মধ্যযুগের কবি কিংবা নাইটদের থেকে শুরু করে বর্তমান যুগের ইতিহাসবিদ, প্রত্নতত্ত্ববিদ, ঔপন্যাসিক, চলচ্চিত্র পরিচালক কিংবা নাৎসি নেতা, সবার মধ্যেই একটি সাধারণ জিনিস হলো এরা সবাই ছুটেছেন হলি গ্রেইলের পেছনে। কিন্তু হলি গ্রেইল জিনিসটা আসলে কী, এর আকার কেমন, এমনকি এটা কি আদৌ পৃথিবীতে রয়েছে কি না, তা নিয়ে এখনো পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়নি।
হলি গ্রেইল নিয়ে সবচেয়ে জনপ্রিয় ধারণাটি হলো, এটি হচ্ছে একধরনের পানপাত্র যা যিশুখ্রিস্ট তার ‘লাস্ট সাপারে’ ব্যবহার করেছিলেন। এমন বিশ্বাসও রয়েছে, পরবর্তীতে এতে যিশুর রক্তও সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছিল। হলি গ্রেইলের পেছনে ছোটা মানুষেরা একে নিয়ে গিয়েছে পবিত্র ভূমি থেকে ইউরোপে, এমনকি ব্রিটেনেও নাকি হলি গ্রেইল ইতিহাসের কোনো একসময়ে ছিল। একে রক্ষা করতে গঠন করা হয়েছিল বিভিন্ন গোপন সংগঠন, এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত বোধহয় ফিশার কিং এবং নাইটস টেম্পলাররা।
এই পবিত্র ও ক্ষমতাধর জিনিসটির সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে বিভিন্ন কল্পিত ইতিহাস, গুজব, অতিপ্রাকৃত জিনিস আর কন্সপিরেসি থিওরিস্টদের আজগুবি তত্ত্ব। তাই বিভিন্ন গুজব আর কল্পকাহিনী থেকে আসল সত্যগুলো আলাদা করে দেখে নেওয়া দরকার, হলি গ্রেইল আসলে কী?
কিংবদন্তীর জন্ম
যিশুর ব্যবহৃত জিনিস নিয়ে পশ্চিমা ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের আগ্রহ কম নয়। বিভিন্ন ক্যাথলিক গির্জা দাবি করে, তাদের কাছে আছে ক্রুশবিদ্ধ করার পর যিশুর দেহ থেকে খুলে নেওয়া চামড়া, আবার অনেকে দাবি করেন তাদের কাছে ক্রুশবিদ্ধ করার সময় ব্যবহৃত পেরেকগুলোও রয়েছে। তবে এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো অধরা হলি গ্রেইল।
হলি গ্রেইল নিয়ে এত মাতামাতি করার কারণ বোধহয় এর আসল আকৃতি, এর অবস্থান কিংবা এর অস্তিত্ব নিয়ে ধোঁয়াশাপূর্ণ ধারণা। খ্রিস্টানদের মধ্যে একটি খুবই জনপ্রিয় বিশ্বাস হলো লাস্ট সাপারের সময় যিশু একে পানপাত্র হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন, এবং যিশু যখন ক্রুশবিদ্ধ হচ্ছিলেন তখন অ্যারিম্যাথিয়ার জোসেফ এই পানপাত্রে যিশুর রক্ত ভরে রেখেছিলেন।
লাস্ট সাপারের সময় ব্যবহৃত এই বিখ্যাত পানপাত্রের উল্লেখ রয়েছে ম্যাথিউ, মার্ক এবং লুকের গসপেলে, যা ইতিহাসবিদদের মতে লেখা হয়েছিল ৮০ থেকে ১০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে। তবে হলি গ্রেইল খ্রিস্টানদের মধ্যে জনপ্রিয় হয় আরো ১ হাজার বছর পর, যখন এর সাথে রাজা আর্থারের গল্পগুলো মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।
লিখিত আকারে হলি গ্রেইলের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ফরাসি কবি দ্য ত্রোয়েসের কবিতায়। ১১৮০ এর দশকে লেখা এই অসম্পূর্ণ কবিতায় কবি উল্লেখ করেছেন, পারসিফাল, রাজা আর্থারের একজন নাইট, ফিশার কিংদের (গ্রেইল রক্ষাকারী বিশ্বস্ত গুপ্তসংঘ) আস্তানায় গিয়ে বিভিন্ন গোপন জিনিসের সন্ধান পায়, যার মধ্যে রয়েছে একটি ‘graal’।
১১৯১ থেকে ১২০২ এর মধ্যবর্তী সময়ে আরেক ফরাসি কবি রবার্ট ডি বোরোঁ তার জোসেফ ডি অ্যারিমাথিয়ে কবিতায় উল্লেখ করেছেন ক্রুশবিদ্ধ করার সময় যিশুর রক্ত হলি গ্রেইলে বোতলবন্দী করার ঘটনা। অর্থাৎ জোসেফ হচ্ছে হলি গ্রেইলের প্রথম প্রধান রক্ষাকর্তা।
ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথমদিকে জার্মান কবি ওলফ্রাম ফন এশেনবাখ তার Parzival কবিতায় তুলে ধরেছেন পারসিভাল নামক এক নাইটের কথা, যে হলি গ্রেইল উদ্ধার করার জন্য এক দুঃসাহসিক অভিযানে নেমেছে। ঐ একই সময়ে ওয়েলসের বিভিন্ন জায়গায় হলি গ্রেইল ও রাজা আর্থারকে নিয়ে বিভিন্ন কাব্যোপন্যাস লেখা হয়, যা পরবর্তীতে স্যার থমাস ম্যালোরি ইংরেজিতে রূপান্তর করেন। তারপর থেকে বিভিন্ন গল্প-উপন্যাসে বারবার উঠে এসেছে এই রহস্যময় জিনিসটির কথা। টেনিসন, স্পিলবার্গ কিংবা ড্যান ব্রাউন, কারও গল্পে কি তাহলে সামান্য সত্যের ছায়া আছে?
দ্য গ্রেইল ট্রেইল
গুজব রয়েছে, ক্রুসেডের সময় সারাসেন বাহিনী যখন জেরুজালেমে প্রবেশ করে, তখন নাইটস টেম্পলাররা এটি নিয়ে পালানোর সময় হারিয়ে ফেলে। পরবর্তীতে একে কোনোভাবে উদ্ধার করে ব্রিটেনে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে হলি গ্রেইলকে নিয়ে গুজবের অভাব নেই। পৃথিবীজুড়ে কম করে হলেও ২০০টি গির্জা এবং জাদুঘর দাবি করেছে যে তাদের কাছে রয়েছে আসল ‘হলি গ্রেইল’! ড্যান ব্রাউনের ‘দ্য ভিঞ্চি কোড’ উপন্যাসে উল্লেখিত রোসালিন চ্যাপেলে রক্ষিত তথাকথিত ‘হলি গ্রেইল’ দেখতে বছরে প্রায় দেড় লক্ষাধিক মানুষ এখানে ভিড় জমায়।
স্পেনের ব্যাসিলিকা অব স্যান ইসিদিরোতে রয়েছে এমন একটি গ্রেইল, যেটিকে স্প্যানিশ লেখক মার্গারিটা তোরেস তার ‘দ্য কিংস অফ দ্য গ্রেইল’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন আসল গ্রেইল হিসেবে। দাবি করা হয়, মধ্যযুগীয় সময়ে এই গ্রেইল কায়রোতে মুসলিমদের কাছে ছিল। পরবর্তীতে মিশরের দুর্ভিক্ষের সময় আন্দালুসের আমির সাহায্য করলে তাকে এই গ্রেইল হস্তান্তর করা হয়। তারও পরে শান্তিচুক্তির প্রতীক হিসেবে আন্দালুসিয়ার শাসক রাজা প্রথম ফার্দিন্যান্দের কাছে এই গ্রেইল হস্তান্তর করে, যা বর্তমানে স্পেনে রয়েছে। কার্বন ডেটিং থেকে জানা যায়, এই পানপাত্র তৈরি করা হয়েছে খ্রিস্টপূর্ব ২০০ অব্দ থেকে ১০০ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে।
এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে অবস্থিত মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অব আর্ট জাদুঘর, স্পেনের ভ্যালেন্সিয়া ক্যাথেড্রাল, ইতালির স্যান লরেঞ্জো ক্যাথেড্রাল, ফ্রান্সের চ্যাটু ডি মন্টসেগুর সহ অসংখ্য গির্জা দাবি করে তাদের কাছে রক্ষিত পানপাত্রটিই আসল হলি গ্রেইল!
আভালোনে হলি গ্রেইল
কিংবদন্তী অনুযায়ী, প্রথম শতাব্দীর দিকে অ্যারিম্যাথিয়ার জোসেফ হলি গ্রেইল সাথে নিয়ে ইংল্যান্ডে আসেন। ইংল্যান্ডের সমারসেটে নৌকায় এসে সেখান থেকে পায়ে হেঁটে ‘গ্লাস্টোনবুরি তোর’ দ্বীপে যান। আর্থারিয়ান উপকথা অনুযায়ী, এই দ্বীপের নাম আভালোন। হেঁটে ক্লান্ত জোসেফ তার জিনিসপত্র মাটির নিচে পুঁতে রেখে ঘুমিয়ে পড়েন। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখেন, সেখানে একটি বিশাল গাছ জন্ম নিয়েছে, বর্তমানে যেটি পরিচিত গ্লাস্টোনবুরি থর্ন নামে।
এরপর জোসেফ স্থানীয়দের মধ্যে খ্রিস্টান ধর্মপ্রচার শুরু করেন। তার প্রচারের ফলে সেখানকার স্থানীয় সবাই খ্রিস্টানে পরিণত হন। ৬০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে ইংল্যান্ডের প্রথম খ্রিস্টান রাজা হন এথেলবার্ট। কিংবদন্তী অনুযায়ী, হলি গ্রেইল এরপর পাতালে চলে যায়, এবং পরবর্তীতে রাজা আর্থার আর তার নাইটরা তা উদ্ধার করে।
এই গল্প নিয়ে কোনো উল্লেখযোগ্য রেকর্ড পাওয়া না গেলেও, এই কাহিনি বিখ্যাত হয় যখন রবার্ট ডি বোরোন তার জোসেফ ডি অ্যারিম্যাথিয়া কবিতায় এটি উল্লেখ করেন।
ব্যবসার জন্য তৈরি কাহিনী
গ্রেইল হচ্ছে কবিদের মস্তিষ্কপ্রসূত আবিষ্কার, আর এটা কখনোই খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেমনটা পাওয়া যাবে না হ্যারি পটারের ‘গোল্ডেন স্নিচ’। – রিচার্ড বারবার, ‘হলি গ্রেইল – দ্য হিস্ট্রি অব আ লিজেন্ড’-এর লেখক
গত দুই শতাব্দী ধরে হলি গ্রেইলের কিংবদন্তী আরো মুখরোচক হচ্ছে, সাধারণ জনগণকে আকৃষ্ট করার জন্য তৈরি করা হচ্ছে কল্পিত ইতিহাসসমৃদ্ধ বই ও চলচ্চিত্র। অনেক ইতিহাসবিদের মতে, শুধুমাত্র ব্যবসা করার উদ্দেশ্যে লেখক আর ফিল্মমেকাররা হলি গ্রেইলকে ব্যবহার করছেন।
১৯৭৫ সালে তৈরি ‘মন্টি পাইথন অ্যান্ড দ্য হলি গ্রেইল’ মুভিতে দেখা যায় রাজা আর্থারের নাইটরা হলি গ্রেইলের পেছনে দৌড়ে বেড়াচ্ছেন, আর তাদেরকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে বিভিন্ন বিপদ আর বাধা-বিপত্তি। এর ঠিক ৬ বছর পর বের হওয়া ‘এক্সক্যালিবার’ মুভিতে দেখা যায় পারসিফাল হলি গ্রেইল খুঁজে বের করে এবং তা থেকে অসুস্থ রাজা আর্থারকে পান করতে দেয়। ফলে রাজা আর্থার সুস্থ হয়ে ওঠেন। ১৯৮৯ সালে মুক্তি পাওয়া বিখ্যাত মুভি ‘ইন্ডিয়ানা জোনস অ্যান্ড দ্য লাস্ট ক্রুসেড’ মুভিতে দেখা যায় হলি গ্রেইলের পেছনে ছোটা নাৎসি বাহিনী আর প্রত্নতত্ত্ববিদ হ্যারিসন ফোর্ডের লড়াই। হলি গ্রেইলের কল্পকাহিনী ব্যবহার করে এই মুভি বক্স অফিস থেকে আয় করে নিয়েছিল ৪৭৪ মিলিয়ন ডলার!
তবে হলি গ্রেইলকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছেন সম্ভবত ড্যান ব্রাউন। তিনি একজন রহস্য রোমাঞ্চ লেখক। তার লেখা ‘দ্য ভিঞ্চি কোড’ উপন্যাসে হলি গ্রেইলকে নিয়ে লেখা কাহিনীর পুরোটাই কল্পনাপ্রসূত। ব্রাউন দাবি করেছেন, হলি গ্রেইল কোনো পানপাত্র নয়, বরং হচ্ছে ম্যারি ম্যাগদালেন নামক একজন নারী। যদিও এই বইটির অনেক উপাদানই এসেছে ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত হওয়া লিন পিকনেটের ‘দ্য টেম্পলার রেভেলেশন’ এবং ১৯৮২ সালে প্রকাশিত হওয়া হেনরি লিংকন ও রিচার্ড লেইয়ের ‘দ্য হলি ব্লাড অ্যান্ড দ্য হলি গ্রেইল’ বই দুটি থেকে। এই বইয়ে উল্লেখ করা প্রায়োরি অব সাইওনের মতো গুপ্ত সংগঠনের দাবিও ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন ইতিহাসবিদরা।
তবে সত্য-মিথ্যা, কল্পনা-বাস্তবতা যা-ই হোক, হলি গ্রেইল মানুষকে আগ্রহী করে এতে কোনো সন্দেহ নেই।