সময়টি নভেম্বর মাস, ১৯১৩ সাল। সান ফ্রান্সিসকো শহরের হিলটপে নতুন গড়ে ওঠা একটি সংগঠন, যারা মূলত ভারতীয়, তাদের দ্বারা গড়ে ওঠে একটি নতুন চেতনা এবং আশ্বাস। এই চেতনাধারী মানুষদের সংগঠনের নাম হলো গদর পার্টি। এই ১৯১৩ সালেই সান ফ্রান্সিসকোতে গড়ে ওঠে তাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে মোকাবেলার প্রস্তুতি এবং নতুন প্রতীক। এই প্রতীক দ্বারা প্রকাশ করা হয় গদর বিপ্লবীদের।
গদর পার্টি বলতে মূলত বোঝায় ভারতীয় বা ভারতবাসীদের দ্বারা গড়ে ওঠা বিপ্লবী সংগঠন এবং এই সংগঠনের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হিন্দু, মুসলিম এবং শিখ ধর্মাবলম্বীদের, যাদের উদ্দেশ্য হলো উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া, অর্থাৎ উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে একটি সশস্ত্র সংগ্রামী বাহিনী, যেখানে উপনিবেশের ধারণা ও বহির্বিশ্বের ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলোর অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো।
১৯১০ সালে মূলত গদর পার্টি আত্ম প্রকাশ করে তার রাজনৈতিক মেনিফেস্টো ও মতবাদ নিয়ে, যাদের প্রধান দাবী ছিল উদারবাদের নীতি অনুসারে অধিকার রক্ষা করা এবং সাংস্কৃতিক স্বীকৃতি পাওয়া একজন ভারতীয় হিসেবে। যেখানে ইংরেজ শাসনামলে ‘ভারতীয়’ শব্দটি বা ভারতে অবস্থিত সংস্কৃতিকে নিচু চোখে গণ্য করা হতো, সেখানে ঠিক এই ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে নতুন করে রাজনৈতিক মঞ্চ সাজিয়ে ভারত এবং তার সংস্কৃতিকে বহির্বিশ্বের সামনে তুলে ধরার যৌক্তিকতা পেশ করে। অর্থাৎ গদর পার্টির আদর্শে সাংস্কৃতিক স্বকীয়তাবোধের জন্ম নেয় এবং জন্ম দেয় এই সংগঠন। এর ফলে ‘ঔপনিবেশিক ভারত’ ধারণার বাইরে তারা স্বাধীন, চেতনাকামী এবং একক রাষ্ট্র হিসেবে গঠন করবার জন্য সংগ্রাম করেন। এই সংগ্রামের পথ অনেকটাই সশস্ত্র এবং চূড়ান্ত রাজনৈতিক হয়ে উঠেছিল। গদর পার্টির মতানুসারে, পৃথিবীতে বর্ণবাদ সৃষ্টির পেছনের মূল কারণ এই ঔপনিবেশিকতা এবং সাম্রাজ্যবাদের কাঠামো, যার দ্বারা সে অন্যান্য দেশকে নিজের আয়ত্বে রেখে শাসন শোষণ করে যাচ্ছে বছরের পর বছর, যেখানে প্রকৃত মানবতা বা মানবাধিকারের কোনো নিশানা নেই, আছে শুধুমাত্র বর্ণের দ্বারা মানব শোষণ পদ্ধতি।
১৯১৩ সালের দিকে এসে তারা আত্মপ্রকাশ করে নতুন এক পতাকার মাধ্যমে, যে পতাকা সরাসরি বহন করে তাদের ভূমি, সংস্কৃতি, মানুষ ও জাতীয়তাবাদের ধারণা।
সান ফ্রান্সিসকোর হিলটপে গড়ে তোলা এই পতাকার বিশেষত্ব হলো এর তিন রঙ। লাল, হলুদ এবং সবুজ প্রকাশ করে যথাক্রমে স্বাধীনতা, ভ্রাতৃত্ব ও সমতা। এই পতাকা প্রকাশ করে স্বাধীন ভারতের মূল্যবোধের সংজ্ঞায়ন এবং সেই সাথে একটি সশস্ত্র বিপ্লবের ধারণা, যা হবে এই নেতিবাচক সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে।
একটি বিষয় এখানে বুঝবার বিষয়, আর তা হলো- ইতিহাসের পাতায় কীভাবে এই সংগঠনের ভিন্ন ভিন্ন ধর্মাবলম্বী এবং ভিন্ন ভিন্ন সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর মধ্যে মেলবন্ধন সৃষ্টি হলো?
মূলত গদর পার্টির এই একতাবদ্ধতার পেছনে যে জাতি বা মানুষগুলো ছিল তারা বেশিরভাগই পাঞ্জাবী অভিবাসী ছিলেন উত্তর আমেরিকায়। শুধু পাঞ্জাবী অভিবাসীরাই নন, একইসাথে বাঙালী ও পাঞ্জাবী বুদ্ধিজীবী, ছাত্র-ছাত্রী, এমনকি যারা ইংরেজ সরকারি অফিস আদালতের কর্মচারীরা ছিলেন তারাও পর্যন্ত এই সংগঠনে একবদ্ধ হন। অথচ সংগঠনে ভিন্ন ভিন্ন সাংস্কৃতিক ও ধর্মের মানুষজন থাকা সত্ত্বেও তাদের মধ্যে সেক্যুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ সৃষ্টি করা একটি মুখ্য লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়, যার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল যেন ধর্ম-বর্ণ-সংস্কৃতির উপর নির্ভর করে কারো সাথে অন্যায়মূলক আচরণ এবং বর্ণবৈষম্য সৃষ্টি না করা হয়। এই লক্ষ্যে তারা অর্থাৎ শিখ, হিন্দু, মুসলিম একত্রিত হয়ে বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমে পড়ে।
১৯১৫ সাল থেকে ব্রিটিশদের দ্বারা এই গদর পার্টি নানাভাবে অত্যাচারিত হতে থাকে। এই অত্যাচারের শেষ ফসল ফলে হয় ১৯২০ সালের দিকে। সংঘটিত হয় বাবর আকালী আন্দোলন। যে আন্দোলনের মূল দাবী ছিল গুরুদুয়ারাকে মুক্ত করে শিখদের দখল করে নেওয়া, যেখানে ইংরেজদের দখলে এর সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ডুবে যাবার পথে ছিল। ইতিহাসে তাদের প্রাকৃতিক সম্পত্তি ও সম্পদকে দখলে নেবার জন্য ব্রিটিশরা তাদের প্রতি যে অন্যায়, অবিচার ও বিশ্বাসঘাতকতা করেছে তার প্রতিশোধস্বরুপ গদর পার্টির শিখ সম্প্রদায় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলে। এর দ্বারা তারা দেশপ্রেম, প্রগতি, গণতন্ত্র ও মুক্তির আকাঙ্ক্ষা ফুটে ওঠে।
এই আন্দোলন ছিল গদর পার্টির অন্যতম শক্তিশালী একটি আন্দোলন, যা ভারত নামক একক রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন দেখেছিলো, যেখানে অন্যায়, অবিচার ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ধারণাকে ঘিরে নতুন করে সাম্যবাদের ধারণার জন্ম নেয়। এই ধারণার পেছনের কারণ হিসেবে যে ইতিহাসটি তাদের উদ্দীপনা দেয় তা হলো ১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপ্লব।
রাশিয়ার তখনকার কৃষক, শ্রমিকসমাজ একত্রে জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে সমাজতান্ত্রিক সাম্যবাদের ধারণা গ্রহণ করে মুক্তির বিপ্লবে ঝাঁপিয়ে পড়ে লেলিনের নেতৃত্বে। ঠিক এই ধারণার একটি বিশাল অংশ প্রবেশ করে গদর পার্টির মধ্যে। ফলে ভারতের গদর পার্টি নতুন করে মার্ক্সসিজম এবং সাম্রাজ্যবাদবিরোধীতাকে একত্র করে নতুন করে ঢেলে সাজায়। ১৯২০ সালে যার ফলে সৃষ্টি হয় কীর্তি কিষাণ পার্টি বা একটি কৃষক সংঘ, যেখানে তাদের অধিকার সোচ্চারের দাবীতে দাসত্বের বাঁধন থেকে মুক্তির আন্দোলনই ছিল প্রধান বিষয়বস্তু।
এই দলের লক্ষ্য ছিলো-
- অস্ত্রের মাধ্যমে ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লব সংগঠন এবং দাসত্ব থেকে মুক্তি। স্বাধীন ভারত প্রতিষ্ঠা করা।
- সান ফ্রান্সিসকোতে তাদের সদরদপ্তর প্রতিষ্ঠা করা, যা এই লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্যসমূহ অর্জনের জন্য সমস্ত ক্রিয়াকলাপ সমন্বয় করার জন্য একটি কেন্দ্র হিসেবে কাজ করবে।
- উর্দু, হিন্দি, শিখ এবং ভারতের অন্যান্য ভাষাভাষীদের জন্য একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করতে হবে।
- প্রতি বছর সাংগঠনিক নির্বাচনের জন্য বিভিন্ন কমিটি থেকে সমন্বয় কমিটি নির্বাচন করতে হবে।
- সমন্বয় কমিটি রাজনৈতিক ও ভূগর্ভস্থ কাজ তত্ত্বাবধানে তিন সদস্যের কমিশন নির্বাচন করবে।
- মাসিক একটি অনুদান হিসেবে সকলকে ১ ডলার করে প্রদান করতে হবে।
- প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ধর্ম নিয়ে আলোচনা বা বিতর্ক করা হয়নি কখনোই। সুতরাং ধর্ম একটি ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু সংগঠন সকল ধর্মের মানুষকে শ্রদ্ধা ও সম্মান করে এবং কার কোন ধর্ম তা নিয়ে রাজনীতি করে না। প্রত্যেক সদস্যের দায়িত্ব ছিল সেই দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণের জন্য, যেখানে তারা বাসিন্দা ছিল।
গদর একটি উর্দু শব্দ, যার মূল এসেছিল আরবী শব্দ থেকে। গদর শব্দের অর্থ ‘অভ্যুত্থান’ বা ‘বিপ্লব’। এই বিপ্লবের তত্ত্ব নিয়ে গদর পার্টির মধ্যে সম্প্রসারিত হয় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী চেতনা। ১৯১৩ সালের দিকে এস্তোরিয়া, আমেরিকাতে অনুষ্ঠিত হয় গদর পার্টির প্রথম সম্মেলন, যেখানে নির্বাচিত হন প্রেসিডেন্ট সোহান সিং বাখনা, ভাইস প্রেসিডেন্ট কেসার সিং এবং জেনারেল সেক্রেটারী লালা হরদয়ালসহ আরো অনেক কার্যনির্বাহী সদস্য। মূলত এই গদর পার্টির অংশে শিখ পাঞ্জাবদের সংখ্যা ছিল বেশি, যার পরিমাণ প্রায় নব্বই শতাংশ।
১৯১৩ সালের এই সম্মেলনের পর নভেম্বর ১, ১৯১৩ সালের দিকে গদর পার্টি তাদের আদর্শের ধারা ও চিন্তাভাবনাকে প্রসারিত করবার উদ্দেশ্যে সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করে, যার নাম ‘হিন্দুস্তান গদর’। হিন্দুস্তান গদরের লক্ষ্য ছিল ভারতের নাগরিকদের উপর কীভাবে বিদেশীরা আক্রমণ ও নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে এবং সেই সাথে বিদেশের মাটিতে ভারতবাসীদের উপর কেমন দাসের ন্যায় আচরণ ও অত্যাচার করছে তার ঘটনা তুলে ধরা। শুধু অন্যায় আচরণ প্রকাশ করে থেমে থাকেনি, বরং এই অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে কীভাবে ভারতের মানুষেরা সোচ্চার হয়ে দমন এবং প্রতিহত করছে তারও চিত্র ফুটিয়ে তুলতো তারা। এই আদর্শকে ঘিরে তাদের সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশের পূর্বে একটি অমর বার্তা প্রদান করে যায় গদর পার্টি,
তারা আজ দেশের মাটিতে শোষণ করছে, কিন্তু আমাদের দেশ দাঁড়িয়েছে তাদের বিরুদ্ধে, যুদ্ধ ঘোষণা করছি তাদের বিরুদ্ধে। ইংরেজ রাজদের বিরুদ্ধে আজ যুদ্ধ ঘোষণা করা হলো। আমাদের না কী? গদর! আমাদের কাজ কী? গদর! আমাদের নাম ও কাজ এক ও অভিন্ন।
এর মাধ্যমে বিপ্লবোত্তর গদর পার্টির শক্তিশালী রাজনৈতিক যাত্রা শুরু হয়। তাদের প্রথম উদ্দেশ্য ছিল আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে এই সংগঠনকে নিয়ে যাওয়া এবং অনেকগুলো শাখা-প্রশাখা সৃষ্টি করা, যেন সব দেশে শোষিত জাতিকে নিয়ে একটি সমন্বয় করা যায়। তাহলে বিপ্লবের আদর্শ আরো শক্তিশালী হবে। এরই লক্ষ্যে তারা আরো নতুন নতুন শাখা স্থাপন করলো, যেমন- ভ্যাঙ্কুভার, এস্তোরিয়া, পোর্ট ল্যান্ড, সেন্ট জনস, স্যাক্রামেন্টো, স্টকটোন, পানামা, ম্যানিলা, হংকং ও সাংহাই।
গদর সংঘের ভেতরে প্রতি সপ্তাহে ২,৫০০ কপি করে তাদের পত্রিকা বিতরণ করা হতো এবং ২,২০০ পত্রিকা ছাপানো হতো উর্দুতে। এভাবে তাদের বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা গঠিত হতো আরেক জ্ঞানের স্তরের সমাজের, যারা ইংরেজদের এই শোষণের পর্যালোচনার সুযোগ পায়। ছয় মাসের মাথায় এই পত্রিকার বাজার আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে ছড়িয়ে যায়, যেমন- ম্যানিলা, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ আফ্রিকা, মিশর, পানামা, প্যারিস ইত্যাদি। সুতরাং বিশ্ব যেন আরেক বিপ্লবী দলের অস্তিত্বের মুখোমুখি হয়, যেমনটা হয়েছিল নেলসন ম্যান্ডেলার সময়কালে।
যুগান্তর আশ্রম তাদের মূল হেডকোয়ার্টার থাকাকালে সেখান থেকে প্রকাশিত হয় আরো বেশ কিছু নথিপত্র, যার মধ্যে অন্যতম হলো ‘জাঙ্গ দা হোকা’ বা ‘যুদ্ধ ঘোষণা’, যেটি প্রকাশ করেছিল তাদের প্রথম যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বার কারণ।
ব্রিটিশরা আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে দখল করেছে। সেই সঙ্গে তারা আমাদের বাণিজ্য ও শিল্প ধ্বংস করেছে। তারা হিন্দুস্তানের সম্পত্তি লুটপাট করেছে এবং দুর্ভিক্ষ ও প্লেগ রোগ নিয়ে এসেছে। ৯০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ এক বেলা খাবার পেতে হিমশিম খায়। তারা ইংল্যান্ডে আমাদের সকল উৎপাদিত পণ্য ও শস্য নিয়ে যায়।
এই দুর্দশা ও হতাশার মধ্যে হিন্দুস্তানীরা তাদের নিজেদের ভূমি ছেড়ে চলে যায় আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা ও ইউরোপে, শুধুমাত্র পেটের দায়ে এবং চাকরির আশায়। যখন তারা নিজেদের পেটে খাবারের যোগান পায় অতি কষ্টে, তখন সেই কষ্ট তাদের চোখ খুলে দিয়েছে, ব্রিটিশদের সমস্ত পরিকল্পনা বুঝতে পেরেছে। যখন আমরা সেই দেশে যাই তখন তারা আমাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। আমাদের জন্য অস্ট্রেলিয়া এবং কানাডার যাত্রাপথও বন্ধ করে দিয়েছে। তারা আমাদের মা-বোনদের সাথে এমন আচরণ করে যেন আফ্রিকার বন্য প্রাণী আমরা।
১৯১৪ সালের আগস্ট মাসে গদর পার্টি এবং তার কার্যনির্বাহী সদস্যদের দ্বারা একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। আর তা হলো বিদেশে অবস্থানরত প্রত্যেক হিন্দুস্তানীরা ফিরে আসবে হিন্দুস্তানে এবং বিশাল আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটাবে, যার লক্ষ্য সশস্ত্র বিদ্রোহ। এভাবে গদরের সকলে ভারতে অবস্থান করবে এবং ব্রিটিশ অপশাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হবে।
গদর পার্টির কনিষ্ঠতম ব্যক্তি কার্তার সিং, বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, তিনিসহ অন্যান্য গদরদের সাথে চলে আসেন ভারতে। ছাত্র সংগ্রামে এক অভূতপূর্ব সাহসের যোগান দিয়েছে কার্তার সিংয়ের এই দেশে ফিরে আসা। অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট সোহান সিং জাপান থেকে গদরের অন্যান্যদের নিয়ে ফেরেন ভারতে। পৃথিবীর অন্যান্য জায়গার গদরেরা নিজেদের কর্মকান্ড ছেড়ে চলে আসে বৃহত্তর ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রামের উদ্দেশ্যে। ১৯১৪ থেকে ১৯১৮ সাল নাগাদ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলে ব্রিটিশরা কিছুটা সংকটে পড়ে গেলে তা ভারতবাসীর জন্য বেশ ভালো একটি সুযোগ হয়ে দাঁড়ায়। ঠিক এই সময়ে উত্তর আমেরিকা থেকে দক্ষিণ আমেরিকার আট হাজারেরও বেশি ভারতীয়দের তারা উদ্ধার করে দেশে নিয়ে আসে। এর মধ্যে তাদের ভারতে ফেরত আসা জাহাজে ব্রিটিশরা প্রায় একশোর মতো গদর গোষ্ঠীর মানুষকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। তবুও গদররা চুপ থাকেনি। এখান থেকে আমরা তাদের নীতি নির্ধারণীর একটি বিশাল ঘটনার মুখোমুখি হই-
- ভারতের অন্যান্য সকল বিপ্লবী গ্রুপের মধ্যে যোগাযোগকে দৃঢ় করে আন্দোলনের ধাপগুলোকে মজবুত করা এবং সেই সশস্ত্র আন্দোলনের লক্ষ্যে আগ্রসর হওয়া।
- গদরদের গ্রাম থেকে গ্রামে ভ্রমণ করতে হবে এবং ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের জন্য জনগণকে প্রস্তুত করতে হবে।
- ক্যান্টনমেন্টে সৈন্যদের মধ্যে প্রচার করা এবং তাদের প্রস্তুত করতে হবে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের জন্য। এই কাজের জন্য একটি বিশেষ কমিটি নির্বাচিত হবে।
- অস্ত্র সংগ্রহের জন্য একটি বিশেষ গ্রুপ সংগঠিত করতে হবে।
- জনগণ ও সৈন্যদের মধ্যে সাহিত্য ও প্রকাশনা বিলি করে দেবার জন্য একটি বিশেষ কমিটি থাকবে।
- জার্মানি ও তুরস্ক থেকে সম্ভাব্য সকল ধরনের সহযোগিতা খুঁজতে হবে এবং অন্যান্য দেশের সাথে বিপ্লবী সম্পর্ক আরো জোরদার করতে হবে যেন সাহায্য পাওয়া যায় সহজেই।
উক্ত লক্ষ্যসমূহের দ্বারা গদর তাদের অবস্থানকে শক্ত করে তোলে। কিন্তু এর মাঝে একটি বিশাল সমস্যার সৃষ্টি হয় এই ১৯১৪ থেকে ১৯১৭ সাল নাগাদ। ইংরেজরা এই পরিকল্পনার নাম দিয়েছিলেন “গদর ষড়যন্ত্র”। এই ষড়যন্ত্রের মধ্যে ছিল চরমপন্থী জাতীয়তাবাদী ভারতীয়, আমেরিকার গদর দল ও জার্মানির ভারত স্বাধীন কমিটি। উক্ত আলোচনার শেষোক্ত পয়েন্টের কারণেই গদর পার্টির সম্পূর্ণ কর্মকান্ডের মধ্যে বিচ্যুতির সৃষ্টি ঘটে।
১৯১৪ সালের বিদ্রোহের সূচনালগ্নে তাদের চিন্তাভাবনা ছিল সিংগাপুর পর্যন্ত এই বিপ্লবকে গতিশীল করে তোলা এবং আফ্রিকা অবধি নিয়ে যাওয়ার চিন্তাও ছিল। ১৯১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের দিকে গদর আন্দোলন ও বিপ্লবে ইংরেজ গোয়েন্দারা ঢুকে পড়লে তারা ভারতের বিপ্লব, স্বাধীনতার জন্য পূর্বপরিকল্পনা সম্পর্কে সচেষ্ট হয়ে যায়। তখন প্রত্যেকটি বিষয়কে নস্যাৎ করে দেয় ব্রিটিশরা এবং সকল মূল নেতাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয়। ‘অ্যানি লারসেন’ অস্ত্র পরিকল্পনার জেরে ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা তাদের চরমপন্থী ও উগ্রবাদী হিসেবে চিহ্নিত করে অনেককে হত্যা করে। আমেরিকায় এই অস্ত্র পরিকল্পনার জন্য সেখানে তাদের লোকদের বিচার করা হয় ‘হিন্দু জার্মান ষড়যন্ত্র’ মামলা এবং ভারতে ব্রিটিশরা তাদের বিচার করে ‘লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা’র দ্বারা। যুক্তরাষ্ট্রে ১৯১৭ সাল নাগাদ বহু হোতাকে আরো গ্রেফতার করে।
বাঙালিদের মধ্যে অন্যতম সাহসী ও প্রাণবন্ত সৈনিক ছিলেন তারকানাথ দাস, যার জন্ম পশ্চিমবঙ্গে। ১৯১১ সালে এমএ পাশ করেন তিনি ওয়াশিংটন থেকে। পরবর্তীতে জার্মান থেকে গদর পার্টি সমর্থন নেওয়ার সময় তিনি বার্লিনের প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। এই ষড়যন্ত্রে ব্রিটিশদের জালে আটকা পড়লে তার ২২ মাসের জেল হয়। তিনি জেলখানায় বসে তার পড়ালেখা চালিয়ে যান এবং জেল থেকে বেরিয়ে তিনি পিএইচডি ডিগ্রী শেষ করেন। সে সময় গদর পার্টির অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়লেও তাদের দেখানো বৈপ্লবিক পথ ধরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় গঠিত হয় ব্রিটিশ বিরোধী সেনাবাহিনীর গ্রুপ, হিন্দ ফৌজ, ইন্দিশ্চে লিজিয়ন, আযাদ হিন্দুস্তান ব্যাটালিয়ন, এবং আজাদ হিন্দ ফৌজ।
১৯১৪ সালের দিকে গদরদের উদ্দেশ্য থাকে তাদের থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়া এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তাদের পক্ষাবলম্বন না করা। এই উদ্দেশ্যে গোপনে যাত্রা হলেও ব্রিটিশরা যেন তাদের কাজকর্মে সন্দেহের চিহ্ন দেখতে পায়।মালয় স্টেটের গাইডকে স্থানান্তরিত করে দেয় পেনাংয়ে। ১৫ অক্টোবর ১৯১৪ সালে সৈন্যদেরকে গোলাবারুদ ও অস্ত্র জমা দেবার নির্দেশ দেন অফিসাররা। কিছু সৈনিক এই আদেশ অমান্য করে সেই রাতেই ব্রিটিশ আর্মির কয়েকজন অফিসারকে গুলি করে হত্যা করে। সাথে সাথে এই খবর ইংল্যান্ডে চলে গেলে ১৮ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ আর্মি এখানে এসে তাদের আটক করে এবং দুই নেতাকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে।
১৯১৫ সালে জানুয়ারি মাসের দিকে রেঙ্গুন ক্যাম্পে বেলুচ রেজিমেন্ট বিদ্রোহ করে। তারা ব্রিটিশদের পক্ষে লড়াই করতে চায়নি। ১৫ জানুয়ারিতে তাদের মুখোমুখী হতে হয় কোর্ট মার্শালের। ৬৯ জনকে আজীবন কারাদন্ড প্রদান করা হয় এবং ৪ জন সৈনিককে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। গদর বাহিনীর অন্যতম সেরা একজন ব্যক্তি ছিলেন পান্ডিত সোহান লাল পাঠান, যাকে মান্দালয় জেলে, ফেব্রুয়ারি ১৯১৬ সালের দিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়।
ডিসেম্বর ১৯১৫ সালে হিন্দুস্থানীদের জন্য বিনামূল্যে নির্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয় আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে। প্রেসিডেন্ট রাজা মহিন্দ্র প্রতাপ, প্রধানমন্ত্রী মৌলবী বারকাতুল্লাহ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মৌলবী ওবায়দুল্লাহ, যুদ্ধমন্ত্রী মৌলবী বশীর প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ ছিলেন এই গদর দলের অর্ন্তভুক্ত। তারা কূটনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করে বিপ্লবের ধারণাকে আরো মজবুত করতে সহায়তা করেন এবং নির্বাসন কেন্দ্রিক সহায়তার আবেদন করেন। জাপান, তুরষ্ক, জার্মানিতে তাদের এই উদ্দেশ্যকে প্রসারিত করে দেন। তুরষ্ককেন্দ্রিক গদর বাহিনীর ব্যক্তিরা ইরান, মেসোপটেমিয়া অঞ্চল এবং বেলুচিস্তানে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছে। তাদের মূল পরিকল্পনা ছিল ইরান হয়ে আক্রমণ করতে করতে বেলুচিস্তানে যাবে, তারপর প্রবেশ করবে পাঞ্জাবে। এজন্য গঠন হয়েছিল ‘ভারত স্বাধীনতা সেনাবাহিনী’। বেলুচিস্তানে পৌঁছলে তারা সেখানকার উপজাতিদের সহায়তায় ব্রিটিশদের দমনে সফল হয়। এদিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় অটোম্যান সাম্রাজ্যের পতন ঘটলে ব্রিটিশরা আরো ভালো সুযোগ পেয়েছিল। তারা তুরস্ক ও ইরান পুনরায় দখল করে নিজেদের আয়ত্ত্বে নিয়ে বসে। আম্বা প্রাসাদ সুফী, সাহসী গদরিয়ান যোদ্ধা ও সৈনিকেরা এই বিপরীত হামলা ঠেকাবার সময় মৃত্যুবরণ করেন। এর মধ্যে তারা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার আগে ব্রিটিশরা পুনরায় দখল করে বসলে গদর পার্টি বিপদের মুখোমুখি হয়।
গদর পার্টি আস্তে আস্তে নিস্তেজ হবার পরেও এই ইতিহাস এক সাহস ও চূড়ান্ত আকাঙ্ক্ষার যোগান সৃষ্টি করে। বিপ্লবের আগে গদর পার্টির একটি খোলা চিঠির কিছু অংশ তুলে ধরা হলো-
ভারতের জনগণের কাছে একটি খোলা চিঠি।
প্রিয় বন্ধুরা,
আপনাদের মনে করিয়ে দিতে হবে না, আপনারা জানেন ব্রিটিশদের শাসনের মধ্যে আমরা কত কষ্ট ভোগ করছি। আমরা সবাই এই বিদেশী সাদা চামড়ার বিশ্বাসঘাতকদের আস্তানা থেকে মুক্তি পেতে চাই। সময় এসেছে যেখানে আমাদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা এই আক্রমণকারীদের জোয়াল ছুঁড়ে ফেলতে সক্ষম হবে। আরেকটি বিশ্বযুদ্ধ এগিয়ে আসছে। আমাদের এই সুযোগ নিতে হবে। আগামী যুদ্ধে জড়িত থাকার ব্যাপারে ইংল্যান্ড নিশ্চিত। আমাদের জন্য এই বিরল সুযোগটি ব্যবহার করতে হবে। আমাদের জীবন-মৃত্যুর সংগ্রামে নিয়োজিত এই বিপ্লব, যেখানে আমাদের স্বাধীনতা ও চাহিদা মুখ্য। জীবন বাঁচানোর জন্য ব্রিটেনের দরকার পড়বে ভারতের বন্ধুত্ব। এই বন্ধুত্বের মূল্য হিসেবে আমরা ভারতের স্বাধীনতা দাবী করছি।
গদর পার্টির আন্দোলন পরবর্তীতে ভারত স্বাধীন হবার একটি আকাঙ্ক্ষা আরো বিশালভাবে জাগিয়ে তোলে, ছড়িয়ে দেয় দর্শন আর আদর্শ, এবং গড়ে তোলে নতুন ভারতের ইতিহাস।