পারস্পারিক চুক্তি বা সমঝোতার মাধ্যমে দুটি দেশের মধ্যে বৈরিতা কাটিয়ে তৈরি হতে পারে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। কখনো বাণিজ্যিক প্রসার, কখনো সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি, কখনো সম্পর্ক উন্নয়ন, কখনো বা দেনা পাওনা বুঝে নিতে এক টেবিলে বসতে বাধ্য হন বিভিন্ন দেশে কর্ণধাররা। কখনো আবার শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সমঝোতার টেবিলে বসে যান পরস্পরের মুখ দেখতে না চাওয়া শত্রুভাবাপন্ন দুটি দেশও।
আধুনিক বিশ্বের অধিকাংশ যুদ্ধ বা বৈরিতার সমাপ্তি ঘটেছে চুক্তির মাধ্যমে। তবে বিশ্বের এমন কিছু চুক্তিও আছে যেগুলো শান্তির পরিবর্তে নিয়ে এসেছে অশান্তির বার্তা। দগদগে ঘায়ে ফেলেছে নুনের ছিটা। ভার্সাই চুক্তি বোধ হয় এমনই একটি চুক্তি ছিল।
বাহ্যিক দৃষ্টিতে দেখা যায় ভার্সাই চুক্তির মাধ্যমেই সমাপ্তি ঘটে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত নিরুপায় জার্মানির উপর এ চুক্তির শর্তগুলো চাপিয়ে দেয়া হয়। এজন্য অনেক বিশ্লেষকই মনে করেন, একপেশে এই চুক্তির কারণেই উন্মুক্ত হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পথ।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরাজয় এবং গ্লানিকর সময় যখন চলছিল, তখন জার্মানির জন্য যুদ্ধবিরতি বা সমঝোতা করা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো উপায় ছিল না। ১৯১৭ সালের অক্টোবরের ঠিক সেই সময় জার্মান সরকার তৎকালীন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসনের কাছে একটি সাধারণ যুদ্ধ বিরতির আহবান জানান। তারই প্রেক্ষাপটে উড্রো উইলসন ১৯১৮ সালের ৮ জানুয়ারি কংগ্রেসে একটি ভাষণ প্রদান করেন, যাতে ইউরোপের শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং জাতিপুঞ্জ গঠনের আহবান জানানো হয়। সে সময় উড্রো উইলসন তার ঐতিহাসিক ১৪ দফা পেশ করেন। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে উড্রো উইলসনের এই ১৪ দফাকেই সঠিক শান্তির একমাত্র উপায় হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
১৪ দফার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দফাটি ছিল জার্মানির কাছে যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত সকল মিত্রপক্ষের ক্ষতিপূরণ দাবী। আরো বেশ কিছু প্রস্তাব ছিল, যেমন- ইতালির সীমানা পুনর্নিধারণ, স্বাধীন পোল্যান্ড রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, সকল রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও স্বাধীনতা রাজ্যসীমা নিরাপত্তা রক্ষায় জাতিপুঞ্জ গঠন করা এবং তুরস্কের সমস্যাগুলোর সমাধান।
সেদিন কংগ্রেসে দাঁড়িয়ে উড্রো উইলসনের সেই ভাষণ শান্তির বাণী হিসেবে আজও স্মরণীয় হয়ে আছে। তিনি বলেন,
পৃথিবীর প্রত্যেক মানুষই লাভের খাতিরে একে অন্যের অংশীদার, এবং আমাদের দিক দিয়ে এটা বলা যায় যে, সেই পর্যন্ত আমাদের সাথে ন্যায়বিচার করা হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা অন্যদের সাথে ন্যায়বিচার করব।
কিন্তু আমেরিকানরা তার এই চৌদ্দ দফা মেনে নিল না। দেশীয় বাধা এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক কারণে তার এই দাবীগুলো জটিল আকার ধারণ করল।
এরপর সময় অনেক গড়াল। ১৯১৯ সালের ১৮ জানুয়ারি এক বসন্তে প্যারিসে শুরু হয়ে গেল শান্তি আলোচনা। ঐতিহাসিক এই সম্মেলনে যোগদান করেন ৩২টি মিত্রদেশের কুটনৈতিকরা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিজয়ী মিত্রপক্ষ পরাজিত অক্ষশক্তির জন্য শর্তাবলি তৈরির জন্যই মূলত এই সম্মেলনের আয়োজন করে। এই শান্তি আলোচনা ছিল একপাক্ষিক। কারণ এই আলোচনাতে জার্মানিসহ পরাজিত কোনো শক্তিকে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হলো না। মূলত প্যারিস শান্তি সম্মেলনের একটা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এখানে কোনো পরাজিত দেশের প্রতিনিধিকে আলোচনায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া হয়নি। সেই হিসেবে জার্মানিকেও এই আলোচনায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয়নি। প্যারিস শান্তি সম্মেলনের পরবর্তী উদ্যোগ হিসেবে এই ভার্সাই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
সম্মেলনের মূল সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে ছিল লিগ অফ নেশনসের সৃষ্টি, পরাজিত দেশগুলোর সাথে পাঁচটি শান্তিচুক্তির পাশাপাশি জার্মানির সাথে ভার্সাই চুক্তি, জার্মানি এবং অটোমানদের বিদেশে দখলকৃত অংশগুলো পুরস্কার হিসেবে দিয়ে দেয়ার আদেশনামা, মূলত ব্রিটেন এবং ফ্রান্সকে দিয়ে দিতে হবে, জার্মানির উপর ক্ষতিপূরণের দায় চাপিয়ে দেওয়া এবং জাতিগত সীমানা নির্ধারণে নতুন জাতীয় সীমারেখা প্রণয়ন। এ সম্মেলনের মুখ্য ভূমিকা পালন করেন ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড লয়েড জর্জ, ইতালির ভিট্টোরিও অরল্যান্ডো, ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী জর্জেস ক্ল্যামেনকু এবং যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন। এই চার ব্যক্তিই মূলত ভার্সাই চুক্তির শর্তগুলো নির্ধারণ করেন। এই চারজন ঐতিহাসিকভাবে ‘বিগ ফোর’ নামে পরিচিত।
এই সম্মেলনের ২৩১ নং অনুচ্ছেদে জার্মানিকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত করা হয় এবং “জার্মানি এবং তার মিত্রদের আক্রমণ”-কে প্রথম যুদ্ধের জন্য দায়ী করা হয়। এটা ছিল জার্মানির জন্য চূড়ান্ত অপমানজনক একটি বিধান।
চারদিন শান্তি আলোচনার পর ২১ জানুয়ারি সম্মেলনের সমাপ্তি ঘোষণা করা হলো। এদিকে ভার্সাই চুক্তির সন্ধিগুলো আগেই নির্ধারণ করা হয়ে গেছে। এখন শুধু শর্তগুলো জার্মানিকে জানিয়ে দেওয়ার পালা। তাই প্যারিস শান্তি সম্মেলনের পর জার্মানির সাথে আলোচনা ও সন্ধি স্থাপনের লক্ষ্যে ভার্সাই রাজপ্রাসাদে একটি বৈঠকের আহ্বান করা হয়। প্যারিস থেকে ভার্সাইয়ের দূরত্ব ছিল মাত্র ২২ কিলোমিটার। ১৬৬০ সালে নির্মিত ভার্সাই রাজপ্রাসাদ ছিল ফ্রান্সের রাজার আবাসস্থল।
১৯১৯ সালের ২৮ জুন ভার্সাই রাজপ্রসাদের মিরর হলে মুখোমুখি বসেছেন জার্মানি এবং মিত্র পক্ষের ৩২টি দেশের নেতৃবৃন্দ। মিত্রবাহিনী কর্তৃক গৃহীত চুক্তিপত্র পড়ে শুনিয়ে দেওয়া হলো জার্মান প্রতিনিধি দলকে। হল রুমে বসেই জার্মান প্রতিনিধি দল সন্ধির শর্তগুলো নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করলেন। কারণ চুক্তিগুলো ছিল একপাক্ষিক। এছাড়া এই চুক্তির শর্ত নির্ধারণে জার্মানিকে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হয়নি। মূল সমস্যা ছিল এই চুক্তিতে জার্মানিকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অসন্তোষ থাকা সত্ত্বেও সেদিন মিত্রবাহিনী কর্তৃক গৃহীত শান্তিচুক্তি পত্রে জার্মানি স্বাক্ষর করে দেয়। কারণ এছাড়া দ্বিতীয় কোনো পথ তাদের জন্য খোলা ছিল না।
২০০ পৃষ্ঠার এই চুক্তিপত্রটি ইংরেজি এবং ফরাসি ভাষায় লেখা ছিল। ১৫টি অধ্যায়ে মোট ধারা সন্নিবেশিত ছিল ৪৩৯টি। জার্মানি সংক্রান্ত শর্তাবলী ছাড়াও আরো বেশ কিছু শর্ত এতে অন্তর্ভুক্ত ছিল। যেমন: লিগ অব নেশনস প্রতিষ্ঠা, আন্তর্জাতিক শ্রমিক দপ্তর এবং একটি স্থায়ী আন্তর্জাতিক বিচারালয় প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত চুক্তিপত্র। এই সন্ধি স্থাপনে মূল ভূমিকা পালন করেন মিত্রপক্ষের ‘বিগ ফোর’ খ্যাত সেই চারজন বিখ্যাত ব্যক্তি।
৪৩৯ ধারার মধ্যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা ছিল এমন-
২৩১: প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মিত্রপক্ষের সকল ক্ষয়ক্ষতির জন্য জার্মানির কাছে ক্ষতিপূরণ দাবী করা হয়। যার মোট পরিমাণ ছিল প্রায় ৩৩ বিলিয়ন ডলার, যার কিছু অংশ পূরণ করতে গিয়েও জার্মানি দেউলিয়া হয় যায়।
১৫৯-১৬৩: ভার্সাই চুক্তির মাধ্যমে জার্মানির সামরিক শক্তি কমিয়ে আনতে বলা হয়, সৈন্য সংখ্যা সর্বোচ্চ ১ লক্ষ নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। আর এসকল সৈন্য শুধুমাত্র অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য নিয়োজিত থাকবে। নৌবাহিনীর সর্বোচ্চ সংখ্যা নির্ধারণ করে দেওয়া হয় ১৫ হাজার। যেসকল যুদ্ধজাহাজ ও সাবমেরিন রয়েছে তা মিত্রবাহিনীর হাতে সমর্পণ করবে। জার্মানির কোনো বিমানবাহিনী থাকতে পারবে না।
২২৭-২৩১: প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্য জার্মানিকে দায়ী করা হয় এবং জার্মানিকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়।
৫১: আলসেস-লাউরেইন অঞ্চলটি জার্মানি ফ্রান্সের থেকে দখল করে নেয় ১৮৭১ সালে। সেটা ফ্রান্সকে ফেরত দিতে হবে।
৮০: জার্মানি থেকে আলাদা করে অস্ট্রিয়াকে স্বাধীনতা দিতে হবে।
১১৯: বিভিন্ন মহাদেশে জার্মানির কলোনিগুলো মিত্রপক্ষ নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেবে। এসকল কলোনি আর কখনো জার্মান সাম্রাজ্যভুক্ত হতে পারবে না। ব্রিটেন, ফ্রান্স নিজেদের মধ্যে ক্যামেরুন ও টোগোকে ভাগ করে নেবে। জার্মান নিয়ন্ত্রিত দক্ষিণ আফ্রিকার অনেক এলাকা দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে হস্তান্তর করে দিতে হবে।
৪২-৪৪: এ সকল শর্ত কার্যকর করার নিশ্চিত করতে রাইন নদীর পশ্চিম তীরবর্তী জার্মান ভূখণ্ডে মিত্রশক্তি ও তাদের সহযোগী সেনাবাহিনীর দখলে থাকবে ১৫ বছর।
১৬৪: জার্মানি অন্য কোনো দেশ থেকে সমরাস্ত্র আমদানি রপ্তানি করতে পারবে না। সাবমেরিন, ভারী কামান, ট্যাংক ও বিষাক্ত গ্যাস তৈরি করতে পারবে না এবং নিজ দখলে রাখতে পারবে না।
৮৭: ক্ষতিপূরণস্বরূপ উত্তর শ্লেসভিগ (Northern Schleswig) ডেনমার্কের কাছে হস্তান্তর করতে হবে। প্রুশিয়ান এলাকাগুলো হস্তান্তর করতে হবে পোল্যান্ডের কাছে।
আধুনিক ইতিহাসে ভার্সাই চুক্তি নিয়ে আলোচনা সমালোচনার শেষ নেই। আজকের জার্মান জাতি একে “Dictated Peace” বা বিজিতের উপর বিজেতার জোর করে চাপিয়ে দেওয়া শান্তি চুক্তি এবং জার্মানির সর্বস্ব হরণের চুক্তি বলে মনে করে। ভার্সাই চুক্তির পূর্বে মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন যে চৌদ্দ দফা দাবী উত্থাপন করেছিলেন সেটাকেই শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সবচেয়ে কার্যকরী ছিল বলে মনে করেন অনেক বিশেষজ্ঞ। ঐতিহাসিক সেই চৌদ্দ দফাতে সকল দেশকেই সমরাস্ত্র ও সামরিক শক্তি কমিয়ে ফেলার জন্য আহবান জানানো হলেও ভার্সাই চুক্তিতে শুধুমাত্র জার্মানিকে সামরিক শক্তি হ্রাস করতে বাধ্য করা হয়।
চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পরের বছরই জার্মানিতে উত্থান ঘটে নাৎসি বিপ্লবী পার্টির। তারা দ্ব্যর্থহীনভাবে ভার্সাই চুক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানির রাজতন্ত্রের বিলুপ্তি ঘটে। প্রতিষ্ঠিত হয় গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা। কিন্তু ফ্যাসিবাদী হিটলারের উত্থানের মাধ্যমে বিলুপ্ত হয়ে যায় গণতান্ত্রিক সরকারও। জার্মানির গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত এবং ফ্যাসিবাদী হিটলারের অভ্যুদয়ের পেছনে এই ভার্সাই চুক্তির সরাসরি কার্যকরী ভূমিকা রয়েছে বলে অনেকেই মনে করেন। ভার্সাই চুক্তির এই অসন্তোষকে মূলধন করে নাৎসি প্রধান হিটলার ভার্সাই চুক্তিকে অস্বীকার করেন। এসবের ধারাবাহিকতায় পরবর্তীকালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপট দানা বাধতে শুরু করে। এজন্য বলা হয়ে থাকে- ভার্সাই চুক্তির মধ্যেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীজ বুনে দেয়া হয়েছিল।
আরো পড়তে পারেন- প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কিত বই