১৮৬০ সালে ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে আব্রাহাম লিংকনকে মুখোমুখি হতে হয় এমন এক সংকটের, যার সামনে পড়তে হয়নি তার আগে কোনো আমেরিকান প্রেসিডেন্টকে, গৃহযুদ্ধ। সেই সময়ে আমেরিকার রাজ্যগুলোর সাথে কেন্দ্রের বেশ কিছু ব্যাপার নিয়ে দ্বন্দ্ব চলছিল। কিন্তু দাসপ্রথা নিয়ে উত্তরের রাজ্যগুলোর সাথে দক্ষিণের রাজ্যগুলোর বিভেদ ছিল দিন আর রাতের মতো পরিষ্কার।
কৃষ্ণাঙ্গদের দাস হিসেবে রাখা না রাখার কেন্দ্রীয় আইন কেন্দ্র ও উত্তরের রাজ্যগুলোর সাথে দক্ষিণের রাজ্যগুলোর বিবাদকেই গৃহযুদ্ধ শুরুর প্রধান কারণ হিসেবে বলে থাকেন অনেক ঐতিহাসিক। ১৮৫২ সালে প্রকাশিত ‘আংকেল টমস কেবিন’ যখন প্রকাশিত হয়, তখনও আমেরিকায় দাসপ্রথা বিরোধী মনোভাব ছিল খুবই কম। কিন্তু খুব দ্রুতই বইটি জনপ্রিয়তা পায় আর মানুষজন সচেতন হয়ে ওঠে দাসদের ব্যাপারে। কিন্তু আমেরিকার দক্ষিণের রাজ্যগুলো ছিল পুরো মাত্রায় দাসনির্ভর। ফলে দাসপ্রথা বিরোধী মনোভাব তাদের নাড়া দিতে পারেইনি, উল্টো পুরো দেশকে দুই ভাগে ভাগ করে দেয়। তবে কি এই একটি বই দায়ী ছিল চার বছরের রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের জন্য? এর উত্তর পেতে হলে ফিরে যেতে হবে উপন্যাসের কাহিনীতে, সেই সাথে পেছনের ইতিহাসেও।
আংকেল টমস কেবিন
উনিশ শতকের সেরা উপন্যাস হিসেবে স্বীকৃত বইটির লেখিকা ছিলেন হ্যারিয়েট বিচার স্টো। প্রথম বছরেই বইটির প্রায় তিন লক্ষাধিক কপি বিক্রি হয়। বিক্রির সংখ্যা দিয়ে একমাত্র বাইবেলই ছিল আংকেল টমস কেবিনের সামনে। উপন্যাসে আর্থার শেলবির ফার্মে ক্রীতদাস হিসেবে কাজ করতেন মধ্যবয়স্ক টম। আর্থার শেলবি তার দাসদের সাথে ভালো ব্যবহার করলেও অর্থের অভাবে সিদ্ধান্ত নেন দুজন দাসকে বিক্রি করে দেবার। সেই দুই দাস ছিলেন টম এবং আর্থারের স্ত্রীর দাস এলিজার ছেলে হ্যারি। তাদের বিক্রি করার টাকা দিয়ে দেনা শোধ করাসহ ফার্মকে লাভজনক করার পরিকল্পনা ছিল আর্থারের।
কিন্তু ঘটনাক্রমে এলিজা এই পরিকল্পনা জেনে যায় এবং তার ছেলে হ্যারিকে নিয়ে পালিয়ে যায় কানাডার উদ্দেশ্যে। আমেরিকায় সেসময় দাসপ্রথা চালু থাকলেও কানাডায় ছিল না। অন্যদিকে এলিজা টমকে পালানোর কথা বললেও তিনি রাজি হননি। ফলে টমকে বিক্রি হয়ে যেতে হয় ক্রীতদাস ব্যবসায়ীদের কাছে। আংকেল টমের পরবর্তী গন্তব্য হয় সেইন্ট ক্ল্যায়ার নামের এক মালিকের কাছে। সেইন্ট ক্ল্যায়ারও দাসদের প্রতি খারাপ ব্যবহার করতেন না, তবে তিনি কৃষ্ণাঙ্গদের নিচু জাত হিসেবেই দেখতেন। সেইন্ট ক্ল্যায়ারের ছোট্ট মেয়ে ইভার সাথে আংকেল টমের বেশ শখ্যতা গড়ে ওঠে। কিন্তু হঠাৎ অসুস্থ হয়ে ইভা মারা যায়। তবে মারা যাবার আগে সে আংকেল টমকে এক অদ্ভুত স্বপ্নের কথা বলে যায়, যেখানে ছিল না কোনো ভেদাভেদ।
ইভা মারা যাবার কিছুদিন পরে তার বাবাও মারা যান। ফলে আংকেল টমকে আবারো বিক্রি হয়ে যেতে হয়। এবার তার গন্তব্য হয় সাইমন লেগ্রির কাছে, যে ছিল এক নিষ্ঠুর মানুষ। সাইমন টমকে নির্দেশ দিত অন্য দাসদের চাবুক দিয়ে পেটানোর জন্য। কিন্তু টম সেই নির্দেশ অমান্য করায় টমের উপর নিদারুণ অত্যাচার করে সাইমন। আংকেল টম খ্রিস্টধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন, সেই সাথে অন্য দাসদেরও বাইবেল থেকে যীশুর বাণী শোনাতেন। এ কাজটিও সাইমনের চক্ষুশূলে পরিণত হয়। ফলে একসময় আংকেল টম অন্যদের বাইবেল পড়ে শোনানো বন্ধ করে দেন।
এর মধ্যে আংকেল টম দুজন দাসকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেন। সাইমন বুঝতে পারেন টম তাদের সাহায্য করেছেন। ক্ষিপ্ত হয়ে সাইমন টমকে প্রচন্ড মারেন এবং মেরে ফেলার নির্দেশ দেন। মারা যাবার আগে আংকেল টম দুটি স্বপ্ন দেখেন- একটিতে যীশুকে, অন্যটিতে ইভাকে। এরপর ধর্মের প্রতি টমের বিশ্বাস আবার ফিরে আসে। এদিকে আংকেল টমের প্রথম মালিক আর্থার শেলবির ছেলে জর্জ শেলবি আংকেল টমকে মুক্ত করে দিতে সাইমনের কাছে আসে, কিন্তু বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছিল তার। জর্জ ফিরে গিয়ে তার ফার্মের সব দাসকে মুক্ত করে দেয়, সেই সাথে তাদের মনে করিয়ে দেয় আংকেল টমের কষ্ট আর নিঃস্বার্থতার কথা।
আংকেল টমস কেবিনের অনুপ্রেরণা
১৮৩০ এর দশকে দক্ষিণ ওহাইয়োতে বাস করতেন হ্যারিয়েট, সে সময় তিনি সাক্ষাৎ পান দাসত্ব থেকে মুক্তি পাওয়া কিছু মানুষের। তাদের কাছ থেকে সরাসরি জানতে পারেন দাসত্ব জীবনের ভয়াবহতার কথা। হ্যারিয়েট সব সময়ই বলেছেন, কোনো নির্দিষ্ট দাসের জীবন নিয়ে তার উপন্যাসটি নয়। আংকেল টমস কেবিন প্রকাশের ঠিক পরের বছরই তিনি আরেকটি বই প্রকাশ করেন, ‘দ্য কি টু আংকেল টমস কেবিন’। এই বইয়ে তিনি প্রকাশ করেন সত্যিকারের দাসদের কষ্টের জীবনের কথা, দাসত্ব থেকে পালিয়ে যাবার কথা। তবে তিনি সাবধানতার কারণে পালিয়ে যাবার ব্যাপারে বিস্তারিত লেখেননি। এই বইটি আমেরিকার দাসপ্রথার অপরাধগুলোর একটি দলিল হিসেবে বলা যেতে পারে।
আংকেল টমস কেবিনের প্রভাব
গৃহযুদ্ধের পেছনে যখন এত কারণ ছিল, তাহলে আংকেল টমস কেবিন ঠিক কীভাবে প্রভাবিত করলো গৃহযুদ্ধের সূচনাকে? উত্তরের জনগণ দাসপ্রথার ব্যাপারে খুব একটা চিন্তিত না হলে কৃষ্ণাঙ্গদের মানুষ হিসেবেই গণ্য করতো না বেশিরভাগ শ্বেতাঙ্গ আমেরিকান। ফলে দক্ষিণের দাসদের ব্যাপারে তাদের না ছিল কোনো চিন্তা, না ছিল কোনো সহমর্মিতা। তারা নিজেদের জীবন নিয়েই ব্যস্ত ছিল, দাস কিংবা কৃষ্ণাঙ্গদের কষ্টের কথা ভাবার কোনো অবকাশ তাদের ছিল না।
কিন্তু ‘আংকেল টমস কেবিন’ প্রকাশিত হবার পর আর গল্প বলার ধরনের জনপ্রিয়তা সবাইকে নতুন করে ভাবিয়ে তোলে। সাধারণ জনগণ নিজেদের অবস্থান থেকে দাসদের অবস্থা বিবেচনা করার সুযোগ পায়। ফলে খুব দ্রুত দাসপ্রথা বিরোধী মনোভাব ছড়িয়ে পড়ে উত্তরের রাজ্যগুলোতে। অনেকটা স্কুলে থাকতে সমাজ বইয়ে মোঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাস পড়া আর আলেক্স রাদারফোর্ডের ‘এম্প্যায়ার অব দ্য মোঘলস’ সিরিজ পড়ে মোঘল সাম্রাজ্য জানার মতো। উপন্যাস পড়ে খুব সহজেই নিজেদের গল্পের চরিত্রগুলোর সাথে মেলানো যায়। আর ঠিক এই জায়গাটিতেই প্রভাব রাখে এই উপন্যাসটি। সবাইকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে দাসত্ব নিয়ে, দাসদের কষ্ট নিয়ে।
উত্তরের জনগণ যেমন উপন্যাস যেমন উত্তরের জনগণকে সচেতন করে সাড়া ফেলে, দক্ষিণে ঘটে ঠিক উল্টো ঘটনা। ‘আংকেল টমস কেবিনকে’ প্রশ্নবিদ্ধ করাসহ দক্ষিণের সাহিত্যিকরা দাসপ্রথার পক্ষে লেখা শুরু করেন। দাসপ্রথা কেন দরকার, দাসপ্রথার উপকারী দিক এসব নিয়ে শুরু হয়ে লেখালেখি। আর এর ফলে গোলাবারুদের গৃহযুদ্ধ শুরু হবার আগেই সাহিত্যিকরা নিজেদের মধ্যে কলমের যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছিলেন, আর এর মূলে যে ছিল আংকেল টমস কেবিন তা তো সহজেই বোঝাই যায়। কিন্তু এই বিখ্যাত উপন্যাসটি সূচনা করে গৃহযুদ্ধের- এ কথাটি বলা কি আদৌ যৌক্তিক? এজন্য আমাদের ফিরে যেতে হবে গৃহযুদ্ধের আগের বছরগুলোতে।
আমেরিকায় দাসপ্রথা
স্বাধীনতার পর শুরু থেকেই আমেরিকায় দাসপ্রথা প্রচলিত ছিল। এমনকি জর্জ ওয়াশিংটনসহ আমেরিকার স্বাধীনতার পথিকৃতদের অনেকেরই ছিল নিজস্ব দাস। তবে শুরু থেকেই আমেরিকার উত্তরের রাজ্যগুলো ছিল দাসপ্রথা বিরোধী মনোভাবের। আর এর ফলস্বরূপ ১৮০০ সালের পর থেকেই রাজ্যগুলো নিজেদের মতো করে দাসপ্রথা, বিশেষ করে আফ্রিকা থেকে দাস নিয়ে আসার উপর কড়াকড়ি আরোপ করা শুরু করে। ১৮০৮ সালে আমেরিকা বাইরে থেকে দাস কেনা-বেচাকে আইনত দন্ডনীয় হিসেবে আইন করে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি রাজ্য নিজেদের রাজ্যে একেবারেই কিংবা ধাপে ধাপে দাসপ্রথা বন্ধ করার উদ্যোগ নেয়। কোনো রাজ্যে অপরাধী ব্যতীত সব দাসকে মুক্ত করা হয়, কোনো রাজ্যে দাসদের শিশুদের মুক্তি দেয়া হয়, আর বয়স্কদের মৃত্যুর মাধ্যমে দাসপ্রথার অবসান করার আইন করা হয়। রাজ্যগুলো মূলত শহুরে হওয়াতে তাদের দাসের প্রয়োজন হতো না, ফলে এ ধরনের আইনগুলো বিরোধীতার মুখোমুখি হয়নি।
১৮৩৫ সালে নিউ ইয়র্কের দুই ব্যবসায়ী বই দাস বিরোধী কিছু লিফলেট দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে প্রচারের চেষ্টা করেন। কিন্তু তাদের চেষ্টা কোনো কাজেই আসেনি। তাদের বানানো পোস্টার আর ব্যানারগুলো দক্ষিণ ক্যারোলিনার রাস্তায় প্রকাশ্যে পোড়ানো হয়। এছাড়া উইলিয়াম গ্যারিসন নামে আরেক ব্যক্তি প্রকাশ্যে আমেরিকার সংবিধান পুড়িয়ে দাবী করেন, এই সংবিধান হচ্ছে সব নষ্টের মূল। আরো অনেকেই ছোটখাট চেষ্টা করেছেন নিজেদের মতো করে। কিন্তু কোনোটাই খুব একটা ফলপ্রসূ হয়নি।
কিন্তু দক্ষিণের রাজ্যগুলোর ক্ষেত্রে দাসপ্রথার ব্যাপারে অবস্থান ছিল পুরো উল্টো। দক্ষিণের রাজ্যগুলো ছিল কৃষি নির্ভর আর কৃষি কাজের জন্য তাদের দরকার হতো প্রচুর দাসের। এছাড়া তামাক, তুলা আর আখের ক্ষেতে অনেক সময় নিয়ে অনেক কাজ করতে হতো বলে দক্ষিণের রাজ্যগুলো ছিল দাসপ্রথার পক্ষে। তবে আংকেল টমস কেবিন প্রকাশিত হবার আগপর্যন্ত পুরো ব্যাপারটিতে সাধারণ জনগণের খুব একটা অংশগ্রহণ ছিল না। তারা ‘যেমন চলছে চলুক’ ধরনের মনোভাব নিয়েই ছিল।
কেন্দ্র বনাম রাজ্য দ্বন্দ্ব
যেকোনো যুদ্ধ কখনোই শুধুমাত্র একটি কারণে সংঘটিত হয় না। প্রতিটি যুদ্ধের পেছনে থাকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক বিভিন্ন কারণ। আবার শুধুমাত্র একটি উপন্যাসের কারণে প্রকাশের প্রায় দেড় দশক পরে দেশ দুই ভাগ হয়ে গৃহযুদ্ধ শুরু করে দেবে এটাও বাস্তবিক না। দাসপ্রথা আর সেটি নিয়ে উত্তর-দক্ষিণের রাজনীতি যুদ্ধ বাঁধার অন্যতম কারণ ছিল, আর এ দ্বন্দ্বের সাথে মিলে যায় কেন্দ্রের সাথে রাজ্যগুলোর নিজেদের অধিকারের দ্বন্দ্ব।
রাজ্যগুলোর নিজেদের অধিকার ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে রাজ্যগুলোর, বিশেষ করে উত্তরের রাজ্যগুলোর দ্বন্দ্বের আরেকটি বড় কারণ। আমেরিকার স্বাধীনতার সময় ১৩টি ভিন্ন ভিন্ন রাজ্য একত্রিত হয়ে গঠন করে যুক্তরাষ্ট্র, যার কেন্দ্রীয় ক্ষমতা ছিল ফেডারেল সরকারের হাতে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ফেডারেল সরকারের সব কথা মানতে নারাজ ছিল অনেক রাজ্যই। রাজ্যগুলো কিছু ব্যাপারে কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতা চেয়েছিল। এ ব্যাপারে আমেরিকার সংবিধান লেখার সময়ে দুই পক্ষের লোক থাকলেও শেষপর্যন্ত রাজ্যগুলোকে সাংবিধানিকভাবে বাধ্য করা হয় কেন্দ্রকে মেনে চলতে। আর এই ব্যাপারটি নিয়েই কেন্দ্রের সাথে দক্ষিণের রাজ্যগুলোর দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে ওঠে দাসপ্রথাকে কেন্দ্র করে।
ড্রেড স্কটের মামলা
আমেরিকায় দাসপ্রথা নিয়ে সাধারণ মানুষের, বিশেষ করে উত্তরের রাজ্যগুলোর সচেতনতা বাড়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে ড্রেড স্কটের মামলা। ১৯৪৩ সালে স্কটের মালিক মারা গেলে স্কট তার নিজের ও পরিবারের মুক্তি দাবী করে। কিন্তু তার মালিকের স্ত্রী আইরিন তাদের মুক্তি দিতে অস্বীকৃতি জানালে স্কট তার স্ত্রীসহ সেইন্ট লুইস কাউন্টি সার্কিট কোর্টে আইরিনের বিরুদ্ধে মামলা করে নিজেদের মুক্তি দাবী করে।
১৯৪৭ সালে সেই কেসের ফলাফল আসে আর সেই ফল যায় আইরিনের পক্ষে। তবে বিচারক স্কটকে দ্বিতীয় ট্রায়ালের সুযোগ দেন। মজার ব্যাপার, এবার ফল যায় উল্টে, আদালত স্কট ও তার পরিবারের মুক্তির পক্ষে রায় দেয়। কিন্তু সেখানে ঘটনার শেষ নয়, বরং শুরু। এবার আইরিন মিসৌরি সুপ্রিম কোর্টে নিম্ন আদালতের বিপক্ষে মামলা করে। ১৮৫২ সালের সেই মামলায় নিম্ন আদালতের রায় বাতিল করা হয়, ফলে স্কটের মুক্তি তখনও পেয়ে ওঠা হয়নি।
ততদিনে স্কটের মালিকানা পেয়েছে আইরিনের ভাই জন স্যানফোর্ড। ১৮৫৩ সালে স্কট আমেরিকার সুপ্রিম কোর্টে মামলা করে তার মুক্তির জন্য। কিন্তু ৪ বছর পর ১৮৫৭ সালে সুপ্রিম কোর্ট জন্ম দেয় আমেরিকার ইতিহাসের অন্যতম বিতর্কিত একটি রায়ের। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে বলা হয়, আফ্রিকান বংশোদ্ভূত কেউ আমেরিকার নাগরিক হিসেবে গণ্য হবে না, সে দাস হোক আর মুক্ত! আর যেহেতু তারা আমেরিকার নাগরিক নয়, তাই আইনত আমেরিকায় তাদের কোনো অধিকারও নেই। এছাড়াও যেহেতু দাসরা আমেরিকার নাগরিক না ও তাদের কোনো নাগরিক অধিকার নেই, সেহেতু কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্য কিংবা দাস মালিকদের ব্যাপারে নাক গলাতে পারবে না!
অবশ্য স্কট ও তার পরিবারের ভাগ্য ভালো ছিল। স্যানফোর্ড স্কট পরিবারকে পিটার ব্লো নামে আরেকজনের কাছে বিক্রি করে দেয়, যে তাদের মুক্তি দিয়ে দেয়। কিন্তু মুক্ত জীবনে বেশিদিন বাঁচা হয়নি স্কটের, ১৮৫৮ সালে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান তিনি। তবে দীর্ঘদিন ধরে চলা স্কটের মামলা আর আদালতের বিতর্কিত রায় উস্কে দেয় রাজনৈতিক বিতর্ক।
১৮৬০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন
১৮৫০ এর পর থেকেই দাস প্রথা নিয়ে উত্তর ও দক্ষিণের রাজ্যগুলোর বিভেদ দিন দিন প্রকট হয়ে উঠছিল। ১৮৬০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে এই বিভেদ এতটাই প্রকট হয়ে ওঠে যে, ডেমোক্রেট পার্টির মধ্যেই উত্তর-দক্ষিণ দুই পক্ষ দাঁড়িয়ে যায়। অন্যদিকে ১৮৫৪ সালে উইগ পার্টি থেকে রূপান্তরিত হওয়া রিপাবলিকান পার্টিতেও কিছুটা বিভেদ ছিল, কিন্তু নিজেদের মধ্যেই দুই ভাগ হয়নি। ১৮৬০ সালের নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টির পক্ষে দাঁড়ান আব্রাহাম লিংকন। তার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন উত্তরের ডেমোক্রেট পার্টির স্টিফেন ডগলাস। দক্ষিণের ডেমোক্রেটদের থেকে নির্বাচনে দাঁড়ান জন ব্রেকেনরিজ। দুই দলের নির্বাচনী প্রচারণাসহ সকল কর্মকান্ডে পরিষ্কার হয়ে উঠছিল যে, কিছুদিনের মধ্যেই একটা ঝামেলা বাঁধবেই। আর সেই ঝামেলা এড়ানোর জন্য কয়েকজন রাজনীতিবিদ গঠন করেন Constitutional Union Party, যে দল থেকে নির্বাচনে দাঁড়ান জন বেল।
৬ নভেম্বর, ১৮৬০, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফলে উত্তর আর দক্ষিণের বিভেদ একেবারে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে ওঠে। উত্তরের রাজ্যগুলোতে লিংকনের সংখ্যাগরিষ্ঠতা আর দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে ব্রেকেনরিজ। মাঝের বাফার রাজ্যগুলোতে যেতেন বেল। যেহেতু আব্রাহাম লিংকন ছিলেন দাস বিরোধী, তাই সবাই ধরে নিয়েছিল এবার ফেডারেল সরকার আইন করে আমেরিকায় দাস প্রথা পুরোপুরি নিষিদ্ধ করবে। ফলে আবারো রাজ্য বনাম কেন্দ্র দ্বন্দ্ব মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
জ্বলন্ত উনুনে বসা আমেরিকার রাজনৈতিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে নির্বাচনের ৪৪ দিনের মাথায়। ১৮৬০ সালের ২০ ডিসেম্বর দক্ষিণ ক্যারোলিনা যুক্তরাষ্টের কেন্দ্র থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। দক্ষিণ ক্যারোলিনার ভয় ছিল এরপর লিংকনের দাসবিরোধী মনোভাব। দক্ষিণ ক্যারোলিনা বিচ্ছিন্ন হবার কিছুদিনের মাঝেই একে একে মিসিসিপি, ফ্লোরিডা, টেক্সাস, আলাবামা, জর্জিয়া ও লুইজিয়ানাও নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে নেয় কেন্দ্র থেকে। এর সবগুলোই ঘটছিলো আব্রাহাম লিংকন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব বুঝে নেবার আগেই। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বুকানন এ ব্যাপারে কিছুই করেননি, বরং সমস্যাটির কোনো সমাধান না করে বোঝা চাপিয়ে গেছেন পরের প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের জন্য। বিদ্রোহী রাজ্যগুলো একত্রিত হয়ে ১৮৬১ সালের ফেব্রুয়ারিতে গঠন করে কনফেডারেশন। বিদ্রোহী রাজ্যগুলো শুধু নিজেদের বিচ্ছিন্নই করেনি, বরং ফেডারেল সরকারের অধীনে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোকেও নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়। ফলে দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে ফেডারেল সরকারের বিন্দুমাত্র ক্ষমতা অবশিষ্ট ছিল না।
১৮৬১ সালের ৬ মার্চ লিংকন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনা নিয়ে। দাসপ্রথা বিরোধী হলেও প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিজের প্রথম ভাষণে তিনি বলেন, যেসব রাজ্যে দাসপ্রথা রয়েছে সেটি বন্ধ করার কোনো পরিকল্পনা তার নেই। কিন্তু তিনি পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেন, কোনো অবস্থাতেই দক্ষিণের রাজ্যগুলোর নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে নেয়া মেনে নেবেন না। সাথে এটাও বলেন, যুদ্ধ ছাড়াই আলোচনার মাধ্যমে পুরো সমস্যাটির সমাধান করতে আগ্রহী তিনি।
কিন্তু সকল শান্তি পরিকল্পনা ভেস্তে যায় ১২ এপ্রিল কনফেডারেট সেনারা দক্ষিণ ক্যারোলিনার সামটার দুর্গে আক্রমণ করলে। ইউনিয়ন সেনাবাহিনী অর্থাৎ আমেরিকার কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে থাকা সেনাবাহিনী কোনো যুদ্ধ ছাড়াই আত্মসমর্পণ করে কনফেডারেশন সেনাবাহিনীর কাছে। ফলে বিনা রক্তপাতে জয়লাভ করে কনফেডারেশন। এ সাফল্য দেখে পরের তিন মাসের মধ্যে আরকানসাস, ভার্জিনিয়া, টেনেসি ও উত্তর ক্যারোলিনা বিদ্রোহ ঘোষণা করে যোগ দেয় কনফেডারেশনে।
শেষ কথা
গৃহযুদ্ধের পেছনে অনেকগুলো কারণ কাজ করেছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু ১৮৩০ এর দিক থেকেই চলে আসা দাসপ্রথা বিরোধী আন্দোলনের পালে হাওয়া লাগায় হ্যারিয়েটের আংকল টমস কেবিন। একটি বই যুদ্ধ বাধিয়ে দিয়েছে এটি সত্য নয় অবশ্যই। কিন্তু আমেরিকার গৃহযুদ্ধের ভিত গড়ে দিয়েছিল এই একটি উপন্যাস। জনগণের সমর্থন ছাড়া আব্রাহাম লিংকন প্রেসিডেন্ট হতে পারতেন না, হয়তো তিনি প্রেসিডেন্ট না হলে গৃহযুদ্ধ লাগতোও না। আর এই জনগণের সমর্থনের পেছনে ভূমিকা ছিল বিখ্যাত উপন্যাসটির। সব মিলিয়ে বলা যায়, আংকেল টমস কেবিনের কারণে আমেরিকার গৃহযুদ্ধ শুরু না হলেও যুদ্ধের সলতেতে আগুনটি এই উপন্যাসই ধরিয়ে দিয়েছিল।