‘দিস ইজ রেডিও বাংলাদেশ মুজিবনগর…’ রেডিও থেকে খাঁটি ব্রিটিশ উচ্চারণে ভেসে আসা এক ভরাট কণ্ঠস্বর, যা ছিল ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশের খবর বহির্বিশ্বে পৌঁছানোর এক বড় উৎস। কণ্ঠস্বরটি সব্যসাচী চিত্র পরিচালক আলমগীর কবিরের। যিনি মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ইংরেজি বিভাগের প্রধান এবং প্রবাসী সরকারের প্রধান প্রতিবেদক। আজীবন একজন বিপ্লবী, যিনি তার বিপ্লবী চিন্তার স্বাক্ষর রেখেছেন সাংবাদিকতা, চিত্র সমালোচনা, লেখালেখি থেকে চলচ্চিত্র পরিচালনা পর্যন্ত। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দিকপাল এবং পথপ্রদর্শক ছিলেন তিনি।
১৯৩৮ সালে রাঙামাটি জেলায় আলমগীর কবিরের জন্ম, তার ডাক নাম ছিল মিন্টু। পিতার চাকরি সূত্রে হুগলীতে থাকায় পড়াশোনা শুরু হয় হুগলী কলেজিয়েট স্কুলে। এরপর দেশভাগের পর ঢাকায় ফিরে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ১৯৫২ সালে ম্যাট্রিক পাশ করেন। ‘৫৪ সালে ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েটের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক পাস করেন। এরপর ইংল্যান্ডে যান অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা করতে।
আলমগীর কবিরের চিন্তা-ভাবনা শুরু থেকেই যে কিছুটা আলাদা ছিল, সেটির পরিচয় পাওয়া যায় স্কুলেরই তার তৎকালীন অগ্রজ বড় ভাই, প্রয়াত সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হকের জবানীতে। সেসময় ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে নিয়মিত পাঠ্য বিষয়ের পাশাপাশি একটি অতিরিক্ত ব্যবহারিক বিষয় নিতে হতো, এরকম একটি ব্যবহারিক বিষয় ছিলো ‘কাঠের কাজ’। এই বিষয়ে কাঠমিস্ত্রীরা যেসব হাতের কাজ করেন, সেগুলো শেখানো হতো এবং ‘শিক্ষিত’ হওয়ার বাসনায় পড়াশোনা করতে আসা ছাত্রদের কেউই এটা নিত না। আলমগীর কবির এই বিষয়টি নিয়েছিলেন এবং অনেকেরই ঠাট্টার শিকার হয়েছিলেন।
পদার্থবিজ্ঞান ও তড়িৎ প্রকৌশলের মতো খটমটে বিজ্ঞানের ছাত্র হয়ে চলচ্চিত্রে কীভাবে তিনি জড়ালেন? অক্সফোর্ডে পড়ার সময় তিনি সুইডিশ পরিচালক ইংমার বার্গম্যানের ‘সেভেনথ সিল’ দেখেন, বেশ ক’বারই দেখেন। সেটি দেখে চলচ্চিত্র তৈরির প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এরপর অক্সফোর্ডেই চলচ্চিত্রের ইতিহাস, পরিচালনা করা, চলচ্চিত্রের নন্দনতত্ত্ব ইত্যাদি বিষয়ে বেশ কিছু কোর্স করেন। যেকোনো কিছুরই তাত্ত্বিক দিকে তার ঝোঁক ছিল বলে জানা যায়।
ছাত্রাবস্থায় ইংল্যান্ডে অবস্থান তাকে পুঁজিবাদের দিকে আকৃষ্ট করতে পারেনি, তিনি ঝুঁকে পড়েন বামপন্থার দিকেই। আলমগীর কবির ইংল্যান্ডের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন এবং পার্টিরই খবরের কাগজ ‘ডেইলি ওয়ার্কার’-এ সাংবাদিকতা শুরু করেন। ষাটের দশকে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির আনুকূল্যে কিউবায় যান, সেখানে তিনি গেরিলা যুদ্ধের উপর প্রশিক্ষণ নেন। এই সময় তিনি ফিদেল ক্যাস্ত্রোর সাক্ষাৎকারও গ্রহণ করেন।
আজীবনই তিনি ছিলেন বিপ্লবী, লেখালেখিই হোক আর চলচ্চিত্র নির্মাণ- সর্বত্রই সেটার ছাপ থাকত। ইংল্যান্ডে থাকতেই লন্ডনে উদ্ভব হওয়া ‘ইস্ট পাকিস্তান হাউজ’ এবং ‘ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্ট’ সংগঠন দুটির সংগঠক ছিলেন তিনি। সংগঠন দুটিই এ দেশের স্বাধীনতার পক্ষে বিদেশের মাটিতে চালিয়েছে প্রচারণা ও আন্দোলন।
ষাটের দশকে ফিলিস্তিন ও আলজেরিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধেও অংশ নেন আলমগীর কবির। আলজেরিয়া তখন ছিল ফ্রান্সের উপনিবেশ, সেখানকার স্বাধীনতা আন্দোলনে জড়ানোয় ফরাসী সরকারের বিরাগভাজন হয়ে কয়েক মাস জেলে থাকতে হয় তাকে। ‘৬৬ সালে দেশে ফিরে আসলে বামপন্থী আন্দোলনে জড়িত থাকার অভিযোগে আবারো গ্রেফতার হন তিনি পাকিস্তান সরকারের হাতে, যদিও ব্রিটিশ নাগরিকত্ব থাকায় পাকিস্তান সরকার একপর্যায়ে তাকে বাধ্য হয় ছেড়ে দিতে।
জেল থেকে ছাড়া পেয়ে তিনি পুরোপুরিভাবে নিয়োজিত হন সাংবাদিকতায়। প্রথমে ‘পাকিস্তান অবজাভার’-এ, এরপর ‘হলিডে’-তে। এরপর আলমগীর কবির নিজেই ‘দ্য এক্সপ্রেস’ নামে একটি পত্রিকা বের করেন। পত্রিকাটি ছিলো ট্যাবলয়েড ধাঁচের। ফলে ভিন্ন ধাঁচের এ পত্রিকা পাঠক মহলে বেশ কৌতূহলের যোগান দিয়েছিলো। ইংল্যান্ডে ট্যাবলয়েড পত্রিকার চল থাকলেও এদেশে ওই সময়ে তা ছিল একেবারেই নতুন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি কলকাতায় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধান প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করেন এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ইংরেজি বিভাগের দায়িত্ব নেন। জহির রায়হানের খুবই ঘনিষ্ঠ সহকর্মী হওয়ায় জহির রায়হানের সাথেই বিভিন্ন রণাঙ্গনে যাওয়া হয়েছে তার। যুদ্ধ চলাকালীনই জহির রায়হান ‘স্টপ জেনোসাইড’ প্রামাণ্যচিত্রটি বানানো শুরু করেছিলেন, যেখানে মূল যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করা হচ্ছিল। এটির সহকারী পরিচালক ছিলেন আলমগীর কবির, এই প্রামাণ্যচিত্রে ধারাভাষ্যের কণ্ঠও তার দেওয়া।
এই প্রামাণ্যচিত্র বানাতে গিয়ে একবার ভয়াবহ অভিজ্ঞতা হয় তাদের। স্বাধীনতার বেশ পরে একটা টিভি সাক্ষাৎকারে ঘটনাটি বলেছিলেন তিনি নিজের মুখে,
“স্টপ জেনোসাইড তৈরি করতে গিয়ে আমরা যখন মালদা বর্ডারে ছিলাম, তখন পাকিস্তানী একটা ক্যাম্প কাছেই ছিল, তারা আমাদের উড়িয়ে দিতে পারত। আমরা দুজনেই একটা মাইনফিল্ডের ভেতর দিয়ে বেকুবের মতো হেঁটে বেরিয়ে গেছি, আমার আগে যারা গেছে তারা মারা গেছে, আমরা বেঁচে আছি। কাজেই আমার আজ এখানে কথা বলার কথা নয়।”
ঠিক কবে থেকে চলচ্চিত্রের কাজে নামেন তিনি? বিভিন্ন সূত্র থেকে যেটি জানা যায় তা হলো, জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিটির কাজ যখন চলছে, তখন ছবিটির শ্যুটিং চলাকালে জহির রায়হানের কাজকর্মের ভিডিও ধারণ করেন তিনি। এভাবে জহির রায়হানের উপর একটি প্রামাণ্যচিত্র বানান, মূলত এটিই তার প্রথম কাজ।
১৯৭৩ সালে প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি বানান আলমগীর কবির, সেটি ছিল মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘ধীরে বহে মেঘনা’। এখনো পর্যন্ত দেশে নির্মিত অন্য সব মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক ছবির থেকে এটি আলাদা। কারণ, এই ছবিতে আলমগীর কবির যোগ করেছেন মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন আসল ফুটেজ। এর ভেতরে আছে মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণের দৃশ্য, যোদ্ধাদের যুদ্ধে যাওয়ার দৃশ্য, ১৬ই ডিসেম্বরে ট্রাকে উল্লাসরত অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধাদের ঘরে ফেরার দৃশ্য ইত্যাদি।
‘৭৫ সালে তিনি নির্মাণ করেন ‘সূর্যকন্যা’, এই ছবিতে সমাজ ও ইতিহাসে নারীর অবস্থান তুলে ধরেন তিনি এবং সেটি অত্যন্ত সাহসীভাবে। এই ছবির কাহিনী, চরিত্র, গান, সংলাপ সবই ছিল চমৎকার ও ব্যতিক্রমী। কাহিনীটি ছিল এক কল্পনাপ্রবণ শিল্পী ভাস্করকে নিয়ে, (বুলবুল আহমেদ) যে নিজের তৈরি এক নারীমূর্তির প্রেমে পড়ে, এভাবে বাস্তবতা আর কল্পনার মিশ্রনে কাহিনী এগিয়ে যায়। এ ছবিতে এক দৃশ্যে আলমগীর কবির অ্যানিমেশনের সাহায্যে কিছু প্রতীকি দৃশ্য দেখিয়েছেন, যা ঐ সময়ে সম্পূর্ণ এক নতুন ব্যাপার ছিল। ছবিটির দুটি গান ‘আমি যে আঁধারে বন্দিনী’ আর ‘চেনা চেনা লাগে তবু অচেনা’ ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।
‘৭৭ সালে তিনি বানিয়েছিলেন ‘সীমানা পেরিয়ে’। ‘৭০ এর ঘূর্ণিঝড়ের এক সত্য ঘটনা নিয়ে বানানো ছবি এটি। ১৯৭০ সালের জলোচ্ছ্বাসের তিনমাস পর একজোড়া মানব-মানবীকে বরিশালের এক সামুদ্রিক চরে পাওয়া গিয়েছিলো, তারা কোনোমতে মানবেতর অবস্থায় বেঁচে ছিলো। সেসময়ে সংবাদপত্রে দেখা ঘটনা নিয়ে আলমগীর কবির বানান তার দ্বিতীয় ছবি। এরপর একে একে বানিয়েছেন মোট সাতটি ছবি, যার মধ্যে আছে ‘রূপালী সৈকতে’, ‘মোহনা’, ‘পরিণীতা’ এবং ‘মহানায়ক’। প্রত্যেকটি ছবিই ছিল সমালোচকদের দ্বারা ব্যাপকভাবে সমাদৃত।
প্রত্যেকটি ছবিতেই তিনি পেয়েছেন দেশি-বিদেশি পুরস্কার, যার মধ্যে আছে একাধিকবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে তার ‘মোহনা’ ছবিটি পায় ‘ডিপ্লোমা অফ মেরিট’ সম্মাননা। এছাড়াও সমগ্র চলচ্চিত্র জীবনে তিনি বানিয়েছেন মোট ৯টি প্রামাণ্যচিত্র।
আলমগীর কবির মূলত একটি চলচ্চিত্র আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটিয়ে দিয়ে গেছেন, যার ধারা পরবর্তীতে অব্যাহত রেখেছেন তার ছাত্ররা, যেমন- তানভীর মোকাম্মেল, তারেক মাসুদ, মোরশেদুল ইসলাম প্রমুখ। এরা সকলেই আলমগীর কবিরের গড়া ‘ঢাকা ফিল্ম ইনস্টিটিউট’ ও ‘বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ’ এর ‘ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন’ কোর্সের ছাত্র ছিলেন। সবার মাঝেই তাই তিনি পরিচিত ‘চলচ্চিত্রাচার্য’ হিসেবে।
চলচ্চিত্র সমালোচনা লিখতেন তিনি অনেক দিন ধরেই, বইও লিখেছেন বেশ কয়েকটি। যেমন- ‘সিনেমা ইন পাকিস্তান (১৯৬৯)’, ‘ফিল্ম ইন বাংলাদেশ (১৯৭৯)’, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে তার লেখা প্রবন্ধগুলো নিয়ে একটি সংকলন ইত্যাদি। তার সব লেখাই ছিল ইংরেজিতে, ফলে এসব লেখা সবসময়ই সাধারণের চোখের আড়ালেই রয়ে গেছে। তবে আশার কথা, সম্প্রতি কিছু উৎসাহী তরুণ ও গবেষক হারিয়ে যাওয়া এসব লেখা বাংলায় অনুবাদ ও সংকলন করার উদ্যোগ নিয়েছেন।
ঠিক যে সময়ে তাকে বেশি দরকার ছিল চলচ্চিত্রে নবজাগরণের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য, ঠিক সেসময়েই তিনি চলে যান না ফেরার দেশে। ১৯৮৯ সালে বগুড়ায় একটা চলচ্চিত্র বিষয়ক অনুষ্ঠান শেষে ফেরার সময় নগরবাড়ি ফেরিঘাটে এক ট্রাকের ধাক্কায় গাড়ি সহ নদীতে পড়ে মারা যান এই কৃতি পরিচালক। কাকতালীয় ব্যাপার হলো, তার প্রিয় ছাত্র চিত্র পরিচালক তারেক মাসুদও সড়ক দুর্ঘটনাতেই প্রাণ হারান।
সহায়ক উৎস- প্রামাণ্যচিত্র ‘প্রতিকূলের যাত্রী’
ফিচার ছবি- প্রতিকূলের যাত্রী