সেভেন সামুরাই, সামুরাই এক্স কিংবা দ্য ল্যাস্ট সামুরাই- হলিউডপাড়ায় সাড়াজাগানো এসব চিত্তাকর্ষক মুভি-সিরিজ একসময় ব্যাপকভাবে আন্দোলিত করেছিল রোমাঞ্চপ্রিয় মুভিপ্রেমীদের হৃদয়। তাদের মননে-মগজে বারংবার জাগিয়ে তুলেছিল কেবল একটিই প্রশ্ন- কখন আসবে পুনরায় এরকম নতুন আরেকটি মুভি?
এমন ভাবনার মূল কারণ, সামুরাইদের প্রতি অপার ভালোবাসা ও তাদের জীবনাচার সম্পর্কে জানার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। কেননা, মুভি-সিরিজের রূপালী পর্দায় দর্শকদের মন জয় করে নেওয়া এসব সামুরাই এককালে ছিল একেকজন অপ্রতিরোধ্য যোদ্ধা। নিজেদের বীরত্বপূর্ণ কাজের মাধ্যমে তারা জায়গা করে নিয়েছিল ইতিহাসের স্বর্ণখচিত পাতায়। চলুন, আজ সেসব পাতা ঘেঁটে জেনে আসা যাক তেমনই বিখ্যাত দশ সামুরাইয়ের অজানা ইতিহাস।
১. টোমোয়ে গোজেন
প্রাচীন জাপানে সামুরাই শাসনকাল শুরু হয়েছে মাত্র। এসময় গোত্র সংঘাত, মোঙ্গল আক্রমণ ও অতর্কিত হামলা শক্ত হাতে মোকাবেলায় গৃহে অবস্থানরত নারীদেরও দেওয়া হয় সামরিক প্রশিক্ষণ। তীর, ধনুক ও বর্শা চালনায় তাদের করে তোলা হয় পারদর্শী। এই নারীদেরই একজন ছিলেন টোমোয়ে গোজেন। তবে তিনি নিজেকে কেবল গৃহরক্ষার কাজেই সীমাবদ্ধ রাখেননি, বরং রণক্ষেত্রে বীরের মতো করেছেন যুদ্ধও। ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নিয়েছেন নারী সামুরাই কিংবদন্তি হিসেবে।
১১৮০-৮৫ সালে সংগঠিত গেনপেই যুদ্ধে গোজেন সামুরাই নেতা মিনামোটোর পক্ষে লড়াই করেন। ১০০০ অশ্বারোহীর এক সুবিশাল সামুরাই সৈন্যদলকে নেতৃত্ব দেন সামনে থেকে। বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত লড়ে যান সমানতালে। ডাকটিকিটের মতো সংগ্রহ করেন শত্রুপক্ষের বিচ্ছিন্ন মাথা। কথিত আছে, গোজেন শুধু যুদ্ধে পারদর্শীই ছিলেন না, পাশাপাশি তিনি ছিলেন এক রূপবতী নারী। তার ঘন-কালো চুল ও মোহনীয় রূপ আকৃষ্ট করতো অনেককে।
২. কুসুনুকি মাসাশিগে
তিনি ছিলেন একজন সমর কৌশলবিদ, সম্রাটের এক বিশ্বস্ত সৈনিক। সম্রাটের বিপক্ষে গিয়ে কামাকুরা শগুনাত যখন একের পর এক দখল করে নিচ্ছিল সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল, ঠিক তখন তিনি লড়াকু সেনার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। ১৩৩২ সালে কামাকুরা শগুনাত হামলে পড়ে ওসাকার দক্ষিণে অবস্থিত চিহায়া দুর্গ দখলে। তখন মাত্র ২০০০ সৈন্যকে সঙ্গী করে শগুনাতের প্রায় ১ লক্ষ সৈনিকের বিপক্ষে লড়াই করেছেন তিনি। ছিনিয়ে নেওয়ার হাত থেকে রক্ষা করেছেন দুর্গ।
তবে, ভয়ংকর এক যুদ্ধে নিজস্ব এক গুপ্তচর গোষ্ঠীর বিশ্বাসঘাতকতায় চড়া মূল্য দিতে হয় তাকে। হেরে যান সম্রাটের পক্ষে লড়তে গিয়ে। অতঃপর, সামুরাই ঐতিহ্য অনুযায়ী, আত্মসমর্পণ না করে নিজের তলোয়ার দিয়ে পেট কেটে আত্মাহুতি দেন এই সৈনিক। সম্রাটের প্রতি তার এমন অগাধ বিশ্বাস, ভালোবাসা ও আনুগত্যের সম্মান সরূপ পরবর্তীতে তিনি সম্রাটের সাহস এবং ভক্তির প্রতীকে পরিণত হন। তার সম্মানার্থে টোকিওর ইম্পেরিয়াল প্রাসাদের বাইরে নির্মাণ করা হয় তার একটি ভাস্কর্য।
৩. সানাদা ইউকিমুরা
তুকোগাওয়া শগুনাতের বিপক্ষে লড়াই করা এ যোদ্ধা সেসময় অর্জন করেন জাপানের সর্বশ্রেষ্ঠ সামুরাইয়ের খ্যাতি। সম্মানের সূচকে ভূষিত হন বারংবার। তুকোগাওয়া শগুনাতের বিরুদ্ধে উয়েদা দুর্গের সুরক্ষায় তিনি নিয়োজিত ছিলেন। যুদ্ধ করে সুবিশাল শগুনাত বাহিনীকে রুখে দেন তার দূরদর্শী নেতৃত্বে।
১৬১৪ সালে ওসাকার অবরোধেও তিনি তার বাহিনীকে চূড়ান্ত নেতৃত্ব দেন। সেসময় শীতকালীন ঝড়ের কবলে পড়ে শগুনাত বাহিনী। ফিরে যায় গ্রীষ্মকালের অপেক্ষায়। ফিরে এসে সেবার পূর্ণ শক্তিতে আক্রমণ করেন তারা। সুবিশাল শগুনাত বাহিনীর কাছে পরাজয় বরণ করেন তিনি। অতঃপর নিজের ইচ্ছায় মৃত্যুবরণ করেন।
৪. ইয়াসুকে
১৫৭৯ সাল; জেসুইট ধর্মপ্রচারক আলেসান্দ্রো ভ্যালিগনানো ইয়াসুকেকে দাস হিসেবে নিয়ে আসেন জাপানে। আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গ এ মানুষটির কুচকুচে কালো শরীর দেখে উল্লাসে ফেটে পড়েন সবাই। কেউ কেউ কেটেও দেখে সে রং মেখেছে নাকি সত্যিই এমন! এমন আচরণের কারণ, এর আগে জাপানিরা কখনো কালো মানুষ দেখেনি।
বাইরে এমন শোরগোল শুনে চমকে ওঠেন তৎকালীন সামুরাই শাসক ওডা নোবুনাগা। তিনি তখন সম্পাদন করছিলেন গুরুত্বপূর্ণ এক বিচারকার্য। একপর্যায়ে ইয়াসুকের দৈহিক গড়ন ও উচ্চতার জন্য নিজের একান্ত সঙ্গী ও ব্যক্তিগত রক্ষক বানিয়েছিলেন। কিছুদিন পর তাকে সামুরাই পদেও ভূষিত করা হয়, প্রদান করা হয় অমূল্য উপহার। ভয়ংকর এক যুদ্ধে ওডা নোবুনাগার পরাজয় হয়, মৃত্যুবরণ করেন তিনি। বিপক্ষদল ইয়াসুকেকে বন্দী করেন। জেসুইট ধর্ম প্রচারকদের সম্মানে তাকে ফেরত পাঠান তাদের কাছে।
৫. উয়েসুগি কেনশিন
মার্শাল আর্টে পারদর্শী এ যোদ্ধা ছিলেন এক শক্তিশালী সামুরাইয়ের চতুর্থ সন্তান। সামরিক দক্ষতায় সকলকে ছাড়িয়ে যাওয়া উয়েসুগি কেনশিন তাকেদা শিনগেনের সঙ্গে লিপ্ত হন যুদ্ধে। ইচিগো অঞ্চলকে সুরক্ষা প্রদানে তিনি উত্তর শিনানোতে অবস্থান করেন। সেখান থেকেই পরিচালনা করেন যুদ্ধ।
১৫৫৩-৬৪ সালে সামুরাইদের একাধিক গোষ্ঠী যখন গোত্র সংঘাতে লিপ্ত, তখন কেনশিন শিনগেনকে প্রায় পরাজিত করে ফেলেছিল। কিন্তু বিপত্তি বাধে শিনগেনের বাহিনী দ্রুতই পৌঁছে যায় সেখানে। প্রতিরোধ গড়ে তোলে কেনশিনের বিরুদ্ধে। কান্টো অঞ্চলের হোজো গোষ্ঠী একসময় শিনগেনকে লবণ প্রদানে অসম্মতি জানায়। তবে, সেসময় কেনশিন ইচিগো থেকে শিনগেনের জন্য লবণ পাঠায়৷ ১৫৭৩ সালের অপরপক্ষের সঙ্গে যুদ্ধে শিনগেনের মৃত্যু হলে কান্নায় ভেঙে পড়েন কেনশিন, যা সামুরাইদের ভেতরকার মমত্ববোধকে নির্দেশ করে।
৫. মিয়ামোতো মুসাশি
জাপানের হায়োগো প্রদেশের দক্ষিণাংশের হারিমা অঞ্চলে জন্ম এই সামুরাই যোদ্ধার। প্রথাগতভাবে তিনি কখনোই ভূস্বামীদের সেবক ছিলেন না। কারণ, তার জন্ম হয়েছিল যখন জাপান এগিয়ে যাচ্ছিল সমৃদ্ধির পানে। তবে, সামুরাই পরিবারে জন্মগ্রহণ করার সুবাধে মুসাশির জন্য প্রয়োজন ছিল যুদ্ধকৌশল রপ্ত করা। তাই তিনি বিভিন্ন দ্বৈত লড়াইয়ে অংশ নেন।
৬০টিরও অধিক দ্বৈত লড়াইয়ে বিজয় অর্জনের পর তিনি সামুরাই শিশুদের জন্য যুদ্ধকৌশল আয়ত্ত্বে প্রতিষ্ঠা করেন বেশ কিছু স্কুল। যেখানে শিশুদের শেখানে হতো তরবারি চালনা, তীরন্দাজী, বর্শা নিক্ষেপ ও ঘোড়সওয়ারী। শেষ বয়সে তিনি পশ্চিমের কুমামোটোর রেইগান্ডো নামক এক গুহায় আশ্রয় নেয়। সেখানে বসে তিনি রচনা করেন চমৎকার এক বই- ‘দ্য বুক অব ফাইভ রিংস’। কিছুদিন পর সেখানেই মারা যান তিনি। তবে, অসংখ্য-অগণিত মুভি-সিরিজে আজও অমর হয়ে আছেন মুসাশি।
৭. তাকেদা শিনগেন
তাকেদা গোত্র ছিল মিনামোটো গোষ্ঠীরই একটি বিচ্ছিন্ন অংশ। এর প্রধান ছিলেন তাকেদা শিনগেন। ১৫৪০ সালে শিনগেন নিজের পিতাকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে আসীন হন গোষ্ঠী প্রধানের ভূমিকায়। অতঃপর একদিন শিনগেন শিনানো প্রদেশ জয়ের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়েন। দুর্গের পর দুর্গ জয় করতে থাকেন অবলীলায়।
একপর্যায়ে কেনশিনের বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ বাধে শিনগেনের। দুজনই অপরাজিত অবস্থায় মনোনিবেশ করেন অন্য অঞ্চলের পানে। ওডা নুবোনাগার মোকাবেলায় একমাত্র শিনগেনকেই ক্ষমতাধর হিসেবে বিবেচনা করা হতো। ১৫৭৩ সালে শিনগেন এক ভয়ানক ক্ষতর কারণে মৃত্যুবরণ করেন। দুঃসাহসী এ সামুরাই যোদ্ধার সম্মানে প্রতি বছর ১২ এপ্রিল কোফু সিটি ইয়ামানাশিতে পালিত হয় শিনগেন-কো উৎসব।
৮. ডেইট মাসামুনে
অদম্য এ বীর ইয়ামাগাতা প্রদেশে জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র ১৪ বছর বয়সে তিনি প্রথম সামরিক অভিযানে যোগ দেন এবং ১৭ বছর বয়সে বাবার সঙ্গে প্রথম বিজয় অর্জন করেন। অতঃপর বেশ কিছু যুদ্ধে তিনি অনেকগুলো গোত্র প্রধানের সঙ্গে একত্রে লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করেন। অর্জন করেন নানাবিধ রণকৌশল।
১৬০৪ সালে মাসামুনে সেন্ডাই শহর প্রতিষ্ঠা করেন। কূটনৈতিক কাজের অংশ হিসেবে প্রথমবার তিনি কোনো জাহাজকে মেক্সিকো উপকূলে প্রেরণ করতে সমর্থ হন। শিশুকালে গুটিবসন্তের কারণে তিনি তার ডান চোখের দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন। তারপর থেকে একচোখা ড্রাগন হিসেবে তিনি পরিচিত পান সর্বত্র।
৯. টয়োটমি হিদেয়োশি
তিনজন সামুরাই যোদ্ধা, যারা বিভিন্ন সময়ে বিভক্ত শাসনতন্ত্রকে একত্রে করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন, তাদেরই একজন টমোটয়ি হিদোয়েশি। তাদের জন্যই আজকের সমৃদ্ধ জাপানের চিত্রপট দেখতে পায় বিশ্ব। ওয়ারি প্রদেশের এক পদাতিক সেনার ঘরে জন্ম হয় তার। ১৫৫৮ সালে তিনিও পদাতিক হিসেবে যোগ দেন ওডার সেনাদলে।
ওডা নোবুনাগার সময়কালে তার বিশ্বস্ত সৈনিকে পরিণত হন তিনি। সেসময় নোবুনাগা ইমাগাওয়াকে পরাজিত করেন। অধিপতি হন ওয়ারি অঞ্চলের। এভাবে বহু যুদ্ধে ওডা নোবুনাগার সঙ্গে অংশ নেন হিদেয়োশি। একসময় মৃত্যুরবরণ করেন নোবুনাগা। তার স্থলাভিষিক্ত হয়ে পুনরায় নব উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধের ময়দানে।
১০. ওডা নোবুনাগা
সময়টা ছিল আশিকাগা শগুনাতের শাসনকাল, ওয়ারি অঞ্চলের এক সামুরাই পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ১৫৫১ সালে বাবার মৃত্যুর পর নোবুনাগা সমগ্র গোষ্ঠীকে একীভূত করেন। নেমে পড়েন যুদ্ধের ময়দানে। একে একে পুনরায় ছিনিয়ে নেন ওয়ারি অঞ্চলের ক্ষমতা।
এভাবে একের পর এক যুদ্ধে গোষ্ঠীকে নেতৃত্ব দেন তিনি। গড়ে তোলেন নিজস্ব রাজ্য। ১৫৮২ সালে হুনুনজি দুর্গে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। অতঃপর, তার হাতে গড়া সামুরাই যোদ্ধা টমোটয়ি হিদোয়েশি তার অসমাপ্ত কাজগুলো সম্পন্নে নেমে পড়েন। সৈন্য-সামন্ত নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন অঞ্চলের সুরক্ষায়।
একসময় সামুরাই শাসনামল শেষ হয়, রচিত হয় নতুন ইতিহাস। তবে, সেসময় আলোচিত এই দশজন যোদ্ধা ছাড়াও ছিলেন আরও অসংখ্য বীর। ছিলেন মিনামোটো ইউশিৎসুন ও তকুগাওয়া ইয়াসুর মতো অপ্রতিরোধ্য সামুরাই শাসক, যারা জীবন বাজি রেখে লড়েছেন, মরেও পেয়েছেন অমরত্বের স্বাদ, জায়গা করে নিয়েছেন রোমাঞ্চকর ইতিহাসের পাতায়। জাপানিরা আজও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন তাদের, তাদের সম্মানে পালন করেন নানাবিধ উৎসব ও আচার-অনুষ্ঠান।