২য় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদী স্বামীদের বাঁচাতে জার্মান নারীদের অভিনব প্রতিবাদ

ছিলেন সাধারণ জার্মান গৃহবধূ। ভালবেসে ইহুদীদের স্বামী হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু কে জানতো নাৎসিদের হাত থেকে তাদের পরিবারও রেহাই পাবে না? সেই ইহুদী স্বামীদের রক্ষার জন্য প্রতিবাদই অস্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন জার্মান রমণীরা। তারপর কী হলো? কীভাবে স্বামীদের উদ্ধার করলেন তারা? সেই অজানা কাহিনী নিয়ে আজকের এই আয়োজন।

হিটলারের নাৎসি বাহিনীর আক্রমণে ইউরোপের একের পর এক দেশ বিধ্বস্ত হচ্ছিলো। দেশগুলো দখলের পর সেখানে অবস্থানরত ইহুদীদের ওপর চালানো হচ্ছিল নারকীয় অত্যাচার। কোনো ইহুদী পরিবারকেই রেহাই দেয়া হচ্ছিলো না। এমনি দুর্বিষহ অবস্থায় জার্মানির বিভিন্ন শহরে বসবাসরত ইহুদীদের অবস্থাও যে খুব একটা ভাল ছিল না, তা বলাই বাহুল্য। তাদেরকেও চেষ্টা করা হয়েছিল কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পাঠানোর, যদি না তাদের জার্মান স্ত্রীরা এই বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধের দেওয়াল তুলে না দিতেন। 

সারা ইউরোপ জুড়ে হিটলারের নাৎসি বাহিনী ইহুদীদের ওপর চালায় বর্বর গণহত্যা; Image Source: wikimedia commons

১৯৪৩ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি। চারদিকে তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে। ফেব্রুয়ারি-মার্চের বার্লিন শহরে তখন বেশ ঠান্ডা। শহরে খুব তুষারপাত হচ্ছে। এই সময়টায় বার্লিনের আবহাওয়া সাধারণত এমনই হয়ে থাকে। প্রচন্ড ঠান্ডার কারণে শহর জুড়ে তেমন কোনো চাঞ্চল্য নেই। কিন্তু শহরের অস্বাভাবিকতা চোখে পড়ছে শুধুমাত্র রোজেনস্ট্রসে থাকা ইহুদীদের এক কমিউনিটি সেন্টারে। সেখানে প্রায় দুই হাজার ইহুদী পুরুষকে ধরে আনা হয়েছে। এ ইহুদিদের কাউকে বাড়ি থেকে, কাউকে অফিস থেকে, আবার কাউকে রাস্তা থেকে তুলে আনা হয়েছে। তারপর ট্রাকে করে তাদের নিয়ে আসা হয় বার্লিন শহর থেকে খানিক দূরে এই কমিউনিটি সেন্টারে।

সে সময়ের রোজেনস্ট্রসের ইহুদী কমিউনিটি সেন্টার; Image Source: wikimedia commons

ক্ষুধায়, তৃষ্ণায় তখন তারা বেশ কাহিল। বাথরুমে যাওয়ার পর্যন্ত কোনো সুযোগ মিলছে না তাদের। হিটলারের ‘থার্ড রাইখ’ এসব ইহুদীদের মানুষই ভাবতেই রাজি না। এসব জার্মান ইহুদীদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হবে? উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় জার্মান সৈন্যরা। কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পাঠানো হবে, না কি কোনো লেবার ক্যাম্পে পাঠানো হবে কঠিন, প্রাণঘাতী পরিশ্রমের জন্য? গেস্টাপোর সদস্যরা অস্থির হয়ে উঠেছিল এদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য।

এসব ইহুদীদের ভাগ্যটা অন্যদের চেয়ে একটু ভালোই বলা যায়। কারণ তারা ‘আর্য’ জার্মান মহিলাদের বিয়ে করেছেন। আবার কারও মা ‘আর্য’ জার্মান। এই ‘আর্য’ মহিলাদের সাথে সম্পর্ক থাকার কারণেই এসব ইহুদীদের এতদিন বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। হিটলারের গেস্টাপো বাহিনী অপেক্ষা করছিল পরবর্তী নির্দেশের জন্য। এর মধ্যেই রোজেনস্ট্রসের সেই কমিউনিটি সেন্টারে ভিড় করতে থাকে সেসব জার্মান গৃহবধূরা। প্রথমদিকে অল্প কয়েকজন এসেছিল শুধুমাত্র তাদের স্বামী, সন্তানদের অবস্থা জানার জন্য। পরে ভিড় বাড়তে থাকে। সঙ্গে তাদের পরিবার-পরিজন। একশো, দেড়শো, দু’শো, পরে একসময় হাজার ছাড়িয়ে গেল রোজেনস্ট্রসের রাস্তায়।স্বামী-সন্তানদের ফিরিয়ে দেয়ার জন্য আকুতি জানাতে লাগলো তারা। 

প্রিয়জনদের কোনো সংবাদ না পেয়ে নানা আশঙ্কায় ভুগছিলো পরিবারগুলো। তারা আরো ভীত হয়ে পড়েছিল হিটলার প্রশাসনের নেয়া ‘ফ্যাক্টরি অ্যাকশন’ এর ফলে। এই ফ্যাক্টরি অ্যাকশনের কারণে প্রায় ১১ হাজারের মতো ইহুদিকে অসউইৎজ ক্যাম্পে পাঠিয়েছিল গেস্টাপোরা। তাই জার্মান গৃহবধূরা ভয়েই ছিলেন। তাদের প্রিয়জনদের জন্যও যদি একই নিয়তি অপেক্ষা করে!

তাদের ইহুদী স্বামী, সন্তানদের যদি অসউইৎজ ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, তবে তাদের যোগাযোগের সব রাস্তাই তো বন্ধ হয়ে যাবে! প্রশাসন থেকে কোনো তথ্য না পাওয়ায় তাদের উদ্বেগ দিন দিন বাড়তে থাকে। তাই নিশ্চিত হওয়ার জন্য একজন, দুজন করে সেই জার্মান গৃহবধূ এবং তাদের পরিবাররা ভিড় জমাতে থাকলেন সেন্টারের সামনে।

বন্দি ইহুদীদের জোরপূর্বক কঠিন সব কায়িক পরিশ্রমে বাধ্য করা হতো; Image Source: timeline.com

প্রথমদিকে জার্মান নারীরা কোনো প্রতিবাদের ভাবনা থেকে রোজেনস্ট্রসের সেই কমিউনিটি সেন্টারে জমায়েত হননি। উদ্দেশ্য ছিল তাদের ইহুদী স্বামী-সন্তানরা কেমন আছে তা জানা, আর পারলে তাদেরকে সেখান থেকে মুক্ত করে বাড়ি নিয়ে যাওয়া। শীতের প্রকোপ উপেক্ষা করে দিন-রাত সেই কমিউনিটি সেন্টারের রাস্তায় পড়ে থাকতেন সেই জার্মান বধূরা।

কখনো রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকে কমিউনটি সেন্টারের সামনে জার্মান বাহিনীর কাছে আকুতি করা, আবার কখনো রাস্তায় বসে অপেক্ষা করা ছাড়া তাদের আর কিছু করার ছিল না। দিনের অধিকাংশ সময় নীরবে চোখের পানি ফেলা আর মাঝে মাঝে স্বামী-পুত্রকে ফিরিয়ে দেওয়ার স্লোগান সম্বলিত দাবী জানাতেন তারা। তারপরও জার্মান প্রশাসন থেকে কোনো সংবাদই দেয়া হচ্ছিলো না।

ফলে ধীরে ধীরে ক্ষোভ বাড়তে থাকে। জার্মান গৃহবধূদের এই জমায়েতের খবর তখন ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বজুড়ে। জার্মান সমাজে এর প্রভাবও পড়তে থাকে। ফলে কমিউনিটি সেন্টারের চারপাশে কাঁটাতারের বেড়া বসানো হলো। সশস্ত্র সেনাদের টহলও বাড়ানো হতে থাকে। সাথে সাথে প্রতিবাদকারীদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। এবার জার্মান সেনারা ভয় দেখানোর জন্য নিরস্ত্র মহিলাদের দিকে সরাসরি মেশিনগান তাক করলো। মাইকে ঘোষণা করা হলো রাস্তা খালি করে দেওয়ার জন্য। সবাইকে বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য বলা হলো, না হলে গুলি চালানো হবে বলে ভয় দেখানোর চেষ্টা করা হলো। কিন্তু এই ঘোষণায় ফল হলো উল্টো। হাজারো নারী কন্ঠে আওয়াজ উঠলো, “খুনি, খুনি…”।

জার্মান বাহনীর সাথে জার্মান প্রোপাগান্ডা-মন্ত্রী জোসেফ গোয়েব্‌লস; Image Source: jspacenews.com

খবর পেয়ে প্রমাদ গুনলেন জার্মান প্রোপাগান্ডা-মন্ত্রী গোয়েব্‌লস। মধ্য বার্লিনের রাস্তায় জার্মান সেনাদের হাতে এসব জার্মান গৃহবধূর রক্ত ঝরার ফল কী হবে তা ভেবে অস্থির হয়ে পড়লেন তিনি। এদিকে বিভিন্ন জায়গায় মিত্রবাহিনীর কাছে জার্মান সেনাদের পরাজিত হওয়ার খবর আসছে। এরই মধ্যে প্রায় ১০ লক্ষ জার্মান সেনার মৃত্যু হয়েছে। এ মুহূর্তে নিজ দেশের খাঁটি জার্মানদের ওপর গুলি চালালে এর ফল যে ভয়াবহ হবে তা বেশ বুঝতে পেরেছিলেন গোয়েব্‌লস। তাই তিনি কোনো ঝুঁকি নিতে চাইলেন না।

বন্দিদের মুক্তি দেয়ার নির্দেশ দিলেন গোয়েব্‌লস। তবে পরে সুযোগ মতো এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, মুক্তি দেয়ার পূর্বে এই ইহুদীদের পরিচয় খাতায় লিখে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। ১২ মার্চের মধ্যে ২৫ জনকে বাদ দিয়ে বাকি সব বন্দীকে মুক্তি দেয়া হয়। ঐ ২৫ জনকে পাঠিয়ে দেয়া হয় অসউইৎজ ক্যাম্পে। মুক্তি পাওয়ার পর ইহুদি স্বামী-সন্তানদের নিয়ে বাড়ি ফিরলেন জার্মান মহিলারা। প্রতিবাদের এক অসাধারণ নজির স্থাপন করলেন তারা।

রোসেনস্ট্রসে জার্মান গৃহবধূদের নীরব প্রতিবাদ; Image Source: you tube

রোসেনস্ট্রস প্রতিবাদে সাফল্য এক অপ্রিয় সত্য উঠে আসে, নাৎসিদের নির্মমতায় কেন জার্মানরা মুখ ‍বুজে ছিল? নাগরিক সমাজ কেন প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে ফেলেছিল? যদি জার্মান নাগরিক সমাজ প্রতিবাদমুখর হতো, তাহলে হলোকাস্টের মতো ঘটনা এড়ানো যেত বলে অনেকেই মনে করেন।

আরেকপক্ষ মনে করেন, সেসময় জার্মান প্রশাসন অত্যন্ত কৌশলে জার্মান সমাজে ইহুদীদের বিরুদ্ধে একধরনের প্রোপোগন্ডা চালাতে থাকে। ইহুদী সাহিত্যের প্রতি অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা, সামরিক বাহিনী, গির্জা ও বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে ইহুদীদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের প্রোপাগন্ডা চালাতে থাকে হিটলারের অনুসারীরা। সবার মাঝে ইহুদীদের বিরুদ্ধে একধরনের ক্ষোভ উসকে দেয়ার চেষ্টা করা হয়। এর ফলে সাধারণ জার্মান সমাজ ও নাগরিকদের মধ্যে ইহদীদের প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মায়। এই সুযোগই নেয় হিটলার আর তার বাহিনী।

১৯৩৩ সালে থার্ড রাইখের উত্থানের ফলে অনেক জার্মানের মধ্যে ইহুদীদের প্রতি অবিশ্বাস তৈরি হতে থাকে। তখন অনেক ইহুদী-জার্মানদের মধ্যকার বৈবাহিক সম্পর্কও ভাঙতে থাকে। পরবর্তীতে সেসব ইহুদীকে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পাঠানোর ব্যবস্থা করে হিটলারের গেস্টাপো বাহিনী।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এক তথ্য হতে জানা যায়, জার্মানির অভ্যন্তরে যে ইহুদীরা বেঁচে গিয়েছিলেন, তাদের ৯৮%-ই জার্মান-ইহুদী মধ্যকার বৈবাহিক সম্পর্কের কারণে রক্ষা পেয়েছিলেন। জার্মান গৃহবধূদের প্রতিবাদ আর সাহসের ফলেই তাদের ইহুদী স্বামী-সন্তানেরা রক্ষা পেয়েছিলেন।

সে সময়ের রোসেনস্ট্রস এখন নতুন রূপে; Image Source: wikimedia commons

জার্মান ঐতিহাসিক হান্স মোমসেন মনে করেন, কোনো প্রতিরোধই সফল হয় না জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছাড়া। জার্মানিতে প্রায় ৭৭,০০০ জার্মান নাগরিক বিভিন্ন সময়ে হিটলারের বাহিনীর হাতে নিহত হয়। নাগরিক সমাজের মধ্যে কোনো প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ না হওয়ার কারণে হিটলার এতটা নির্মম হতে পেরেছিলেন বলে তিনি মনে করেন।

রোসেনস্ট্রসের সেই কমিউনিটি সেন্টার এখন আর নেই। তবে সেই ঐতিহাসিক ঘটনাকে জার্মানদের স্মৃতিতে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য ১৯৯৫ সালে সেই স্থানটির কাছাকাছি একটি পার্কে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। জার্মান ভাষায় এর নাম ‘Block der Frauen’, যার অর্থ ‘নারীদের প্রতিরোধ’।     

রোসেস্ট্রসে ঘটে যাওয়া জার্মান নারীদের সেই আন্দোলনকে স্মরণীয় করে রাখতে নির্মিত হয় এক স্মৃতিস্তম্ভ; Image Source: Wikimedia commons

স্মৃতিস্তম্ভের শিলালিপিতে লেখা রয়েছে,

“প্রিয়জনের প্রতি ভালবাসায় উৎসারিত হয়ে একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন জার্মান মহিলারা, দেখিয়ে দিয়েছিলেন সাধারণ নাগরিক সমাজের শক্তি। এখানেই তারা আওয়াজ তুলেছিলেন, “ফিরিয়ে দাও আমাদের প্রিয়জনদের।” তাদের প্রতিবাদে একনায়কতন্ত্রের ভিত নড়ে গিয়েছিল এবং মুক্তি পেয়েছিল তাদের ইহুদী স্বামী-সন্তানেরা।”

ফিচার ইমেজ- Berlino Magazine

Related Articles

Exit mobile version