উৎপত্তির পর থেকে রাষ্ট্রটি কখনোই নিপীড়নবাদী চরিত্রের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। রাষ্ট্রের শক্তিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে সরকার তার সাথে ভিন্নমত পোষণকারীদের নির্মূলের জন্য নির্মম নিপীড়নের আশ্রয় নিয়েছে বারংবার। নিরস্ত্র মুক্তিকামী মানুষের ওপর রাষ্ট্রটি ফ্রাংকেস্টাইনের দানবের রূপ নিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে আঘাত হেনেছে। অমানবিক এসব ঘটনার জন্ম দিতে কখনও যুক্তির আশ্রয় নেয়া হয়নি, ভাবা হয়নি মানবতার কথা।
‘লেটলোলকো গণহত্যা’ শুধুই যে মেক্সিকোর ইতিহাসে কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে তা নয়, গোটা লাতিন আমেরিকার ইতিহাসে কলঙ্ক লেপন করেছে। নিরস্ত্র ছাত্রদের উপর, খেটে খাওয়া মুক্তিকামী সাধারণ জনতার উপর মেক্সিকান সরকারের আজ্ঞাবাহী সশস্ত্রবাহিনীর পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞের ভয়াল দৃশ্য বুকে কাঁপন ধরিয়ে দেয়, রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের নগ্ন, নির্মম দিকটি উন্মোচিত করে দেয় আরেকবার।
গত শতাব্দীর ষাটের দশকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মুক্তিকামী জনতা রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, অনাচারের প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে এসেছিল, প্রতিবাদ জানিয়েছিল ঘৃণাভরে। সে বিপ্লবের ডাক ছড়িয়ে পড়েছিল এক দেশ থেকে আরেক দেশে, এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে। মেক্সিকোর রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন ও কর্তৃত্ববাদী শাসনে অতিষ্ঠ হয়ে মেক্সিকোর জনগণও সেই বিপ্লবের ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন, রাষ্ট্রের সামনে অনেকগুলো প্রশ্নবোধক চিহ্ন হাজির করেছিলেন।
দীর্ঘদিন ধরে মেক্সিকান সরকার জনগণের ওপর অত্যাচারের স্টিম রোলার চালিয়ে আসছিলেন। যে-ই সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলেছে, তাকেই জেলে পুরে রাখা হয়েছে বছরের পর বছর। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনীর উপস্থিতি নিশ্চিতের ফলে গণতান্ত্রিক অধিকার ভোগ করা থেকে বিরত থাকতে বাধ্য করা হয়েছে ছাত্রদের। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো রাষ্ট্রের নিপীড়ন ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি আওয়াজ তোলে।
১৯৬৮ সালের অলিম্পিক গেমস অনুষ্ঠিত হয় মেক্সিকোতে। লাতিন আমেরিকার প্রথম অলিম্পিক বলে কথা। মেক্সিকো অলিম্পিক আয়োজনের প্রস্তুতিতে ঘাটতি রাখেনি এক চুলও। রাষ্ট্রের নাগরিকের প্রতি খেয়াল না রেখে অলিম্পিক-প্রস্তুতিতে ১৫০ মিলিয়ন ডলার ঢেলে দেয়ার বিষয়টি মেক্সিকোর সাধারণ জনগণ মেনে নিতে পারেনি কোনোভাবেই। তাই আন্দোলনের অন্যতম জনপ্রিয় স্লোগান ছিল, “আমরা অলিম্পিক চাই না, আমরা বিপ্লব চাই!”
১৯৬৮ সালের জুলাইয়ে হাই স্কুলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে মারামারি শুরু হয় একটি ফুটবল ম্যাচকে কেন্দ্র করে। ছাত্রদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল মেটাতে মেক্সিকান সরকার দাঙ্গা পুলিশ পাঠায়, যাতে তারা পরিস্থিতি ঠান্ডা করতে পারে। কিন্তু ছাত্ররা তাদের ক্যাম্পাসে সশস্ত্রবাহিনীর উপস্থিতি মেনে নিতে মোটেও রাজি ছিল না। দাঙ্গা পুলিশকে রাস্তায় কয়েক ঘন্টা অবরোধ করে রাখে, ক্যাম্পাসে ঢুকতে বাধা দেয়। দাঙ্গা পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হলে সরকার এবার সেনাবাহিনীকে আমন্ত্রণ জানায়। সেনাবাহিনী ছাত্রদের প্রচন্ড বাধা উপেক্ষা করে স্কুলের প্রধান গেট বাজুকা দিয়ে উড়িয়ে দেয়, গোলার আঘাতে বেশ কয়েকজন ছাত্র মারা যায়। মেক্সিকান ছাত্রদের গণআন্দোলনের শুরুর গল্পটা এরকমই।
এই ঘটনার পর মেক্সিকোর ছাত্রসমাজ সরকারের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠে। জুলাইয়ের পর কয়েক মাস মেক্সিকো অনেকগুলো বিক্ষোভ-সমাবেশের সাক্ষী হয়। কিন্তু এসবের প্রতি মেক্সিকান সরকারের অবহেলা ছিল চোখে লাগার মতো। ছাত্রদের ন্যায্য দাবিগুলোর প্রতি মেক্সিকোর নিপীড়নবাদী সরকার কোনো ভ্রুক্ষেপ তো করেইনি, বরং মেক্সিকান প্রেসিডেন্ট দাম্ভিক কন্ঠে বলেছিলেন, “আর কোনো বিশৃঙ্খল অবস্থা সহ্য করা হবে না।” বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেনাসদস্যদের উপস্থিতি আরও বাড়িয়ে দেয়া হয়। বলা চলে ক্যাম্পাসগুলোর পুরো দখল নিয়ে নেয়া হয়।
সে বছরেরই অক্টোবরের ২ তারিখে সন্ধ্যায় লেটলোলকো হাউজিং কমপ্লেক্সের ‘থ্রি কালচার্স’ স্কয়ারে প্রতিবাদ সমাবেশের ডাক দেয় ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটি। আর দশ দিন পরেই অলিম্পিক শুরু হবে। এ সময়টাকে তাই বেশ গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করেছিল তারা, কারণ অসংখ্য বিদেশি সাংবাদিক মেক্সিকোতে অবস্থান করছিলেন সে সময়ে।
অসংখ্য ছাত্রের আগমনে পুরো হাউজিং কমপ্লেক্স এলাকা ভরে যায়। শুধু ছাত্ররাই নন, সাধারণ মানুষও এতে যোগ দেন। সহিংসতার কোনো লক্ষণ ছিল এ জমায়েতে, আরেকটি শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ সমাবেশের অপেক্ষায় ছিল সবাই। কিন্তু সেই অপেক্ষাই যে অনেকের জীবনের শেষ অপেক্ষা হবে, সেটা কি তারা জানতো?
আন্দোলনের নেতাদের গ্রেফতার করার জন্য সেনাবাহিনী ছাত্রদের সেই বিশাল জমায়েত ঘিরে ফেলে। গ্রেফতারপর্ব শুরু হয়। কিন্তু হঠাৎ করে সেনাবাহিনীর দিকেই গুলি ধেয়ে আসতে থাকে থ্রি কালচার্স চত্বরের পাশের বিশাল দালানগুলো থেকে।
আসলে প্রেসিডেন্সিয়াল গার্ড, যারা মেক্সিকান সেনাবাহিনীর একটি বিশেষ ইউনিট, তারা আগেই স্নাইপারদের থ্রি কালচার্স স্কয়ারের আশেপাশের ভবনগুলোতে প্রস্তুত করে রেখেছিল। তাদের পরিকল্পনা ছিল এরকম, সেনাবাহিনী আসার পর স্নাইপাররা সেনাবাহিনীর দিকে গুলি ছুড়বে। সেনাবাহিনী ভাববে, ছাত্ররা তাদের দিকে গুলি ছুড়ছে। ফলে তারাও পাল্টা গুলি চালাবে এবং ছাত্রদের ছত্রভঙ্গ করে দিয়ে আন্দোলনের শখ মিটিয়ে দেবে চিরতরে। সেনাবাহিনী পরিকল্পনামাফিক তা-ই করেছিল।
প্রায় দুই ঘন্টা ধরে সেনাবাহিনী ছাত্রদের উপর গুলি চালিয়েছিল। গুলি চালানো শুরু হলে নিরীহ ছাত্ররা প্রাণ বাঁচাতে দিগ্বিদিক দৌড়াতে শুরু করে। সেনাবাহিনীর ট্যাংক ছেড়ে দেয়া হয় জমায়েতের উপর। অনেকে ট্যাংকের নিচে পিষে মারা যায়।
শুধুই যে ছাত্রদের উপর গুলি চালানো বা ট্যাংক ছেড়ে দেয়া হয়েছিল, তা নয়। সাংবাদিক, পথচারী কিংবা সাধারণ মানুষ– কাউকেই বাদ রাখা হয়নি। ইতালিয়ান সাংবাদিক ওরিয়ানা ফেল্লাসি ছাত্রদের প্রতিবাদ সমাবেশের সংবাদ কাভার করতে সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তাকেও গুলি করে মেরে ফেলা হয়।
পরের কয়েক সপ্তাহ ধরে সরকার-নিয়ন্ত্রিত মেক্সিকান গণমাধ্যম প্রচার করে, ছাত্ররাই গুলি চালিয়েছে সেনাসদস্যদের উপর। ‘নিজেদের আত্মরক্ষার্থে সেনাবাহিনী পাল্টা গুলি ছুড়েছিল’– এরকম বিবৃতি প্রদানের মাধ্যমে নিজেদের দায়মুক্তি দেয়ার চেষ্টা করে মেক্সিকান সরকার।
ঠিক কতজন মারা গিয়েছিল মেক্সিকান সরকারের এই পরিকল্পিত গণহত্যায়, তা নির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল। কারণ পরিস্কার কোনো তদন্ত হয়নি এ গণহত্যার। মেক্সিকান সরকার প্রথমে দাবি করে চারজন মারা গিয়েছে। পরবর্তীতে মৃতের সংখ্যা ২৬ জন, আহত ১০০ জন বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়।
কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, শত শত ছাত্রের লাশ ট্রাকে করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। হাজার হাজার ছাত্রকে গ্রেফতার করে সামরিক ঘাঁটিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, যাদেরকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। অনেকের মতে হতাহতের সংখ্যা তিন হাজারের কাছাকাছি।
এই ভয়াবহ গণহত্যার অনেক বছর পরে মেক্সিকান ও আমেরিকান সরকার বেশ কিছু ডকুমেন্ট প্রকাশ করে, যেগুলোতে স্নাইপার দিয়ে সেনাবাহিনীর উপর গুলি চালানোর সত্যতা পাওয়া যায়। মেক্সিকান সরকার গোপনে পুরো গণহত্যা ভিডিও করে রেখেছিল। বিশ বছর পরে সেই ভিডিও জনসম্মুখে আসে।
২০০০ সালে মেক্সিকোয় ভিনসেন্ট ফক্স প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর আশার আলো দেখে মেক্সিকোর সাধারণ মানুষ। প্রেসিডেন্ট ফক্সের ‘স্পেশাল প্রসিকিউটর ফর ক্রাইমস্ অব দ্য পাস্ট’ অর্ডারের মাধ্যমে লেটলোলকো গণহত্যার তদন্ত শুরু হয়। কিন্তু দীর্ঘ দিন অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার ফলে তদন্ত বাধাগ্রস্ত হয়। অনেক তথ্য-উপাত্ত আগের সরকারগুলো পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করে ফেলে। সরকারি তদন্তে প্রায় তিন হাজার মৃত্যুর যে দাবি করা হয়ে আসছিল এতদিন ধরে, তার সত্যতা পাওয়া যায়।
নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের উপর হামলা করা পৃথিবীর সবচেয়ে কাপুরুষোচিত কাজগুলোর একটি। মেক্সিকান ছাত্ররা ন্যায়ের দাবি নিয়েই এসেছিল, কিন্তু বিনিময়ে বুলেটের আঘাতে কিংবা ট্যাংকের চাকার নিচে পিষে মারা যেতে হয় তাদের। রাষ্ট্র আরেকবার তার নাগরিকের উপর, যারা তার চলার অর্থের যোগান দেয় তাদের উপরই হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে বসে। এ ন্যাক্কারজনক ঘটনা মেক্সিকান সমাজের উপর দগদগে ক্ষত সৃষ্টি করেছে, যা আজও মেক্সিকান নাগরিকদের পীড়া দেয়।