.jpeg?w=1200)
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষাংশেই শুরু হয়ে যায় পারমাণবিক প্রতিযোগিতা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যারা ছিল একে অপরের মিত্র, যুদ্ধ শেষ না হতেই তারা আর একে অপরের উপর আস্থা হারাতে থাকল। কড়া নজর রাখতে শুরু করল একে অপরের উপর। লেলিয়ে দিল গুপ্তচর।
সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের আবিষ্কৃত প্রথম পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় ১৯৪৯ সালের ২৯ আগস্ট। এটি ছিল RDS-1 নামক একটি প্লুটোনিয়াম বোমা। এর মাধ্যমে রুশরা বিশ্বের দ্বিতীয় পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এর আগে ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট জাপানের হিরোশিমায় পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র ছিল বিশ্বের প্রথম পারমাণবিক শক্তিধর দেশ।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পারমাণবিক পরীক্ষার ঘটনায় বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায় পুরো বিশ্ব। পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে এটা ছিল যেন এক মহাবিস্ময়। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক প্রকল্প ছিল বিশ্বের সবচেয়ে গোপন প্রকল্পগুলোর মধ্যে অন্যতম, যার তথ্য অন্য কোনো দেশের হাতে পড়ার সম্ভাবনাই ছিল না। সিআইএ-এর হাতে যে তথ্য ছিল, সেই অনুযায়ী ১৯৫৩ সালের আগে সোভিয়েতের পারমাণবিক প্রযুক্তিধর হওয়ার কোনো সম্ভবনাই ছিল না। কিন্তু তাহলে তারা কীভাবে পরীক্ষামূলক পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটাল?
সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, সোভিয়েত ইউনিয়নকে পারমাণবিক বোমার প্রযুক্তি দিয়ে যিনি সাহায্য করেন, তিনি একজন আমেরিকান বিজ্ঞানী! তিনি ম্যানহাটান প্রজেক্টের এক জুনিয়র বিজ্ঞানী, নাম থিওডোর হল।

অবশ্য থিওডোর হল একাই সাহায্য করেননি। আরো অনেককেই এক্ষেত্রে সোভিয়েত ইউনিয়নকে সাহায্য করে। কিন্তু হল তার ‘অপরাধ’-এর জন্য অন্য সবার মতো বিচারের সম্মুখীন হননি। এই দেশদ্রোহী অপরাধ করেও তিনি খুব ভালোভাবেই ছাড় পেয়ে যান। মজার ব্যাপার হচ্ছে, নিউ ইয়র্কে জন্ম নেওয়া এবং হার্ভার্ডে পড়া এই বিজ্ঞানী কীভাবে একজন রুশ গুপ্তচরে পরিণত হলেন!

থিওডোর হলের জন্ম ১৯২৫ সালের ২০ অক্টোবর। তার বাবা ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। তিনি এমন একটা সময়ে বেড়ে ওঠেন যখন সাধারণ আমেরিকানদের দিনাতিপাত করতে হত অনেক কষ্টে। কিন্তু এই কঠিন পরিস্থিতি হলের মেধার বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করতে পারেনি। গণিত এবং পদার্থবিদ্যায় ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী। মাত্র ১৬ বছর বয়সেই তিনি হার্ভাড ইউনিভার্সিটিতে জায়গা করে নেন। ১৯৪৪ সালে হার্ভাড থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন।
তার এই অসাধারণ মেধা এবং প্রতিভা নজর এড়ায়নি মার্কিন কর্তৃপক্ষের। ১৯৪৩ সালের শুরুর দিকেই টপ সিক্রেট লস অ্যালামস গবেষণাগারের একটি পদের জন্য ইন্টারভিউ নেওয়া হয় হলের। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো, মার্কিন কর্মকর্তারা জানতেন না, এই তরুণ পদার্থবিদকে অন্য আরেকটা গোষ্ঠীও তাদের দলে আগেই ভিড়িয়ে নিয়েছে।
থিওডোর হল ছিলেন হার্ভার্ডের মার্ক্সিস্ট ছাত্র সংগঠনের সদস্য। হার্ভার্ডে পড়ার সময় তার রুমমেট ছিলেন স্যাভিল স্যাক্স। নিউ ইয়র্কে বেড়ে ওঠা স্যাক্স ছিলেন রুশ অভিবাসী দম্পতির সন্তান। তিনি ছিলেন একজন চরম কমিউনিস্ট। আমেরিকায় বসবাস করলেও তার সকল কার্যক্রমই ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্য। সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে কাজ করার জন্য হলকে তিনিই দলে ভেড়ান।
ততদিনে হল অবশ্য পুরোদমে কাজ করে যাচ্ছেন ম্যানহাটান প্রজেক্ট নিয়ে। পারমাণবিক প্রযুক্তির অনেক তথ্যই তিনি জানেন এবং সব তথ্যই তার হস্তগত হয়েছে। ১৯৪৪ সালের ডিসেম্বরে এই তরুণ বিজ্ঞানী প্রথমবারের মতো তার সাবেক রুমমেটের সহায়তায় বোমাটির গোপন তথ্য সোভিয়েতদের কাছে হস্তান্তর করেন। এটা ছিল প্লুটোনিয়াম বোমা সংক্রান্ত একটি আপডেট।
হলের দেওয়া তথ্য কাজে লাগিয়ে খুব দ্রুতই পারমাণবিক শক্তিধর হয়ে ওঠে সোভিয়েত ইউনিয়ন। ১৯৪৯ সালের ২৯ আগস্ট সকাল ৭টা; কাজাখস্তানে পারমাণবিক বোমার পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণের মাধ্যমে পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে দেশটি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অবশ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একই শত্রুর মোকাবেলা করে। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়ে একই শত্রুর বিরুদ্ধে। কিন্তু এই সম্পর্ক কখনোই ওয়াশিংটনকে মস্কোর উপর নজরদারি থেকে বিরত রাখেনি। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রত্যেকটি গোপন সামরিক কার্যক্রমে ওয়াশিংটন নজর রাখত। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক কর্মকাণ্ডের ওপরও নজর রাখত সোভিয়েত ইউনিয়ন। প্রকৃতপক্ষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপক ও বিস্তৃত কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স গ্রুপগুলো প্রতিষ্ঠিতই হয়েছিল সোভিয়েতকে লক্ষ্য করে। যুক্তরাষ্ট্র এ গোয়েন্দা কার্যক্রমের নাম দিয়েছিল ‘ভেনোনা’। ভেনোনার কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৪৩ সালের ফেব্রুয়ারি থেকেই।
১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরে গোপন সংকেতের পাঠোদ্ধারকারীরা সোভিয়েত ইউনিয়নের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এনকেভিডি-র সাংকেতিক বার্তার পাঠোদ্ধার করতে সক্ষম হয়। এখান থেকে এমন কিছু তথ্য পাওয়া যায়, যা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে ম্যানহাটান প্রজেক্টের গোপন তথ্যগুলো পাচার করা হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে। কিছু সাংকেতিক টেলিগ্রাফ উদ্ধার করা হয়, যেখান থেকেও এই একই আলামত পাওয়া যায়।

১৯৫০ সালের এক সন্ধ্যায় এফবিআই সদস্যরা কড়া নাড়ে হলের দরজায়। সেসময় তিনি ইউনিভার্সিটি অফ শিকাগোতে পিএইচডি-রত ছিলেন। একটি এনক্রিপ্টেড বার্তার তথ্যানুযায়ী তিনি মস্কোর কাছে তথ্য পাচার করেছেন বলে সন্দেহ করা হয়। এদিকে লস অ্যালমসের আরেকজন গুপ্তচর ছিলেন জার্মান পদার্থবিদ ক্লাউস ফুকস। তিনি গ্রেপ্তার হন এই ঘটনার ঠিক আগের বছরই। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে পারমাণবিক প্রযুক্তির তথ্য পাচার করার কথা স্বীকারও করে নেন। কিন্তু অনেক চেষ্টা করার পরও হলের কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায়ে ব্যর্থ হয় এফবিআই। জিজ্ঞাসাবাদে স্যাভিল স্যাক্সের কাছ থেকেও তেমন কিছু জানতে পারেননি কর্মকর্তারা।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তির জন্য অনেক মার্কিন কর্মকর্তাই গ্রেপ্তার হন। কিন্তু কেউই হলের নাম নেননি। গোয়েন্দা নজরদারিতে তার বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির কোনো তথ্য-প্রমাণ মেলাতে পারেনি এফবিআই। আসল কথা হচ্ছে, ম্যানহাটন প্রজেক্ট সমাপ্ত হওয়ার পর পরই গুপ্তচর হিসেবে আর সক্রিয় ছিলেন না হল।
অবশ্য এমন কিছু প্রমাণাদি মার্কিন কর্তৃপক্ষের কাছে ছিল, যার মাধ্যমে খুব সহজেই ফেঁসে যেতে পারতেন থিওডোর হল। মস্কোর সাথে থিওডোরের তারবার্তাগুলো ছিল, যেগুলো প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা যেত। কিন্তু মার্কিন কর্মকর্তারা সেগুলোকে আদালতে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করেননি। আসলে তারা চাননি, তারা যে সোভিয়েত গোপন তারবার্তাগুলোর সংকেত ধরতে পেরেছেন সেই কথা জনসম্মুখে প্রকাশ হয়ে যাক। এর ফলে অন্য গুপ্তচরদের মতো হলকে কারাদণ্ড বা মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করা যায়নি। খুব সহজেই পার পেয়ে যান তিনি।

কিন্তু এরপরও নিজের এবং নিজের পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা দূর হলো না থিওডোর হলের। শিকাগোর সম্মানজনক শিক্ষকের চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি নিউ ইয়র্কের একটি হাসপাতালে নিচু পদে চাকরি গ্রহণ করলেন। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চাকরির প্রস্তাব পেলে ১৯৬২ সালে সস্ত্রীক পাড়ি জমান যুক্তরাজ্যে। ১৯৮৪ সালে অবসরে যান হল। তারপরও মৃত্যুর আগপর্যন্ত লোকচক্ষুর আড়ালেই ছিলেন তিনি।
১৯৯৬ সালে অতীত হলকে আবারও তাড়া করতে শুরু করে। তার সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নের চুক্তি সংক্রান্ত তারবার্তাগুলো ডি-ক্লাসিফায়েড করা হয় এবং সেগুলো জনসমক্ষে উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু ততদিনে স্যাভিল স্যাক্সসহ তার গুপ্তচরবৃত্তিক কর্মকাণ্ডের কোনো প্রত্যক্ষদর্শীই আর বেঁচে ছিল না।
মৃত্যুর আগে ১৯৯৭ সালে নিউ ইয়র্ক টাইমসকে এক সাক্ষাৎকার দেন থিওডোর হল। সেখানে তিনি বলেন,
আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে আমি ইতিহাসের গতি বদলে দেওয়ার জন্য দায়ী। হয়তো ইতিহাসের গতি অপরিবর্তিত থাকলে ৫০ বছর আগেই তা একটি পারমাণবিক যুদ্ধ ডেকে নিয়ে আসতো। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৪৯-৫০ সালের গোড়াতেই বোমাটি ফেলা হত চীনের উপরে। ইতিহাস বদলে দিয়ে আমি যদি সেটা ঠেকাতে সাহায্য করে থাকি, তাহলে অভিযোগ স্বীকার করে নিলাম।
মূলত, নিউ ইয়র্ক টাইমসের সাক্ষাৎকার অনুযায়ী থিওডোর হল বোঝাতে চেয়েছিলেন, তিনি কোনোভাবেই চাইছিলেন না যে একমাত্র যুক্তরাষ্ট্রই পারমাণবিক শক্তিধর হয়ে থাকুক। এ মনোপলি একটি যুদ্ধ-পরবর্তী মন্দা সৃষ্টি করবে কি না তা নিয়ে ১৯৪৪-এ উদ্বিগ্ন ছিলেন তিনি। তার মতে, সোভিয়েত ইউনিয়ন পারমাণবিক শক্তিধর হয়ে উঠলে তা একটি ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরি করবে।
১ নভেম্বর, ১৯৯৯ সালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ৭৪ বছর বয়সে কেমব্রিজে মারা যান এই বিজ্ঞানী। সোভিয়েতদের কাছে আজও থিওডোর হল একজন মহান বীর হিসেবে পরিচিত।
সাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা হামলা সম্পর্কে আরও জানতে সংগ্রহ করতে পারেন এই বইটি:
১) সাচিকো – নাগাসাকির পারমাণবিক বোমাহামলা থেকে বেঁচে যাওয়া এক শিশুর সত্য কাহিনী