ভারতবর্ষে মোঘল সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব যখন হুমকির মুখে উপনীত, তখন সাম্রাজ্যের ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন মহামতি আকবর। গ্রহণ-বর্জনের দূরদর্শিতা নিয়ে আকবরের নানা নীতি সাম্রাজ্যকে শুধু সুদৃঢ়ই করেনি, ভবিষ্যৎ বংশধরদের সাম্রাজ্য পরিচালনার পথকেও অনেক ক্ষেত্রে নিষ্কন্টক করে দিয়েছিল। বংশপরম্পরায় আকবরের মৃত্যুর পরে সিংহাসনে বসেন তার জ্যেষ্ঠপুত্র শাহজাদা সেলিম। পুরো নাম মির্জা নূরউদ্দিন বেগ মোহাম্মদ খান সেলিম জাহাঙ্গীর। ১৬০৫ সালে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার সময় তিনি ‘নূরউদ্দিন মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর পাদশাহ গাজী’ উপাধি গ্রহণ করেন। এ কারণে ক্ষমতায় আসার পর যুবরাজ সেলিম জাহাঙ্গীর নামেই অধিক পরিচিত হন তিনি। বিশাল ব্যক্তিত্ব ও কিংবদন্তীতুল্য মেধার অধিকারী আকবরের পর সম্রাট হিসেবে মূল্যায়ন করলে যে কাউকেই নিষ্প্রভ মনে হওয়া স্বাভাবিক। তবু জাহাঙ্গীর পিতার যোগ্য উত্তরসূরীই ছিলেন বলতে হয়।
শাহজাদা সেলিম ছিলেন আকবরের অনেক সাধনার পুত্রসন্তান। আকবরের প্রথম বয়সের সকল সন্তানই মৃত্যুবরণ করেছিল। তাই একটি পুত্র সন্তানের তীব্র আকাঙ্ক্ষায় কায়মনোবাক্যে তিনি প্রার্থনা করতেন। অনেক পীর-দরবেশের দরবারে মানতও করেছিলেন তিনি। আজমীরে খাজা মঈনুদ্দিন চিশতীর দরবারে তিনি এই উদ্দেশ্য নিয়ে বেশ কয়েকবার যান। ফতেহপুর সিক্রিতে এ সময় খানকাহ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বিখ্যাত সাধক শেখ সেলিম চিশতী। সম্রাট আকবর প্রতি সপ্তাহে তার দরবারেও যেতেন। অবশেষে পীর সাহেব আশ্বাস দেন সম্রাটের ঘরে তিনটি পুত্র সন্তান জন্ম নেবে। ১৫৬৯ সালের ৩০ আগস্ট আকবরের রাজপুত বেগমের ঘরে জন্ম নেন শাহজাদা সেলিম। পীর সাহেবের নামানুসারে আকবর সন্তানের নাম রাখেন সেলিম। মানত পূরণের জন্য আকবর পায়ে হেঁটে আজমীরে মঈনুদ্দিন চিশতীর দরবারে যান।
সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারী হিসেবে শাহাজাদা সেলিমকে উপযুক্তভাবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন তার পিতা। সে যুগের সুযোগ্য শিক্ষকদের তিনি নিয়ে এসেছিলেন শাহজাদার লেখাপড়ার জন্য। একাধারে ফারসি, তুর্কি ও হিন্দি ভাষা এবং গণিত, ইতিহাস, ভূগোলসহ নানা বিষয়ে পাঠদান চলতে থাকে। যোগ্য শিক্ষকদের পরিচর্যায় শাহজাদা সেলিম বিভিন্ন বিষয়ে পারদর্শী হয়ে উঠতে থাকেন। ধীরে ধীরে তার মধ্যে কাব্যপ্রতিভারও বিকাশ ঘটে। বিদ্যাশিক্ষার পাশাপাশি সেলিম যুদ্ধবিদ্যার দীক্ষা গ্রহণ করেন। এদিক থেকে তিনি যথেষ্ট যোগ্যতার পরিচয় দিতে সমর্থ হন। ১৫৮১ সালে কাবুল অভিযানে তার সফল নেতৃত্ব এর বড় একটি প্রমাণ। সেলিমকে বিচার বিভাগ ও রাজকীয় উৎসবের কিছু কিছু দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৫৭৭ সালে তাকে দশ হাজার মনসবদারী দেয়া হয়। ১৫৮৫ সালে তা বারো হাজারীতে উন্নীত করা হয়।
স্রষ্টার কর্ম বোঝা সত্যিই মানুষের সাধ্যাতীত। সিংহাসনে কে বসবে সে চিন্তায় অস্থির হয়ে একটি পুত্র সন্তানের জন্য কত পীর-ফকিরের দরবারে মানত করে বেড়ালেন সম্রাট আকবর, অথচ শেষ বয়সে তিন তিনটি পুত্র থাকার পরেও সিংহাসনের যোগ্য তার কাউকে মনে হলো না; আর অনেক সাধনার ধন পুত্র সেলিম পিতার বিরুদ্ধে করলো বিদ্রোহ!
একজন সফল সম্রাট আকবরও তার পারিবারিক জীবনে ব্যর্থতা এড়াতে পারেননি। তার তিন সন্তান ছিলেন সেলিম, মুরাদ ও দানিয়েল। জ্যেষ্ঠপুত্র সেলিম কিছুটা আয়েশী হয়ে বেড়ে ওঠেন। দ্বিতীয় পুত্র মুরাদ ছিলেন অত্যাধিক পানাসক্ত। অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে তার মৃত্যু হয়। কনিষ্ঠ পুত্র দানিয়েলের প্রতি আকবরের সদয় দৃষ্টি সেলিমকে সিংহাসনের উত্তরাধিকার দেবার বিষয়ে সন্দিহান করে তোলে। উচ্ছৃঙ্খল আচরণের জন্য আকবরের ঘনিষ্ঠজনেরাও সেলিমের উপর রুষ্ট ছিল। এর মধ্যে আকবরের সভার নবরত্নের অন্যতম আবুল ফজলও ছিলেন। আবুল ফজলের সদয় দৃষ্টি সেলিম কখনোই পাননি। বলা হয়ে থাকে, এ কারণেই সেলিমের নির্দেশে বীরসিংহ দেববুন্দেলা আবুল ফজলকে হত্যা করেছিলেন।
সিংহাসনের আকাঙ্ক্ষায় পিতার মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চাইলেন না সেলিম। তাই আকবরের জীবদ্দশাতেই তিনি বিদ্রোহ করে বসেন। দাক্ষিণাত্যে সম্রাট যখন কর্মব্যস্ত ছিলেন, সেই সময় সুযোগ বুঝে সেলিম এলাহাবাদে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। একজন সম্রাটের মতোই তিনি জায়গীর বিতরণ করতে থাকেন ও নিজ নামে মুদ্রা জারি করেন। ১৬০১ থেকে ১৬০৪ সাল পর্যন্ত আকবরকে পুত্রের বিদ্রোহের মুখে থাকতে হয়। যদিও এই বিদ্রোহ আকবরকে ঘোরতর সঙ্কটে ফেলতে পারেনি, তবু বৃদ্ধ বয়সে তাকে এক রাজনৈতিক সমস্যায় নিপতিত করেছিল এ ঘটনা।
সেলিমের এই বিদ্রোহের সময় মানসিংহের মতো প্রভাবশালী অমাত্যরা সেলিমের পুত্র খসরুকে আকবরের উত্তরাধিকারী নির্বাচনের চেষ্টা করেন। এই সিদ্ধান্তে সেলিম বিচলিত হয়ে পড়েন। তাই বাধ্য হয়ে তিনি পিতার কাছে আত্মসমর্পণ করেন। ইতিমধ্যে দানিয়েল অকালে মারা যান। শোকাহত সম্রাট আকবর সেলিমকে ক্ষমা করে দেন। এর কিছুদিন পরে আকবর অসুস্থ হয়ে পড়েন। মৃত্যুর আগে সেলিমকে তিনি পরবর্তী মোঘল সম্রাট হিসেবে অভিষিক্ত করে যান। ১৬০৫ সালের ২৫শে অক্টোবর মহামতি আকবরের জীবনাবসান ঘটে। যুবরাজ সেলিম চতুর্থ মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর হিসেবে সিংহাসনে বসেন।
পিতার মতো জাহাঙ্গীরও রাজ্য বিস্তারের নীতি গ্রহণ করেছিলেন। অজেয় মেবারের উপর ১৫৯৭, ১৬০৮ ও ১৬১৩ সালে পরপর তিনবার আক্রমণ করে জাহাঙ্গীর তাদেরকে বশীভূত করেন। ক্ষমতা ও আভিজাত্যের দ্বন্দ্ব ছিল মুঘল সাম্রাজ্যের একটি চিরন্তন ক্ষত। তাই আকবরের পরিচর্যার পরেও জাহাঙ্গীর তার সাম্রাজ্য পরিচালনা ক্ষেত্রে নিরঙ্কুশ স্থিতিশীলতা পাননি। একদিকে তিনি যেমন মেবার, দাক্ষিণাত্য ও পূর্ব ভারতে আধিপত্য সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, অন্যদিকে মুখোমুখি হয়েছিলেন একাধিক বিদ্রোহের। পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার সময় প্রথম সারির অভিজাতদের অনেকেই ছিলেন তার বিরুদ্ধপক্ষ। সমর্থনে যাদের পেয়েছিলেন, তাদের বেশিরভাগই ছিল সাধারণ মাপের মানুষ। কর্মক্ষমতা ও যোগ্যতা বিচারে তারা মুঘল সম্রাটের সহযোগী হওয়ার মতো ছিল না। এই সংকট জাহাঙ্গীরের শাসনামলের প্রথম দিককে কিছুটা তমসাচ্ছন্ন করে রাখে।
অম্বরের রানা রাজা ভগবান দাস ছিলেন জাহাঙ্গীরের মামা। পনের বছর বয়সে জাহাঙ্গীরের সাথে ভগবান দাসের কন্যা মনা বাঈয়ের বাগদান সম্পন্ন হয়। ১৫৮৫ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি হিন্দু ও মুসলিম রীতির সমন্বয়ে বিপুল আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে দিয়ে তাদের বিয়ে হয়। মনা বাঈয়ের প্রতি সেলিমের যথেষ্ট ভালোবাসা ছিল। তিনি তাকে ‘শাহবেগম’ উপাধি দিয়েছিলেন। এই মনা বাঈয়েরই হতভাগ্য পুত্র ছিলেন শাহজাদা খসরু, যাকে আকবর ও তার অমাত্যবৃন্দ জাহাঙ্গীরের বিদ্রোহের সময় সিংহাসনের উত্তরসূরী মনোনীত করেছিলেন। মোঘল ইতিহাসে যে কয়েকজন হতভাগ্য শাহজাদার জন্ম হয়েছিল, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন খসরু।
পিতার আদর্শ অনুসরণ করে খসরুও নিজ পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন। তার বিদ্রোহ এক রক্তাক্ত পরিণতির মাধ্যমে ব্যর্থ হয়েছিল। পিতার প্রতি খসরুর অশোভন আচরণ সইতে না পেরে মনা বাঈ ১৬০৪ সালে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। মনা বাঈয়ের মৃত্যুতে জাহাঙ্গীর অতিশয় ব্যথিত হন। জানা যায়, চারদিন পর্যন্ত তিনি কোনো প্রকার খাদ্য ও পানীয় স্পর্শ করেননি। জীবনের শেষভাগে জাহাঙ্গীর আরেক পুত্র খুররমের বিদ্রোহের মুখে পড়েন। জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর পর খুররম শাহজাহান নাম নিয়ে সিংহাসনে আরোহণ করেন।
জীবদ্দশায় জাহাঙ্গীর আরও অনেক রমণীর পাণি গ্রহণ করেন। এদের মধ্যে নূরজাহান সবচেয়ে বেশি আলোচিত। জাহাঙ্গীরের উপর তার প্রভাবও অনেক বেশি ছিল। জাহাঙ্গীর ও নূরজাহানের প্রেমকাহিনী ইতিহাসে সুবিখ্যাত।
জাহাঙ্গীর ধর্ম বিষয়ে আকবরের মতোই সহিষ্ণু ছিলেন। তিনি তার অভিজাতদের সতর্ক করে দিয়েছিলেন যাতে ইসলাম কারো উপর চাপিয়ে দেওয়া না হয়। খ্রিষ্টান পাদ্রীদের মুসলিম উলামাদের সাথে জনসমক্ষে ধর্মীয় বিতর্ক করার ও গসপেল প্রচারের অধিকার ছিল। জাহাঙ্গীর নিজেও হিন্দু ব্রাহ্মণদের সাথে ধর্মীয় নিগুঢ়তা, বিশেষ করে অবতারের সম্ভাব্যতা বিষয়ে আলোচনা উপভোগ করতেন। তার দরবারে সুন্নী, শিয়া দুই সম্প্রদায়ের মুসলিমরাই সমান অধিকার পেতো।
১৬২৭ সালে স্বাস্থ্য রক্ষার উদ্দেশ্যে সম্রাট জাহাঙ্গীর প্রথমে কাবুল ও পরে কাশ্মীর যান। কিন্তু অতিরিক্ত ঠান্ডায় কাহিল হয়ে জাহাঙ্গীর কাবুলে চলে আসেন। সেখান থেকে পুনরায় কাশ্মীর যাবার পথে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। দেহ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে তার দেহ থেকে অন্ত্র বের করে তাকে কাশ্মীরের বাঘসর দুর্গে দাফন করা হয়। পরে সেখান থেকে তার দেহাবশেষ সরিয়ে লাহোরের শাহদারা বাগে সমাধিস্থ করা হয়। বর্তমানে তার দৃষ্টিনন্দন সমাধিক্ষেত্র দর্শনার্থীদের জন্য আকর্ষণীয় একটি স্থান।
জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর পরে তার তৃতীয় পুত্র খুররম শাহজাহান নাম নিয়ে সিংহাসনে বসেন। সম্রাট জাহাঙ্গীর ও তার সাথে সম্পৃক্ত আরও কিছু চরিত্র নিয়ে পরবর্তী সময়ে আরও বেশ কিছু লেখা নিয়ে আসার আশা পোষণ করছি।
তথ্যসূত্র
ভারত উপমহাদেশের ইতিহাস- মধ্যযুগঃ মোঘল পর্ব- এ কে এম শাহনেওয়াজ