শতায়ুর অধিকারী মানুষ পৃথিবীতে বিরল নয়। কিন্তু বয়স কারো বেলায় কখনো কেবলই সংখ্যা রয়ে যায়, আর কিছু মানুষ স্বল্পায়ু জীবন নিয়েও হয়ে যান ইতিহাসের নির্মাতা। মাত্র পঞ্চাশ বছরের জীবনকালেই পৃথিবীতে এক সমৃদ্ধির ইতিহাসের বীজ বপন করে যাওয়া তেমনই একজন মানুষ ইয়াতারো ইওয়াসাকি।
ইয়াতারোর জন্ম ১৮৩৫ সালে, ইয়াজিরো-মিওয়া ইওয়াসাকি দম্পতির ঘরে। দরিদ্র এই পরিবারটির বসবাস ছিল জাপানের তৎকালীন তোসা প্রদেশে, যেটি বর্তমানে কোচি অঞ্চলের আকি শহর হিসেবে পরিচিত। ইয়াতারোর বাবা কৃষিকাজ করতেন। তার বেড়ে ওঠা প্রচণ্ড দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে। ঋণের বোঝা তার পরিবারকে এতটাই কাবু করেছিল যে, তার পরদাদা তাদের বংশের সামুরাই উপাধি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। জীবনের রূঢ় বাস্তবতা কিশোর ইয়াতারোর মনে দারুণ প্রভাব ফেলেছিল; ঐ বয়সেই তার মনে উপলব্ধি জন্মেছিল, সমাজে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করতে হলে প্রয়োজন আকাশ-সম উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর সঠিক শিক্ষা অর্জন।
১৮৫৪ সাল, ইয়াতারোর বয়স তখন উনিশ। পড়ালেখার উদ্দেশ্যে তোসা গোত্রেরই আরেক সদস্যের সাথে এদো শহরে (বর্তমান টোকিও) যাবার সিদ্ধান্ত নিল সে। তাদের গ্রামের পেছনে ময়কেন নামের পাহাড়টিতে প্রায়ই উঠতো কিশোর ইয়াতারো। সেই পাহাড়ের উপরে একটি মন্দির ছিল। এদোর উদ্দেশ্যে রওনা হবার আগের রাতে ইয়াতারো সেই পাহাড়ের চূড়ায় উঠলো। ভবিষ্যতের স্বপ্ন আঁকতেই যেন সেখানে গিয়েছিল সে। মন্দিরের দরজায় স্বপ্নালু যুবক ইয়াতারো খোদাই করে লিখলো- “আমার ইচ্ছে পূরণ করার আগে আর কখনো এই পাহাড়ে উঠব না।”
এদোর বিখ্যাত পণ্ডিত গোনসাই আসাকার অধীনে শিক্ষাজীবন শুরু হলো ইয়াতারোর। কিন্তু ভাগ্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে তখনও অনেক পথ বাকি। একটি ঘটনায় এক বছরের মাথায় তাকে ফিরতে হলো গ্রামে। গ্রাম প্রধানের সাথে দ্বন্দ্বের জের ধরে ভয়ঙ্করভাবে আহত হয়েছিলেন ইয়াতারোর বাবা। স্থানীয় ম্যাজিস্ট্রেট বিচার তো দূরের কথা, তাদের কোনো কথাই শুনতে চাইলো না। তার আচরণে রেগে গিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটকে দুর্নীতিবাজ বলে অভিযোগ করে বসলেন ইয়াতারো। ফলাফল, সাত মাসের কারাদণ্ডের আদেশ এলো তার উপরেই।
জেল থেকে বেরুনোর পর ইয়াতারো একটি পাঠশালার সাথে যুক্ত হলেন। এটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তোয়ো ইয়োশিদা নামের তোসা গোত্রের একজন প্রভাবশালী কর্মকর্তা। ইয়োশিদাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল গোত্রের মানুষদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য। তার কাছ থেকেই ইয়াতারো শিল্পায়নের মাধ্যমে সমাজের উন্নয়নের ধারণার সাথে পরিচিত হলেন। ইয়োশিদার পরিচয়ের সূত্রে ইয়াতারো তোসা প্রদেশের সরকারের অধীনে কেরানির পদে একটি চাকরি পেলেন। আন্তরিকতার সাথে কাজ করে দ্রুতই উন্নতি করতে লাগলেন তিনি। তিন পুরুষ আগে হারানো পরিবারের সামুরাই মর্যাদা পুনরুদ্ধার করলেন ইয়াতারো।
ঠিকঠাক চলছিল সবই। কিন্তু সমৃদ্ধির পথ কখনো মসৃণ হয় না। হঠাৎ দুর্যোগ এলো তাদের নির্বিঘ্ন জীবনে, আততায়ীর হাতে খুন হলেন ইয়োশিদা। ইয়োশিদার সূত্রে ইয়াতারোর যেসব রাজনৈতিক যোগাযোগ তৈরি হয়েছিল, সবই হারাতে হলো। এরপর পাঁচ বছর ইয়াতারো কাজ করলেন গ্রামের খেতখামার আর বনাঞ্চলে। ১৮৬৭ সালে ইয়োশিদার ভাতিজার বদৌলতে আবার তোসা গোত্রের চাকরিতে ফিরলেন তিনি।
একটু একটু করে ইতিহাসকে নিজের করে নেবার পথেই যেন এগুচ্ছিলেন ইয়াতারো। নাগাসাকির বন্দরে তোসা গোত্রের ব্যবসা-বাণিজ্য চলতো, ইয়াতারোর চাকরি স্থানান্তরিত হলো সেখানে। কর্মচারী থেকে তিন মাসের মধ্যেই কর্মকর্তা হিসেবে পদোন্নতি আদায় করে নিলেন তিনি। সেখানে তার মূল কাজ ছিল জাহাজ আর অস্ত্র কেনা। এসব কেনার জন্য অর্থ যোগাড় করতে কর্পূরের তেল, কাগজ ও অন্যান্য পণ্য রপ্তানীর কাজটিও করতেন ইয়াতারো।
কিছুদিনের মধ্যেই বাণিজ্য বন্দর হিসেবে নাগাসাকির জায়গা নিয়ে নিল ওসাকা। এদিকে ইয়াতারো ততদিনে তার কর্মক্ষেত্রের যাবতীয় বিষয় দেখভালের দায়িত্ব নিয়ে ফেলেছেন। নাগাসাকির বন্দরে ব্যবসার উদ্দেশ্যে আসা বিদেশীদের সাথে তার দারুণ সখ্যতা। ধীরে ধীরে নিজের জীবনটা গুছিয়ে নিচ্ছিলেন তিনি, হয়ে উঠছিলেন এক নবীন উদ্যোক্তা, স্বপ্নের পারদ যার আকাশছোঁয়া। বয়স যখন ২৭, নতুন জীবন আরম্ভ করলেন ইয়াতারো, সেরে নিলেন বিয়ের পর্ব।
ইয়াতারোর জীবনে সুবাতাস বইতে লাগলো একটু একটু করে। ১৮৬৮ সালে সামন্তীয় সামরিক শাসক শগুনদের ৩০০ বছরের রাজত্ব শেষ হলো। ক্ষমতায় বসলেন সম্রাট মেইজি। নতুন সরকার নিয়ম করল, গোত্রগুলো আর ব্যবসা-বাণিজ্য চালাতে পারবে না। সেসময় ইয়াতারোর জীবনের সবচেয়ে সুবর্ণ মুহূর্তটি এল। এই নিয়মের পর তোসা গোত্রেরও ব্যবসা গোটাতে হতো, তাদের কাছ থেকে ব্যবসার অনুমতিপত্র ইজারা হিসেবে নিয়ে নিলেন ইয়াতারো। জমানো টাকা দিয়ে ওসাকায় তাদের নতুন অফিসটিও কিনে নিলেন তিনি, তখন এর নাম ছিল সুকোমো ট্রেডিং কোম্পানি। ইয়াতারো হলেন এর প্রধান কর্মকর্তা।
পরবর্তীতে কোম্পানির নাম পাল্টে রাখা হলো মিতসুকাওয়া। ১৮৭৩ সালে আবারও সেটা পাল্টে নতুন নাম হলো ‘মিতসুবিশি’। তৈরি হলো ইতিহাস বিখ্যাত তিনটি হীরের সেই লোগো। ইওয়াসাকি পরিবার ও তোসা গোত্রের প্রধান ইয়ামাউচি পরিবারের প্রতীকের সম্মিলিত রূপ ছিল লোগোটি। ‘মিতসু’ শব্দের অর্থ ‘তিন’, আর ‘হিশি’ হলো একটি ফলের নাম, বাংলায় যাকে বলে পানিফল। এই দুইয়ে মিলেই হলো মিতসুবিশি। জাপানী ভাষায় এই ‘হিশি’ শব্দটি ব্যবহৃত হয় রম্বস আকৃতি বা হীরার দ্বিমাত্রিক রূপ বোঝাতে। ইয়াতারো ইওয়াসাকি আনুষ্ঠানিকভাবে কোম্পানির প্রেসিডেন্ট হলেন।
সাফল্যের পথে যাত্রা শুরু হলো ইয়াতারোর। ‘মিতসুবিশি ট্রান্সপোর্টেশন কোম্পানি’ হিসেবে তার প্রতিষ্ঠানের পরিচিতি বাড়তে লাগলো। বাড়তে থাকলো জাহাজের সংখ্যা, বিস্তৃত হতে থাকলো তাদের যাত্রী এবং পণ্য পরিবহণ সেবার পরিধি। ১৮৭৪-৭৫ সালে জাপানের সেনাবাহিনীর তাইওয়ান অভিযানের সময় মিতসুবিশির কাছ থেকে জাহাজ কিনলো জাপান সরকার। সরকারের সাথে বাণিজ্য চুক্তি তৈরি করে দিল মিতসুবিশির সমৃদ্ধির পথ।
কয়েক বছরের মধ্যেই ইয়াতারো এক বিশাল বাণিজ্যিক সাম্রাজ্যের ভিত গড়ে তুললেন, ইতিহাসে যেটি পরবর্তীতে পরিণত হবে জাপানের বাণিজ্য জগতের সবচেয়ে বিখ্যাত স্তম্ভে। সেই যে পাহাড়ের চূড়ায় উঠে জীবন নিয়ে পণ করেছিল এক কিশোর, পরিণত বয়সে এসে সে সত্যিই উঠতে লাগলো বিশালত্বের শিখরের পানে। তার হাতেই জন্ম নিলো মিতসুবিশি, সৃষ্টি হলো জাপানের ইতিহাসের এক শক্তিশালী অধ্যায়ের।
এরপর ধীরে ধীরে কীভাবে পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে পড়ল মিতসুবিশির জয়যাত্রা, সে গল্প থাকছে পরের পর্বগুলোতে।
দ্বিতীয় পর্ব: মিতসুবিশি মোটরস: ইয়াতারো ইওয়াসাকির স্বপ্নের পথচলা
ফিচার ইমেজ: shikokutours.com