ভাই ও বোনের সম্পর্ক কতকটা ভালোবাসার, কতকটা স্নেহের আর বেশিরভাগ জুড়েই খুনসুটির। ছোটবেলা থেকে বড় হওয়া পর্যন্ত যে মানুষটা সবসময় বন্ধু হয়ে থাকে, প্রয়োজনে কিছুটা অভিভাবকসুলভ হয় আর অপ্রয়োজনেও বাবা মায়ের শাসন থেকে স্নেহের চাদরে যে মানুষটা আগলে রাখে সে-ই বড় ভাই কিংবা বোন। ধর্মীয় থেকে শুরু করে দেশীয়, পারিবারিক বিভিন্ন উৎসব পালনের মতোই ভাই-বোনের সম্পর্ক উদযাপনের একটি নাম রক্ষা বন্ধন বা রাখি বাঁধা। রক্ষা বন্ধন বা রাখি বাঁধা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের একটি ধর্মীয় রীতি বা উৎসব। মূলত ভারত এবং নেপালে এ প্রথা প্রচলিত। হিন্দু ধর্ম অনুযায়ী বলা হয়ে থাকে, সকল ধরনের বিপদ থেকে উদ্ধারের প্রতিশ্রুতি করে এ উৎসবে ভাই বোনের থেকে রাখি বাঁধায়। রীতি অনুযায়ী, ভাইয়ের হাতে বোন রাখি বেঁধে দেয় এবং তার সর্বাঙ্গীণ উন্নতি কামনা করে। অন্যদিকে ভাই তার সকল পরিস্থিতিতে বোনকে রক্ষা করার শপথ নেয়। অবশ্য প্রথানুযায়ী রাখি বাঁধিয়ে নেয়ার বিনিময়ে ভাইয়ের কাছ থেকে একটি উপহারও পাওনা থাকে বোনের।
হিন্দু চন্দ্রপঞ্জিকা অনুযায়ী, প্রতি বছর শ্রাবণ মাসের শেষ পূর্ণিমার দিন রক্ষা বন্ধন পালন করা হয়। রক্ত-সম্পর্কিত না হলেও কোনো নারী পুরূষকে রাখি বেঁধে দেয়ার মাধ্যমে ভাই-বোনের সম্পর্ক স্থাপন করতে পারেন। আর রাখি বাঁধার মাধ্যমে এভাবে ভাই-বোনের সম্পর্ক তৈরির সাথে অনেক ঘটনা জড়িত থাকলেও ঐতিহাসিক মর্যাদায় সবচেয়ে বেশি প্রচলিত মেওয়ারের রাজপুত রাণী কর্ণাবতী ও সম্রাট হুমায়ুনের ইতিহাস।
রানী কর্ণাবতী ছিলেন বর্তমান ভারতের রাজস্থানে অবস্থিত মেওয়ারের রাজধানী চিতোরের রাজা রানা সংগ্রাম সিং/রানা সাঙ্গার স্ত্রী। তার অন্যতম আরেকটি পরিচয় হলো তিনি রাজপুতদের গৌরব মহারাণা প্রতাপের পিতামহী। জন্মসূত্রে রাণী কর্ণাবতী ছিলেন বুন্দির রাজকন্যা। ১৫২৬ সালে দিল্লীর সিংহাসনে সম্রাট বাবরের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা হলে রানা সাঙ্গার নেতৃত্বে রাজপুত রাজারা একত্র হয়ে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। ১৫২৭ সালে খনোয়ায় সম্রাট বাবরের সাথে সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হলে রাজা সাঙ্গা আহত হন এবং পরবর্তী সময় আঘাতের ক্ষতের কারণে কিছুদিন পর মৃত্যুবরণ করেন। এ সময়ে শিশু সন্তান রাণা বিক্রমাদিত্যের হয়ে ১৫২৭ থেকে ১৫৩৩ এ ছয় বছর রানী কর্ণাবতী রাজ্যের ভার নিজ কাঁধে তুলে নেন এবং রাজ্যের শাসনকার্য পরিচালনা করেন। পরবর্তীতে পরিণত বয়স হলে রাজ্যের দায়িত্ব রানী কর্ণাবতী তার পুত্র বিক্রমাদিত্যের হাতে তুলে দেন। কিন্তু অল্প বয়সে সিংহাসনে বসে ক্ষমতার চূড়ান্ত স্বাদ পাওয়ার ফলে রাজা বিক্রমাদিত্যের মাঝে ঔদ্ধত্যের বাড়াবাড়ি পরিলক্ষিত হয়। এছাড়াও শাসক হিসেবে তিনি ছিলেন একইসাথে অদক্ষ এবং অযোগ্য। তার এসব দুর্ব্যবহারে বেশিরভাগ সভাসদ এবং পার্শ্ববর্তী অন্য রাজারা তার ওপরে রুষ্ট হয়ে পড়েন। এর সুযোগ নেন গুজরাটের রাজা বাহাদুর শাহ। ১৫৩২-এ প্রথমবার চিতোর আক্রমণের পর দ্বিতীয়বারের মতো পুনরায় তিনি চিতোরের সিংহাসন দখলের জন্যে বেরিয়ে পড়েন।
এমতাবস্থায় রানী কর্ণাবতী রাজপুত রাজাদের কাছে সাহায্য চাইলে বেশিরভাগ রাজাই বিক্রমাদিত্যকে সাহায্য করতে অস্বীকৃতি জানায়। কিন্তু রানী কর্ণাবতীও হেরে যাবার মানুষ নন। তিনি সকলের সাথে আলাপ করে বিক্রমাদিত্যের জন্য না হোক, অন্তত সিসোদিয়ার (ভারতীয় রাজপুত গোষ্ঠী) কথা ভেবে হলেও সাহায্যের জন্যে অনুরোধ করেন। তার এ কথায় সকল রাজপুত রাজা রাজি হন। কিন্তু এর বিনিময়ে জুড়ে দেন একটি শর্ত। আর তা হলো যুদ্ধ চলার সময় রানী কর্ণাবতীর দুই পুত্র রাণা বিক্রমাদিত্য ও রাণা উদয় সিংকে বুন্দিতে পাঠিয়ে দিতে হবে। রাণী কর্ণাবতী এ শর্তে রাজি হন এবং দুই পুত্রকে তার বিশ্বস্ত দাসী পান্না বাইয়ের সাথে বুন্দিতে পাঠিয়ে দেন তাদের দেখাশোনা করার জন্যে। বিশ্বস্ত দাসী পান্না বাই তাকে ছেড়ে যেতে প্রথমে রাজি না হলেও পরে তার নির্দেশে যেতে বাধ্য হন। রানী তাকে বুঝিয়ে বলেন যে, সকল রাজপুত রাজারা তাকে সাহায্য করছে। কিছুদিনের মাঝেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
রাজপুত রাজাদের সাথে সবকিছু ঠিক করার পরও রাজা বাহাদুর শাহের সৈন্যবাহিনী ও তাদের দক্ষতা তথা শক্তি সম্পর্কে অবগত থাকায় জয় নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন রানী কর্ণাবতী। তাই সাহায্যের আশায় রাজপুতদের দীর্ঘ সময়ের শত্রু মোঘল সম্রাট হুমায়ুনকে বার্তাবাহক মারফত একটি রাখি পাঠান। ঐ চিঠিতে রানী কর্ণাবতী দিল্লীর তৎকালীন সম্রাট হুমায়ুনকে ভাই ডাকেন এবং তার সাহায্য চেয়ে চিঠি লেখেন। বলা হয়ে থাকে, রক্ষা বন্ধন সকল প্রকার শত্রুতা ও ধর্মের উর্ধ্বে। এ চিঠিটিই তার প্রমাণ। রানী কর্ণাবতীর চিঠি সম্রাট হুমায়ুনকে এতটাই আবেগপ্রবণ করে তুলেছিল যে বাংলা জয় মাঝ রাস্তাতেই ছেড়ে দিয়ে বোন রানী কর্ণাবতীকে বাঁচাতে গোয়ালিওর থেকে চিতোরের উদ্দেশে যাত্রা করেন সম্রাট। তবে ঐতিহাসিকভাবে ঐ চিঠির কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এছাড়াও দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকা মোঘল ও রাজপুতদের মাঝে বৈরী সম্পর্ককে উন্নত করতে এ সুযোগকে রাজনৈতিক চালে পরিণত করার কথা ভেবে রানী কর্ণাবতীর সাহায্যের অনুরোধ গ্রাহ্য করে ছুটে এসেছিলেন বলেও শোনা যায়। কিন্তু এর কোনোটিরই ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। বরং রানী কর্ণাবতীর পাঠানো রাখি এবং সেইসাথে ভাই ডেকে সাহায্যের অনুরোধই সম্রাট হুমায়ুনকে আলোড়িত করেছিল বলে বাংলা জয় শেষ হবার আগেই ছুটে আসা অধিক যৌক্তিকতা বহন করে।
অন্যদিকে রাজপুত রাজারা এক হয়ে গুজরাটের রাজা বাহাদুর শাহের সঙ্গে বীরত্বের সাথে প্রাণপণ যুদ্ধ করেন। কিন্তু সে যুদ্ধে রাজপুত রাজারা পরাজিত হন। এদিকে আসন্ন হার নিশ্চিত জেনে আত্মসম্ভ্রম বাঁচাতে ১৫৩৫ সালের ৮ মার্চ রানী কর্ণাবতী অন্দর মহলের প্রায় ১৩০০০ রমণীসহ ‘জওহর’ ব্রত পালনের জন্যে বিশাল অগ্নিকাণ্ডে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মাহুতি দেন। চিতোরের ইতিহাসে জওহর ব্রতের ঘটনা দ্বিতীয় বারের মতো ঘটে।
এদিকে সম্রাট হুমায়ুনের মেওয়ার পৌঁছাতে প্রায় পনেরোদিন দেরি হয়। এর মাঝে রাজা বাহাদুর শাহ চিতোরের সিংহাসন দখল করে নেয়। শোনা যায়, পথিমধ্যে রানী কর্ণাবতীর আত্মাহুতির কথা শুনে হুমায়ুন অত্যন্ত কষ্ট পান এবং বাহাদুর শাহের ওপর আক্রোশে ফেটে পড়েন। বাহাদুর শাহকে প্রাপ্য শাস্তি দেয়ার জন্যে ১৯৩৫ এ বাহাদুর শাহের থেকে মাণ্ডু দখল করে তাকে হত্যার নির্দেশ দেন। অন্যদিকে, সম্রাট হুমায়ুনের নির্দেশ শুনে বাহাদুর শাহ মাণ্ডুতে পালানোর চেষ্টা করেন। পরবর্তী সময় পর্তুগিজদের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়লে পর্তুগিজরা তাকে বন্দি করে পর্তুগিজ অধিকৃত দিউতে পাঠিয়ে দেয়। সেখানে পর্তুগিজরা বাহাদুর শাহকে হত্যা করে। মৃত্যুর সময় বাহাদুর শাহের বয়স হয়েছিল ৩১ বছর। সম্রাট হুমায়ুন বোনকে বাঁচাতে না পারলেও বোনের সন্তান রাণা বিক্রমাদিত্যকে পুনরায় সিংহাসনে বসান এবং নিজ রাজ্যে ফেরত যান।
সম্পর্ক সবসময় রক্ত বা বংশীয়সূত্রে তৈরি হয় না, তৈরি হয় মন থেকে। অনেকসময় রক্তসূত্রের আত্মীয়রা যেখানে বিপদে ফেলে পিছু হটে, তখন অনাত্মীয় কেউই এগিয়ে আসে যে সম্পর্ক থেকে, তা-ই সত্যিকারের সম্পর্ক। সম্পর্ক আসলেই সম্পর্ক হয় ওঠে পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং সম্মান থেকে। আর তারই দৃষ্টান্ত রানী কর্ণাবতী ও সম্রাট হুমায়ুনের সম্পর্ক। রাণী কর্ণাবতী ও সম্রাট হুমায়ুনের সম্পর্কের বুনিয়াদ ছিল শুধুই একটি রাখি আর সাথে থাকা একটি চিঠি। ভিন্ন ধর্ম কিংবা রাজনৈতিক সম্পর্ক কিছুই মুখ্য হয়নি ভাইকে পাঠানো বোনের রক্ষাবার্তায়। বোনকে রক্ষায় ছুটে এসেছেন ভাই। শেষ রক্ষা না হলেও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়েছেন অপরাধীকে।