিল নাকচ করে দেন। ফলে আইনত জমিদারির পূর্ণ অংশের অধিকার পান সন্ন্যাসী রাজা। কিন্তু ততদিনে রাজার বিষয়াদির উপর লোভ লালসা চলে যায়। সন্ন্যাস ধর্মকেই নিজের ধ্যান জ্ঞান মেনে রাজা ভাওয়াল রাজ্য ত্যাগ করেন, এমন ঘটনা প্রচলিত রয়েছে।

ভাওয়াল রাজার এই গল্পের অনেকটাই বাস্তব হলেও গল্পে, চলচ্চিত্রে, পত্র-পত্রিকায় ও নাটকেও অনেক কাল্পনিক ঘটনার সৃষ্টি হয়েছে। এখনও স্থানীয়দের লোকমুখে রাণী বিভাবতী ও চিকিৎসক আশুতোষ দাসগুপ্তকে নিয়ে রসাত্মক অনেক গল্প প্রচলিত রয়েছে। বিখ্যাত অভিনেতা উত্তম কুমারের একটি চলচ্চিত্র ‘সন্ন্যাসী রাজা’, যা এই ভাওয়াল রাজাকে নিয়েই নির্মিত হয়েছিল। অবশ্য চলচ্চিত্রটির উপস্থাপনে মূল ঘটনা থেকে খানিকটা ভিন্নতা রয়েছে।

উত্তম কুমার অভিনীত সন্ন্যাসী রাজা; Source: youtube.com

ইংরেজ শাসনামলের অবসানের পর ১৯৫১ সালে জমিদারি প্রথা বাতিল না হওয়া পর্যন্ত ভাওয়ালের জমিদারির উত্তরাধিকারের বিষয়টি কোর্ট অব ওয়ার্ডসের অধীনে থাকে। পাকিস্তান আমলেও জমিদারির বিষয়টি কোর্ট অব ওয়ার্ডসই দেখাশুনা করত। বর্তমানে ভাওয়াল এস্টেটের কর্মকাণ্ড গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ভূমি সংস্কার বোর্ড পরিচালনা করে।

বড়ই বিচিত্র আমাদের এই পৃথিবী। কত ধরনের অদ্ভুত সব ঘটনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে আমাদের চারপাশে। মাঝে মাঝে বাস্তবেও আমাদের এমন ঘটনার সাক্ষী হতে হয়, যার সাথে চলচ্চিত্রের কাল্পনিক গল্পের পার্থক্য করাই মুশকিল হয়ে পড়ে। ভাওয়াল রাজার এই কাহিনী তাই আজও উপজীব্য হয়ে আছে বিভিন্ন বইয়ের কাহিনীতে বা নাটকে।

ফিচার ইমেজ- hinduhistory.info

Related Articles