১৯৭১ সালের জুলাই মাস, সারা বাংলাদেশে তখন চলছে মুক্তিসংগ্রাম। বাঙ্গালীর মুক্তিসংগ্রাম আলোড়ন তুলেছে সারা বিশ্বজুড়ে। পাকিস্তানী বাহিনীর অস্ত্র কেড়ে নিচ্ছে শত-সহস্র বাঙ্গালীর প্রাণ। পাকিস্তানের অন্যতম মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে নানাভাবে অস্ত্র সহায়তা দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। নিক্সন সরকারের সহায়তা নিতে পাকিস্তানী জাহাজগুলো ভিড় করছে আমেরিকার বন্দরে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষকে পাকিস্তানী বাহিনীর গণহত্যার খবর বেশ নাড়া দিয়েছিলো। প্রেসিডেন্ট নিক্সন পাকিস্তানকে মিত্র প্রমাণ করতে গিয়ে অস্ত্র সরবরাহ করে যাচ্ছেন। এই ব্যাপারটি আমেরিকার সাধারণ মানুষ মোটেই ভালোভাবে নেয়নি।
ফিলাডেলফিয়ার প্রবাসী বাঙ্গালী আর সাধারণ আমেরিকানরা মিলে তৈরি করলেন ‘ফ্রেন্ডস অফ ইস্ট বেঙ্গল’ নামে একটি সংগঠন। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের প্রতি যে অবিচার হচ্ছে সেই ব্যাপারে জোরালো আওয়াজ তুলেছিলেন তারা। ‘ফ্রেন্ডস অব ইস্ট বেঙ্গল’ সংগঠনের সভাপতি চার্লস কান ছিলেন পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিলোসফির অধ্যাপক। চার্লস খবর পেলেন জুলাইয়ের ৮ তারিখে বাল্টিমোর বন্দরে ভিড়বে ‘পদ্মা’ নামের এক পাকিস্তানী জাহাজ, অস্ত্র আর গোলাবারুদের বোঝা নিয়ে রওনা দিবে পূর্ব বাংলার দিকে, শত মায়ের কোল খালি করে দিতে বাংলার মাটিতে ঝাঁপিয়ে পড়বে হায়েনার দল।1
ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত একদল প্রবাসী আর আমেরিকান মিলে গড়ে তুলেছিল ‘The Bangladesh Information Center (BIC)‘ নামে আরেক সংগঠন। এটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আমেরিকার সাধারণ মানুষের জনমত আদায়, পাকিস্তান সরকারকে সহায়তা বন্ধের মতো দাবীতে প্রতিবাদ শুরু করে। এই সংগঠনের সভাপতি ছিলেন ডক্টর উইলিয়াম গ্রীনো। কর্মসূত্রে গ্রীনো ১৯৬৪-৬৫ সাল পর্যন্ত তৎকালীন ঢাকায় অবস্থিত কলেরা রিসার্চ ল্যাবরেটরির প্রধান ক্লিনিক্যাল রিসার্চার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। বাংলা ভাষা বেশ ভালোই বুঝতে এবং বলতে পারেন ডক্টর গ্রীনো।2
পাশাপাশি বাঙ্গালীদের সাথে কাজ করার সুবাদে এই দেশ আর মানুষের জন্য বেশ সহানুভূতির জায়গা তৈরি হয়েছিলো এই প্রভাবশালী বিজ্ঞানীর মনে। বাঙ্গালীদের উপর দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বৈষম্যের অনেকটাই নিজের চোখে দেখে এসেছিলেন। তাই যখন পাকিস্তানী বাহিনীর এই বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞের খবর পেলেন, তখন মূলত ডক্টর উইলিয়াম গ্রীনোর সভাপতিত্বেই গড়ে উঠেছিলো ‘The Bangladesh Information Center (BIC)‘। তার কাছেই প্রথম খবর এলো যে ‘পদ্মা’ কানাডার মন্ট্রিয়ল বন্দরে ভিড়েছে। অচিরেই সেটি অস্ত্র-গোলাবারুদ সংগ্রহের জন্য বাল্টিমোরে ভিড়বে। এই বন্দর থেকে জাহাজ যদি অস্ত্র নিয়ে ফিরতে পারে তবে বাঙ্গালীদের যে কী অপরিমেয় ক্ষতি হবে তা সহজেই অনুমান করতে পারলেন ডক্টর গ্রীনো। তাই রওনা হলেন তিনি বাল্টিমোরের দিকে। ইতোমধ্যে পত্রপত্রিকায় ‘পদ্মা’র বাল্টিমোরে পৌঁছানোর খবর বেশ ফলাও করে প্রচারিত হলো।
পাকিস্তানী জাহাজ বন্দরে যাতে ভিড়তে না পারে সেজন্য আন্দোলনে যাওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হলো। ‘ফ্রেন্ডস অব ইস্ট বেঙ্গল’ আর ‘The Bangladesh Information Center (BIC)‘ উভয়পক্ষই কাজ করে যাচ্ছিলো। কিন্তু মার্কিন প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিলো ‘পদ্মা’ বাল্টিমোর বন্দরে ভিড়ছে খাদ্যদ্রব্য আর অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী সংগ্রহের জন্য। তবে যেহেতু কানাডার মন্ট্রিয়ল বন্দরে ‘পদ্মা’র জন্য ‘Hazardous Cargo Permit‘ জোগাড় করা হয়েছিলো সেহেতু সন্দেহ আরো প্রবল হয়। কিন্তু বাল্টিমোর বন্দর কর্তৃপক্ষ দিনক্ষণ ঠিক করে ফেলেছে। তাই এই তাড়াহুড়ো দেখে সাধারণ মানুষের এটি বুঝতে আর বাকী ছিলো না যে ‘পদ্মা’য় করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে অস্ত্র।
তাই সাধারণ মানুষ সিদ্ধান্ত নিল তারা ‘পদ্মা’কে বাল্টিমোর বন্দরে ভিড়তে দিবে না। ফিলাডেলফিয়া আর বাল্টিমোরের সাধারণ আমেরিকান জনগণ ঠিক করলেন তারা ‘অহিংস উপায়ে’ বন্দরের কাজ বাধাগ্রস্ত করবেন। ‘এসোসিয়েটেড প্রেস’, ‘ইউনাইটেড প্রেস ইন্ট্যারন্যাশনাল’ ছাড়াও স্থানীয় পত্রপত্রিকা আর রেডিও টেলিভিশনে এই অহিংস আন্দোলনের খবর পৌঁছে দেওয়া হলো। লোকজনকে বলা হলো তারা যেন গাড়ির ছাদে করে তাদের ছোট নৌকা কিংবা জলযানগুলো নিয়ে আসেন।
১৯৭১ সালের ১৪ জুলাই পাকিস্তানী জাহাজ ‘পদ্মা’ বাল্টিমোরের বন্দরের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। অসাধারণ মনোবল নিয়ে ৩০-৩৫ জন সাহসী মানুষের একটি দল তাদের ছোট ছোট নৌকার দেয়াল তৈরি করে দিল পাকিস্তানী জাহাজের সামনে। তাদের তৈরি এই মানব দেয়াল ডিঙিয়ে জাহাজ বন্দরে ভেড়ানো ছিলো বেশ কঠিন ব্যাপার। তবে বন্দর কর্তৃপক্ষ, সরকারি কর্মকর্তা আর পুলিশ সদস্যরা বেশ ঘটা করে বলে যাচ্ছিলেন যে, “এই জাহাজে কোনো অস্ত্র চালান করা হচ্ছে না।”
বন্দর কর্তৃপক্ষ আর পুলিশ সদস্যরা আন্দোলনকারীদের সরে যাওয়ার জন্যে মাইকে ঘোষণা দেয়। তারা যদি জলের তৈরি মানব দেওয়াল সরিয়ে না নেয় তাহলে জাহাজ তাদের ওপর দিয়ে চালিয়ে বন্দরে ভিড়ানো হবে এই ঘোষণাও দেওয়া হয়। কিন্তু ন্যায়ের দাবীতে এই সৈনিকদল ছিলো অবিচল। আর আগে থেকে জানিয়ে দেওয়ায় রেডিও, টেলিভিশন আর সংবাদপত্রের প্রতিনিধিরা এই সংবাদ প্রচারের জন্যে ঘটনাস্থলেই উপস্থিত ছিলেন। আন্দোলনকারীদের একজন ছিলেন রিচার্ড টেইলর। বাংলাদেশের মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা থেকে এই মানুষটি সেদিন তার ছোট ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে ছুটে গিয়েছিলেন পাকিস্তানী জাহাজের সামনে। এমনকি নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও সেদিন তিনি পাকিস্তানী জাহাজকে রুখে দিতে প্রস্তুত ছিলেন।
দৃঢ়চেতা এই মানুষগুলোকে কথা দিয়ে সরানো যাচ্ছিলো না। শেষপর্যন্ত ইউএস কোস্ট গার্ডের সদস্যরা রিচার্ড টেইলর সহ তার সাথে থাকা নৌকা নিয়ে জড়ো হওয়া সবাইকে গ্রেপ্তার করে। কিন্তু এই গ্রেপ্তারের ঘটনা বেশ সাড়া ফেলে আমেরিকান গণমাধ্যমে। বন্দরে ভিড়ে পাকিস্তানী জাহাজ ‘পদ্মা’। কিন্তু এতগুলো মানুষকে গ্রেপ্তার করে জাহাজ বন্দরে ঢোকার সুযোগ করে দিয়ে বেশ চাপে পড়ে যায় নিক্সন প্রশাসন। সেখান থেকে জন্ম নেয় নতুন আন্দোলন। প্রতিবাদকারীরা রওয়ানা হয় ওয়াশিংটনের দিকে। তবে এই আন্দোলন সংগঠিত করে তোলা থেকে শুরু করে পাকিস্তানী জাহাজকে ভিড়তে না দেওয়ার প্রতিটি ধাপ ছিলো শান্তিপূর্ণ। আর শান্তিপূর্ণ সেই আন্দোলনের অভিজ্ঞতা নিয়েই পরবর্তীতে ‘Blockade! A Guide to Non-violent Intervention‘ নামে একটি বই লিখেছিলেন এই আন্দোলনের অন্যতম কাণ্ডারি রিচার্ড টেইলর। ১৯৭৭ সালে প্রকাশিত সেই বইয়ে উঠে আসে এই আন্দোলনের অনেক খুঁটিনাটি।
বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে করা সকল অত্যাচারের প্রতিবাদে ওয়াশিংটন ডিসিতে হোয়াইট হাউজের সামনে প্রতিবাদের সিদ্ধান্ত নিলেন একদল স্বেচ্ছাসেবী। পত্রপত্রিকায় ততদিনে কলকাতায় বাংলাদেশের শরণার্থীদের হৃদয় বিদারক সব ছবি প্রকাশিত হচ্ছিলো। এত বিশাল সংখ্যক মানুষকে মাথা গোজার ঠাঁই দিতে বেশ হিমশিম খেতে হয় ভারত সরকারকে। তাই বাধ্য হয়ে খোলা আকাশের নিচে তো বটেই, অব্যবহৃত পয়নিষ্কাশন পাইপকে মাথা গোজার ঠাঁই বানিয়ে নেন অনেকেই। আর এই মানবেতর পরিবেশে জীবনযাপন করার এমন একটি ছবি বেশ আলোড়ন তোলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে।
আমেরিকায় বসবাসরত বাঙ্গালীদের পাশাপাশি মানবাধিকার সচেতন সেই মানুষগুলো চাইছিলেন নিক্সন প্রশাসনের এই ব্যাপারে টনক নড়ুক। তারা হোয়াইট হাউজের সামনে কলকাতার সেই শরণার্থী শিবিরের অনুরূপ একটি শিবির তৈরি করলেন। একই রকম পয়নিষ্কাশন পাইপ জোগাড় করে হোয়াইট হাউজের খুব কাছেই খোলা আকাশের নিচে ঘাঁটি গাড়লেন তারা। এই ঘটনাও বিশ্বজুড়ে ব্যাপক সাড়া ফেলে, শরণার্থী শিবিরে ধুঁকে ধুঁকে মরা মানুষগুলোর জন্যে বিশ্বব্যাপী তৈরি হয় জনমত। কিন্তু অনেক আবেগ নিয়ে করা এই আন্দোলন কি নিক্সনের প্রশাসনের মন গলাতে পেরছিলো?
দীর্ঘদিন ধরে চলা এই আন্দোলনে একাত্মতা প্রকাশ করেছিলেন ৩৫০ জন বিশিষ্ট আমেরিকান ব্যক্তি, যার মধ্যে পাঁচজন ছিলেন নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং গবেষক। সরকারের কাছে দেওয়া এক সম্মিলিত বিবৃতিতে তারা বলেছিলেন,
“অবিলম্বে পাকিস্তানকে সকল প্রকার অর্থনৈতিক, সামরিক এবং কূটনৈতিক সহায়তা দেওয়া বন্ধ করতে হবে এবং পূর্ব পাকিস্তানের মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়নে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে হবে।” 3
এমনইভাবে নাম না জানা হাজারো সাধারণ আমেরিকান জনগণ সেই অগ্নিঝরা ১৯৭১ সালে এসে দাঁড়িয়েছিল বাঙ্গালীদের পাশে। কেউ বাড়িয়ে দিয়েছিলো তাদের সহায়তার উষ্ণ হাত, কেউ আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের ন্যায্য দাবীকে গণমাধ্যমের সামনে তুলে ধরেছিলেন।
বাল্টিমোর বন্দরের সেই অহিংস প্রতিবাদের অন্যতম সংগঠক রিচার্ড টেইলরের লেখা বই ‘Blockade! A Guide to Non-violent Intervention‘এর উপর ভিত্তি করে প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের একটি অসাধারণ কাজ করেছেন আরিফ ইউসুফ ও তাসবীর ইমাম।
তাদের সাথে ছিলেন মৃদুল চৌধুরী, রশীদ মামুন, সুজন বিন ওয়াদুদ নামের কিছু আত্মবিশ্বাসী তরুণ প্রাণ। পঁচাশি মিনিট দীর্ঘ সেই প্রামাণ্যচিত্রটিতে উঠে এসেছে বেশ কিছু দূর্লভ ছবি আর তথ্য। পাশাপাশি রিচার্ড টেইলর, তার স্ত্রী ফিলিস টেইলর ছাড়াও সেই আন্দোলনের সাথে জড়িত এক প্রবাসী বাংলাদেশী সুলতানা আলমের সাক্ষাৎকারও উঠে এসেছে। নিজেদের অর্থায়নে মুক্তিযুদ্ধের অমূল্য এই ইতিহাস সংরক্ষণে এগিয়ে এসে বেশ প্রশংসিতও হয়েছেন তারা। তাই দেরী না করে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের নিপীড়িত জনতার পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে কাজ করা বিদেশী এই বন্ধুদেরকে সম্মান জানানোর পাশাপাশি তাদের মূল্যবান বক্তব্যগুলোও সংরক্ষণ করে রাখা এখন সময়ের দাবী হয়ে উঠেছে।
তথ্যসূত্র:
- Taylor, Richard (1977). Blockade! A Guide to Non-violent Intervention, page: 9-14
- Taylor, Richard (1977). Blockade! A Guide to Non-violent Intervention, page:15-20
- Taylor, Richard (1977). Blockade! A Guide to Non-violent Intervention, page: 91
ফিচার ইমেজ: Wipf and Stock