আজকে যে জিনিসগুলো আপনি বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করছেন, সেগুলোর সবগুলো কিন্তু ঠিক এই উদ্দেশ্যেই তৈরি করা হয়নি। কিছু কিছু জিনিসের উদ্ভাবন ঘটেছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্যে। চলুন এমন কিছু জিনিস সম্পর্কেই জেনে নেয়া যাক।
চা
চা ছাড়া পুরো একটি দিন! এখন কল্পনাতেও এমন একটি দিনের কথা ভাবতে পারে না অনেকে। তবে বহু বছর আগে চীনে চা ব্যবহার করা হতো শক্তিবর্ধক ঔষধ হিসেবে। যখন চা ইউরোপে আসলো, তখন পুরোপুরিভাবে ঔষধ হিসেবেই এর ব্যবহার শুরু হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গেঁটে বাতের ব্যথার জন্য ব্যবহার করা হতো। চিকিৎসক করনেলিস ডেক্কার দাবি করেছিলেন, জীবন সায়াহ্নে পৌঁছানো মানুষদের জন্য চা বেশ উপকারী একটি পানীয়। তিনি আরও দাবি করেছিলেন, একজন ব্যক্তির দিনে ৫০ কাপ চা পান করা প্রয়োজন। কিছু মানুষ মনে করত, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাকে বেশ উচ্চ বেতনে চাকরিতে নিয়োগ দিয়েছিলো।
অন্ধ ব্যক্তিদের লেখা ও পড়ার পদ্ধতি
১৮০৮ সালে ক্যাপ্টেন চার্লস বারবিয়ার তৈরি করেন ‘নাইট অ্যালফাবেট’ বা রাতের অক্ষর। আসলে এই অক্ষরটি ছিলো সেনাবাহিনীর সুবিধার্থে তৈরি বিশেষ একধরনের ব্যবস্থা, যাতে করে রাতের আঁধারে পাঠানো বিভিন্ন তথ্য তারা এই কোড ম্যাসেজের মাধ্যমে পড়তে ও জানতে পারতেন। আলোতে শত্রুপক্ষের চোখে ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকে বেঁচে নিরাপদে তথ্য আদান-প্রদানের জন্য তার এই পদ্ধতি বেশ কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। বারবিয়ার ভাবলেন, তার এই উদ্ভাবন দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের কাজে আসতে পারে।
এ সিদ্ধান্ত বেশ কাজে দেয় এবং সেই নাইট অ্যালফাবেট ‘হাউই’ (তখনকার দিনে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের অক্ষর চেনার একধরনের পদ্ধতি) এর চাইতে অধিক সহজতর পদ্ধতি হিসেবে বিবেচিত হয়। লুই ব্রেইল, যিনি দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের পড়া ও লেখার জন্য আধুনিক পদ্ধতি উদ্ভাবনের জনক, তিনি এ নাইট অ্যালফাবেট থেকেই অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।
এম এন্ড এম ক্যান্ডি
আশ্চর্যজনভাবে এই ক্যান্ডির ইতিহাসও সেনাবাহিনীর সাথে জড়িত! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সেনাবাহিনীর সদস্যদের জন্য তৈরি করা হয়েছিলো বর্তমান সময়ের এই বিখ্যাত ক্যান্ডি এম এন্ড এম। সাধারণ চকলেট সূর্যের আলোতে গলে গেলেও ক্যান্ডির প্রলেপ দেয়া এই মিষ্টিগুলো একেবারেই গলে যেত না। ১৯৪০ সালের দিকে এসে এই ক্যান্ডিটি সাধারণ জনগণের উদ্দেশ্যে বাজারজাতকরণ শুরু হয়। ইংরেজিতে তাদের একটি নীতিবাক্য প্রচলিত আছে– ‘মেল্টস ইন ইওর মাউথ, নট ইন ইউর হ্যান্ড’, যার ভাবানুবাদ করলে দাঁড়ায়- ‘আপনার মুখের ভেতর গলে যায়, হাতে না’। আর ঠিক এজন্যই এই ক্যান্ডিটি তৈরি করা হয়েছিলো।
ছাতা
শুধুমাত্র বৃষ্টি থেকে রক্ষা পাওয়াই কিন্তু ছাতা বানানোর মূল উদ্দেশ্য ছিলো না। ইউরোপ এবং চীনে ছাতা বানানো এবং ব্যবহার করা হতো রোদ বা সূর্যের আলো থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য। ইংরেজ পর্যটক জোনাস হ্যানওয়ে ১৭৫০ সালে বৃষ্টি থেকে রক্ষা পাওয়ার উদ্দেশ্যে ছাতার ব্যবহার শুরু করেন এবং বৃষ্টি উপেক্ষা করতে ছাতার ব্যবহারের প্রচলন শুরু করার ক্ষেত্রে তিনিই প্রথম ছিলেন।
ইরেজারের নীল অংশ
সাধারণত পেন্সিলের লেখা মোছার জন্য যে সাদা রঙের ইরেজার ব্যবহার করা হয়, তার থেকে ব্যতিক্রমধর্মী ইরেজার আছে যার অর্ধেকটা নীল আর বাকিটা লাল রঙের হয়ে থাকে। লাল অংশটি সবসময় পেন্সিলের লেখা মোছার জন্য এবং নীল অংশটি কলমের কালি তোলার জন্য ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এই ইরেজার তৈরির আসল উদ্দেশ্যে এটা ছিলো না। এটি মূলত দুটি ভিন্ন রকমের কাগজের জন্য বানানো হয়েছিলো। কারণ ইরেজারের অপেক্ষাকৃত নরম অংশটি পাতলা কাগজ থেকে কোনো দাগ সহজে মুছতে পারতো না এবং মোছার পরেও কাগজে কিছু দাগ থেকেই যেতো। সেই কারণেই তুলনামূলক শক্ত নীল রঙের অংশটি যুক্ত করা হয়েছিল। পরবর্তীতে সবাই ইরেজারের এই নীল অংশটি হাঁড়ির দাগ তোলার কাজে ব্যবহার করতে শুরু করে। কর্তৃপক্ষ বিষয়টি বুঝতে পারে এবং পরবর্তীতে তারা এই নীল অংশটি কলমের কালি ওঠানোর উদ্দেশ্যেই ব্যবহার শুরু করে।
বেলুন দিয়ে তৈরি নানা আকৃতির জীবজন্তু
বিষয়টি অবাস্তব এবং উদ্ভট মনে হলেও সত্যি যে, বেলুন পেঁচিয়ে বিভিন্ন আকৃতির জীবজন্তু তৈরির ধারণাটি এসেছে অ্যাজটেকদের (স্পেন কর্তৃক মেক্সিকো জয়ের আগে সেখানে সাম্রাজ্য গড়ে তোলা জাতির সদস্য) থেকে। সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে ত্যাগ করার মূর্ত প্রতীক হিসেবে পিরামিডের উপর তারা এ ধরনের বেলুন পোড়াতো। আর এরকম বেলুন বানানোর জন্য তারা জীবজন্তুর অন্ত্রের ভেতর বাতাস ভরে তা পাতা দিয়ে তৈরি সুতা দিয়ে বাঁধতো।
জিন্স প্যান্টের সবচেয়ে ছোট পকেট
জিন্স পরার সময় কি কখনো খেয়াল করেছেন সবচাইতে ছোট পকেটটি বা কখনো জানতে চেয়েছেন এর উদ্দেশ্য কী হতে পারে? যদিও সাধারণ ভাবনায় ছোট যেকোনো কিছু রাখার জন্য এই পকেট প্যান্টে দেয়া থাকে বলতে পারেন। তবে এই পকেটটি এমনিতে বানানো হয়নি। জিন্স প্যান্টের সবচাইতে ছোট পকেটটি সর্বপ্রথম লিভাইস কোম্পানির জিন্সের প্যান্টগুলোতে দেখা যায় ১৮৭৩ সালে। এটি তৈরি করা হয়েছিলো পকেট ঘড়ি রাখার জন্য। এমনকি আজকের সময়েও এই পকেটটি তাদের ক্যাটালগে ওয়াচ পকেট নামে রয়েছে।
কোকাকোলা
ডক্টর জন পেমবার্টন ১৮৮৬ সালে কলম্বাসের যুদ্ধের সময় যখন খুব বড়সড় এক দুর্ঘটনার শিকার হন, তখনই তিনি প্রথম ব্ল্যাক সিরাপের মূল বিষয়টি উদ্ভাবন করেন। এরপর থেকে তিনি আশাহতভাবেই ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী মরফিনের প্রতি আসক্ত হয়ে যান (জেরেমি অ্যাগনিউ এর লেখা ‘অ্যালকোহল অ্যান্ড আফিম ইন দ্য ওল্ড ওয়েস্ট’ বইয়ের আলোকে)। যেহেতু তিনি ফার্মাসির বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিলেন, তাই নেশা করার জন্য তিনি নিজস্ব পদ্ধতিতে নতুন পন্থা অবলম্বন করেন। এর ফলশ্রুতিতেই তৈরি করে ফেলেন ‘পেমবার্টনস্ ফ্রেঞ্চ ওয়াইন কোকা’। এটি ছিলো এমন একধরনের পানীয়, যাতে দেয়া হতো অ্যালকোহল ও কোকোয়া পাতার নির্যাস। যখন কোকাকোলা প্রথম যাত্রা শুরু করে, তখন এটি বাজারজাত করা হতো স্নায়ুর টনিক বা ঔষধ হিসবে, যা ক্লান্তি দূর করতে সাহায্য করতো। তবে ১৯০৩ সাল থেকে কোকাকোলাতে কোকেন ব্যবহার বন্ধ করে দেয়া হয়।
কোটেক্স
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় কিম্বারলি-ক্লার্ক কোম্পানি অস্ত্রোপচারের পর ড্রেসিংয়ের জন্য স্তুপের মতো একটি পণ্য তৈরি করে, যাতে অপেক্ষাকৃত নতুন ধরনের কাঁচামাল সেলিউকটন ব্যবহার করা হয়। যুদ্ধের সময় সৈনিকদের ক্ষতস্থানের জন্য বেশ ভালোই কাজ করতো তাদের এই পণ্যটি। কিন্তু রেড ক্রসে কর্মরত নার্সরা বুঝতে পারে যে, মাসিকের সময়ে ব্যবহারের জন্য এই পণ্যটি বেশ উপকারী হবে। কারণ এর শোষণ ক্ষমতা ছিলো বেশ প্রখর। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অস্ত্রোপচারের পর ড্রেসিংয়ের জন্য বাজারে এর চাহিদা কমে যায়। তবে কোটেক্স কোম্পানি স্যানিটারি ন্যাপকিন হিসেবে এর বাজারজাতকরণ শুরু করে। নতুন এই পণ্যের নাম দেয়া হয় ‘কোটেক্স’। যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহৃত উপাদানকে যে একটি ভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে, সে বিষয়টিও অনেক হাঁকডাকের সাথেই প্রচার করেছিলো তারা।
ফিচার ইমেজ: Friss hírek