ক্ষমতাবান রাজা বাদশাদের অনেকেই নিজেদের হারেমে প্রচুর নারী রাখতো। এরা ছিল শুধুই উপভোগের জন্য, বিয়ে টিয়ে বা এরকম কোনো সম্পর্ক ঐ নারীদের সাথে থাকতো না। সময়ে সময়ে রাজা তাদের সাথে সময় কাটাতো। রাজ্যের অন্যান্যরা রাজার ক্ষেত্রে একে স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিতো। রাজকীয় সদস্যদের বেলায় এটাকে অপরাধ বলে গণ্য করা হতো না। এটা ছিল অলিখিত এক নিয়ম। এই ধরনের নারীদেরকে বলে ‘রক্ষিতা’। প্রাচীন চীনে শাসক রাজারা রক্ষিতা রাখার দিক দিয়ে অনেক এগিয়ে ছিল। বিস্তৃত চীনের অবস্থা এমন ছিল যে যার যত বেশি রাক্ষিতা নারী আছে সমাজে তার স্ট্যাটাস তত উঁচুতে। সম্রাটদের বেলায় রক্ষিতা রাখা ছিল নিয়ম। কোনো কোনো সম্রাটের হারেমে হাজার হাজার রক্ষিতা থাকতো। সংখ্যাটা সত্যিই হাজার হাজার। মিং রাজবংশ এই দিক থেকে বিখ্যাত। মিং শাসনামলে তাদের হারেমে ২০ হাজার নারী ছিল।
রাক্ষিতা রাখার প্রধান কারণ জৈবিক চাহিদা পূরণ করা। এবং আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে অধিক পরিমাণ সন্তান উৎপাদন করা। রাজকীয় রক্তে অধিক পরিমাণ উত্তরাধিকার রেখে যাওয়া। রাজ পরিবার যেন বিলুপ্ত হয়ে না যায় তা নিশ্চিত করা।
এই নারীগুলোকে জোর করে ধরে আনা হতো কিংবা পরিবার থেকে ছিনিয়ে আনা হতো। তাই এরা যেন পালিয়ে না যায় বা ভেতরে কোনো ঝামেলা না করে তার জন্য পাহারাদার রাখা হতো। নারী দিয়ে পাহারার কাজ চলে না, পাহারাদার হতে হবে কোনো পুরুষ। কিন্তু এখানে একটা সমস্যা দেখা দেয়, পাহারাদার হিসেবে যে যে পুরুষ থাকবে তারা আবার রক্ষিতাদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলবে নাতো? রক্ষিতাদের ঔরসে শুধুই রাজ রক্তের উত্তরাধিকার তৈরি হবার পাশাপাশি বাইরের রক্ত মিশ্রিত হয়ে যাবার একটা ভয় থেকেই যায়। এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য রাজারা একটা পথ বেছে নেয়। পাহারাদারদের যৌন ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়া। যৌন ক্ষমতা নষ্ট করে দেবার প্রক্রিয়াকেই বলে খোজাকরণ। যাদের যৌন ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়া হয় তাদের বলে ‘খোজা’। ইংরেজি Eunuch শব্দের প্রতিশব্দ হচ্ছে খোজা। ইউনাক শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ Eunoukhos থেকে, যার অর্থ শয়নকক্ষের পাহারাদার।
ঔরসের বিশুদ্ধতার ব্যাপারে অধিক পরিমাণ নিশ্চিত থাকার জন্য রাজারা এই পদ্ধতি বেছে নিতো। কারণ সুযোগ থাকলে স্বাভাবিক পুরুষ পাহারাদার অবশ্যই হারেমের নারীদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলবে। আর এখানে তার সম্ভাবনাও বেশি। কারণ হারেমে শত শত নারীর বিপরীতে পুরুষ থাকতো মাত্র একজন। স্বাভাবিক গাণিতিক বাস্তবতা থেকেই বলা যায় অনেক রক্ষিতা নারীই জীবনের প্রয়োজনীয় স্বাভাবিক যৌন চাহিদা থেকে বঞ্চিত হবে। যৌন অতৃপ্তির কারণে পাহারাদারদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়। এই সমস্যা থেকে বাঁচার জন্য রাজারা অমানবিক পন্থার দ্বারস্থ হতো- পাহারাদারদের যৌনাঙ্গ কেটে ফেলে ক্ষমতা নষ্ট করে দিতো।
প্রকারভেদ
খোজাকরণ মূলত তিন ধরনের হতে পারে। ১. শুধু পুরুষাঙ্গ কর্তন করে ফেলা; ২. শুধু শুক্রথলী কর্তন করা ও ৩. পুরুষাঙ্গ ও শুক্রথলী উভয়ই কর্তন করা। প্রাচীন চীনে তৃতীয় প্রকার খোজাকরণ প্রচলিত ছিল। এই প্রক্রিয়ায় খুব ধারালো ছুরির সাহায্যে পুরুষাঙ্গ ও অণ্ডকোষ উভয়ই কেটে ফেলা হতো। চীনে খ্রিষ্টপূর্ব ১৬০০ অব্দ থেকে শুরু করে পরবর্তী কয়েক হাজার বছর পর্যন্ত এই প্রক্রিয়া প্রচলিত ছিল। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় ঝুঁকি বেশি। এই প্রক্রিয়ায় প্রচুর মানুষের মৃত্যু হতো। খোজা হতে ইচ্ছুক বা খোজা করতে ইচ্ছুক মানুষের পরিমাণ তো আর অসীম নয়, তাই এই সমস্যার একটা সমাধানে পৌঁছা দরকার। মৃত্যুহার কমানোর জন্য ধীরে ধীরে পুরুষাঙ্গ রেখে শুধুমাত্র শুক্রথলী কেটে খোজা বানানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়।
কিন্তু তারপরেও সমস্যা থেকে যায়। পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলে শুধুমাত্র অণ্ডকোষ কেটে খোজাকরণ সম্পন্ন করা হলেও চীনের রাজাদের চাহিদা থেকে যায় উভয় অঙ্গ কর্তিত খোজার উপর। তাই দেখা যায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চীনের খোজারা উভয় অঙ্গ কর্তিত থাকে। তবে পরবর্তীতে চীনের খোজাকরণ প্রক্রিয়া বেশ উন্নত হয় এবং তারা মৃত্যুহার কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়। তারা এই কাজে এতটাই পারদর্শী হয়ে উঠে যে মৃত্যুহার একদম ছিল না বললেই চলে।
যেভাবে খোজা বানানো হতো
প্রাচীন চৈনিক সাম্রাজ্যে খোজাকরণের কাজটি করা হতো মূল প্রাসাদের বাইরে বিচ্ছিন্ন কোনো স্থানে। রাজ প্রাসাদের চারদিকে দেয়ালঘেরা সীমানা থাকে। এই সীমানার কোনো একটি স্থানে ব্যবহার করা হয় না এমন একটি পাহারা কক্ষ থাকে, যা দরকার পড়ে না বলে ব্যবহার করা হয় না। এই ধরনের পরিত্যক্ত ঘরকে ব্যবহার করা হতো খোজাকরণের অপারেশন কক্ষ হিসেবে।
প্রথমে ব্যক্তিটিকে ঐ কক্ষে নিয়ে একটি কাঠের পাটাতনে শুইয়ে দেয়া হতো। তারপর হালকা গরম পানি দিয়ে যৌনাঙ্গ ও যৌনাঙ্গের আশেপাশের স্থান ধুয়ে নেয়া হতো। এরপর অবশ করতে পারে এমন উপাদানের প্রলেপ দিয়ে যৌনাঙ্গকে অবশ করে ফেলা হতো। তখনকার সময়ে অবশকারী হিসেবে প্রচণ্ড ঝালযুক্ত মরিচ বাটা ব্যবহার করা হতো। যিনি খোজা করবেন তিনি হচ্ছেন অপারেশনের প্রধান। প্রধানের পাশাপাশি কয়েকজন সহকারী থাকতো। অবশ করার পর সহযোগীরা মিলে দেহটিকে কাঠের পাটাতনের সাথে শক্ত করে বেঁধে ফেলতো। তারপর দুইজন সহকারী দুই পা ফাঁকা করে ধরে রাখতো যেন যৌনাঙ্গ কাটার সময় পায়ের দ্বারা কোনো অসুবিধা না হয়। দুইজন তো দুই পায়ে শক্ত করে ধরে রাখতোই, তার উপর আরো দুইজন কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে একজন হাত দুটি বেঁধে চেপে ধরে রাখতো।
কর্তক ব্যক্তি সুবিধা করে দুই পায়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে শুক্রথলী ও পুরুষাঙ্গ হাতের মুষ্টির ভেতর ধরতো। যৌনাঙ্গ মুষ্টির ভেতরে রেখে শায়িত ব্যক্তির কাছ থেকে সম্মতি নেয়া হতো যে তিনি স্বেচ্ছায় খোজাকরণ করতে দিচ্ছেন। সম্মতি পাবার সাথে সাথে চোখের পলকেই ধারালো ছুরি দিয়ে একসাথে কেটে ফেলা হতো মুষ্টির ভেতরে থাকা অণ্ডকোষ ও পুরুষাঙ্গ।
এই অবস্থায় প্রচুর রক্তপাত হতো। এই ধাপ শেষ করার পর থাকে বড় চ্যালেঞ্জটি। রোগীটিকে এই ধাক্কা কাটিয়ে তুলে বাঁচানো যাবে কিনা। কর্তন প্রক্রিয়া শেষ করার পর পরই একটি মূত্রনালিতে একটি নল প্রবেশ করিয়ে দেয়া হতো। প্রস্রাব বের হবার রাস্তা যেন বন্ধ হয়ে না যায় সেজন্য এই নল প্রবেশ করানো হতো। নল ছিল অনেকটা আজকের যুগের স্যালাইনের পাইপের মতো, এর ভেতর দিয়ে প্রস্রাব বের হতো।
এরপর প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে রোগীকে ঐ কক্ষে তিন দিন রেখে দেয়া হতো। ঐ সময়ে রোগীকে কোনো প্রকার খাবার দেয়া হতো না। এই ধাপ পার হতে পারলে চতুর্থ দিনে রোগীকে প্রস্রাব করতে বলা হতো। যদি প্রস্রাব করতে পারতো তাহলে অপারেশন সফল হয়েছে বলে ধরে নেয়া হতো, আর যদি প্রস্রাব করতে না পারতো তাহলে ধরা হতো এই অপারেশন সফল হয়নি। এক্ষেত্রে রোগী ব্যথা ও ইনফেকশনে মারা যেত। তবে প্রাচীন চীনারা ধীরে ধীরে এই কাজে এতটাই দক্ষ হয়ে উঠেছিল যে অপারেশনে মৃত্যুহার নেমে এসেছিল প্রতি হাজারে ১ জন।
এখন বিশ্ব আধুনিক হয়েছে। রাজাদের হাজার হাজার নারী রাখার প্রথা বিলুপ্ত হয়েছে। পাশাপাশি উঠে গেছে খোজাকরণের চরম বিশ্রী একটি সংস্কৃতি।