প্রাণিজগতের আলোচনায় ‘গণবিলুপ্তি’ অতি পরিচিত এক শব্দ। কোনো একটি প্রজাতির সর্বশেষ বেঁচে থাকা জীব বা প্রাণীটি মারা গেলে ওই প্রজাতিকে বিলুপ্ত হিসেবে ধরা হয়। আর ব্যাপক পরিসরে ঘটা বিলুপ্তির নাম দেওয়া হয়েছে গণবিলুপ্তি। চিরসুন্দর এই ধরণী তার ৪৫০ কোটি বছরের ইতিহাসে দেখে এসেছে ক্ষুদ্র এককোষী ব্যাকটেরিয়া থেকে জটিল মস্তিষ্কের মানব প্রজাতিকে। অবলোকন করেছে সৃষ্টির প্রাক্কালে গলিত লাভার বিস্ফোরণ থেকে পৃথিবী দাপিয়ে বেড়ানো বৈচিত্র্য প্রাণী সমাহারকে। তবে সৃষ্টির শুরু থেকে এই পর্যন্ত বহু প্রজাতির প্রাণী পৃথিবীর বুক চষে বেড়ালেও, বর্তমানে অনেক প্রজাতিই পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। আর আদিমকালের এই প্রাণী প্রজাতিগুলো বিলুপ্ত হয়ে যাবার পেছনে অন্যতম বড় নিয়ামক হচ্ছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে ঘটা গণবিলুপ্তি। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন দশ বৃহৎ গণবিলুপ্তি নিয়েই আজকের এই আয়োজন।
অক্সিজেনের মহাসংকট
সময়: ২৩০ কোটি বছর পূর্বে
জীব অস্তিত্বের ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা ঘটে যায় আজ থেকে আনুমানিক প্রায় ২৫০ কোটি বছর পূর্বে। তখন ব্যাকটেরিয়া সূর্যরশ্মিকে ব্যবহার করে কার্বন ডাই-অক্সাইডকে ভেঙে শক্তি অবমুক্তির মাধ্যমে সালোকসংশ্লেষণের ক্ষমতা অর্জনে সক্ষম হয়। দুর্ভাগ্যবশত, এই সালোকসংশ্লেষণের মুখ্য একটি উপজাত হলো অক্সিজেন, যা কিছু জীবের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। ৩৫০কোটি বছর পূর্বে পৃথিবীতে আবির্ভূত হওয়া সে প্রাণীগুলো অক্সিজেনের উপস্থিতিতে বেঁচে থাকতে পারত না। বর্তমানেও এমন কিছু ব্যাকটেরিয়া পৃথিবীতে বিদ্যমান, যা অক্সিজেনের উপস্থিতিতে মারা যায়। বিবর্তনের মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়া সালোকসংশ্লেষণের ক্ষমতা অর্জনের ২০ কোটি বছর পর পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে যথেষ্ট পরিমাণে অক্সিজেন জমা হয়। ফলে, অক্সিজেনের উপস্থিতি সহ্য করতে না পারা জীবগুলোর গণবিলুপ্তি ঘটে।
তুষার গোলকের পৃথিবী
সময়: ৭০০ মিলিয়ন বছর পূর্বে
প্রতিষ্ঠিত কিছু হাইপোথিসিস থেকে জানা যায়, আজ থেকে প্রায় ৭০০-৬৫০ মিলিয়ন বছর পূর্বে পৃথিবীর প্রতিটি ইঞ্চি বরফের শুভ্র চাদরে ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। তুষার গোলকে পরিণত হওয়া পৃথিবী থেকে ওই সময় সালোকসংশ্লেষী বহু প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যায়। তখন মেরু অঞ্চলে এত পরিমাণ বরফের চাঁই জমা হয়েছিল যে, সূর্যের আলো তাতে প্রতিফলিত হয়ে আবার মহাশূন্যে ফেরত চলে যেত। এর ফলে পৃথিবীর উষ্ণতা ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে। শীতল আবহাওয়া ও পর্যাপ্ত পরিমাণ সূর্যের আলো না থাকায় তখন সালোকসংশ্লেষণও সম্ভব হচ্ছিল না। ফলশ্রুতিতে, খাদ্যশৃঙ্খল ভেঙে গিয়ে বহু জীবের বিলুপ্তি ঘটে। এছাড়াও বৈশ্বিক হিমবাহ পৃথিবীর কার্বন চক্রের গতিপথ পাল্টে দেওয়ায় সালোকসংশ্লেষণের জন্য পর্যাপ্ত কার্বন ডাই-অক্সাইডের সংকট তৈরি হয়েছিল।
এন্ড-এডিয়াকারান গণবিলুপ্তি
সময়: ৫৪২ মিলিয়ন বছর পূর্বে
এডিয়াকারান যুগের সাথে অনেকেই হয়তো পরিচিত নয়। কারণ, সায়েন্টিফিক কম্যুনিটি থেকে এই যুগ চিহ্নিত করা হয়েছে ২০০৪ সালের দিকে। ভূতাত্ত্বিক সময়রেখা অনুযায়ী, এডিয়াকারান এবং ক্যামব্রিয়ান সময়ের মধ্যবর্তী সীমায়, প্রায় ৫৪২ মিলিয়ন বছর পূর্বে ঘটে যায় এন্ড-এডিয়াকারান গণবিলুপ্তি। এরপরই সূচনা ঘটে ক্যামব্রিয়ান যুগের, যেখানে জীব বৈচিত্র্যের বিকাশ ঘটেছিল অতিদ্রুত। এন্ড-এডিয়াকারান যুগের পর সামুদ্রিক পরিবেশে জটিল বহুকোষী জীবের উদ্ভব ঘটে। এই গণবিলুপ্তির যাঁতাকলে পিষে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় বহু এরিকাডান প্রাণী, যারা পৃথিবীর জটিল, বহুকোষী জীবের পূর্বপুরুষ।
ক্যামব্রিয়ান-অরডোভিসিয়ান গণবিলুপ্তি
সময়: ৪৮৮ মিলিয়ন বছর পূর্বে
আদিম পৃথিবীতে ক্যামব্রিয়ান-অরডোভিসিয়ান গণবিলুপ্তির ধারা কয়েক মিলিয়ন বছর পর্যন্ত বজায় ছিল। এই গণবিলুপ্তির পদরেখা অনুসরণ করেই ক্যামব্রিয়ান যুগের অবসান এবং অরডোভিসিয়ান যুগের সূচনা ঘটে। এই সময়ে, অগণিত প্রজাতির সামুদ্রিক জীবপ্রজাতি, যেমন- ট্রিলোবাইট, ব্রাকিউপড, গ্র্যাপটোলাইট, কনোডন্ট ইত্যাদি প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যায়। সংখ্যার হিসেবে, ৬০% অমেরুদণ্ডী প্রজাতি, এবং ৮৫% সামুদ্রিক প্রজাতি ওই সময় বিলুপ্তির ফাঁদে পড়ে দুনিয়া থেকে হারিয়ে যায়।
বিজ্ঞানীরা এই ক্যামব্রিয়ান-অরডোভিসিয়ান গণবিলুপ্তির কারণ হিসেবে কিছু থিওরি দাঁড় করিয়েছেন। এক থিওরি অনুযায়ী, সেসময় পৃথিবীর তাপমাত্রা হঠাৎ নিচে নেমে যাওয়ায়, বিশাল সব হিমবাহ সমুদ্রের স্তর ও উচ্চতাকে কমিয়ে দিয়েছিল। এতে করে বাস্তুসংস্থানে ব্যাপক পরিবর্তন আসার পাশাপাশি, সমুদ্রে অক্সিজেনের মাত্রাও কমে যায়। ফলশ্রুতিতে আরেক গণবিলুপ্তির সম্মুখীন হয় পৃথিবী। আরেক থিওরিতে বলা হয়েছে, একটি সুপারনোভা বিস্ফোরণের ফলে মহাজাগতিক বিকিরণ মাত্রা অধিকহারে বৃদ্ধি পাওয়ায় সামুদ্রিক জীবের ব্যাপক বিলুপ্তি ঘটে।
অরডোভিসিয়ান গণবিলুপ্তি
সময়: ৪৪৭-৪৪৩ মিলিয়ন বছর পূর্বে
প্যালিয়োজয়িক যুগে ঘটা অরডোভিসিয়ান গণবিলুপ্তি মূলত দুটি পৃথক বিলুপ্তির সমন্বয়ে গঠিত। একটি ঘটেছিল ৪৪৭ মিলিয়ন বছর পূর্বে, এবং অন্যটি ৪৪৩ মিলিয়ন বছর পূর্বে। তখন বিশ্বের সামুদ্রিক অমেরুদণ্ডী প্রাণীর সংখ্যা এক ধাক্কায় একেবারে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পেয়েছিল। এদের মধ্যে ব্র্যাকিওপড, বাইভালভ এবং প্রবাল উল্লেখযোগ্য। অর্ডোভিসিয়ান বিলুপ্তির কারণ এখনও বিজ্ঞান মহলে একটি রহস্যের ধোঁয়া সৃষ্টি করে রেখেছে। এজন্য পৃথিবীর কাছাকাছি একটি সুপারনোভা বিস্ফোরণকে দায়ী করা হয়, যা পৃথিবীতে ক্ষতিকারক গামা রশ্মি নিয়ে এসেছিল বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। সমুদ্রতল থেকে বিষাক্ত ধাতু নির্গত হওয়াকেও এই গণবিলুপ্তির অন্যতম কারণ হিসেবে মনে করা হয়।
ডেভোনিয়ান গণবিলুপ্তি
সময়: ৩৭৫ মিলিয়ন বছর পূর্বে
অরডোভিসিয়ান গণবিলুপ্তির পর ডেভোনিয়ান গণবিলুপ্তি ছিল প্যালেয়োজয়িক মহাযুগের দ্বিতীয় বিপর্যয়। আজ থেকে প্রায় ৩৭৫ মিলিয়ন বছর পূর্বে সংঘটিত হওয়া ডেভোনিয়ান গণবিলুপ্তির সাথে আগের ঘটা মহাবিলুপ্তির সময় ব্যবধান ছিল মাত্র ৬৫ মিলিয়ন বছর। একসাথে প্যালেওজয়িক যুগের দুই গণবিলুপ্তি পৃথিবী থেকে প্রায় ৮০ ভাগ জলজ ও স্থলজ প্রাণী নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল। ডেভোনিয়ান গণবিলুপ্তি দুই ধাপে সম্পন্ন হয়েছে বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা। প্রথম ধাপে, সমুদ্রের পরিবেশ হঠাৎ বিষাক্ত হয়ে উঠতে শুরু করে। ফলে, সামুদ্রিক উদ্ভিদের বিশাল এক অংশ স্থলভাগে অভিযোজন করে নেয়। সমুদ্রে তখন অক্সিজেন উৎপাদনকারী না থাকায় দেখা দেয় প্রকট অক্সিজেন সংকট। ফলে অধিকাংশ সামুদ্রিক ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে।
আবার, স্থলভাগে উদ্ভিদের সংখ্যা প্রাণীর সংখ্যার চেয়ে অতি দ্রুত হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় পৃথিবীর আবহাওয়া এবং জলবায়ুতে আসে সমূহ পরিবর্তন। দ্রুত হ্রাস পায় কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ। গ্রিনহাউজ গ্যাস হ্রাস পাওয়ার আগেই দ্রুত নেমে যায় পৃথিবীর তাপমাত্রা। ফলে আবহাওয়া হয়ে ওঠে চরম প্রতিকূল, মৃত্যুকে বরণ করে নিতে হয় অধিকাংশ জীবপ্রজাতিকে। এটা ছিল প্রথম ধাপের বিবরণী। দ্বিতীয় ধাপের জন্য দায়ী করা হয় বড় ধরনের আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত বা উল্কাপিণ্ডকে।
পারমিয়ান গণবিলুপ্তি
সময়: ২৫০ মিলিয়ন বছর পূর্বে
প্যালিওজয়িক মহাযুগ জীবজগতের ইতিহাসে এক অন্ধকার অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত। কারণ, প্রাণীকুল তিন-তিনটি গণবিলুপ্তির সম্মুখীন হয়েছে এই মহাযুগে। প্যালিওজয়িক যুগের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দিয়ে পরিসমাপ্তি সম্পন্ন করে পারমিয়ান গণবিলুপ্তি। এই পারমিয়ান গণবিলুপ্তিকে সকল গণবিলুপ্তির ‘মাতা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। আনুমানিক ২৫০ মিলিয়ন বছর পূর্বে ঘটা এই বিলুপ্তিতে ৯৫% সামুদ্রিক এবং ৭০% স্থলজ প্রাণীর বিলুপ্তি ঘটে। এই মহাবিলুপ্তি এতোটাই ভয়াবহ ছিল যে, পৃথিবীতে জীবপ্রজাতি মোটামুটি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে প্রায় ১০ মিলিয়ন বছর লেগে যায়।
কেন ঘটেছিল এই মহাবিলুপ্তি? এর নির্দিষ্ট কোনো উত্তর বিজ্ঞানীরা দিতে পারেননি। তাদের ধারণা, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত এবং বড় উল্কাপতনের ফলেই পৃথিবী থেকে হারিয়ে যায় প্রায় ৯৬% প্রজাতি। অগ্ন্যুৎপাত আর উল্কাপতন সম্মিলিত ভাবেই ঘটিয়েছিল এই মহাবিপর্যয়। ওই সময় বায়ুতে অত্যধিক হারে মিথেনের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় আবহাওয়া-জলবায়ুতে নেমে আসে দারুণ নেতিবাচক প্রভাব। তাপমাত্রা প্রতিকূলতার সীমা ছাড়িয়ে যাওয়া পৃথিবী হয়ে উঠেছিল পুরোপুরি জীবন বসবাসের অনুপযুক্ত। এসকল নিয়ামকের সমষ্টি মুষ্টিমেয় কিছু প্রাণী বাদে সকলকে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। এভাবেই অবসান ঘটে প্যালিওজয়িক যুগের, আর পৃথিবী পদার্পণ করে মেসোজয়িক যুগে।
ট্রায়াসিক-জুরাসিক গণবিলুপ্তি
সময়: ২০০ মিলিয়ন বছর পূর্বে
ক্রিটেসিয়াস-টারশিয়ারি গণবিলুপ্তি পৃথিবীতে ডাইনোসরদের রাজত্বের পুরোপুরি অবসান ঘটালেও, তাদের পতনের শুরুটা হয়েছিল ট্রায়াসিক-জুরাসিক গণবিলুপ্তির মাধ্যমেই। এই গণবিলুপ্তিই ধূসর পৃথিবীতে দীর্ঘকাল ধরে তাদের একচেটিয়া আধিপত্যে মোটা দাগে সীমারেখা টেনে দিয়েছিল। প্রায় ২০০ মিলিয়ন বছর পূর্বে ঘটা ট্রায়াসিক-জুরাসিক গণবিলুপ্তি মূলত একাধিক ছোট ছোট গণবিলুপ্তিকে একত্রে বুঝিয়ে থাকে। এর সময়কাল স্থায়ী হয় দীর্ঘ ১৮ মিলিয়ন বছর জুড়ে, এবং এই সময়ের মাঝে পৃথিবী দাপিয়ে বেড়ানো প্রায় ৫০% প্রজাতি চিরতরে হারিয়ে যায়। দীর্ঘ সময় ধরে নিভু নিভু অঙ্গারের ন্যায় জ্বলতে থাকা এই গণবিলুপ্তির কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতকে দায়ী করে থাকেন। তখন আগ্নেয়গিরির গলিত লাভার স্রোতে মহাকালের গর্ভে হারিয়ে যেতে হয় বহু জীবপ্রজাতিকে। প্রচুর পরিমাণ অগ্ন্যুৎপাত বাতাসে মিথেনের পরিমাণ অত্যধিক হারে বাড়িয়ে দেয়, জলবায়ু হয়ে ওঠে পুরোপুরি জীব বসবাসের অযোগ্য। প্রকৃতির এই নির্মম ধাক্কা সহ্য করতে না পেরে নিশ্চিহ্ন হবার যাত্রায় সামিল হয় বহু স্থলজ উভচর, আর্কোসোর্স এবং থেরাপসিডস।
ক্রিটেসিয়াস-টারশিয়ারি গণবিলুপ্তি
সময়: ৬৫ মিলিয়ন বছর পূর্বে
মানবহীন পৃথিবীতে সর্বশেষ ঘটা গণবিলুপ্তি হলো ক্রিটেসিয়াস-টারশিয়ারি গণবিলুপ্তি। সময়রেখার দিকে তাকালে দেখা যাবে, এই গণবিলুপ্তিই সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে ঘটেছে। বিজ্ঞানীদের কাছে এই বিলুপ্তির বহু চিহ্ন ও প্রমাণ রয়েছে। ট্রায়াসিক-জুরাসিক গণবিলুপ্তির ধাক্কা সামলে ডাইনোসরের কিছু প্রজাতি অবশিষ্ট থাকলেও ক্রিটেসিয়াস-টারশিয়ারি গণবিলুপ্তি থেকে তারা নিজেদের আর রক্ষা করতে পারেনি।
যথেষ্ট প্রমাণ হাতে থাকায় এই গণবিলুপ্তি সম্পর্কে বিজ্ঞানী সুস্পষ্ট এবং পরিষ্কার ধারণা দিতে পেরেছেন। এর সূত্রপাত ঘটায় বিশাল এক উল্কাপাত বা গ্রহাণু। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের সাথে ঘর্ষণে পুরোপুরি জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের রূপ ধারণ করা উল্কা বা গ্রহাণুগুলো পৃথিবীর বুকে সজোরে আঘাত হেনেছিল। যার নির্মম পরিণতি ঠাহর করতে পৃথিবীর প্রাণীকুল কোনোভাবেই প্রস্তুত ছিল না। কী স্থলজ, কী জলজ, সকলেই সামিল হয় বিলুপ্তির মহাযাত্রায়। বিস্ফোরণের কাছাকাছি থাকা প্রাণীরা তো নিজেদের বাঁচাতেই পারেইনি, উল্টো পুরো বায়ুমণ্ডল পরিপূর্ণ হয়ে যায় ধূলিকণা আর বিষাক্ত গ্যাসে। ফলে, পৃথিবী থেকে হারিয়ে যায় তখনকার জীবজগতের ৭৫% প্রজাতি।
মানবঘটিত গণবিলুপ্তি
উপর্যুক্ত আলোচনা সবকটিই ছিল প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে সাধিত হওয়া গণবিলুপ্তি, মানুষ তখনও পৃথিবীতে আসেনি। তবে মানুষও যে কতক প্রাণীকূলকে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে, তা হয়তো অনেকেরই অজানা। লোমশ ম্যামথ, লম্বা দাঁতওয়ালা বাঘ, দৈত্যাকৃতির ওমব্যাট, বিভার পৃথিবী থেকে হারিয়েছে শুধুমাত্র মানুষের কারণেই।
আজ থেকে প্রায় ৪৫ হাজার বছর পূর্বে অস্ট্রেলিয়ায় উপনিবেশ স্থাপন করে হোমো স্যাপিয়েন্সরা। তৎকালীন অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে হরহামেশাই দেখা মিলত দু’শ কেজি ওজনের ক্যাঙ্গারুর, যারা লম্বায় ছিল প্রায় দুই মিটার। ওই মহাদেশ দাপিয়ে বেড়াতো মারসুপিয়াল সিংহ, যারা ছিল তখনকার সর্ববৃহৎ শিকারি প্রাণী। উড়তে অক্ষম উটপাখির দ্বিগুণ আকারের একদল পাখির ধুমধাম পদশব্দে মুহূর্তেই ভেঙে যেত প্রকৃতির সকল নিস্তব্ধতা। বনে-জঙ্গলে নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াত দানবাকৃতির প্রাণী ডাইপ্রোটোডন। তাদের একেকটির গড় ওজন ছিল প্রায় আড়াই টনের কাছাকাছি। স্যাপিয়েন্সরা অস্ট্রেলিয়ায় বসতি গড়ার কয়েক হাজার বছরের মধ্যেই বিলুপ্তির খাতায় নাম উঠে যায় প্রায় সবগুলো দৈত্যাকৃতির প্রাণীর।
অস্ট্রেলিয়াতে তখন পঞ্চাশ কেজির বেশি ওজনের চব্বিশ প্রজাতির প্রাণী বাস করত, যার মধ্যে তেইশটি প্রজাতিই বিলুপ্ত হয়ে যায়। অপেক্ষাকৃত ছোট আকৃতির অসংখ্য প্রজাতিও বিলুপ্তির এই ঘূর্ণিপাকে অস্ট্রেলিয়া থেকে বিলীন হয়ে যায়। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে তিল তিল করে গড়ে ওঠা অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের বাস্তুসংস্থানের খোলস কয়েকশত বছরের মধ্যেই ভেঙে যায়। এভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বহু দৈত্যাকৃতির প্রাণী বিলুপ্ত হয়েছে মানুষের কারণে।