.jpeg?w=1200)
ক্রিকেট কিংবা ফুটবলসহ পৃথিবীর সকল জনপ্রিয় খেলাই বিশ্বের বিভিন্ন স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। বার্সেলোনার ন্যু ক্যাম্প বা ইংল্যান্ডের লর্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ডের মতো স্টেডিয়ামগুলোর সাথে খেলাগুলোর ঐতিহ্য জড়িয়ে আছে, বিভিন্ন ঐতিহাসিক মুহুর্তের সাক্ষী এই স্টেডিয়ামগুলো। শুধু গতানুগতিক খেলাধুলা আয়োজনের মধ্যে আটকে নেই এসব, ‘দর্শনীয় স্থান’ হিসেবে এগুলোতে প্রতিবছর হাজার হাজার পর্যটক ভ্রমণ করে থাকেন। এসব স্থানে যখন কেউ যখন দুর্দান্ত ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স উপহার দেন, তখন সেগুলো আলাদাভাবে মূল্যায়িত করা হয়। যেমন- কেউ যদি লর্ডসে সেঞ্চুরি করেন কিংবা কেন ফুটবলার যদি ন্যু ক্যাম্পে গিয়ে হ্যাটট্রিক করে বসেন, নিশ্চিতভাবেই এসব ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সকে আর আট-দশটা পারফরম্যান্সের তুলনায় আলাদা নজরে দেখা হবে।
স্টেডিয়াম বা সেই ধরনের স্থাপনাগুলোতে গিয়ে একসাথে অনেকজন মানুষের একত্রে বসে খেলা দেখা বা দর্শনীয় কিছু উপভোগ করার ধারণা একেবারে নতুন কিছু নয়। প্রাচীনকাল থেকেই এটি হয়ে আসছে। প্রাচীন রোমে স্টেডিয়াম-ঘরানার স্থাপত্যে জড়ো হয়ে একসাথে প্রায় পঞ্চাশ হাজার মানুষ গ্লাডিয়েটরদের সাথে হিংস্র পশুদের রোমাঞ্চকর লড়াই উপভোগ করতো। জ্বি, ঠিক পড়েছেন। আজ থেকে প্রায় দুই হাজার বছর আগে পঞ্চাশ হাজার মানুষ একসাথে বসে শিকার কিংবা লড়াই উপভোগ করতে পারতেন– অবিশ্বাস্য হলেও এটাই সত্যি। আজকে থেকে দুই হাজার বছর আগে বিজ্ঞানের খুব বেশি অগ্রগতি ছিল না, বিজ্ঞান তখনও মানবজীবনে খুব বেশি প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। তখনকার প্রযুক্তি খুব বেশি উন্নত ছিল না। তারপরও একটি অভিন্ন স্থাপনায় পঞ্চাশ হাজার মানুষকে জায়গা দেয়া এবং কোনো দুর্ঘটনা ছাড়াই প্রায় পাঁচশো বছর কাজ চালিয়ে যাওয়া– রোমানরা বিখ্যাত কলোসিয়ামের মাধ্যমে সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছিল।

একটু ইতিহাসের দিকে তাকানো যাক। “রোম যখন পুড়ছিল, নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিল“– এ রকম একটি প্রবাদের সাথে আমরা প্রায় সবাই পরিচিত। প্রবাদের এই নিরো ছিলেন রোম সাম্রাজ্যের সবচেয়ে ইস্পাত-দৃঢ় নেতাদের একজন, সম্রাট নিরো। প্রবাদে যেরকম বলা হয়েছে যে, রোম নগরী যখন পুড়ছিল তখন তিনি বাঁশি বাজাচ্ছিলেন– এটা নিয়ে বেশ বড় বিতর্ক রয়েছে। আমরা সেদিকে যাচ্ছি না। বাস্তবে সম্রাট নিরো ছিলেন একজন প্রচন্ড ক্ষমতালোভী ব্যক্তি। সিংহাসনে বসার ক্ষেত্রে তার আপন ভাই ব্রিটানিকাস বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে– এই ধরনের অনুমান থেকে তিনি তার আপন ভাইকে বিষপ্রয়োগের মাধ্যমে সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা করেন। পরবর্তীতে মায়ের সাথে ঝামেলা হওয়ায় তিনি তার মাকেও হত্যা করেন। কিন্তু তার অত্যাচারী শাসনে রোমের সিনেট একসময় তাকে জনগণের শত্রু হিসেবে আখ্যায়িত করে, তিনি প্রাসাদ ছেড়ে পালিয়ে যান। পরবর্তীতে মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে আত্মহত্যার মাধ্যমে তার জীবনাবসান ঘটে।
সম্রাট নিরোর শাসনামলে রোমান জনগণের তীব্র জনরোষ থেকে বেশ কয়েকটি গৃহযুদ্ধ বেধে যায় এবং নানা চড়াই-উতরাই পাড়ি দিয়ে শেষপর্যন্ত ভেসপাসিয়ান নামের একজন ব্যক্তি রোম সাম্রাজ্য শাসনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সম্রাট নিরোর পরিণতি থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন সম্রাট ভেসপাসিয়ান রোমান জনগণের সন্তুষ্টি অর্জন ও সাম্রাজ্যের হারানো খ্যাতি ফিরিয়ে আনার জন্য বেশ কিছু স্থাপনা তৈরির ঘোষণা দেন। এসবের মধ্যে একটি ছিল এমন একটি বিনোদনের স্থান তৈরি করা যেখানে হাজার হাজার মানুষ একত্রে কোনোকিছু উপভোগ করতে পারবে। সম্রাট নিরোর তৈরি ‘গোল্ডেন প্যালেস’-এর সামনে বিশাল জায়গা জুড়ে বাগান ও নহর ছিল। সোনালি প্রাসাদের সামনে বাগানের জায়গাটিই প্রস্তাবিত কলোসিয়াম তৈরির স্থান হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। এরপর ৭২ খ্রিস্টাব্দে পূর্ণোদ্যমে নির্মাণকাজ শুরু করা হয়।

বিখ্যাত এই স্থাপনার পরিকল্পনাকারী কে ছিলেন– এটা আসলে জানা যায়নি। নির্মাণের জন্য সবকিছু গাণিতিকভাবেই নির্ধারণ করা হয়েছিল। ধারণা করা হয়, পুরো স্থাপনায় প্রবেশের জন্য মোট আশিটি দরজা রাখা হয়েছিল, যা মধ্যে ছিয়াত্তরটি দরজা দিয়ে সাধারণ মানুষেরা প্রবেশ করতে পারত। বাকি চারটি দরজার মধ্যে দুটি ছিল সম্রাটের জন্য সংরক্ষিত, আরেকটি দিয়ে বিজয়ী সৈন্যরা কলোসিয়াম ত্যাগ করতেন, অপরটি দিয়ে হিংস্র পশুর মৃতদেহ কিংবা পরাজিত/নিহত সৈন্যদের লাশ সরিয়ে ফেলা হতো। কলোসিয়ামের ভেতরে যেখানে গ্ল্যাডিয়েটররা যুদ্ধে লিপ্ত হতেন, তার মেঝেতে বালির পুরু স্তর রাখা হয়েছিল, যাতে করে তা রক্ত শুষে নিতে পারে। যেখানে খেলা কিংবা লড়াই অনুষ্ঠিত হতো, তার সবচেয়ে কাছাকাছি থাকতো সম্রাট ও তার পরিবারের সদস্যরা। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী অনুযায়ী আসনের ক্ষেত্রেও তারতম্য ছিল। প্রায় পঁয়তাল্লিশ হাজার দর্শকের জন্য বসার ব্যবস্থা ছিল, আর বাকি পাঁচ হাজার দর্শককে দাঁড়িয়ে থাকতো হতো।
সম্রাট ভেসপাসিয়ানের সময় নির্মাণকাজ শুরু হলেও তার সন্তান সম্রাট টিটাসের সময় নির্মাণকাজ শেষ হয়। টানা একশো দিন বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজনের মধ্য দিয়ে এই স্থাপত্যের রাজকীয় উদ্বোধন সম্পন্ন হয়। সম্রাট টিটাসের সময় একেবারে সমস্ত নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়নি, কিছু বাকি কাজ পরবর্তীতে তার ভাই ডমিটিয়ানের শাসনামলে গিয়ে শেষ হয়। কলোসিয়ামের সামনে সম্রাট নিরোর একটি মূর্তি প্রায় চারশো বছর টিকে ছিল। কলোসিয়ামের ক্ষেত্রে সবচেয়ে যে বিষয়টি ইতিহাসে চেপে যাওয়া হয়, তা হলো এটি নির্মাণের জন্য প্রায় ষাট হাজার ইহুদি শ্রমিককে রাত-দিন খাটানো হয়। এ জন্যই পঞ্চাশ হাজার মানুষ ধারণক্ষমতার একটি স্থাপনা সেসময়ে মাত্র এক যুগেরও কম সময়ে নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়।
কলোসিয়ামের জন্য পশু আনা হতো সুদূর আফ্রিকা থেকে। গ্ল্যাডিয়েটরদের সামনে হিংস্র পশু, যেমন- লেপার্ড, গন্ডার, সিংহ কিংবা হাতি ছেড়ে দেয়া হতো। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, যারা এসব হিংস্র পশুদের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে সমর্থ হতো, তারা সমাজে বীরের মর্যাদা লাভ করতো। মানুষ বনাম পশু ছাড়াও অনেক সময় দন্ডপ্রাপ্ত আসামীকে ভয়ংকর পশুদের সামনে ছেড়ে দিয়ে নির্মমতার সাথে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হতো। শিকারের জন্যও কলোসিয়াম ব্যবহার করা হতো বলে জানা যায়। এমনকি বিনোদনের জন্য সেখানে একদিনে হাজারেরও অধিক পশু হত্যা করা হয়েছে বলে জানা যায়।

মানুষের রুচি ও সময়ের পরিবর্তনের ফলে ৪০৪ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট অনারিয়াস কলোসিয়াম বাতিল ঘোষণা করেন। কিন্তু তারপরও পরবর্তী এক শতাব্দী ধরে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির শাস্তি কার্যকর করার জন্য কলোসিয়ামকে ব্যবহার করা হয়েছে। ৪২২ সালের ভূমিকম্পে এটি বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং সম্রাট দ্বিতীয় থেওডোসিয়াস ও সম্রাট তৃতীয় ভ্যালেন্টাইনিয়ান একে সংস্কার করে পুনরায় ব্যবহারোপযোগী করে তোলেন। দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত থাকার পর বারো শতাব্দীতে গিয়ে অ্যানিবাল্ডি পরিবার ও ফ্রাঞ্জিপানি পরিবারের দূর্গ হিসেবে ব্যবহৃত হয় এটি। কিন্তু পরবর্তীতে ভূমিকম্পের কারণে স্থাপনার বিভিন্ন অংশ ভেঙে পড়ে।
ইতালিতে রেঁনেসা শুরু হলে এটি আবার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে এবং পর্যটকেরা ইতালির বিভিন্ন স্থাপনার পাশাপাশি এখানেও ভ্রমণ করতে শুরু করেন। সেসময়ের পোপ এর যেকোনো ধ্বংসাবশেষ নেওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। পরবর্তীতে ইতালির বিভিন্ন সরকার এই মহামূল্যবান স্থাপত্য সংরক্ষণের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্যোগ নেয়। ১৯৯০ সালের দিকে একে সংস্কারের মাধ্যমে আরও দর্শনীয় করে তোলা হয়। এটি বিশ্বের সপ্তাশ্চর্যের একটি হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। বর্তমানে প্রতিবছর লাখ লাখ পর্যটক এই স্থাপত্য দেখতে যান।

কলোসিয়াম কারও কাছে ছিল নিছক বিনোদনকেন্দ্র, আবার কারও কাছে ছিল মানবতা ভূলুন্ঠনের জায়গা। আসামীদের অত্যন্ত নির্মম কায়দায় মেরে ফেলা হতো এখানে, যার মাধ্যমে অন্যান্য রোমান অধিবাসীদেরও সতর্কবার্তা দেয়া হতো। রোমানরা সেই সময়েই এই একটি স্থাপনার মাধ্যমে পৃথিবীবাসীর সামনে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ দিয়েছিল।