মুক্তিযুদ্ধের গহীনে: গণহত্যা, পাকিস্তানের ইতিহাস জালিয়াতি ও অন্যান্য

“আপনি কি এখনো মনে করেন পাকিস্তান অখণ্ড, মিস্টার ভুট্টো?”

– “অবশ্যই। অবশ্যই অখণ্ড।”

– “এটা কি বাস্তবমুখী ভাবনা হলো?”

– “একদম বাস্তব। বাস্তবতা কী? এসব ক্ষণস্থায়ী পরিস্থিতি কোনো বাস্তবতা না… ইতিহাস সাক্ষী থাকবে, পাকিস্তানের ধ্যান ধারণা, পাকিস্তানের আদর্শ কখনোই এভাবে মুছে যাবে না।”

কথাগুলো বলছিলেন জুলফিকার আলী ভুট্টো, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের মাত্র তিন দিন পর। নিউ ইয়র্ক থেকে ফিরছিলেন পাকিস্তানে, যাত্রাবিরতিতে ক্রিসমাসের আগে আগে লন্ডনের হিথ্রোতে এক ব্রিটিশ রিপোর্টারের কাছে সাক্ষাৎকারে এই কথাগুলো বলেন তিনি।

৪৬ বছর পর আজ হঠাৎ যদি জানতে ইচ্ছে হয়, ১৬ ডিসেম্বর নিয়ে অর্থাৎ ১৯৭১ নিয়ে পাকিস্তান তাদের নতুন প্রজন্মকে কী জানাচ্ছে? ইতিহাসের কতটুকু কীভাবে জানছে সেদেশের শিশুরা? প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে বেরিয়ে পড়বে এক ভয়ঙ্কর মগজ ধোলাইয়ের চিত্র, কীভাবে দেশটিতে প্রজন্মের পর প্রজন্মের মনে মিথ্যা ইতিহাসের আবরণে রোপণ করা হচ্ছে এক সুতীব্র ঘৃণার বীজ।

এই লেখাটিতে আলোচনা করা হবে বর্তমানে পাকিস্তানের মানুষের ইতিহাস জানার পরিস্থিতি, সেই সাথে মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশের কিছু চিত্র, আর সারা পৃথিবীতে এই যুদ্ধের পক্ষে-বিপক্ষের কিছু ঘটনা নিয়ে।

‘১৯৭১’ সংখ্যাটি বাংলাদেশের মানুষের জন্য অনেক বড় অর্থ বহন করে, কিন্তু এই সংখ্যাটি দেখা মাত্রই অধিকাংশ পাকিস্তানির মাথায় আসে দুটো শব্দ: ‘ভারতীয় ষড়যন্ত্র’। সত্যি!

একাত্তরের সময় পাকিস্তানের যারা বেঁচে ছিল, তাদের কথা না হয় বাদই দিলাম; এখন যে প্রজন্মটি বড় হচ্ছে, তাদেরকে শিশুকাল থেকেই শেখানো হয় যে, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের একটি ‘অঙ্গ’ তারা হারিয়েছিল ভারতের ষড়যন্ত্রের কারণে। এখনো ১৬ ডিসেম্বরকে পাকিস্তানে স্মরণ করা হয় ‘Fall of Dhaka’ বা ‘ঢাকা পতন দিবস’ হিসেবে!

Fall of Dhaka-র শোকে পাকিস্তান; Source: Spiritual Pakistan

আমরা খোঁজ করেছিলাম যে, পাকিস্তানের স্কুলে এখন ইতিহাসের নামে কী শেখানো হয়, ১৯৭১ সালের মতো বড় একটি বিষয় নিয়ে কী লেখা আছে সেখানে। দেখা গেল, পেশোয়ারের পঞ্চম শ্রেণীর একটি পাঠ্যবইতে লেখা, “১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পর পূর্ব পাকিস্তানে বাসরত হিন্দুদের সহায়তায় ভারত ঐ অঞ্চলের জনগণকে পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করে এবং নিজেই ১৯৭১ এর ডিসেম্বরে পূর্ব পাকিস্তানে অনুপ্রবেশ করে বসে। এই ষড়যন্ত্রের ফসল হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান আমাদের থেকে আলাদা হয়ে যায়। আমাদের প্রত্যেকের উচিৎ মিলিটারি ট্রেইনিং নেওয়া এবং শত্রুর সাথে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত থাকা।”

এটুকুতেই শেষ কিন্তু! আর কিছু নেই! বছরের পর বছর নির্যাতন, প্রবল এক যুদ্ধ, এক সাগর রক্ত- কোনো কিছুরই নাম-গন্ধও নেই! এই কয়েকটি লাইন লিখে, ইতিহাসের এই বিশাল অংশ বাদ দিয়ে তারা এরপর সোজা চলে যায় পাকিস্তানে জিয়াউল হকের শাসনামলে (১৯৭৮-১৯৮৮)। গোটা ইতিহাসে বাংলাদেশ বলে কিছুই নেই!

আর সেখানে সবকিছুতে অবশ্যই শত্রু হলো ‘হিন্দু’ ভারত। চিন্তা করতেই অবাক লাগে, এত ছোট বয়স থেকে ইতিহাসের এত বড় একটা ঘটনাকে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে কেবলই ‘ভারতের ষড়যন্ত্র’ হিসেবে। ছোট থেকেই মিথ্যে তথ্য দিয়ে তাদের মনে শত্রুতা আর একটি ধর্মের অনুসারীদের বিরুদ্ধে বৈরী মনোভাব সৃষ্টি করে দেওয়া হচ্ছে!

কেউ যদি ভাবেন, ছোট ক্লাস দেখে তেমন কিছু লিখেনি, বড় ক্লাসে লিখবে; তাহলেও ভুল হবে। পরের শ্রেণীর বইয়েও নেই, সপ্তম শ্রেণীতেও না, অষ্টমেও না, এমনকি নবম শ্রেণীতেও এই ব্যাপারে কিছু নেই। দশম শ্রেণীতে গিয়ে ১৯৭১ প্রসঙ্গ আসলো আবার। এলেও, সেটা এতই তুচ্ছ করে লেখা, যেন কিছুই ঘটেনি। মোট সাতটি অধ্যায় আছে সে বইয়ে। শুরুটা হয়েছে ৭১২ সালের মুহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু বিজয় দিয়ে। চলতে চলতে, সপ্তম অধ্যায়ের মাত্র একটা উপ-অনুচ্ছেদ হিসেবে জায়গা হয়েছে আমাদের ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের। ‘Fall of East Pakistan’ শীর্ষক স্বল্প আলোচনায় ব্যাখ্যা করা হয়েছে, কীভাবে পাকিস্তানের সীমান্তে ভারত ‘আক্রমণ’ চালিয়েছে আর পাকিস্তানি সেনারা কত বীরত্বের সাথে সেটা মোকাবেলা করেছে!

তবে হ্যাঁ, কিছু কারণ লেখা আছে, কী কী কারণে পূর্ব পাকিস্তানিরা এই ‘বিদ্রোহ’টা করেছিল। কী কী ‘কারণ’ ছিল তাদের মতে?

  • হিন্দু শিক্ষক নেওয়া: তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, অন্যতম ‘কারণ’ ছিল ‘হিন্দু’ শিক্ষক। সেখানে বলা হচ্ছে, “পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিশাল সংখ্যক হিন্দু শিক্ষক ছিল। তারা বাঙালিদের মগজধোলাই করছিল এবং তারা এমন সব সাহিত্য রচনা করত, যেটা পড়ে বাঙালিরা পশ্চিম পাকিস্তানিদের ঘৃণা করা শুরু করে।”
  • আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র: তাদের ভাষ্যমতে আরেকটি কারণ হলো ‘আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র’। বলা হচ্ছে, “পূর্ব পাকিস্তানে ১ কোটি হিন্দু ছিল। ভারত তাদের রক্ষা করতে সর্বাত্মক চেষ্টা করত। ভারত চাচ্ছিল পূর্ব পাকিস্তানকে আলাদা করতে, যেন হিন্দুদের অর্থনৈতিক অবস্থা আরো ভাল হয়। এই হিন্দুদের অনেকেই মূলত ছিল ভারতের গুপ্তচর। রাশিয়া এই পূর্ব পাকিস্তানের উপর ভারতের জুলুমে মুক্তকণ্ঠে সমর্থন দিয়েছিল। “

এভাবে চতুর্থ আর পঞ্চম শ্রেণীতে শেখানো শুরু হয়, হিন্দু আর শিখরা কতটা খারাপ। আর উচ্চ শ্রেণীগুলোতে গিয়ে সেই কুশিক্ষাকে চিরস্থায়ীভাবে গেঁথে দেওয়া হয় তাদের মন-মগজে। সত্যি বলতে, পাকিস্তানের ইতিহাস বইগুলোতে ‘ভারত’ আর ‘হিন্দু’ শব্দ দুটোর ব্যবহারের মাঝে তেমন কোনো পার্থক্য আসলে করা যায় না, দুটোর যেকোনো একটি দিয়ে পড়লেই বাক্যগুলো অর্থবোধক হয়ে যায়। তাদের কাছে সকল সমস্যার কারণ হলো ভারত, আর সমাধান হলো ভারতীয় হিন্দু নিধন। শিশুরা একটা বড় হলে তাদেরকে অন্যান্য ইসলাম ব্যতীত ধর্ম নিয়েও এমনভাবে ঘৃণামূলক কথা বলা শুরু হয়।

সবকিছুর ফলাফল যেটি দাঁড়ায় তা হলো, পাকিস্তানিদের বেশিরভাগের কাছেই আসলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ একটি অজানা অধ্যায়। যারা নিজে থেকে ইতিহাস নিয়ে ঘেঁটেছে, তারা বাদে বাকিরা একেবারে জানেই না। ক্ষমা প্রার্থনা তো অনেক পরের কথা। তাদেরকে জানানো হয়, পাকিস্তানে-পাকিস্তানে কোন্দল ছিল, সুতরাং বড় জোর এটি সিভিল ওয়ার বা গৃহযুদ্ধ, এর বেশি কিছু না। অথচ এটি ছিল একটি ভূখণ্ডের মানুষের স্বাধীনতার সংগ্রাম!

১৯৭১ সালে বাংলাদেশে বর্বরতম গণহত্যা চালায় পাকিস্তানি সেনারা; Source: Herald Magazine – Dawn

শেষ পর্যন্ত একাদশ শ্রেণীতে আরেকটু বিস্তারিত কাহিনী পাওয়া যায়। সেখানে বলা হয়,

“এই বিদ্রোহ দমনে সামরিক শাসকগণ সিদ্ধান্ত নিলেন সশস্ত্র বাহিনী ব্যবহারের। এই সামরিক অপারেশনগুলোতে জামায়াতে ইসলামির সশস্ত্র স্বেচ্ছাসেবকগণও অংশ নেন। এর ফসল হিসেবে, আওয়ামী লীগের অনেক কর্মী ভারতে পালিয়ে যায়। এই কর্মীদের ভারত প্রশিক্ষণ দেয় এবং পূর্ব পাকিস্তানে আবার পাঠায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করতে। তারা তাদের গেরিলা কার্যক্রম চালাতে থাকে ‘মুক্তিবাহিনী’র স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে। ১৯৭১ এর ডিসেম্বরের ৩ তারিখ ভারত বনাম পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হল। স্থানীয় মানুষ তেমন সাহায্য না করায় এবং পর্যাপ্ত মানুষ আর রসদ না থাকায়, পাকিস্তানি সৈনিকগণ ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন ১৬ ডিসেম্বর। সেদিন পূর্ব পাকিস্তান একটি স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশে পরিণত হলো।”

সম্ভবত লেখকের ঐ শেষ লাইনটি লিখতে খুব কষ্ট হচ্ছিল, স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ! পাকিস্তানে ১৬ ডিসেম্বর মানে তো ‘ফল অফ ঢাকা’ নামে শোক পালনের দিবস।

এসবের চেয়ে পাকিস্তানের ‘ও লেভেল’ এর ইতিহাস বইতে তুলনামূলক বেশ ভালো তথ্য আছে। রিজওয়ানা জাহিদ আহমেদের ‘Pakistan– The Real Picture (A Comprehensive History Course)’ বইতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কুকীর্তির কথা লেখা আছে। সম্ভবত এটিই একমাত্র পাঠ্যবই, যেখানে এই কথাগুলো আছে। কিন্তু সবার তো আর এই বই পড়ার কথা নয়। পাকিস্তানের অধিকাংশ শিশুই ছোটবেলা থেকে এটি পড়ে বা জেনেই বড় হয়ে যে, ‘ভারতের ষড়যন্ত্রে একটি গণ্ডগোলের ফসল হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানি ‘ভাই’দেরকে তাদের ছেড়ে চলে আসতে হয়।’ এছাড়াও গল্প উপন্যাস তো আছেই এই মিথ্যে ইতিহাসকে ভিত্তি করে।

একাত্তরে কী হয়েছিল, আর পাকিস্তানিরা কী কী না পড়েই ইতিহাস জেনে গেছে বলে ধরে নেয়, তার কিছু নজির আজকের লেখায় আমরা পড়ব। চলুন দেখি একাত্তরে নির্যাতিত কিরণবালার ভাষ্যে ইতিহাসের ভয়ঙ্করতম নির্যাতনের ঘটনার একটি নমুনা-

“আমার ঠিক পাশেই ছিল একটি মেয়ে। অসম্ভব রূপবতী এবং খুব কম বয়সী। সবাই (পাকি হায়েনারা) তাই তাকে একটু বেশি মাত্রায় ‘পছন্দ’ করত। একদিন ৩-৪ জন একসাথে এলো ওরা। এবং, প্রত্যেকেই চাচ্ছিল মেয়েটিকে। নিজেরা সিদ্ধান্ত নিতেও পারছিল না কে আগে করবে, কে পরে। এটা নিয়েই ঝগড়া শুরু করে দিল তারা।

এরপর, সবাই একসাথে ঝাঁ পিয়ে পড়ল ওর উপর। তারা এতটা উন্মাদ ছিল যে বুঝে উঠতে পারছিল না কী রেখে কী করবে। তারা যা পারছে তাই করতে লাগল মেয়েটির সাথে, সে কী অত্যাচার! তারপর একে একে তাকে ধর্ষণ করতে লাগল। মেয়েটি আর সইতে না পেরে একজনকে লাথি দিল আর সে পড়ে গেল। আল্লাহ! এখন ওকে বাঁচাবে কে!

তারা আরো নির্যাতন চালালো, আরো ধর্ষণ করল, এরপর চলে গেল। আমরা আল্লাহ্‌কে ধন্যবাদ দিচ্ছিলাম, অন্তত মেয়েটি বেঁচে তো আছে। কিন্তু, একটু পরেই তারা আবার ফিরে এলো। ঢুকেই তারা মেয়েটিকে লাথি দিতে লাগল তাদের বুট দিয়ে। তারপর, তার যোনিদ্বারে গরম ডিম ঢুকিয়ে দিল। আপনি যদি দেখতেন মেয়েটির চিৎকার! মনে হচ্ছিল, তার চিৎকারে দেয়ালগুলো ধ্বসে যাবে। কিন্তু তারা একটুও দয়া দেখালো না। তারা পর পর তিনটি গরম ডিম ঢুকালো। মেয়েটি চিৎকার করতেই থাকলো, কিন্তু কিছুক্ষণ পর তার গলা দিয়ে আর আওয়াজ বেরুলো না।

পরদিন তারা আবার এলো। মেয়েটিকে তারা বলল, চুপ থাকতে। নাহলে, আরও অত্যাচার করবে। মেয়েটার অবস্থা খুব বেশি খারাপ ছিল। তারা তাদের রাইফেলের সম্মুখটা তার যোনিতে প্রবেশ করাতে লাগল। একজন তার পেটের উপর দাঁড়িয়ে ছিল। এমনভাবে তার শরীর থেকে রক্ত বেরুতে লাগল, যেন মাত্রই কেউ গরু জবাই করেছে। তার শরীরটা নড়ল কিছু, এরপর স্থির হয়ে গেল। কিন্তু সে তখনও মারা যায় নি। আল্লাহও তার দিকে তাকাননি। পরের কয়েকদিন তারা তার সাথে এমনটাই করতে লাগল। মেয়েটি এমন করে ৭-৮ দিন বেঁচে ছিল। পরের দুদিন সে অজ্ঞান ছিল… এবং অবশেষে… মেয়েটি মারা গেল।”

– কিরণবালা
ভালুকা, ময়মনসিংহ, বাংলাদেশ।

২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাংলাদেশে অপারেশন সার্চলাইটের নামে চালায় ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাযজ্ঞ! মূলত এই অপারেশন ছিল নভেম্বরে পরিকল্পিত ‘Operation Blitz’, যেটার পরিকল্পনা ছিল ২৬ মার্চ তারিখে বাংলার প্রধান শহরগুলোর দখল নিয়ে নেওয়া, এরপর সকল রাজনৈতিক বা সামরিক প্রতিপক্ষকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া। ফেব্রুয়ারিতে একটি কনফারেন্সে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বলেছিলেন,

“Kill three million of them (Bangladeshis) and the rest will eat out of our hands.” (Robert Payne, Massacre [1972], p.50)

কাকতালীয় হলেও, সত্যি সত্যিই ইয়াহিয়া খান ‘ত্রিশ লাখ’ মানুষকেই হত্যা করতে বলেছিলেন! এই পরিকল্পনার ধারাবাহিক অংশই হলো অপারেশন সার্চলাইট। ‘৭১ এর মার্চে আলোচনার নামে ১০ দিন ঢাকায় কাটিয়ে ইয়াহিয়া খান ২৫ তারিখ চলে গেলেন পশ্চিম পাকিস্তানে। তিনি পাকিস্তানে পা ছোঁয়ানোর সাথে সাথেই নির্দেশ দেওয়া হলো অপারেশন শুরু করার। তবে পূর্ব পাকিস্তানের কর্মরত যেসব পাকিস্তানী সিনিয়র অফিসার এই গণহত্যা সমর্থন করতে চাননি, তাদেরকে বরখাস্ত করা হয়। এরা ছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল শাহাবজাদা ইয়াকুব খান (পূর্ব পাকিস্তানের জিওসি) আর গভর্নর ভাইস অ্যাডমিরাল সৈয়দ মোহাম্মদ আহসান।

ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বসে লিড পেন্সিল দিয়ে আকাশি নীল রঙের একটি প্যাডে পাঁচ পাতা জুড়ে ১৬টি অনুচ্ছেদে এই পরিকল্পনা লেখা হয়েছিল- কখন, কীভাবে, কাদের খুন করতে হবে। নেপথ্যে ছিলেন জেনারেল রাও ফরমান আলী। পরিকল্পনা অনুযায়ী কোন প্ল্যাটুন কোথায় আক্রমণ করবে, সব বলা ছিল। পরিকল্পনার একটই অংশবিশেষ এরকম:

1. Impose curfew at 0110 hrs and close telephone, telegraph and radio station and shut all presses down.
2. Arrest Sheikh Mujib and 15 top Awami League leaders during operation.
3. Subdue Dhaka University, EPR HQ and Rajarbagh police line, disarm 2nd and 10th EBR.
4. Seal off the city by taking over road, rail and river communication and Patrol River.
5. Take over and protect Ammunition factory at Gazipur and Arms depot at Rajendrapur.
6. Conduct house to house search in Dhanmondi and Hindu areas.

প্রশ্ন জাগতে পারে মনে, আন্তর্জাতিকভাবে এই গণহত্যাকে পাকিস্তান কীভাবে ‘ন্যায্য’ বলে দাবি করেছিল? উত্তর হলো, মার্চের শুরুতে চট্টগ্রামে দাঙ্গায় ৩০০ বিহারি মারা যায়; এর শায়েস্তা করতেই এ গণহত্যা করা হয় বলে দাবি তাদের।

সেই ভয়াল রাতের গণহত্যার ছোট একটি পরিসরের উদাহরণ দেওয়া যাক, দেখা যাক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কী হয়েছিল। সেখানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১৮ নং পাঞ্জাব, ২২ নং বেলুচ এবং ৩২ নং পাঞ্জাব রেজিমেন্টের বিভিন্ন ব্যাটেলিয়ন শুরু করে হামলা। অপারেশন সার্চলাইট শুরুই হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহুরুল হক হলে হামলার মধ্য দিয়ে। টিচার্স কোয়ার্টারে গিয়ে শিক্ষকদেরকে মারা তো হয়েছিলই, সেই সাথে চলছিল হলে হলে অভিযান। যেমন- রোকেয়া হলে আগুন ধরিয়ে দেয় তারা, এরপর ছাত্রীরা পালাতে গেলে গুলি করে তাদের মারা হয়। অতিথি হিসেবে যারা থাকতে এসেছিল, তারাও মারা পড়ে।

একটি পরিবারের কথা বলা যায়। মধুসূদন দে’র পরিবার। তাঁর ঘরে ঢুকে হানাদাররা তার স্ত্রীকে মারলো, পুত্র ও পুত্রবধূকে মারলো এবং এরপর আহত মধুসূদনকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হলো জগন্নাথ হলে, এরপর লাইনে দাঁড়া করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করা হলো। নাম শুনেই পাঠকদের বুঝে ফেলবার কথা, এই মধুসূদন দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনের প্রতিষ্ঠাতা।

মধুর ক্যান্টিন; Source: shamprotik.com

সেদিন মধ্যরাতের পর ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেন পাক সেনাদের হাতে গ্রেফতার হবার আগে। ২৫ মার্চের রাতেই মারা যান অন্তত ৭,০০০ থেকে ১০,০০০ মানুষ, কিংবা আরো বেশি! কয়েক দিন স্থায়ী এ অপারেশনে নিহত হন অসংখ্য বাঙালি। তৎকালীন নিউ ইয়র্ক টাইস পত্রিকার খবর অনুযায়ী, সংখ্যাটি ৩৫ হাজার, সিডনি মর্নিং হেরাল্ড পত্রিকার মতে সংখ্যাটি এক লাখ পর্যন্ত হতে পারে! এবং, সেটি শুধুই ঢাকায়।

এই গণহত্যাটি কিন্তু বিশ্বের কাছে প্রথমে এতটা বড় করে প্রকাশ পায়নি। সেই রাতের ভয়াবহতা আন্তর্জাতিকভাবে প্রথম যিনি তুলে ধরেছিলেন, তার নাম ছিল আর্চার ব্লাড। তিনি ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ছিলেন। ৬ এপ্রিল ১৯৭১ তারিখে তিনি তীব্র ভাষায় টেলিগ্রাম পাঠান যুক্তরাষ্ট্রে, এই গণহত্যার ভয়াবহতা জানিয়ে। এটি ‘ব্লাড টেলিগ্রাম’ নামে পরিচিত। তবে তার আগে ২৭ তারিখও তিনি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন, কিন্তু আদৌ পাত্তা পাননি।

আর্চার ব্লাড; Source: http://adst.org

এত ভয়াবহতার পরেও আমেরিকা তার মিত্র পাকিস্তান অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়ে যায়, এই গণহত্যা নিয়ে তারা কিছু বলেনি! পাকিস্তানকে শাসানোর সুযোগ থাকলেও তারা টু শব্দটাও করেনি, বরং তাদের আরও অস্ত্র যোগান দিয়েছে। সে অস্ত্র দিয়েই চলেছে বাংলার মানুষের উপর নিধনযজ্ঞ।

তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ছিলেন রিচার্ড নিক্সন। আর তার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ছিলেন হেনরি কিসিঞ্জার। কিসিঞ্জার শঙ্কিত ছিলেন যে, ভারত ও সোভিয়েত রাশিয়ার মাঝে সদ্য সমাপ্ত মিত্রচুক্তির কারণে হয়ত দক্ষিণ এশিয়াতে সোভিয়েত প্রভাব থাকবে। তাহলে মার্কিন প্রভাব এখানে খাটবে না হয়তো। তখন স্নায়ুযুদ্ধের যুগ ছিল, যেটা কিনা এমনকি মহাকাশ পর্যন্ত গড়িয়েছিল; ঠিক তার দু’বছর আগে ‘৬৯ সালে নিক্সন প্রশাসন চাঁদে অ্যাপোলো-১১ এর মাধ্যমে মানুষ পাঠিয়ে মহাকাশ দৌড়ে সোভিয়েতকে ‘পরাজিত’ করে। সুতরাং, সেই ‘বিজয়ধারা’ অব্যাহত থাকুক সেটাই মার্কিন প্রশাসন চেয়েছিল। তারা চায়নি যে, দক্ষিণ এশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের হাত থেকে ছুটে যাক। কিসিঞ্জার ভেবেছিলেন, ভারত যেহেতু পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল এবং তাদের মিত্র পাকিস্তানের ‘শত্রু’, তার মানে ভারতের মিত্র সোভিয়েতের প্রভাব থেকে এই এলাকাকে মুক্ত করতে অবশ্যই পাকিস্তানকে জিততে হবে। এজন্য যুক্তরাষ্ট্রের দরকার ছিল চীনের সাহায্য, চীনের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন করা। আর পাকিস্তান ছিল সে কাজের জন্য ‘মধ্যস্থতাকারী’ বা ‘দূত’ মাত্র।

হেনরি কিসিঞ্জার; Source: The Atlantic

তখনকার সময়, সরকারি কর্মকর্তারা সহজে চীনে যেতে না পারলেও, খেলোয়াড়দের অবাধ প্রবেশ ছিল। ঠিক যেদিন আর্চার ব্লাড সেই মর্মান্তিক টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলেন, সেদিনই মার্কিন টেবিল টেনিস বা পিংপং টিম চীনে গেল। সাথে ছিলেন পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত। সেখানেই এই যুদ্ধ নিয়ে আলোচনা সেরে ফেলা হয়; চীন সমর্থন দেবে পাকিস্তানকে, যেমনটি আমেরিকা দিচ্ছে। এ পুরো ব্যাপারটি ইতিহাসে ‘পিংপং ডিপ্লোম্যাসি’ নামে পরিচিত।

এই কাজে আর্চার ব্লাডের টেলিগ্রাম ছিল বড় বাধা। নিক্সন-কিসিঞ্জার প্রশাসন তাই তাকে বলল, “এরকম রং মাখানো ভুয়া কথা আর নয়।” শাস্তিস্বরূপ তাকে ঢাকা থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। আর্চার পরে বাংলাদেশের জন্ম নিয়ে বই লিখেন, যেটি লিখতে গিয়ে তিনি কেঁদে ফেলেছিলেন। তিনি নিজেই সেটা বলেছিলেন, কারণ ২৫ তারিখের ভয়াল রাতে তার অনেক বন্ধুও মারা যান। ওদিকে এই কিসিঞ্জারই দু’বছর পর নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়ে যান, তবে সেটা ভিয়েতনাম যুদ্ধ নিয়ে। নিচে যে ছবিটা দেখতে পাচ্ছেন, সেখানে লাল দেশগুলো ছিল পাকিস্তানের পক্ষে, আর হলুদগুলো বাংলাদেশের পক্ষে।

Source: theworldreporter.com

‘৭১ এর ৬ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলের ১১৮ নং কক্ষে একদল ছাত্র জড়ো হন স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকার পরিকল্পনা করতে। আঁকতে ভালো পারতেন শিবনারায়ণ দাস। মিটিংয়ে পতাকার ডিজাইন পরিকল্পনা শেষে নিউ মার্কেট থেকে সবুজ কাপড়ে লাল বৃত্ত সেলাই করে আনা হলো। বুয়েটের তিতুমীর হলের (তৎকালীন কায়েদে আজম হল) ৩১২ নং কক্ষ থেকে অ্যাটলাস নিয়ে বুয়েটেরই শেরে বাংলা হলের ৪০১ নং রুমে ট্রেসিং পেপার আর রং-তুলি দিয়ে সে রাতে আঁকা হলো লাল বৃত্তের বুকে মানচিত্র।

মানচিত্রসহ বাংলাদেশের পতাকা; Source: Wikimedia Commons

বলা বাহুল্য, শিবনারায়ণ দাসকে না পেয়ে কুমিল্লায় পাকবাহিনী তার বাবাকে নৃশংসভাবে খুন করে। শিবনারায়ণ দাসের মাথার দাম ঘোষণা করা হয় ১০ হাজার টাকা। সেই হুলিয়া পায়ে পিষ্ট করে তিনি এখনো বেঁচে আছেন।

শিবনারায়ণ দাস; Source: সমীক্ষণ

নয় মাসের যুদ্ধে প্রায় এক কোটি লোক দেশছাড়া হয়। সীমান্ত অতিক্রম করে তারা আশ্রয় নেয় ভারতে। স্বাভাবিকভাবেই সেটি ভালো চোখে দেখেনি পাকিস্তান আর চীন। বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে কোনোভাবেই স্বীকৃতি দিতে চায়নি পাকিস্তান। পরিস্থিতি পাল্টাতে তাই সরাসরি ভারত আক্রমণের পরিকল্পনা হয়। ‘Operation Chengiz Khan’ নামে এই অপারেশনে ৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় পাকবাহিনী সরাসরি আক্রমণ করে বসলো কিছু ভারতীয় বিমানঘাঁটিতে। ফলে, ভারত এটিকে ‘Act of War’ হিসেবে নিলো। তখন থেকে ভারত বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর সাথে একজোট হয়ে যুদ্ধে নামলো। এই যৌথবাহিনী পাক সেনাদের একদম কোণঠাসা করে ফেলতে লাগলো।

মিত্র পাকিস্তানের এই অবস্থা দেখে তখন যুক্তরাষ্ট্রের মাথায় হাত। প্রেসিডেন্ট নিক্সন ৯ ডিসেম্বর রণতরী USS Enterprise পাঠালেন বঙ্গোপসাগরে, ভারতকে হুমকিস্বরূপ। সেটি এসে পৌঁছে ১১ তারিখ। এটি ছিল তৎকালীন বিশ্বের সবচাইতে বড় রণতরী এবং পারমাণবিক ক্ষমতাসম্পন্ন। ওদিকে আবার, পাকিস্তানের সমর্থনে ব্রিটিশ রণতরী ‘ঈগল’-ও এগিয়ে আসতে থাকে।

এই সেই মার্কিন রণতরী USS Enterprise, যা কিনা নিউক্লিয়ার ক্ষমতা সম্পন্ন ছিল; Source: উইকিমিডিয়া কমন্স

১০ ডিসেম্বর কিসিঞ্জার চীনকে বললেন, কিছু একটা করো তোমরা। কিন্তু চীন ভাবলো, ভারতে কিছু করলে রাশিয়া অর্থাৎ সোভিয়েত ইউনিয়ন ক্ষেপে যাবে, যার ফল ভালো হবে না। তবে পাকিস্তান ধরে নিলো, আচ্ছা, চীন তো সাথে আছেই, কিছু হলে ওরা সাহায্য করবেই নিজেদের শক্তি দিয়ে। এ উদ্যমে পাকিস্তান চালিয়ে গেল যুদ্ধ।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকাণ্ড দেখে সোভিয়েত রাশিয়া ৬ আর ১৩ ডিসেম্বর দুই গ্রুপে নিউক্লিয়ার মিসাইল বোঝাই জাহাজ পাঠিয়ে দেয়। ব্রিটিশ তরী পৌঁছানোর পর দেখে, সেখানে সোভিয়েত জাহাজ! তখন ব্রিটিশ রণতরী পালিয়ে যায় মাদাগাস্কারের দিকে। যাবার আগে মার্কিন নৌবহরের কমান্ডারকে তারা জানিয়ে যায়, “স্যার, আমরা দেরি করে ফেলেছি।” ফলে যুক্তরাষ্ট্রও অগ্রসর হলো না। যদি তারা পারমাণবিক যুদ্ধে লিপ্ত হতোই, তবে বিশ্ব নিশ্চিতভাবেই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ দেখে ফেলত!

পাকিস্তান দেখতে পেলো, তখন ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র, চীন- কেউ আর সাথে নেই। পরাজয় নিশ্চিত দেখে এবার তারা মরণছোবল বসানোর পরিকল্পনা করলো। এলো ১৪ ডিসেম্বর। রাজাকার-আল বদরের নেতৃত্বে পাকবাহিনী শেষবারের মতো বড় আক্রমণ চালালো বাংলাদেশকে পঙ্গু করতে, এদেশের বরেণ্য ও মেধাবী বুদ্ধিজীবীদের পরিকল্পনামাফিক হত্যা করলো তারা।

যা-ই হোক, যুক্তরাষ্ট্র দেখলো, ভারতের আক্রমণ শুরু হওয়াতে তাদের সরবরাহ করা মালামাল ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই তারা বললো, যুদ্ধ থামাও। জাতিসংঘে বসে মার্কিন দূত জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ এই প্রস্তাব দিলেন। জুলফিকার আলী ভুট্টো তখন রেগেমেগে কাগজ ছিঁড়ে বেরিয়ে গেলেন। ভুট্টো ক’দিন পর লন্ডনে বসে ক্রিসমাসের আগে এটিও বলেছিলেন যে, এসব কিছুই না। আবার সব ঠিক হয়ে যাবে। জোড়া লেগে যাবে দুই পাকিস্তান! সেই সাক্ষাৎকারের কিছু অংশই এ লেখার শুরুতে ছিল।

৬ ডিসেম্বর ভুটান আর ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। কে আগে দিয়েছিল, সেটি নিয়ে বেশ বিতর্ক ছিল, তবে ২০১৪ সালে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মোঃ শহিদুল হক জানান, একই দিনে দু’দেশই স্বীকৃতি দেয়, তবে ভারতের কয়েক ঘণ্টা আগে ভুটান স্বীকৃতি দিয়ে তারবার্তা পাঠায়। ১৯৭৪ সালে স্বীকৃতি দেয় পাকিস্তান, তুরস্ক আর ইরান। তারও পরে ১৯৭৫ সালে দেয় চীন আর সৌদি আরব। এমনকি ইসরায়েলও ১৯৭২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু তৎকালীন পররাষ্ট্র মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ ইসরায়েলি সরকারকে লেখা চিঠিতে এ স্বীকৃতি প্রত্যাখ্যান করেন।

১৬ ডিসেম্বর। এদিন পাকিস্তানের ৯৩ হাজার সেনা নিয়ে জেনারেল নিয়াজি আত্মসমর্পণ করে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ডের কাছে। অস্ত্র ছাড়বার সময় একজনকে অনুভূতি জিজ্ঞেস করা হলে তিনি উত্তর দিলেন, “It’s just part of the game!

পাকিস্তান আত্মসমর্পণ করছে; Source: deccanchronicle.com

অনেকে জিজ্ঞেস করে থাকে, এখানে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এম এ জি ওসমানি কোথায় ছিলেন? তাহলে কি পাকিস্তান কেবল ভারতের কাছে আত্মসমর্পণ করল?

উত্তর হলো, না, বাংলাদেশ তখনো জেনেভা কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশ ছিল না, অর্থাৎ মুক্তিবাহিনী এই নীতির অধীনে ছিল না। তাই আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, পাকিস্তান মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে পারে না, তাই যৌথ বাহিনীতে ভারতের পক্ষে লেফটেন্যান্ট জেনেরাল অরোরার কাছে সমর্পণ করতে হয়েছিল।

এমন প্রশ্নও করা হয়, আমাদের স্বাধীনতার দলিল ভারতে কেন?

উত্তর হলো, দলিল শুধু একটি স্বাক্ষরিত হয়নি, মোট তিনটি দলিল স্বাক্ষরিত হয়েছিল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর তারিখে। তিনটি দলিলের একটি বাংলাদেশের জাতীয় জাদুঘরে, একটি ভারতে দিল্লী জাদুঘরে এবং অন্যটি পাকিস্তানে কোনো একটি সিন্দুকে বন্দী হয়ে আছে।

২০০২ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ বাংলাদেশে আসেন, তিনি যান স্মৃতিসৌধে। ১৯৭১ সালের জন্য ‘রিগ্রেট’ অর্থাৎ অনুতাপ প্রকাশও করেন। সেখানে ‘ভিজিটর্স বুকে’ তার লেখা কিছু লাইনে ছিল, “আপনাদের পাক ভাই-বোনেরা আপনাদের ‘৭১ এর দুঃখ অনুভব করে। আসুন আমরা এসব ভুলে গিয়ে সামনে এগিয়ে যাই।” সেই কথা শুনে তার আহ্বানকে মনে হতে পারে এমন- আসুন আমরা নিজেদের ইতিহাসের শিকড়কে ভুলে যাই।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিভিন্ন দেশের অবস্থানের প্রসঙ্গ ধরে পৃথিবীর নানা প্রান্তের কিছু মানুষের কথা উল্লেখ করা যায়। একজন ছিলেন বেলজিয়ান নাগরিক মারিও রয়ম্যান্স। ১৯৭১ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ২১ বছর বয়সী রয়ম্যান্স বেলজিয়ামের ব্রাসেলসের ফাইন আর্টস প্যালেস থেকে ‘লাভ লেটার’ নামের এক বিখ্যাত ছবি চুরি করেন।

মারিও রয়ম্যান্স; Source: essentialvermeer.com

এরপর তিনি বলেন, চিত্রকর্মটি ফিরিয়ে দেবেন যদি তার দাবি মানা হয়। আর তাঁর দাবি ছিল ২০০ মিলিয়ন বেলজিয়ান ফ্রাঁ। নিজের জন্য নয়, বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য। কারণ, তার দাবি, বেলজিয়ান সরকার তাদের সাহায্য করছে না।

অবাক করা বিষয়, একজন চিত্রকর্ম-চোরকে যেখানে গালি দেবার কথা, সেখানে পুরো বেলজিয়াম জুড়ে সমর্থনের বন্যা বয়ে গেল সেই চোরের জন্য! তাদেরও দাবি ছিল, এই টাকা পাঠাতে হবে। তবে তিনি পেইন্টিং সহ ৬ অক্টোবর ধরা পড়েন। অবশ্য তার দাবিটি মানা হয়নি, তার দু’বছরের জেলও হয়।

এবার ফরাসি নাগরিক ২৮ বছর বয়সী জ্যঁ ক্যুয়ে-র কাহিনী বলা যাক। তিনি ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর ফ্রান্সের অর্লি বিমানবন্দরে পাকিস্তান এয়ারওয়েজের বিমানে উঠে সোজা ককপিটে চলে যান। সেখানে পিস্তল দিয়ে জিম্মি করে ফেলেন পুরো বিমান, পাকিস্তানি নাগরিকে ভর্তি ছিল সেটি। তার হাতে ছিল একটি বাক্স, সেখানে বোমা। ৫ ঘণ্টা বিমানবন্দরে যাত্রীদের জিম্মি করে রাখেন তিনি।

তার দাবি ছিল, পূর্ব পাকিস্তানের যুদ্ধরত মানুষ আর শরণার্থীদের জন্য ২০ টন ওষুধ আর ত্রাণ পাঠাতে হবে। এই অবাক করা ঘটনাটি তখন সরাসরি সম্প্রচার করা হচ্ছিল। ফ্রান্সের সরকার বলল, ঠিক আছে, দাবি মানা হচ্ছে। ওষুধ পাঠানো হলো। কিন্তু যারা ওষুধ নিয়ে এলেন তারা ছিলেন ছদ্মবেশী পুলিশ। তারা প্লেনে উঠেই কাবু করে ফেললেন তাকে। দেখা গেলো, আসলে কোনো বোমাই ছিল না ঐ বাক্সে। যাত্রীরা জানালেন, তাদের সাথে কোনো খারাপ ব্যবহারও করা হয়নি। জ্যঁ ক্যুয়েকে ৫ বছরের জেল দেওয়া হয়। যে ২০ টন ওষুধের দাবি তিনি করেছিলেন, ফরাসি রেড ক্রস সেটি তাৎক্ষণিক পাঠিয়ে দেয় বাংলাদেশের জন্য!

আরেকটি বিশেষ নাম উজ্জ্বল হয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে। জর্জ হ্যারিসন। ‘৭১ সালের পহেলা আগস্ট বিটলসের প্রাক্তন গিটারিস্ট হ্যারিসন বন্ধু রবিশংকরের অনুরোধে একটি কনসার্টের আয়োজন করেন নিউ ইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে। ৪০ হাজার মানুষ সেই কনসার্ট উপভোগ করেন এবং সেখান থেকে আয় হয় তখনকার সময়ের আড়াই লাখ ডলার, যা এখনকার হিসেবে প্রায় ১২ কোটি টাকার সমান। তিনি যুদ্ধ আক্রান্ত বাংলাদেশের জন্য তুলেছিলেন এ টাকাটা!

জর্জ হ্যারিসনের বাংলাদেশ কন্সার্ট; Source: Beatles Magazine

বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী বুয়েটের প্রাক্তন শিক্ষক মাসুদ করিম খান স্মরণ করছিলেন সে দেশে তার সাথে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার।

ঢাকা যেমন রিকশার শহর, নিউ ইয়র্ক তেমনি ট্যাক্সির শহর। আর এই ট্যাক্সি চালকদের একটা বিরাট অংশ আমাদের উপমহাদেশীয়। গত লেবার ডে উইকেন্ডে বেড়াতে গেলাম নিউ ইয়র্কে মামার বাসায়। অনেকেই মনে করে নিউ ইয়র্কের মত ব্যস্ত শহরে বোধহয় গাড়ি চালানো কঠিন কাজ। আসলে গাড়ি চালানো ততোটা কঠিন না, কঠিন কাজ হচ্ছে গাড়ি পার্ক করা। তাই, শহরের ভিতরে চলাফেরা করার জন্য বাস বা সাবওয়েই তুলনামূলকভাবে ভালো মাধ্যম।

সেদিন সন্ধ্যায় বাংলাদেশি একটা অনুষ্ঠান ছিলো মেডিসন স্কয়ার গার্ডেনে। অনুষ্ঠান দেখতে গেলাম আমরা এবং মামা-মামী। রাতে বাসায় ফেরার সময় যে ট্যাক্সিটা পেলাম সেটার চালক ছিলো এক পাকিস্তানি যুবক। চেহারা দেখে মনে হয় বয়স বড়জোর ২৫ থেকে ৩০-এর মধ্যে। দেশি চেহারা দেখে আমাদের সাথে গল্প জুড়ে দিলো। আমরা বাংলাদেশি শুনেই সে ভাবে গদগদ।

– “আমরা তো সবাই ভাই ভাই, মাঝখান থেকে ভারত এসেই যত গোলমাল পাকালো।”

– “কীরকম গোলমাল?”, মামা জিজ্ঞেস করলেন। উনি সামনের সিটে বসেছিলেন।

– “আর বোলো না, আমরা মুসলিম ব্রাদাররা সব এক সাথে সুখে শান্তিতে বাস করতাম। ইন্দিরা গান্ধী আর মুক্তি বাহিনী মিলে ষড়যন্ত্র করে আমাদেরকে আলাদা করলো। আমরা দুই ভাই একসাথে থাকলে ভারত আজকে এতো বাড়াবাড়ি করতে পারে?”

– “তুমি কি আদৌ জানো ‘৭১ সালে কি হয়েছিলো? এই সব কোথা থেকে শিখেছো।” মামা শান্ত ভাবে জিজ্ঞেস করলেন। পিছনের সিটে আমি রাগে জ্বলছি। আমার বউ আমাকে ইশারা করছে কিছু না বলতে।

– “আমরা স্কুল কলেজে বইতে পড়েছি। তাছাড়া অনেক গল্প উপন্যাসেও বলা আছে কীভাবে ভারত আর মুক্তি বাহিনী মিলে আমাদের দেশকে আলাদা করেছে।”

– “পাকিস্তানি আর্মি যে আমাদের ৩ মিলিয়ন মানুষকে মেরে ফেলেছে ওই ব্যাপারে কিছু জানো?” মামা জিজ্ঞেস করলেন।

– “ওগুলো ভারত আর মুক্তি বাহিনীর প্রোপাগান্ডা!”

– “তাই নাকি? আচ্ছা মুক্তি বাহিনী সম্বন্ধে কী জানো?”

– “মুক্তি বাহিনী হচ্ছে হিন্দু আর ভারতীয়দের একটি গ্রুপ, যারা মিলে শান্তি শৃঙ্খলার কাজে বাধা দিতো আর লুটপাট করতো। এদেরকে ঠেকানোর জন্য আমাদের আর্মি অনেক চেষ্টা করেছে কিন্তু ইন্দিরা গান্ধীর ষড়যন্ত্রের কারণে পারে নাই।” ব্যাটা আরও কিছু বলার চেষ্টা করছিলো কিন্তু মামা তাকে থামিয়ে দিলেন।

– মামা বললেন, “আমি নিজে মুক্তিবাহিনীর লোক, আমি হিন্দুও না, ভারত থেকেও আসি নাই। অতএব তোমার শিক্ষায় ভুল আছে। ‘৭১ সালে আমি তোমাদের আর্মির অত্যাচার দেখেছি, কীভাবে তারা নিরীহ মানুষকে খুন করেছে আর গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে। নিজ হাতে গুলি করে তোমাদের আর্মিকে থামিয়েছি কয়েক জায়গায়। এই যে পিছনের সিটে বসা আমার ভাগ্নেকে দেখছো, এর জন্ম ওই যুদ্ধের সময়। ওর মা আমার ছোট বোন, সে ৮ মাসের প্রেগন্যান্ট অবস্থায় প্রায় ৮০ মাইল রাস্তা পায়ে হেঁটে শহর থেকে গ্রামে পালিয়ে গিয়েছিলো তোমাদের আর্মির হাত থেকে বাঁচার জন্য। আমি কোনো লোকমুখে শোনা গল্প বলছি না। আরও কিছু শুনতে চাও? তুমি যদি মুক্তিবাহিনী সম্বন্ধে আরেকটা বাজে কথা বলো এখনই তোমার ট্যাক্সি থেকে আমরা নেমে যাবো।” এটুকু বলে মামা থামলেন, আমি দেখছি মামা রাগে কাঁপছেন।

বাকি রাস্তা আর কোন কথা হলো না। ২৩ স্ট্রিট আর ১ এভিনিউর মোড়ে ট্যাক্সি থেকে নামলাম।

ট্যাক্সি ড্রাইভারের গাড়ি থেকে নামার কথা না, তবুও সে নেমে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, তোমার মা কি জীবিত আছেন। আমি বললাম, হ্যাঁ। সে আমাকে বললো, “তোমার মাকে বোলো একজন পাকিস্তানি তাঁর কাছে মাফ চেয়েছে।”

নিশ্চিতভাবেই এই ট্যাক্সি ড্রাইভার ছেলেটি তার মনে পাকিস্তানি চেতনা গড়ে ওঠার আগেই নিজের দেশ ত্যাগ করে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছে স্বপ্নপূরণের আশায়। বেশিদিন পাকিস্তানে থাকলে তার ‘পাকিস্তানি’ বিবেক তাকে এই ক্ষমাটা প্রার্থনা করতে দিত না। গৌতম বুদ্ধের একটি উক্তি আছে, “Children who are fed lies breed violence.” তাই কি নয় আসলে?

লেখাটি শেষ করবার আগে দুটো চিঠির কথা বলা যাক। প্রথমটি শহীদ রুমী তার মামাকে লিখেছিলেন, তবে ইংরেজিতে। তার বাংলা অনুবাদ দাঁড়ায় এরকম-

প্রিয় পাশা মামা,

অবাক হয়ো না! এটি লেখাও হয়েছিল আর তোমার কাছে পর্যন্ত পৌঁছালোও। পড়ার পর চিঠিটা নষ্ট করে ফেলো। এ নিয়ে আম্মাকে কিছু জানানোর চেষ্টা করো না। তাহলে তাদের বিপদে পড়তে হবে।

তাড়াহুড়ো করে লিখলাম।। হাতে সময় খুব কম। বেস ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে কাল এখান থেকে চলে যেতে হবে।

আমরা একটা ন্যায়সঙ্গত যুদ্ধ করছি। আমরা জয়ী হব। আমাদের সবার জন্য দোয়া করো। কী লিখব বুঝতে পারছি না- কত কী নিয়ে যে লেখার আছে। নৃশংসতার যত কাহিনী তুমি শুনছ, ভয়াবহ ধ্বংসের যত ছবি তুমি দেখছ, জানবে তার সবই সত্য। ওরা আমাদের নৃশংসতার সঙ্গে ক্ষতবিক্ষত করেছে, মানব-ইতিহাসে যার তুলনা নেই। আর নিউটন আসলেই যথার্থ বলেছেন, একই ধরনের হিংস্রতা নিয়ে আমরাও তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ব। ইতোমধ্যে আমাদের যুদ্ধ অনেক এগিয়ে গেছে। বর্ষা শুরু হলে আমরা আক্রমণের তীব্রতা বাড়িয়ে দেব।

জানি না আবার কখন লিখতে পারব। আমাকে লিখো না। সোনার বাংলার জন্য সর্বোচ্চ যা পারো করো। এখনকার মতো বিদায়।

ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা সহ,

রুমী

শহীদ রুমী; Source: The Daily Star

রুমী বলছিলেন, আমরা জয়ী হব, এবং আমরা হয়েছি!

অন্য চিঠিটি মুক্তিযোদ্ধা আতাউর রহমান খান কায়সার পাঠিয়েছিলেন তার ছোট্ট মেয়ে ওয়াসেকা খানকে, যে কিনা তখনো পড়তেই শেখেনি।

মামণি আমার,

তুমি যখন ইনশাআল্লাহ পড়তে শিখবে, বুঝতে শিখবে, তখনকার জন্য এই চিঠি লিখছি। তোমার ছোট্ট বুকে নিশ্চয়ই অনেক অভিমান জমা, আব্বু তোমাকে কেন দেখতে আসে না। মা আমার, আব্বু আজ তোমার জন্মদিনে তোমাকে বুকে নিয়ে বুক জড়াতে পারছে না এই দুঃখ তোমার আব্বুর জীবনেও যাবে না। কী অপরাধে তোমার আব্বু আজ তোমার কাছে আসতে পারে না। তোমাকে কোলে নিয়ে আদর করতে পারে না, তা তুমি বড় হয়ে হয়তো বুঝবে, মা। কারণ আজকের অপরাধ তখন অপরাধ বলে গণ্য হবে না। আজকে এ দেশের জনসাধারণ তোমার আব্বুর মতই অপরাধী, কারণ তারা নিজেদের অধিকার চেয়েছিল। অপরাধী দেশবরেণ্য নেতা, অপরাধী লেখক, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক- এ দেশের সব বুদ্ধিজীবী, কারণ তারা এ দেশকে ভালবাসে। হানাদারদের কাছে, শোষকদের কাছে এর চেয়ে বড় অপরাধ আর কিছুই নেই। এই অপরাধের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। সেই দণ্ড এড়াবার জন্য লাখ লাখ লোক দেশ ত্যাগ করেছে। সেই দণ্ড এড়াবার জন্য তোমার আব্বুকে গ্রামে গ্রামে পাহাড়ে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে। তাই আজ বুক ফেটে গেলেও আব্বু এসে তোমাকে কোলে নিয়ে আদর করতে পারছে না। মনের মণিকোঠায় তোমার সে ছোট্ট মুখখানি সব সময় ভাসে, কল্পনায় তাকে চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিই। আর তাতেই তোমার আব্বুকে সান্ত্বনা পেতে হয়।

আম্মু, নামাজ পড়ে প্রত্যেক ওয়াক্তে তোমার জন্য দোয়া করি। আল্লাহ রহমানুর রাহিমের কাছে মোনাজাত করি তিনি যেন তোমার আম্মুকে আর তোমাকে সুস্থ রাখেন, বিপদমুক্ত রাখেন।

মামণি, তোমার আম্মু লিখেছে তুমি নাকি এখন কথা বল। তুমি নাকি বল, আব্বু জয় বাংলা গাইত। ইনশাআল্লাহ সেই দিন বেশি দূরে নয় আব্বু আবার তোমাকে জয় বাংলা গেয়ে শোনাবে। যদি আব্বু না থাকি তোমার আম্মু সেদিন তোমাকে জয় বাংলা গেয়ে শোনাবে। তোমার আম্মু আরও লিখেছে, তুমি নাকি তোমাকে পিট্টি লাগালে আম্মুকে বের করে দেবে বলে ভয় দেখাও। তোমার আম্মু না ভীষণ বোকা। খালি তোমার আর আমার জন্য কষ্ট করে। বের করে দিলে দেখো আবার ঠিক ঠিক ফিরে আসবে। আমাদের ছেড়ে থাকতে পারবে না।

তোমার আম্মু দুঃখ পেলে এখন আর কাউকে বলবে না। একা একা শুধু কাঁদবে। তুমি আদর করে আম্মুকে সান্ত্বনা দিও, কেমন? তুমি আমার অনেক অনেক চুমো নিও।

ইতি,

আব্বু

ছোট্ট ওয়াসেকা হয়ত তার আম্মুকে আদর করে দিত, সান্ত্বনা দিত, এবং নিজে জয় বাংলা গেয়ে শোনাতো যুদ্ধ শেষে, বড় ওয়াসেকা এখন থাকেন চট্টগ্রামে।

কী গভীর আবেগ এই চিঠিগুলোতে, কত লুকোনো ভালোবাসা! খেলার মাঠে পাকিস্তানের চার-ছক্কায় উল্লাস করে ওঠা সেই আবেগের সাথে যে সেই আবেগের আকাশ-পাতাল তফাৎ! যুদ্ধরত রুমী কোনোদিন জানতে পারেননি যে, স্বাধীন বাংলাতেও কিছু মানুষের মাঝে পরাধীনতার আবেগ রয়ে যাবে, সেই বাংলার জন্য যে তাঁর যুদ্ধ ছিল না!

গভীর আবেগ, ভালোবাসা আর সাহসের সম্মিলন ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধ; Source: Herald Magazine – Dawn

বাংলাদেশকে না চিনেও এদেশের শরণার্থীদের জন্য কোটি কোটি টাকা উঠিয়ে ফেলা জর্জ হ্যারিসনের সেই গানের লিরিকগুলো দিয়ে এই লেখার ইতি টানছি।

“My friend came to me
With sadness in his eyes
He told me that he wanted help
Before his country dies

Although I couldn’t feel the pain
I knew I had to try
Now I’m asking all of you
To help us save some lives

Bangladesh, Bangladesh
Where so many people are dying fast
And it sure looks like a mess
I’ve never seen such distress

Now won’t you lend your hand and understand?
Relieve the people of Bangladesh”

ফিচার ইমেজ- লেখক

Related Articles

Exit mobile version