Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

জেল পালানো দুঃসাহসিক কয়েকটি অন্তর্ধানের গল্প

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঘটে যাওয়া স্বাধীনতা যুদ্ধ, নানা আন্দোলন ও সংগ্রাম কিংবা নানা অপরাধে সাজা পাওয়া বন্দিদের জেল পালানোর নানা রোমাঞ্চকর ঘটনা থ্রিলার গল্পের চেয়েও কম আকর্ষণীয় নয়। বিচিত্র সব উপায় ও দুঃসাহসিক নানা কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে জেল থেকে পালানো এমন কয়েকটি লোমহর্ষক কাহিনী নিয়ে সাজানো আজকের এই আয়োজন।

জোয়েল কাপলান এবং কার্লোস কাস্ত্রো

১৮ আগস্ট, ১৯৭১; মেক্সিকোর সান্তা মার্টা আকাতিতলা কারাগার। সবে সূর্য অস্তমিত হয়ে সন্ধ্যে নেমে এসেছে। কারাগারের বিস্তীর্ণ প্রাঙ্গণ প্রায় ফাঁকা। সারাদিনের নানা পরিশ্রমের পর প্রহরীদের সতর্ক দৃষ্টির মধ্যে কয়েদিরা যে যার নিজের সেলে ফিরে চলেছে।

এরই মাঝে একধারে দাঁড়িয়ে কিসের জন্য যেন অপেক্ষা করছে দুই কয়েদী জোয়েল কাপলান এবং কার্লোস কাস্ত্রো। চোখেমুখে তীব্র উত্তেজনা। কারো জন্য যেন অপেক্ষায় প্রহর গুনছে এই দুজন। বারবার এ ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছে। পাশে দাঁড়ানো কাপলানকে ফিসফিস করে কী যেন বলতে লাগল কাস্ত্রো।

জোয়েল কাপলান এবং কার্লোস কাস্ত্রো; Source: mirror.co.uk

কিছুক্ষণ পরেই আকাশ ফুঁড়ে উদয় হলো এক নীল হেলিকপ্টার। প্রচন্ড গর্জন করতে-করতে চোখের নিমিষে এসে নামল জেলখানার সামনে। ঠিক এই মুহূর্তটারই অপেক্ষায় থাকা জোয়েল ও কার্লোস ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে গেল হেলিকপ্টার খোলা দরজার দিকে। দুজনেরই হাতে ধরা খবরের কাগজ। সাত-আট সেকেন্ডের মধ্যে সকলের চোখের সামনে ওদের তুলে নিয়ে আকাশে উঠে গেল হেলিকপ্টার। হতভম্ব প্রহরীরা যখন বুঝতে পারল, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। দুর্ভেদ্য জেলের গন্ডি পেরিয়ে দুই বন্দি তখন ধরাছোঁয়ার বাইরে।

মেক্সিকোর সান্তা মার্টা আকাতিতলা কারাগার; Source:  alamy.com

জেল থেকে পালানোর এই দুঃসাহসিক পরিকল্পনা কিন্তু অনেক বুদ্ধি খাটিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। তখন মেক্সিকোর সরকারি হেলিকপ্টারগুলোতে নীল রং ব্যবহার করা হতো। আর তাই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে প্রহরীদের সন্দেহ এড়ানোর জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল নীল রঙের হেলিকপ্টার।

কারাগারে বন্দি অবস্থায় জোয়েল কাপলান; Source: pvangels.com

পাইলট যাতে সহজে বন্দি দুজনকে চিনতে পারে সেজন্য দুজনের হাতে ছিল পাকানো খবরের কাগজ। প্রহরীদের বোকা বানানোর জন্য এই সময় ছিল মাত্র ১০ সেকেন্ড। ওই ১০ সেকেন্ডের মধ্যে কার্লোস ও কাপলান হেলিকপ্টারটিতে উঠতে না পারলে তাদের ছাড়াই ফিরে যেত হেলিকপ্টার।

মূলত গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগেই বন্দি করা রাখা হয়েছিল কাপলানকে। কিন্তু তিনি সবসময় নিজেকে নির্দোষ বলে দাবী করতেন। জেলে থাকার সময় আরো তিনবার তিনি চেষ্টা করেছিলেন জেল থেকে পালাবার জন্য। কিন্তু সেসময় ব্যর্থ হয়েছিলেন কাপলান। সঙ্গী কার্লোসকে নিয়ে চতুর্থবারের চেষ্টায় এলো মুক্তি। এই রোমাঞ্চকর অন্তর্ধান ‘দ্য টেন সেকেন্ড ব্রেক আউট’ নামে পরে খ্যাত হয়েছিল।

প্যাপিলন অঁরি শারিয়ের

১৯৩১ সালের ঘটনা। হত্যার দায়ে সাজা হয় ২৫ বছরের এক যুবক অঁরি শারিয়ের। তিনি নাকি নৃশংসভাবে একজনকে হত্যা করেছেন। ফরাসি নাগরিক অঁরি শারিয়ের অবশ্য বরাবর এই অভিযোগ অস্বীকার করে গেছেন। খুনের অপরাধে অঁরি শারিয়ের দ্বীপান্তরের সাজা হয়। তাকে পাঠানো হয় শয়তানের দ্বীপ তথা ডেভিলস আইল্যান্ডে। ফরাসি গায়ানার উপকূল থেকে সামান্য দূরে, আটলান্টিক মহাসাগরের বুকে ছোট্ট এক দ্বীপ এই ডেভিলস আইল্যান্ড।

ডেভিলস আইল্যান্ড; Source: wikimedia commons

ভয়ঙ্কর সব অপরাধীদেরকে শাস্তি হিসেবে এখানে দ্বীপান্তরে পাঠানো হতো। আটলান্টিকের এই নিঃসঙ্গ দ্বীপান্তরে শারিয়েরের বুকে তখন তীব্র ক্ষোভের আগুন। বিনা অপরাধে সাজা পাওয়ায় ক্ষোভ। যেকোনোভাবে, যেকোনো উপায়ে এই দ্বীপান্তর থেকে তাকে মুক্তি পেতেই হবে। আর তাই ‘শয়তানের দ্বীপ’ ছেড়ে বারবার পালানোর চেষ্টা করেছেন অঁরি শারিয়ের। সব মিলিয়ে নয়বার।

ডেভিলস আইল্যান্ডে কয়েদীদের রাখার জন্য স্থাপিত কারাগারের প্রবেশ পথ; Source: atlasobscura.com

নয়বার পালনোর চেষ্টা করেও বারবার ধরা পড়েছের শারিয়ের। পালিয়ে যাওয়ার এই তীব্র আকাঙ্খার জন্য দ্বীপান্তরের অন্য বন্দিরা তার নাম দিয়েছিলেন ‘প্যাপিলন’, অর্থাৎ প্রজাপতি।

শিল্পীর তুলিতে অঁরি শারিয়ের; Source: wikimedia commons

দশমবার নতুন এক পরিকল্পনা সাজালেন। তৈরি করলেন গোটা নারকেল ভর্তি এক বস্তার ভেলা। সময় ও সুযোগ বুঝে সেই ভেলা নিয়ে পাড়ি দিতে উদ্যোত হলেন আটলান্টিক মাহাসাগর। সাগরের তীব্র ঢেউয়ে কোনোমতে নিজের প্রাণ রক্ষা করে ভেলা নিয়ে এগোতে লাগলেন শারিয়ের। ভাসতে ভাসতে শেষ অবধি তিনি পৌঁছলেন এল ডোরাডো শহরে। এখন তিনি স্বাধীন। পরবর্তীতে ভেনেজুয়েলার নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছিলেন একদা বন্দি ফরাসি অঁরি শারিয়ের।

অঁরি শারিয়ের অন্তর্ধানের অভিজ্ঞতা নিয়ে রচিত বই ‘প্যাপিলন’; Source: stuckonrecord.blogspot.com

শয়তানের দ্বীপ ছাড়িয়ে দুঃসাহসিক এই অন্তর্ধানের অভিজ্ঞতা নিয়েই পরবর্তীকালে একটি বই লিখেছিলেন অঁরি শারিয়ের। বইয়ের প্রতিটি পাতায় তার পলায়নের সেই রোমাঞ্চকর মুহূর্তগুলো ফুটে উঠেছে জ্বলজ্বল করে। পরে বইটি বেস্টসেলার বইয়ের খেতাব পায়। বইয়ের নাম শারিয়ের নিজেই রেখেছিলেন। দ্বীপান্তরের সেই দিনগুলোর কথা মনে রেখে সেই বইয়ের নাম তিনি দিয়েছিলেন ‘প্যাপিলন’।

জিওভানি কাসনোভা

ইতালির স্বনামধন্য পর্যটক জিওভানি কাসনোভা। তিনি যেমন এডভেঞ্চার প্রিয় ছিলেন, তেমনি সুলেখক, অভিনেতা হিসেবে একসময় বেশ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।

১৭৫৬ সালের দিকের ঘটনা। ৩০ বছর বয়সী কাসনোভা এক বিশেষ মামলায় গ্রেফতার হন। বিচারে তার পাঁচ বছর জেল হয়। তখন বন্দি কাসনোভাকে ভেনিসের ডুকাল প্রাসাদের একটি সেলে বন্দি রাখা হয়। বন্দি অবস্থায় দিন কাটাচ্ছিলেন কাসানোভা। একাকী বন্দিদশা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। তাই ফন্দি আঁটতে থাকলেন পালাবার।

সেই মোতাবেক সংগ্রহ করলেন একটি ধারালো লোহার টুকরো। তা দিয়ে সেলের মেঝেতে ‍ফুটো করে পালাবার পথ অনেকটা তৈরি করে ফেলার পরই ঘটলো বিপর্যয়। এমন ভাগ্য যে, ঠিক সেই সময়েই অন্য সেলে স্থানান্তরিত করা হলো কাসানোভাকে। সব পরিশ্রম বিফলে যেতে বসলো।

শিল্পীর আঁকা জিওভানি কাসনোভা; Source: Famous Biographies

দমে না গিয়ে পাশের সেলে বন্দি বালবি নামের এক যাজকের সাথে বন্ধুত্ব পাতালেন তিনি। জেলারের মাধ্যমে তারা যেসব বই দেওয়া-নেওয়া করতেন, তাতে অদৃশ্য কালিতে লেখা থাকতো গোপন পরিকল্পনা। প্ল্যান অনুযায়ী এক প্লেট খাবারের মধ্য দিয়ে বালবিকে কাসানোভা তার লোহার ফলাটা পাঠালেন।

ফলাটিকে কাজে লাগিয়ে নিজের সেলের দেওয়াল ফুটো করে এক রাত্রে কাসানোভার সেলে ঢুকে পড়লেন বালবি। দুজনের অক্লান্ত চেষ্টায় ওপরের দেয়ালের একটি অংশ ভেঙে ফেলতে সক্ষম হলেন। সেই ভাঙা অংশ দিয়ে দুজনে ছাদে উঠলেন। কোনো রকমে সকলের নজর এড়িয়ে জানালা টপকে প্রাসাদের একটি ঘরে নামলেন তারা। এবারই আসল কাজ।

শিল্পীর তুলিতে জিওভানি কাসনোভার পালানোর মুহূর্ত; Source: oddsalon.com

কাসানোভার সাথে সবসময় থাকতো কিছু ধোপদুরস্ত পোশাক। আর থাকতো অভিজাত টুপি। সেগুলো পরে কাসানোভা ও তার সঙ্গী রক্ষীদের সামনে দিয়ে প্রাসাদের বাইরে বেরিয়ে গেলেন। এতটাই নিখুঁত হলো অভিনয় যে, রক্ষীরা ফিরেও তাকালো না। প্রাসাদের বাইরে এসে মুক্তির আনন্দে কেঁদেই ফেললেন কাসানোভা। তার এই অন্তর্ধান ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে রয়েছে। ১৭৮৮ সালে কাসানোভা তার এই এই অন্তর্ধান নিয়ে এক অসামান্য বই লেখেন যা তাকে লেখক হিসেবে রাতারাতি পরিচয় এনে দেয়।

উইনস্টন চার্চিল

প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের পালানোর কাহিনী হলিউডের যেকোনো থ্রিলারের সাথে পাল্লা দেয়ার ক্ষমতা রাখে। যুবক চার্চিল তখনও ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী হননি। সাংবাদিক হিসেবে সেসময় বেশ সুনাম অর্জন করেছিলেন। যুদ্ধ সংক্রান্ত তার ক্ষুরধার প্রতিবেদন সেসময় বেশ সাড়া ফেলেছিল।

বোর যুদ্ধের সময় যুদ্ধকালীন সাংবাদিক হিসেবে কাজ করা চার্চিল; Source:Getty Images

১৮৯৯-১৯০২ সালের বোর যুদ্ধের সময় ‘মর্নিং পোস্ট’ পত্রিকার একজন সাংবাদিক হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকা গিয়েছিলেন চার্চিল। সেখানে তাকে প্রায় বিনা কারণে গ্রেফতার করে বন্দি হিসেবে রাখা হয়েছিল।

চার্চিলকে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রোটিয়া শহরের এক স্কুলে অন্য ব্রিটিশ অফিসারদের সাথে বন্দি করে রাখা হয়। জেলে থাকাকালীন সময়ে জেল থেকে পালানোর নানা পরিকল্পনা করতে থাকেন চার্চিল। সাথে নেন জেলের দুই বন্দিকে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, সঙ্গী দুজন প্রহরীদের নজর এড়াতে ব্যর্থ হল।

বন্দি অবস্থায় চার্চিল (সর্ব ডানে); Source: history.com

প্রহরী সবাইকে ফাঁকি দিয়ে চার্চিল একাই জেলের পাঁচিলের কাছে পৌঁছলেন। কিছুক্ষণ চারদিক লক্ষ্য করে দেখলেন, কেউ তাকে অনুসন্ধান করছে কিনা? যখন দেখলেন, কেউ তার খোঁজ করছে না, বুঝলেন এটাই সুবর্ণ সুযোগ। তখন দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলেন পালানোর।

ক্যাম্পের চারদিক ১০ ফুট চওড়া দেওয়াল দিয়ে ঘেরা ছিল। চারদিক লক্ষ্য করতে করতে চার্চিল হাতের কাছে পেয়ে গেলেন একটি টুল। সেটার ওপর দাঁড়িয়ে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে লাফ দিলেন। পড়তে পড়তে কোনো ক্রমে ধরে ফেললেন পাঁচিলের মাথা। তারপর? কয়েক সেকেন্ডর মধ্যেই চার্চিল পৌঁছে গেলেন বোর প্রিজনের বাইরে।

এখানেই শেষ নয়। সেই স্থানটি সম্পর্কে চার্চিলের কোনো ধারণাই ছিল না। সাথে থাকা ম্যাপ ও কম্পাসও তিনি ফেলে এসেছিলেন জেলে। রাতের অন্ধকারে আকাশের তারাই ছিল পথ চেনার একমাত্র অবলম্বন। প্রায় দুই ঘন্টা হাঁটার পর দেখতে পেলেন রেল স্টেশনের আলো। অন্ধকারে লুকিয়ে থেকে ট্রেনের অপেক্ষা করতে লাগলেন চার্চিল।

যথাসময়ে ট্রেন এলো। কিন্তু স্টেশনের চারপাশে সেন্যদের এড়িয়ে ট্রেনে ওঠা এক কথায় প্রায় অসম্ভব। এই সময় ট্রেনে উঠতে গেলে ধরা পড়া প্রায় নিশ্চিত। তাই অপেক্ষা করতে লাগলেন, কখন ট্রেন চলা শুরু করবে? ট্রেন যখন সবে গতি বাড়াতে শুরু করেছে, লাইনের ধার দিয়ে ছুটতে শুরু করলেন চার্চিল।

পালানোর শেষ সুযোগ হিসেবে প্রচন্ড ঝুঁকি নিয়ে চলন্ত ট্রেনে উঠে পড়লেন চার্চিল (শিল্পীর কল্পনায়); Source: historyanswers.co.uk

প্রাণপণে দৌড়ে প্রচন্ড ঝুঁকি নিয়ে একসময় উঠেও পড়লেন কয়লা ভর্তি একটি কামরায়। উপস্থিত বুদ্ধি আর ইচ্ছেশক্তিই মুক্তি এনে দিল অসমসাহসী চার্চিলকে। শুধু সাহস আর বুদ্ধির জোরে বোর জেল থেকে পালিয়ে এসেছিলেন চার্চিল।

ফিচার ইমেজ: CNN.com

Related Articles