দ্য লাস্ট সেইলর স্ট্যান্ডিং আর্টিফিসার মোহাম্মদ রুহুল আমিন

১০ ডিসেম্বর, ১৯৭১
খুলনা, বাংলাদেশ।

‘ইনকামিং এয়ারক্রাফট, বিয়ারিং…’

গানবোটের ভয়েস পাইপ[1] বেয়ে বয়ে আসা লুক আউট ম্যানের[2] যান্ত্রিক কণ্ঠেও যেন একরাশ শঙ্কা ভেসে এল। গলা বাড়িয়ে উড়ে আসা বিমান তিনটার দিকে তাকিয়েই কেন যেন রুহুল আমিনের বুকটা ধক করে উঠল! গত আট মাসের সম্মুখ সমরের অভিজ্ঞতা তাকে এজাতীয় ‘বেসিক কমব্যাট ইন্সটিংক্ট’[3] কে আমলে নিতে শিখিয়েছে। প্লেন তিনটার স্পিড আর ওড়ার ফর্মেশন দেখেই বোঝা যাচ্ছে সব কয়টাই ফাইটার প্লেন (জঙ্গি বিমান)। তাই তার গানবোট ‘পলাশ’-এর অ্যান্টি এয়ারক্রাফট গান (বিমান বিধ্বংসী কামান) ক্রুদের প্রস্তুত হওয়ার তাগাদা দিলেন রুহুল।

ভারতীয় সেনাপতি মানেকশ বর্ষা চলে আসার আগেই যুদ্ধটা শেষ করতে চাইছেন। সীমিত সময়ের জন্য তার মাউন্টেইন ডিভিশনগুলো দিয়ে ‘ব্লিতজক্রিগ’[4]-এর মতো একটা ‘লাইটেনিং ক্যাম্পেইন’ প্ল্যান করেছেন তিনি। পাকিস্তানি সেনাপতি নিয়াজির সীমান্তজুড়ে ‘হেজহজ’[5] স্টাইলে সাজানো ‘ফোর্ট্রেস ডিফেন্স’[6] ধূর্ততার সাথে বাইপাস[7] করে মানেকশর ভারতীয় ডিভিশনগুলো এখন কে কার আগে ঢাকা পৌঁছাতে পারে, সেই প্রতিযোগিতা শুরু করেছে। নিয়াজি আর অরোরা, দুজনের কাছেই ব্যাপারটা এখন দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে ঢাকা পতন মানেই এই যুদ্ধের শেষ। মুক্তিবাহিনী আর ভারতীয় সেনাবাহিনী মিলে গড়া মিত্রবাহিনী আপামর বাঙালিদের অকুণ্ঠ সমর্থন আর সহায়তায় বিদ্যুৎগতিতে ঢাকার দিকে ধেয়ে যাচ্ছে। তিন স্তরের ‘ঢাকা বাউল ডিফেন্স’[8]-এর মধ্যমণি জেনারেল নিয়াজি বর্ডার জুড়ে মিত্রবাহিনী দ্বারা বাইপাসড হয়ে শেষ বয়সে এসে নতুন করে শিখলেন যে স্থানীয় জনগণের সমর্থন আর রসদ সহায়তা (লোকাল সাপোর্ট) ছাড়া প্রতিরক্ষা যুদ্ধে লড়ে জেতা অসম্ভব। তাই ডিসেম্বরের উত্তুরে বাতাসে যেন আসন্ন বিজয়ের সুঘ্রাণ ভেসে আসতে শুরু করেছে।

মার্চের গোড়ার দিকে পাকিস্তানি সাবমেরিন পিএনএস (পাকিস্তান নেভি শিপ) ম্যাংরো গিয়েছিল ফ্রান্সের তুলন সাবমেরিন ডকইয়ার্ডে। ২৫ মার্চ ঢাকায় ক্র্যাকডাউনের খবর পেয়ে তুলন থেকে সব কজন বাঙালি সাবমেরিনার নিরুদ্দেশ হলেন। মে মাস নাগাদ তাদের ৮ জন সাবমেরিনার আর কিছু ইন্ডিয়ান নেভাল ইন্সট্রাকটর মিলে সব সেক্টর থেকে বাছাই করা ৩০০ জনের একটা নৌ-কমান্ডো দল গড়ে ফেলল। তারা আগস্টের ১৬ তারিখে চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দর আর চাঁদপুর ও নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দরে একযোগে ‘জ্যাকপট’ নামের এক সফল অভিযান চালিয়ে পাকিস্তানিদের ভিত নাড়িয়ে দিল। অবশ্য এরপর পাকিস্তানিরা নিরাপত্তা এত বাড়িয়ে দিল যে নিজেদের একটা নৌবাহিনী ছাড়া সফল নৌ অভিযানের কথা আর ভাবাই যাচ্ছিল না।

নৌবাহিনী গড়ার পরিকল্পনা অবশ্য সেই সেক্টর ১০ সৃষ্টির সময় থেকেই শোনা যাচ্ছিল। যুদ্ধের এই ডামাডোলের ভেতরই হপ্তা ছয়েক হলো দুটো টাগবোটকে গানবোটে রূপান্তরিত করে সদ্যোজাত বাংলাদেশ নৌবাহিনী যাত্রা শুরু করেছে। দেশি নৌ অফিসার না থাকায় ভারতীয় নৌবাহিনীর অফিসাররাই আপাতত গানবোটগুলোর অধিনায়কত্ব করে যাচ্ছেন। কিন্তু দুই গানবোট পদ্মা আর পলাশ নিয়েই নবজাতক এই ফ্লোটিলা ইতিমধ্যে অপারেশনে নেমে গেছে। রুহুল আমিন বাংলাদেশ নৌবাহিনী জাহাজ পলাশের ইঞ্জিন আর্টিফিসার, আর ভারতীয় লেফটেন্যান্ট কমান্ডার সামন্ত পলাশের অধিনায়ক।

ইঞ্জিনরুম আর্টিফিসার হয়েও রুহুল মাইন লেয়িংটা[9] বেশ ভালো করেই রপ্ত করে নিলেন। ১১ নভেম্বর চালনা বন্দর মোহনায় মাত্র এক ঘণ্টায় ৪টা মাইন লাগিয়ে তিনি সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। ইঞ্জিনরুম আর্টিফিসার হয়েও স্রেফ দেশের টানে রুহুলের এমন অলরাউন্ডার পারফরম্যান্সে মিত্র নৌবহরের ট্যাকটিক্যাল কমান্ডার ভারতীয় ক্যাপ্টেন মনীন্দ্রনাথ পর্যন্ত অবাক!

আর্টিফিসার মোহাম্মদ রুহুল আমিন। (১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৪ – ১০ ডিসেম্বর, ১৯৭১)। অলংকরণ: রহমান আজাদ

মুক্তিসেনাদের হাতে ৬ ডিসেম্বর যশোর ক্যান্টনমেন্টের পতন হওয়ার পর মংলা বন্দর আর খুলনার পাক নৌঘাঁটি তিতুমীর শত্রুমুক্ত করার দায়িত্ব দেওয়া হয় মিত্র নৌবাহিনীকে। সেই উদ্দেশ্যে ভারতের হলদিয়া ঘাঁটি থেকে পদ্মা, পলাশ আর ভারতীয় গানবোট পানভেল রওনা দিল। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান স্টিমার রুট ধরে তারা বাংলাদেশে প্রবেশ করে। সুন্দরবনের কাছাকাছি আসার পর ৮ ডিসেম্বর ভারতীয় পেট্রোল ক্রাফট চিত্রাঙ্গদাও তাদের সাথে যোগ দিল।

৯ ডিসেম্বর রাত ৮টার দিকে তারা কোনো বাধা ছাড়াই হীরণ পয়েন্টে প্রবেশ করল, আর পরদিন সকাল সাড়ে ৭টার ভেতর মংলা বন্দরে পৌঁছে গেল। মংলায় চিত্রাঙ্গদাকে রেখে সাড়ে ৯টায় তারা রওনা দিল-  চূড়ান্ত লক্ষ্য পাক নৌঘাঁটি তিতুমীর দখলের উদ্দেশে। সবার সামনে পানভেল, পেছনে পলাশ আর পদ্মা।

খুলনা শিপইয়ার্ডের কাছাকাছি পৌঁছাতেই তারা জঙ্গি বিমান তিনটা দেখতে পেল। সচকিত বাঙালি নাবিকরা দেরি না করে বিষয়টা ট্যাকটিক্যাল কমান্ডার ক্যাপ্টেন মনীন্দ্রনাথকে জানালেন, আর এন্টি এয়ারক্রাফট গান দিয়ে ফায়ার করে বিমানগুলোকে চ্যালেঞ্জ করার অনুমতি চাইলেন। জঙ্গি বিমান নিঃসন্দেহে দুর্ধর্ষ এক সমরাস্ত্র। কিন্তু তারাও পারতপক্ষে এন্টি এয়ারক্রাফট গানের ফায়ার এড়িয়ে চলে। তার ওপর সব জঙ্গি বিমানের আরেকটা বড় সীমাবদ্ধতা হলো জ্বালানি। প্রত্যেক পাইলটই জানেন ঠিক কতক্ষণের ভেতর তার বিমানের জ্বালানি ফুরিয়ে যাবে, মানে ঠিক কতক্ষণ সে আকাশে থাকতে পারবে। তাই একবার এন্টি এয়ারক্রাফট গান ফায়ারের কারণে ফিরে আসতে হলে শিগগিরই তারা আবার আক্রমণ করতে ফিরে আসে না।

কিন্তু ট্যাকটিক্যাল কমান্ডার ক্যাপ্টেন মনীন্দ্রনাথ বিমানগুলোকে ভারতীয় বিমানবাহিনীর সি হক বিমান বলে ধরে নিলেন, আর তাই স্বভাবতই এন্টি এয়ারক্রাফট গান ফায়ারের অনুমতি দিলেন না। তবুও রুহুল আমিনদের সন্দিগ্ধ চোখ বিমানগুলোকে অনুসরণ করতে লাগল। হঠাৎই বিমানগুলো তাদের সবাইকে হতবাক করে দিয়ে সহজাত অ্যাটাক ফর্মেশনে নিচু হয়ে তাদের দিকে ধেয়ে এল। প্রথম দফা জঙ্গি বিমানের গোলার আঘাতে মুহূর্তেই পদ্মার ইঞ্জিনরুমে দাউদাউ করে আগুন ধরে গেল।

তখনো পানভেল আর পলাশ অক্ষত, কিন্তু প্রকাশ্য দিবালোকে পদ্মার করুণ পরিণতি দেখে ততক্ষণে অন্য নাবিকদের ভেতর চক্রবৃদ্ধি হারে ভীতি আর হতাশা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। রুহুল আমিন বারবার এন্টি এয়ারক্রাফট গান ক্রুদের তাগাদা দিতে লাগলেন, কিন্তু সবাই ক্যাপ্টেন মনীন্দ্রনাথের আদেশের জন্য ইতস্তত করতে লাগলেন। কিন্তু ক্যাপ্টেন মনীন্দ্রনাথ সিদ্ধান্ত নিতে পারার আগেই জঙ্গি বিমানগুলো দ্বিতীয় দফা আক্রমণ হানল, এবার টার্গেট পলাশ!

মুহূর্তেই আগুনের লেলিহান শিখা পলাশের ইঞ্জিনরুম গ্রাস করতে চাইল। পলাশের কাপ্তান লেফটেন্যান্ট কমান্ডার সামন্ত রায় চৌধুরী বুঝলেন কিছুক্ষণের ভেতরই আগুন আরও ছড়িয়ে পড়বে, আর জাহাজের গোলাবারুদে আগুন লাগতেই এই আগুন নিয়ন্ত্রণের সম্পূর্ণ বাইরে চলে যাবে। কিন্তু রুহুল আমিন তার সহকর্মী মুহিবুল্লাহকে নিয়ে উদ্‌ভ্রান্তের মতো আগুন নেভানোর প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

কিছু আগুন নেভার নয়। ইঞ্জিনরুম, ফুয়েল স্টোর আর এমুনিশন স্টোর অবধি ছড়িয়ে পড়া এই আগুন তেমনি আগুন। তবু দুটি মাত্র গানবোট নিয়ে গড়া সদ্যোজাত বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে চোখের সামনে ধ্বংস হতে দেখে প্রায় উন্মাদ রুহুল আমিন সর্বস্ব দিয়ে সেই আগুন নেভানোর চেষ্টা করতে লাগলেন! মিত্র নৌ ফ্লোটিলার ভারতীয় নৌ কাপ্তান মনীন্দ্রনাথ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে লেলিহান আগুনের বিরুদ্ধে রুহুল আমিনের সেই হার না-মানা দ্বৈরথ দেখতে দেখতে ভাবলেন, কিছু মোটিভেশনও সেই কিছু আগুনের মতোই, কিছুতেই দমার নয়!

মনীন্দ্রনাথ একজন পেশাদার নেভাল অফিসার হিসেবে আক্রান্ত গানবোট দুটোর করুণ পরিণতি মেনে নিতে বাধ্য হলেন। বাস্তবতা মেনে নিয়ে তিনি চোখ থেকে বাইনোকুলার সরিয়ে পদ্মা আর পলাশের সবাইকে গানবোট ত্যাগ করে রূপসার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দিলেন। কারণ নিরাপদ দূরত্বে সরে যেতে যেতে পানভেলের হাল ধরা ক্যাপ্টেন মনীন্দ্রনাথ গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে উপলব্ধি করলেন, ‘এদের সত্যিই আর খুব বেশিদিন কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না…’

বিকট শব্দ করে পলাশের ইঞ্জিনরুম আর গোলাবারুদের স্তূপ বিস্ফোরিত হতেই অর্ধদগ্ধ রুহুল আছড়ে পড়লেন ডিসেম্বরের হাড়কাঁপানো শীতে শীতল রূপসার বুকে; নদীর পাড়টাকে মনে হয় যেন যোজন-যোজন দূর। ঢেউ ভেঙে অবশেষে তীরে পৌঁছাতেই তাকে হায়েনাদের মতো ঘিরে ধরে কুলাঙ্গার রাজাকারের দল। তাদের পৈশাচিক হিংস্রতায় চাপা পড়ে যায় আহত, রক্তাক্ত আর মুমূর্ষু রুহুলের দুর্বল প্রতিরোধ। গাছের ডালে বসা শবখেকো স্বাস্থ্যবান শকুনের দল অলস পাখা ঝাপটায়। ইদানিং তাদের কোনো তাড়া নেই…

অলংকরণ: রহমান আজাদ

বীরশ্রেষ্ঠ আর্টিফিসার মোহাম্মদ রুহুল আমিনের সংক্ষিপ্ত জীবনী

বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনের জন্ম ১৯৩৪, সালের ১ ফেব্রুয়ারি, নোয়াখালীর সোনাইমুড়ি উপজেলার বাঘচাপড়া গ্রামে। পিতা মোহাম্মদ আজহার পাটোয়ারি ছিলেন মোটামুটি সচ্ছল গৃহস্থ এবং মাতা জোলেখা খাতুন ছিলেন গৃহিণী।

তিনি ছিলেন বাবা-মায়ের প্রথম সন্তান। তারা ছিলেন ছয় ভাইবোন। ছোটবেলায় তার পড়াশোনা শুরু হয় পাড়ার মক্তবে ধর্মীয় শিক্ষার মাধ্যমে, পরে বাঘচাপড়া প্রাইমারি স্কুলে। স্কুল পাস করে ভর্তি হন আমিষা পাড়া হাইস্কুলে। এ সময় তার পিতার আর্থিক সচ্ছলতা কমতে থাকে। রুহুল আমিনকে এবার জীবিকা নিয়ে ভাবতে হয়।

হাই স্কুল পাস করে ১৯৫৩ সালে তিনি নৌবাহিনীতে জুনিয়র মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যোগ দেন এবং প্রাথমিক প্রশিক্ষণের জন্য গমন করেন করাচির অদূরে মানোরা দ্বীপে পাকিস্তানি জাহাজ (পিএনএস) বাহাদুরে। প্রাথমিক প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর সেখান থেকে পিএনএস কারসাজ (পাকিস্তান নৌ বাহিনীর কারিগরী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান) এ যোগদান করেন।

পরবর্তী সময়ে পিএনএস বাবর, পিএনএস খাইবার, পিএনএস তুঘরিলে দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৮ সালে পেশাগত প্রশিক্ষণ শেষ করেন। ১৯৬৫ সালে মেকানিশিয়ান কোর্সের জন্য নির্বাচিত হন। পুনরায় পিএনএস কারসাজে প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করার পর আর্টিফিসার পদে নিযুক্ত হন। ১৯৬৮ সালে চট্টগ্রাম পিএনএস বখতিয়ার নৌঘাঁটিতে বদলি হয়ে যান।

১৯৭১ সালের মার্চের শেষে কিংবা এপ্রিলের শুরুর দিকে একদিন রুহুল আমিন সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে বের হয়ে পড়েন নৌঘাঁটি থেকে৷ তারপর বাড়িতে গিয়ে ছাত্র, যুবক ও সামরিক-আধা সামরিক বাহিনীর লোকদের মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেন। এর কিছুদিন পর ভারতের ত্রিপুরা সীমান্ত অতিক্রম করে আগরতলা সেক্টর-প্রধান কোয়ার্টারে যান এবং সেখানে মেজর সফিউল্লাহর অধীনে ২ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২ নম্বর সেক্টরের অধীনে থেকে বিভিন্ন স্থলযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।

১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশ নৌবাহিনী গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়৷ এ উদ্দেশ্যে নৌবাহিনীর সদস্যদের যারা বিভিন্ন সেক্টর ও সাব-সেক্টরে থেকে মুক্তিযুদ্ধ করছিলেন তাদের সেপ্টেম্বর মাসে একত্র করা হয় আগরতলায় এবং গঠন করা হয় ১০নং সেক্টর৷ ইঞ্জিনরুম আর্টিফিসার মোহাম্মদ রুহুল আমিন নৌবাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে আগরতলায় একত্র হয়ে কলকাতায় আসেন এবং যোগ দেন ১০নং নৌ সেক্টরে৷ পরবর্তী সময়ে ভারত সরকার বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীকে কলকাতা বন্দরে গার্ডেনরিচ ডক ইয়ার্ডে দুটি গানবোট উপহার দেয়। সেখানে প্রতিটি বোটে কানাডীয় ধরনের ২টি বাফার গান লাগিয়ে এবং ব্রিটিশ ধরনের ৫০০ পাউন্ড ওজনের ৪টি মার্কমাইন বহনের উপযোগী করে গানবোটে রূপান্তর করা হয়। গানবোটের নামকরণ করা হয় ‘পদ্মা’ ও ‘পলাশ’। রুহুল আমিন পলাশের প্রধান ইঞ্জিনরুমে আর্টিফিসার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

৬ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে যশোর সেনানিবাসের পতন ঘটে। পাকিস্তানি বাহিনী পিছু হটতে থাকে। সে সময় খুলনায় পাকিস্তানি বাহিনীর ঘাঁটি তিতুমীর দখল করার পরিকল্পনা নিয়ে ভারতীয় গানবোট পাভেলের সাথে যুক্ত হয়ে পলাশ ও পদ্মা ভারতের হলদিয়া নৌঘাঁটি থেকে খুলনার উদ্দেশে রওনা দেয়। পথে জঙ্গি বিমান হামলায় পদ্মা ও পলাশ ধ্বংস হলে তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন। পরে রূপসার তীরে রাজাকাররা তাকে হত্যা করেছিল। বাগমারা গ্রামে রূপসা নদীতীরেই তাকে দাফন করা হয়।

ফুটনোট

[1] জাহাজের ডেক থেকে নিচে কথোপকথন ‘ব্রডকাস্ট’ বা প্রচার ব্যবস্থা

[2] জাহাজের ওপর দূরবীক্ষণ যন্ত্রসহ কর্তব্যরত প্রহরী।

[3] দীর্ঘদিন যুদ্ধক্ষেত্রে থাকার মাধ্যমে গড়ে ওঠা সহজাত প্রবৃত্তি।

[4] দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান সেনাবাহিনির আক্রমণ কৌশল।

[5] ব্লিতজক্রিগ আক্রমণ প্রতিহত করতে জেনারেল ম্যাক্সিম ওয়েগান্ড প্রস্তাবিত প্রতিরক্ষা কৌশল।

[6] জেনারেল নিয়াজির মূল শহরকেন্দ্রিক প্রতিরক্ষা কৌশল।

[7] কোনো শত্রু অবস্থান আক্রমণ না করে পাশ কাটিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া।

[8] ১৯৭১ সালের শেষভাগে ঢাকা প্রতিরক্ষায় পাকিস্তানিদের নেওয়া ত্রিস্তর বিশিষ্ট প্রতিরক্ষা ব্যুহ।

[9] পানিতে মাইন স্থাপন কৌশল।

তথ্যসূত্র ও সহায়ক গ্রন্থাবলি

১।  হাসান হাফিজুর রহমান কর্তৃক সম্পাদিত, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ, অষ্টম থেকে একাদশ খণ্ড, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষে সম্পাদিত, বিজি প্রেস, তেজগাঁও, ঢাকা, নভেম্বর, ১৯৮২।
২।  গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক সংকলিত, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ-ব্রিগেডভিত্তিক ইতিহাস, দশদিশা প্রিন্টার্স, ১২৪, আরামবাগ, ঢাকা-১০০০, মার্চ, ২০০৬।
৩।  গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক সংকলিত, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ-সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, দশদিশা প্রিন্টার্স, ১২৪, আরামবাগ, ঢাকা-১০০০, মার্চ, ২০০৬।
৪।  মুহাম্মদ নূরুল কাদির, দুশো ছেষট্টি দিনে স্বাধীনতা, মুক্ত প্রকাশনী, ১২৯ দক্ষিণ কমলাপুর রোড, ঢাকা-১২১৭, ২৬ মার্চ, ১৯৯৭।
৫।  বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, ১ম থেকে ৭ম খণ্ড, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শিক্ষা পরিদপ্তর কর্তৃক প্রকাশিত, এশিয়া পাবলিকেশনস, ৩৬/৭ বাংলাবাজার, ঢাকা, বইমেলা ২০০৮।
৬।  মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান, ১ম থেকে ৭ম খণ্ড, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শিক্ষা পরিদপ্তর কর্তৃক প্রকাশিত, এশিয়া পাবলিকেশনস, ৩৬/৭ বাংলাবাজার, ঢাকা, মে ২০১৫।
৭।  বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইতিহাস, ১ম থেকে ৫ম খণ্ড, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শিক্ষা পরিদপ্তর কর্তৃক প্রকাশিত, এশিয়া পাবলিকেশনস, ৩৬/৭ বাংলাবাজার, ঢাকা, মে ২০১৫।
৮।  মিলি রহমান সম্পাদিত, বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর স্মারকগ্রন্থ, আগামী প্রকাশনী, ৩৬ বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০, ফেব্রুয়ারি ২০০৫।
৯।  লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির, বীর প্রতীক, বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুরের দেশে ফেরা, শুধুই মুক্তিযুদ্ধ প্রকাশনী, ৭২ ইন্দিরা রোড, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫, ফেব্রুয়ারি ২০০৮।
১০। চন্দন চৌধুরী, বীরশ্রেষ্ঠ, কথাপ্রকাশ, আজিজ সুপার মার্কেট, শাহবাগ, ঢাকা-১০০০, ফেব্রুয়ারি ২০০৮।
১১। সাইদ হাসান দারা, সাত বীরশ্রেষ্ঠ ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, সময় প্রকাশন, ৩৮/২ক বাংলাবাজার, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০১০।
১২। ডা. মোহাম্মদ সেলিম খান, বাংলার বীরশ্রেষ্ঠ, মুক্তপ্রকাশ, ৩৮ বাংলাবাজার, ঢাকা, ডিসেম্বর ২০১১।
১৩। History of Counter Insurgency Operations in Chittagong Hill Tracts (1976-1999), Vol-2, Chapter – 3, 4 and 5, Page – Appendix 4E1-1.

ফিচার ছবি- রহমান আজাদ

[বি: দ্র: ডেল এইচ খানের লেখা সাতজন বীরশ্রেষ্ঠের বীরত্বের সবকটি গল্প পড়তে চাইলে দেখুন আদর্শ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের বীরগাথা‘ বইটি।]

Ruhul Amin, better known as Shaheed Mohammad Ruhul Amin, was an engine room artificer in the Bangladesh Navy who was posthumously awarded the nation's highest bravery award, Bir Sreshtho, for his service during the Liberation War.

Related Articles

Exit mobile version