‘সাবমেরিন’ শব্দটি শোনামাত্র আধুনিক নৌবাহিনী ও নৌযুদ্ধের ইতিহাসপ্রেমীদের চোখের সামনে ‘নিঃশব্দ আততায়ী’ শব্দযুগল ভেসে ওঠে। নাবিকদের কাছে গভীর জলের আতঙ্ক হিসেবে খ্যাত সাবমেরিন এমন একপ্রকার জলযান যা পানির উপরে ও নিচে সমানভাবে চলতে পারে। একে শনাক্ত করা বেশ কঠিন বিধায় বর্তমান যুগের প্রতিটি আধুনিক নৌবাহিনীর জন্য সাবমেরিন একটি কৌশলগত অস্ত্র।
গভীর সাগরে সাবমেরিন খুঁজে বের করা খড়ের গাদায় সূচ খোঁজার চেয়েও কঠিন কাজ। শত্রুর উপর নিঃশব্দ নজরদারি বা আচমকা হামলার জন্য এর জুড়ি মেলা ভার। কিন্তু শিকারী কখনো হয়ে যায় শিকার। বিভিন্ন যুদ্ধে একাধিক সাবমেরিন ডুবে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। আবার দুর্ঘটনায় প্রচুর প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে।
সাবমেরিনের প্রধান শক্তি এর ‘স্টেলথ’ তথা নিজেকে লুকিয়ে রাখার সক্ষমতা। কিন্তু শক্তিই দুর্ঘটনায় পড়া নাবিকদের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বেশ কিছু সাবমেরিন দুর্ঘটনার ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়- হয়তো সংশ্লিষ্ট নৌবাহিনী সময়মতো দুর্ঘটনার খবর জানতে পারেনি। কিংবা জানলেও সময়মতো সাবমেরিনের অবস্থান শনাক্ত করা যায়নি। ফলে ঘটে যায় সর্বোচ্চ প্রাণহানির কিছু ট্রাজেডি। আজকের লেখায় আমরা কিছু ভয়াবহ সাবমেরিন দুর্ঘটনা সম্পর্কে জানব। দুর্ঘটনার তালিকা বেশ লম্বা বিধায় শুধুমাত্র পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিনগুলোর মধ্যে ভয়াবহ পাঁচটি দুর্ঘটনার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়ে আজকের লেখাটি সাজানো হয়েছে।
সাবমেরিন দুর্ঘটনা কেন হয়?
এই প্রশ্নের উত্তর পেতে প্রথমে আপনাকে সাবমেরিনের খুঁটিনাটি সম্পর্কে সাধারণ ধারণা নিতে হবে। জানতে হবে সাবমেরিন কীভাবে কাজ করে, এবং অপারেশন পরিচালনা করে। শান্তিকালে সাবমেরিন স্বতন্ত্রভাবে সাগরে অপারেশন চালায়। ডিজেল-ইলেকট্রিক শক্তিচালিত সাবমেরিনের মতো পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিনগুলোর নির্দিষ্ট সময় পর পর জ্বালানি নেয়ার ঝামেলা নেই। ফলে এরা মাসের পর মাস একটানা পানির নিচে ঘুরে বেড়াতে পারে। নির্দিষ্ট সময় পর পর এরা হেডকোয়ার্টারের সাথে রেডিও যোগাযোগ করে। যুদ্ধকালে বা মহড়া চলাকালে সত্যিকারের যুদ্ধাবস্থা তৈরির জন্য অনেক সময় ইচ্ছা করেই দীর্ঘ সময়ের জন্য রেডিও সাইলেন্স বজায় রাখা হয়। মোটকথা, সাবমেরিন নিজে থেকে আপনার সাথে যোগাযোগ না করলে এর অবস্থান আপনি সহজে জানতে পারবেন না। আবার নির্দিষ্ট গভীরতায় উঠে আসা ব্যতীত সাবমেরিন রেডিও যোগাযোগ করতে পারে না। ফলে একে সাধারণ যুদ্ধজাহাজের মতো সার্বক্ষণিক যোগাযোগ বা রাডার/সোনার দ্বারা শনাক্ত করা যায় না। শত্রুর নজরদারি বা সম্ভাব্য হ্যাকিং থেকে বাঁচতে একে স্যাটেলাইট দ্বারা ট্র্যাকিং করা হয় না। তাছাড়া, অতি গভীরতায় জিপিএস টেকনোলজি সঠিকভাবে কাজ করে না।
বেশিরভাগ দুর্ঘটনাকবলিত সাবমেরিনের ঘটনা তদন্তে দেখা গিয়েছে- হয় ভেতরে কোনো অংশে (টর্পেডো, মিসাইল, ইঞ্জিন, নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টরে) বিস্ফোরণ বা অগ্নিকান্ড ঘটেছে। যার ফলে এটি পাওয়ার সাপ্লাই হারিয়ে যোগাযোগ করতে পারেনি। এতে আগুনে পুড়ে, তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে বা অক্সিজেন সাপ্লাই বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ক্রুরা মারা গেছে। কিংবা বিস্ফোরণে সাবমেরিনের Hull (বডি) ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে পানি ঢুকেছে। এর ফলে সেটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তার ক্র্যাশ ডেপথ লিমিট অতিক্রম করে ধ্বংস হয়েছে। আপনারা জানেন যে প্যাসকেলের সূত্রানুযায়ী পানির যতই গভীরে যাওয়া যায়, ততই চাপ বৃদ্ধি পায়। প্রতিটি সাবমেরিন নির্দিষ্ট গভীরতায় যাওয়ার উপযোগী করে বানানো হয়। সাধারণ অবস্থায় একটি সাবমেরিন সর্বোচ্চ যে গভীরতায় অপারেশন চালাতে সক্ষম তাকে ‘টেস্ট ডেপথ’ এবং যে গভীরতায় অতিক্রম হলে এটি ধ্বংস হয়ে যাবে তাকে ‘ক্র্যাশ ডেপথ’ বলে। দুর্ঘটনায় এই সীমা অতিক্রম করলে পানিই হয়ে যাবে সাবমেরিনের বড় শত্রু। শক্তিশালী ইস্পাত-টাইটেনিয়ামের হালের তৈরি সাবমেরিনও পানির প্রচণ্ড চাপ সইতে না পেরে চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে যাবে। এ সংক্রান্ত কিছু আলোচনা “মানুষের পক্ষে পানির সর্বোচ্চ কত গভীরে যাওয়া সম্ভব?” শিরোনামের লেখায় বিস্তারিত ব্যখা করা হয়েছে।
আর দেরি না করে চলুন জেনে নেয়া যাক প্রাণহানির দিক দিয়ে ভয়াবহ কিছু সাবমেরিন দুর্ঘটনা সম্পর্কেই।
১) কুরস্ক সাবমেরিন দুর্ঘটনা
সাম্প্রতিক ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকর সাবমেরিন দুর্ঘটনা ঘটে রাশিয়ার অস্কার-২ ক্লাসের পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন K-141 Kursk এর ক্ষেত্রে। ২০০০ সালের ১২ আগস্ট এক এক্সারসাইজের সময় টর্পেডো ফায়ারিংয়ের প্রচন্ড বিস্ফোরণে ব্যারেন্টস সাগরের ১১৫ মিটার গভীরে আটকে যায়। ১৬ হাজার টনের সাবমেরিনটি টাইপ-৬৫ নামক শক্তিশালী টর্পেডো বহন করত, যা মূলত সিঙ্গেল শটে মার্কিন এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার ডোবানোর উপযোগী করে বানানো হয়েছিল। এতে উচ্চগতির জন্য হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড নামক রাসায়নিক যৌগকে ফুয়েল হিসেবে ব্যবহার করত। অনুশীলনে সেটি ফায়ারের সময় বিস্ফোরিত হয়ে এই দুর্ঘটনার সূত্রপাত। পরে রুশ নৌবাহিনীর ব্যর্থতায় ১১৮ জন নাবিকের সবাই মারা যায়। এই ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পড়ুন এই লেখাটি:
২) কমসোমোলেটস অগ্নিকান্ড
কুরস্কই যে সোভিয়েত ইউনিয়নের একমাত্র দুর্ঘটনা তা কিন্তু নয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো এত বেশি সাবমেরিন দুর্ঘটনা আর কোনো দেশে ঘটেনি। ১৯৮৯ সালে কে-২৭৮ কমসোমোলেটস নামের একটি প্লাভিক ক্লাস সাবমেরিনের ভেতর সৃষ্ট অগ্নিকান্ড ও তা থেকে সূত্রপাত হওয়া বিভিন্ন ঘটনার ফলে এটি নরওয়ের উপকূলে ডুবে যায়। এটি ছিল সোভিয়েত নৌবাহিনীর টেস্টবেড তথা নতুন টেকনোলজি পরীক্ষার কাজে ব্যবহৃত সাবমেরিন। টাইটেনিয়াম প্রেশার হালের তৈরি এই সাবমেরিন ছিল বিশ্বের বেশিরভাগ সাবমেরিন থেকে একেবারেই আলাদা। সাধারণ সাবমেরিনের যেখানে পানির ২০০-৫০০ মিটার গভীরে যাওয়ার গড় সক্ষমতা আছে, সেখানে কে-২৭৮ কমসোমোলেটসকে ১,০০০ থেকে ১,৫০০ মিটার গভীরে ডুব দেয়ার উপযোগী করে বানানো হয়েছিল। ১৯৮৪ সালে এটি ১,০২৪ মিটার গভীরে ডাইভ দিয়ে কমব্যাট সাবমেরিনের যে রেকর্ড গড়েছিল, তা এখনও অক্ষত।
১৯৮৯ সালের ৭ এপ্রিল কমব্যাট পেট্রোলের সময় ৩৩৫ মিটার গভীরে থাকা সাবমেরিনটির পেছনের দিকের ইঞ্জিনিয়ারিং কম্পার্টমেন্টে ইলেকট্রিক শর্টসার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। ক্যাপ্টেন নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টর শাটডাউন করে সাবমেরিন পানির উপরে ভাসানোর নির্দেশ দেন। জাহাজের ইলেকট্রিক সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় আগুন লাগা কম্পার্টমেন্টের এয়ার ভেন্ট বন্ধ করা যায়নি। ফলে অক্সিজেনের সাপ্লাই পেয়ে আগুন ভয়াবহ আকার ধারণ করে।
দুর্ঘটনার ১১ মিনিটের মাথায় সাবমেরিনটি পানির উপরে ভেসে ওঠে। নাবিকদের জাহাজ ত্যাগের নির্দেশ দিয়ে চার অফিসারসহ সাবমেরিনে থেকে যান ক্যাপ্টেন ভেনিন। তিনি আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টার পাশাপাশি দুর্ঘটনার খবর হেডকোয়ার্টারে জানিয়ে সাহায্যের আবেদন জানান।
সাবমেরিন ডুবে যাওয়া শুরু করলে ক্যাপ্টেন বাকি চারজনকে নিয়ে এস্কেপ ক্যাপসুলে চড়ে পানির উপরে উঠে আসেন। কিন্তু একজন ছাড়া কেউই ক্যাপসুল থেকে বের হতে পারেননি। এদিকে সাগর তখন উত্তাল, পানির তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। হাড়কাঁপানো ঠাণ্ডায় হাইপোথার্মিয়া হয়ে একে একে নাবিক মারা যেতে শুরু করে। এরই মধ্যে সোভিয়েত উদ্ধারকারী বিমান এসে একাধিক লাইফ বোট ফেলে গেলেও বাতাস ও তীব্র ঢেউয়ের কারণে বেশিরভাগই নাবিকদের হাতছাড়া হয়। সাবমেরিন কে-২৭৮ কমসোমোলেটস ডুবে যাওয়ার ৮১ মিনিট পর নিকটস্থ একটি মাছ ধরার জাহাজ রেডিও মেসেজ শুনে সাহায্যের জন্য এগিয়ে এসে সবাইকে তুলে নেয়। ততক্ষণে ৬৯ নাবিকের মধ্যে মাত্র ২৭ জন বেঁচে আছে।
নিহত ৪২ জনের মধ্যে দুর্ঘটনাজনিত আগুন ও অন্যান্য কারণে ৯ জন মারা যায়। বাকি ৩০ জনই ব্যারেন্টস সাগরের প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় হাইপোথার্মিয়ায় মারা যায়। এ ঘটনায় দ্রুত সাড়া দেয়ার ক্ষেত্রে ব্যর্থতার জন্য রুশ নৌবাহিনীর ব্যাপক সমালোচনা হয়। এছাড়া সাগরের ১,৭০০ মিটার গভীরে পড়ে থাকা সাবমেরিনটি উদ্ধারের জন্যও কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। এলাকাটি নরওয়ের উপকূলবর্তী হওয়ায় দেশটি নিউক্লিয়ার টর্পেডো ও রিয়্যাক্টর পানির নিচ থেকে উদ্ধারের জন্য ব্যাপক চাপ দিলে রাশিয়া পরবর্তীতে সাবমেরিনটি সিল করে দেয়। ১৯৯৪ সালে টর্পেডোর প্লুটোনিয়াম ওয়ারহেড থেকে রেডিয়েশন নির্গত হওয়ার বিষয়টি ধরা পড়ার পর নরওয়ে ও আন্তর্জাতিক পরিবেশবাদী সংস্থাগুলো রাশিয়ার উপর চাপ প্রয়োগ করে। পরে আবারো কমসোমোলেটসকে ভালোভাবে সিল করে দেয়া হয়। রুশ কর্তৃপক্ষের অনুমান অনুযায়ী- এটি ২০২৫ সাল পর্যন্ত অক্ষত থাকবে। প্রতি বছর পানির স্যাম্পল পরীক্ষার মাধ্যমে বিষয়টি নজরদারি করে নরওয়ে। সাবমেরিনটির ধ্বংসাবশেষের ছবি দেখুন এখানে।
৩) কে-৮ সাবমেরিনের দুর্ভাগ্য
আগুনে সাবমেরিন ডুবে যাওয়ার বিষয়টি সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্য নতুন নয়। কমসোমোলেটস ডুবে যাওয়ার আগে ১৯৭০ সালে সোভিয়েত নৌবাহিনীর একটি কিট ক্লাস সাবমেরিন ডুবে যায়। এর কোনো ডাকনাম ছিল না, তাই একে ইউরোপের সামরিক জোট ন্যাটো কর্তৃক ‘কে-৮’ নাম দেয়া হয়।
এই সাবমেরিনটি যেন সোভিয়েত নৌবাহিনীর দুর্ভাগ্যের প্রতীক। ১৯৬০ সালে এক দুর্ঘটনায় স্টিম জেনারেটরের কুল্যান্ট পদার্থ লিকেজ হয়ে নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টরের তেজস্ক্রিয় গ্যাস পুরো সাবমেরিনে ছড়িয়ে পড়েছিল। এতে কেউ মারা না গেলেও রেডিয়েশনে বেশ কয়েকজন ক্রু অসুস্থ হয়ে পড়েন। ১৯৭০ সালের ৮ এপ্রিল জেনারেটর ফুয়েলের মাধ্যমে আগুন ধরে অক্সিজেন সাপ্লাইয়ের এয়ার ভেন্টের মাধ্যমে পুরো সাবমেরিনে ছড়িয়ে পড়ে। এতে ৮ জন মারা যান। ক্যাপ্টেন বেসোনভ পানির উপরে ভেসে উঠতেই জাহাজ ত্যাগের নির্দেশ দেন। পরে উদ্ধারকারী জাহাজ ঘটনাস্থলে আসলে সাবমেরিন টেনে ঘাঁটিতে নিয়ে যাওয়ার সিধান্ত নেয়া হয়। ফলে নাবিকদের আবারো সাবমেরিনে প্রবেশের নির্দেশ দেয়া হয়।
কিন্তু টেনে নিয়ে যাওয়ার সময় উত্তাল সাগরে সাবমেরিনের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যালাস্ট ট্যাংক ভারসাম্য হারায়। ফলে মুহূর্তের মধ্যে ডুবতে শুরু করে কে-৮। শেষ পর্যন্ত ৫২ জন নাবিককে নিয়ে তলিয়ে যায় সাবমেরিনটি। ৭৩ জন নাবিক বেঁচে গিয়েছিলেন। নিহত ক্যাপ্টেন বেসোনভকে প্রতিকূল মুহূর্তে নেতৃত্ব ও তার আত্মত্যাগের জন্য সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘হিরো অফ দি সোভিয়েত ইউনিয়ন’ পদকে ভূষিত করা হয়। চারটি নিউক্লিয়ার টর্পেডোসহ কে-৮ সাবমেরিনটি বর্তমানে আটলান্টিকের সাড়ে চার হাজার মিটার গভীরে ডুবে আছে। বরাবরের মতো রাশিয়া ব্যাপক অর্থ খরচ করে তাদের পারমাণবিক সাবমেরিন উদ্ধারের ক্ষেত্রে উদাসীন। এই উদাসীনতার ১৯৭৩ সালে তাদের বিশাল ক্ষতি হয়ে যায়। সেই ঘটনা পড়বেন এখনই।
৪) ইউএসএস স্করপিয়ন
দুর্ঘটনায় যে শুধু সোভিয়েত ইউনিয়ন সাবমেরিন হারিয়েছে তা কিন্তু নয়। স্নায়ুযুদ্ধের সময় ইউএসএস স্করপিয়ন নামে একটি পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন আকস্মিকভাবে ডুবে যায়। এটি সোভিয়েত নৌবহরের উপর গোয়েন্দাগিরির কাজে নিয়োজিত ছিল। নির্ধারিত সময়ের পরও বন্দরে ফিরে না আসা ও রেডিও যোগাযোগ না করায় মার্কিন নৌবাহিনী ব্যাপক আকারে সার্চ অপারেশন শুরু করে। পাঁচ মাস পর ৩০ অক্টোবর সাবমেরিনের ধ্বংসাবশেষ পানির তিন হাজার মিটার গভীরে খুঁজে পাওয়া যায়। এটি কী কারণে ডুবে গিয়েছিল তা আর জানা যায়নি। নিজস্ব টর্পেডোর বিস্ফোরণ, ব্যাটারি বিস্ফোরণ, ব্যাটারির হাইড্রোজেন গ্যাস লিক থেকে বিস্ফোরণসহ সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিশোধমূলক টর্পেডো হামলার কথা ধারণা করা হয়। কিন্তু কীসের প্রতিশোধ?
১৯৬৮ সাল ছিল যেন সাবমেরিন দুর্ঘটনার বছর। সে বছর চার দেশের চারটি সাবমেরিন রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়ে যায়। এগুলো হলো ইসরায়েলি সাবমেরিন ‘আইএনএস ডাকার’ (১৯৬৮ সালের ২৫ জানুয়ারি), ফরাসি সাবমেরিন ‘মিনেখভ’ (১৯৬৮ সালের ২৭ জানুয়ারি), সোভিয়েত সাবমেরিন ‘কে–১২৯’ (১৯৬৮ সালের ৮ মার্চ) এবং মার্কিন সাবমেরিন ইউএসএস স্করপিয়ন (১৯৬৮ সালের ২২ মে)।
স্করপিয়ন বাদে বাকি তিনটি সাবমেরিন ডিজেল-ইলেকট্রিক বিধায় এই আর্টিকেলে তাদের সম্পর্কে লেখা হলো না। তবে সোভিয়েত ইউনিয়নের ব্যালাস্টিক মিসাইল সাবমেরিন ‘কে-১২৯’ সম্পর্কে কিছু না বললেই নয়। ৯৮ জন নাবিক নিয়ে ডুবে যাওয়া এই সাবমেরিনের ডুবে যাওয়ার আসল কারণ জানা যায়নি। ধারণা করা হয়, লেড এসিড ব্যাটারি বিস্ফোরণ, মিসাইল হ্যাচ লিক অথবা মার্কিন সাবমেরিনের সাথে ধাক্কা লাগায় এটি ডুবে যায়। এছাড়া একটি জনপ্রিয় গুজব হলো যে কে-১২৯ আসলে মার্কিন টর্পেডো হামলায় ডুবে গেছে! ফলে এই ঘটনার দু’মাস পর ইউএসএস স্করপিয়নের রহস্যময়ভাবে উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনায় অনেকেই ধারণা করেন যে সোভিয়েত ইউনিয়নের টর্পেডো হামলায় এটি ডুবে গেছে। দুটো ঘটনায় সোভিয়েত ও মার্কিন প্রশাসন যেভাবে যে যার সাবমেরিন নিখোঁজের ঘটনা ধামাচাপা দিতে এত বেশি চেষ্টা করেছে যে তাতে উক্ত কন্সপিরেসি থিওরির কথা অনেকটাই বিশ্বাসযোগ্য। স্করপিয়নের ডুবে যাওয়ার ঘটনা নিয়ে বিস্তারিত পড়ুন,
ইউএসএস স্করপিয়ন: হারিয়ে যাওয়া এক মার্কিন সাবমেরিনের অমীমাংসিত রহস্য
পরবর্তীতে ১৯৭৩ সালে পানির ১৬ হাজার ফুট গভীরে থাকা কে-১২৯ সাবমেরিনের নিউক্লিয়ার ব্যালাস্টিক মিসাইলসহ স্পর্শকাতর যন্ত্র চুরি করতে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এক অবিশ্বাস্য অপারেশন পরিচালনা করে। এতে সোভিয়েত নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড ও রেডিও যোগাযোগ সামগ্রীসহ গোপন কোডবুক পেয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্র। আগ্রহী পাঠকরা চাইলে বিস্তারিত পড়ে নিতে পারেন,
প্রজেক্ট অ্যাজোরিয়ান: সোভিয়েত সাবমেরিন দখলে সিআইএ-র গোপন অপারেশন
৫) ইউএসএস থ্রেশার
ডুবে যাওয়া মার্কিন সাবমেরিন ইউএসএস থ্রেশার ছিল বিশ্বের প্রথম নিউক্লিয়ার সাবমেরিন দুর্ঘটনা। ১৯৬৩ সালের ১০ এপ্রিল ৪০০ মিটার গভীরে ডুব দেয়ার একটি পরীক্ষা করার সময় সাবমেরিনটির ইঞ্জিন রুমের হাল (বডি) পানির প্রচণ্ড চাপে ফুটো হয়ে পানি ঢুকতে শুরু করে। একসময় নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টরে পানি ঢুকে সেটি বন্ধ হয়ে যায়। সাবমেরিনের ডাইভ দেয়া নিয়ন্ত্রণকারী ব্যালাস্ট ট্যাংকের পাইপে ক্রুটি থাকায় এটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ক্র্যাশ ডেপথ লিমিট অতিক্রম করে পানির চাপে চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে ধ্বংস হয়ে যায়। পানির উপরে থ্রেশারের সঙ্গী একটি উদ্ধারকারী জাহাজ থাকলেও সেটি কিছুই করার সুযোগ পায়নি। এতে ১২৯ জন নাবিকের সবাই প্রাণ হারায় যা প্রাণহানির দিক দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঘটনা। ১৩০ জন নাবিকের মৃত্যু নিয়ে সবার উপরে আছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের ফরাসি সাবমেরিন ক্রুজার ‘সুরক্যুফ’। এই সাবমেরিনের ডেকের উপর ৮ ইঞ্চি ব্যাসের দুটো কামান থাকায় একে সাবমেরিন ক্রুজার বলা হতো।
ক্ষেত্রবিশেষে সাবমেরিন শত্রুর জন্য যতটা ভয়ংকর, তারচেয়েও ভয়ংকর নিজেদের জন্য। বর্তমানে দুর্ঘটনা থেকে বাঁচতে আধুনিক সাবমেরিনগুলোতে স্যাটেলাইট যোগাযোগ, ইমারজেন্সি সোনার বিকন, লাস্ট পজিশন আইডেন্টিফাইং বয়া, সাবমেরিন থেকে বের হবার জন্য ইমারজেন্সি এস্কেপ ক্যাপসুলসহ সাবমেরিন উদ্ধারকারী বিশেষ ধরনের জলযান ইত্যাদি সুবিধা বিভিন্ন দেশের নৌবাহিনীতে থাকে। অতীতের এসব ভয়াবহ দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি আর কোনো দেশের ক্ষেত্রে না ঘটুক- এই আমাদের প্রত্যাশা।
সাবমেরিন সম্পর্কে আরও জানতে পড়ে নিন এই লেখাগুলো:
১) মিসাইল দিয়ে চিঠি ডেলিভারির বিচিত্র এক ইতিহাস
২) আই-৪০০ ক্লাস সাবমেরিন: পানির নিচের জাপানি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার
৩) ভারত-পাকিস্তান নৌ যুদ্ধ (পর্ব-৩) : যেভাবে ডুবে গিয়েছিল গাজী সাবমেরিন