রামায়ণের কুম্ভকর্ণের গল্প তো অনেকেই জানেন। যারা জানেন না তাদের জন্য গল্পটি্র একটু সার সংক্ষেপ বলছি। লঙ্কেশ্বর রাবণের ছিল তিন ভাই। রাবণ, বিভীষণ এবং কুম্ভকর্ণ— তারা ছিলেন বিশ্রবা মুনির পুত্র। অন্য ভাইদের চেয়ে কুম্ভকর্ণ ছিলেন খুবই ধার্মিক‚ বুদ্ধিমান এবং সাহসী। তাকে ঈর্ষা করতেন স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্র। সম্পদের দেবতা কুবের ছিলেন এই তিন ভাইয়ের বৈমাত্রেয় ভাই। বিশ্রবা সবসময় চেয়েছিলেন রাবণ-সহ তার বাকি দুই পুত্রও কুবেরের তুল্য যোগ্য এবং মর্যাদা পূর্ণ আসন লাভ করেন। সেজন্য তিন ভাই কঠোরভাবে শুরু করেন ব্রহ্মার তপস্যা।
ব্রহ্মা এই তিন ভাইয়ের তপস্যায় সন্তুষ্ট হন। তাদের বর দিতে চান। রাবণ প্রার্থনা করেন, তাকে যেন দেব-নাগ-যক্ষ-রক্ষ-কিন্নর-পক্ষী— কেউ হত্যা করতে না পারে। বিভীষণ চান সারাজীবন সত্যের পথে থাকতে। ব্রহ্মা এদের দুজনেরই প্রার্থনা পূর্ণ করেন।
কুম্ভকর্ণের পালা যখন আসে তখন দেবতারা প্রমাদ গুনেন। ইতিমধ্যেই কুম্ভকর্ণ তার ভীষণকায় চেহারা এবং পরাক্রম শক্তি দিয়ে ত্রিভুবনে বিস্তর ত্রাস সৃষ্টি করেছিলেন। যদি তিনি অপরাজেয় হওয়া বা ওই জাতীয় বর প্রার্থনা করেন তাহলে বিপদ হতে পারে। তারা ব্রহ্মার পত্নী দেবী সরস্বতীর কাছে আর্জি জানান, বর দান কালে কুম্ভকর্ণের জিহ্বায় অধিষ্ঠান করতে এবং উচ্চারণে গোলমাল ঘটিয়ে তার প্রার্থিত বরকে নস্যাৎ করে দিতে।
কুম্ভকর্ণ দেবরাজ ইন্দ্রের সমতুল্য হওয়ার বর প্রার্থনার জন্য মনে মনে ঠিক করে নেন। ব্রহ্মার কাছে বর প্রার্থনার সময় জড়িয়ে গেল কুম্ভকর্ণের জিভ। তিনি চেয়েছিলেন ‘ইন্দ্রাসন’ কামনা করবেন। কিন্তু সেটা উচ্চারণ করতে পারলেন না। আড়ষ্টভাবে তিনি চেয়ে বসলেন ‘নিদ্রাসন’। জিভ বাঁধা থাকায় ইন্দ্রাসন হয়ে গেল নিদ্রাসন। ব্যস যা হওয়ার তাই হলো। ইন্দ্রের উদ্দেশ্য পূরণ।
সেই বর (বা অভিশাপ)-এর দৌলতে কুম্ভকর্ণ ছ’ মাস ঘুমোতেন। বাকি ছ’ মাস জেগে থাকতেন। যখন ঘুম ভাঙত‚ পাগলের মতো খিদে পেত কুম্ভকর্ণের। হাতের কাছে যা পেতেন ধরে কপাকপ মুখে চালান করতেন। এর মধ্যে মানুষও নিস্তার পেত না।
এই ঘটনায় হতচকিত হয়ে পড়েন রাবণ। তিনি উপলব্ধি করেন, কুম্ভকর্ণের মতো পরাক্রমশালী ভাই বরাবর ঘুমিয়ে থাকলে তার ত্রিভুবন জয়ের আশা দিনে দিনে ক্ষীণ হয়ে পড়বে। তিনি ব্রহ্মার কাছে প্রার্থনা করেন, তিনি যেন বর ফিরিয়ে নেন।
ব্রহ্মা জানান, তা আর সম্ভব নয়। তবে ব্রক্ষা এক নিদান দেন। বলেন, ৬ মাস টানা ঘুমানোর পরে একদিন কুম্ভকর্ণ জাগবেন। সেদিন তিনি আহারাদি গ্রহণ করবেন। এবং পরের দিন আবার ঘুমিয়ে পড়বেন। ব্রহ্মার বর সঙ্গে সঙ্গে ফলে যায়। মহাবলী কুম্ভকর্ণ সেই মুহূর্তেই নিদ্রাভিভূত হয়ে পড়েন। প্রথম দফায় একটানা ছয়মাস ঘুমানোর পরে পরে কুম্ভকর্ণ জেগে ওঠেন ঠিকই, কিন্তু পুরোপুরি জাগ্রত অবস্থায় তিনি কখনও পৌঁছয়নি।
ঠিক এমনই সত্যকার মহিলা কুম্ভকর্ণের দেখা মেলেছে ইংল্যান্ডের স্টকপোর্ট শহরে। কোন অভিজাত বংশে জন্ম হয়নি মেয়েটির। বাবা-মার অতি আদরের এই মেয়ে। মা বাবা সাধ করে মেয়ের নাম রাখে বেথ গুডিয়ার। সুন্দরী হিসেবে পাড়ায় তার বেশ সুনামই ছিল। তারা স্বপ্ন দেখতেন তাদের আদরের মেয়ে পড়াশোনা করে সমাজের উচ্চ শিখরে আরোহন করবে। কিন্তু মা বাবার সে আশা পূরণ হয়নি।
ছাত্রী হিসেবেও বেথ গুডিয়ার ছিল উজ্জ্বল। স্কুলের পরীক্ষাগুলোতে সে তার স্বাক্ষরও রেখেছে। শিশু মনস্তত্ত্ব নিয়ে পড়ার স্বপ্ন ছিল তার। এতদিনে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে যাওয়ার কথা। হয়তো বা এতদিনে শিশু মনস্তত্ত্বের জগতে নিজের জায়গাও করে নিতে পারতো। কিন্তু সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেল ২০১১ সালের নভেম্বর মাসে। বেথের ১৭তম জন্মদিনে। ঐদিন বেথকে অন্য সব দিনের চেয়ে আরো আকর্ষণীয় লাগছিল। এই বার্থডে গার্লকে নিয়ে সবাই যেন ছিল প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কিন্তু বিধাতার কি নির্মম পরিহাস! এই দিনের সুন্দর কিছু মুহূর্ত নিয়ে সেই দিনে সে যেই ঘুমোতে গেল মেয়েটি, তারপর থেকে তার ঘুম ভাঙ্গারই নাম নেই। দুঃখের পর সুখ আসে, কিন্তু দুঃখ যেন চিরস্থায়ী রূপ নিল। তারপর পাঁচ বছরেও পুরোপুরি ভাঙেনি সেই ঘুম।
কিন্তু কেন বেল এভাবে ঘুমিয়ে থাকলো তা অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায়, বেথ এক বিরলতম রোগে আক্রান্ত, যে রোগের নাম ক্লেন লেভিন সিনড্রোম (কেএলএস), ওরফে স্লিপিং বিউটি সিনড্রোম। এটি একটি বিরল ও জটিল স্নায়ু ব্যাধি। সাধারণত বয়ঃসন্ধিকালের ছেলে মেয়েরা এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তবে ছোট শিশুরাও এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। এই রোগে আক্রান্ত মানুষের সর্বক্ষণই ঘুম পায়। ঘুমের প্রকোপ এতটাই বেশি থাকে যে, দিনের অধিকাংশ সময়টায় ঘুমিয়েও থাকতে চায়। কিছুতেই কাটতে চায় না ঘুমের রেশ। অনেক সময়ে একটানা বেশ কয়েকদিন কিংবা কয়েক সপ্তাহও কেটে যায় ঘুমিয়ে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, সাধারণত ১৬ বছর বয়সেই এই রোগ বাসা বাঁধে মানুষের শরীরে। বেথের বয়স যখন ১৭, তখন তার শরীরে ধরা পড়ে কেএলএস-এর আক্রমণের লক্ষণ।
বেথের মা জেনাইন বলেন, গত পাঁচ বছরে তাঁর মেয়ে শতকরা ৭৫ ভাগ সময়ই ঘুমিয়ে কাটিয়েছে। এখন শুধু নামমাত্র খাওয়া, সামান্য পরিমাণ পানি পান করা এবং টয়লেটে যাওয়ার জন্য সে ওঠে। বাকি সময়টা সে ঘুমিয়েই কাটায়। যে সময়টা সে জেগে থাকে সেই সময়টাও তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় কাটে বেথের। বাচ্চাদের মতো করে কথা বলে, মুখ দিয়ে লালা গড়ায়, আর তেল-মশলা যুক্ত জাঙ্ক ফুড খাওয়ার জন্য বায়না করে। গত পাঁচ বছরে কেবল কয়েকবার ডাক্তারের কাছে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়েছে বেথ। সেই সময়েও হুইল চেয়ারে করে তাকে নিয়ে যেতে হয়েছে।
বেথের ডাক্তার স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ গাই লেসসাইজার বলেন, ‘ক্লেন লেভিন সিনড্রোম – রোগটি বিরলতম হলেও সাধারণত ১৩ বছরের বেশি স্থায়ী হতে দেখা যায় না। বেথের পাঁচ বছর কেটে গিয়েছে। যদিও তার মধ্যে উন্নতির কোনো লক্ষণ এখনো দেখা যাচ্ছে না। হয়তো আরও বেশ কিছু সময় অপেক্ষা করতে হতে পারে বেথের সুস্থ হয়ে ওঠার জন্য’।
বেথের পরিবার এখন আশার আলোয় বেঁচে আছেন কবে তাদের আদরের মেয়ে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে। কবে সে অন্য সব সাধারণ মেয়েদের মতো হৈ চৈ করে বেড়াবে। তাদের অপেক্ষার পালা কবে শেষ হবে আমাদের জানা নেই।
তবে একটি আশার কথা আপনাদের শুনিয়ে যাই। বেথ এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার তিন বছর আগে তার ছিল এক ভালবাসার মানুষ। নাম তার ড্যান। ২৫ বছর বয়সি এই প্রাথমিক স্কুল শিক্ষকের সঙ্গে হঠাৎই আলাপ হয় বেথের। সেসময় এ্ক মধুর বিকেলে বেথের হাত ধরে ড্যান বলেছিলেন, তার হাত কখনো ছাড়বেন না।
ড্যান এখনো বেথকে পাগলের মতো ভালোবাসে। পরিবারের নিষেধ সত্ত্বেও ড্যান কিছুতেই বেথকে ছাড়তে পারবে না বলে সবাইকে জানিয়ে দিয়েছে। বেথের জীবনে এখন আশার আলো জ্বালিয়ে রেখেছেন তার ভালবাসার মানুষ ড্যান। হয়তো একদিন ড্যানের ভালোবাসার শক্তিতে বেথ সুস্থ হয়ে ফিরে আসবে ড্যানের বুকে। আমাদের সবার ভালোবাসা, চাওয়া বেথ যেন সুস্থ হয়ে ওঠে।