রাতের এই সময়টায় হাইওয়ে একদম ফাঁকা। নির্জন নিস্তব্ধ প্রকৃতি। চারপাশে কেমন একটা ঘোর লাগা পরিবেশ। এরই মধ্যে অনেকগুলো ইঞ্জিনের গুঞ্জন জোরালো হচ্ছে। হাইওয়ের বিশুদ্ধ বাতাস খেতে খেতে খোশমেজাজে চট্টগ্রামের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফি। পাকিস্তান আর্মির ৫৩ ব্রিগেডের কমান্ডার সে। সময় তখন ৮টার কাছাকাছি। তারিখ ২৬ মার্চ, ১৯৭১। একটু পরেই চট্টগ্রাম পৌঁছে বাঙালিদের গণহত্যা শুরু করতে যাচ্ছে সে।
হঠাৎ করেই হাইওয়ের এক জায়গায় গাছের গুড়ি দিয়ে রাস্তা অবরোধ করা। কিঞ্চিৎ বিরক্ত ব্রিগেডিয়ার সিপাহিরদের ব্যারিকেড পরিষ্কারের অর্ডার দিলেন।
বাঙালি অতিথিপরায়ণ জাতি। চাটগাঁইয়ারা কি একটু বেশিই? চট্টগ্রামে আগমন উপলক্ষে ব্রিগেডিয়ার শফিকে আপ্যায়ন না করলে কেমন হয়?
হঠাৎ একঝাঁক বুলেট এসে স্বাগত জানাল শফি সাহেবের বহরকে। তিনদিক থেকে গুলি চালাচ্ছে কারা যেন। ভড়কে উঠলো সবাই। ইকবাল শফি তেলাপোকার মতো ছুটছেন কভার (আড়াল) নিতে। জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হলেন তিনি। একটু আগেও খোশমেজাজে থাকা ইকবাল শফির রক্ত এখন হিম হয়ে আসছে। মুক্তিবাহিনীর অ্যামবুশে পড়েছেন তারা!
বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্ন পদানত করতে অপারেশন সার্চলাইট শুরু করে পাকবাহিনী। এর ২৪ ঘণ্টা হয়েছে প্রায়। এত দ্রুত প্রতিরোধের আশা করেনি পাকবাহিনী। পেছনের গল্প জেনে আসা যাক তাহলে।
২৬ মার্চ, ১৯৭১, বিকাল ৫টা।
চট্টগ্রাম শহর থেকে কুমিরার দিকে এগিয়ে চলেছে ৫টি ট্রাক। তাদের ঘিরে জনতা স্লোগান দিচ্ছে। জয় বাংলা! ইস্ট বেঙ্গল জিন্দাবাদ! ইপিআর জিন্দাবাদ! কুমিরার দিকে এগিয়ে যাওয়া এই দলটির কমান্ডার ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ সুবিদ আলী ভূঁইয়া (পরে মেজর জেনারেল)। তিনি খবর পেয়েছেন পাকবাহিনীর বিশাল বহর চট্টগ্রাম আসছে। চট্টগ্রাম শহরে পাক সেনা আগে থেকেই ছিল। এরা এসে তাদের সাপোর্ট দেবে। চট্টগ্রামে পাক বাহিনীর রিইনফোর্সমেন্ট (নতুন করে শক্তি বৃদ্ধি) আসার এই খবর আরো কয়েকজন পেয়েছিল।
কুমিল্লা থেকে বাঙালি অফিসার মেজর এম এইচ বাহার চট্টগ্রামের ক্যাপ্টেন রফিককে (পরে মেজর রফিকুল ইসলাম, বীর উত্তম) এই খবর দিয়েছিলেন। ক্যাপ্টেন রফিক চট্টগ্রামের হালিশহরে থাকা সুবেদার মুসাকে জানান। তারাও ১ কোম্পানি সৈন্য নিয়ে পাক বাহিনীর বহরটিকে বাধা দিতে যান। তাদের বহরে ছিল কয়েকটি হালকা ও ভারি মেশিনগান, ৩ ইঞ্চি মর্টার এবং রকেট লাঞ্চার। তাছাড়া ক্যাপ্টেন ভূঁইয়ার পরামর্শে কালুরঘাট এলাকা থেকে ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি ছোট দল রওনা দেয়। পথিমধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় ক্যাপ্টেন সাদেক আহত হয়ে কুমিরা পৌঁছাতে ব্যর্থ হলেও ঐ দলের সৈনিকেরা সরাসরি কুমিরা এলাকায় রণাঙ্গনে যোগদান করে।
সন্ধ্যা ৬ টার মধ্যে বড় দুটি দল এবং আরো কিছু সৈন্য এসে পৌঁছায় কুমিরাতে। সামরিক জ্ঞানহীন মানুষও বুঝতে পারবে এই শক্তি পাক বাহিনীকে বাধা দেওয়ার জন্য তেমন কিছুই নয়। ক্যাপ্টেন ভূঁইয়া সব দলের অধিনায়কত্ব গ্রহণ করলেন। ভাটিয়ারী এবং সীতাকুন্ডের মাঝে এই জায়গা। একপাশে সাগর, আরেক পাশে পাহাড়। কুমিরায় হাইওয়ের পাশেই অবস্থান নিল মুক্তিবাহিনী।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি হলেও প্রতিরক্ষাব্যূহ তৈরির জন্য কুমিরা এক আদর্শ অবস্থান। পশ্চিমে সাগর আর পূর্বে পাহাড়ের মাঝ দিয়ে চলে যাওয়া ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ে ধরে এগিয়ে যাওয়া শত্রুদের ফাঁদে ফেলার জন্য চমৎকার একটি স্থান। কারণ, শক্রর ডানে ও বাঁয়ে প্রতিবন্ধকতা। এগোতে হলে সামনের রাস্তা দিয়েই এগোতে হবে।
হাইওয়ের ওপর একটা খাল ছিল, যেটা একটু সামনে গিয়েই সাগরে পতিত হয়েছে। ক্যাপ্টেন ভূঁইয়া খালকে ৩০০-৪০০ মিটার পেছনে রেখে অবস্থান নেন। যদি পিছু হটতে হয় তাহলে খাল পার হয়ে অন্যদিকে চলে যাওয়া যাবে বা খালের অপর প্রান্তে অবস্থান নেওয়া যাবে। সেনাদের তিন ভাগে ভাগ করেন তিনি। তিনজন প্লাটুন কমান্ডারকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেন। ডান পাশে পাহাড়ের ঢালে ভারি মেশিনগান স্থাপন করা হলো। সুবেদার মুসা নিজেই এটা চালানোর দায়িত্ব নেন। বামে কয়েকটি হালকা মেশিনগান বসানো হয়। মাঝেও একটু পেছনে পজিশন নেয় আরেকটি দল। সব মিলিয়ে অবস্থানটি ছিল ইংরেজি U-এর মতো। একদিক খোলা রাখা হয়। খোলা মুখ দিয়ে শিকার আসলেই সবাই ঝাঁপিয়ে পড়বে।
এদিকে সংখ্যায় পাকিস্তানিরা ছিল অন্তত ১২ থেকে ১৫ গুণ। ফ্রন্টিয়ার ফোর্স এবং ফিল্ড ইঞ্জিনিয়ারদের ছাড়াও এই দলের সাথে আলাদা একটি ১২০ মিলিমিটার মর্টারসহ একটি বাহিনী (৮৮ মর্টার ব্যাটারি ইউনিট অন্তর্গত) ছিল। মর্টার ইউনিটের নেতৃত্বে ছিলেন পাক কর্নেল শাহপুর খান বখতিয়ার।
ফেনীর কাছাকাছি এসে পাকবাহিনীর ইকবাল শফির বাহিনী থেমে যেতে বাধ্য হয়। কারণ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যরা অথবা স্থানীয় জনতা ইতোমধ্যেই ঢাকা-চট্টগ্রাম রোডের শুভপুর সেতুটি উড়িয়ে দিয়েছে। ঢাকায় ১৪ ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল খাদিম রাজাকে ২৫ মার্চ রাত ১২টা ১৫ মিনিটে কুমিল্লা থেকে সেনাদলের পথরোধের খবর রিপোর্ট করেন ব্রিগেডিয়ার শফি। ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফিকে তিনি পুলটি পাশ কাটিয়ে পাশের গিরিখাদ পার হয়ে চট্টগ্রাম শহরের দিকে এগিয়ে যাবার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু শুভপুর সেতু দখল না করে ইকবাল শফি তার পুরো বহরকে চট্টগ্রামে যাবার পথ করে দিতে সক্ষম হলেন না।
ভারি যানবাহনের বহর পেছনে রেখে হালকা যানবাহন নিয়েই তিনি এগিয়ে আসেন। মর্টার এবং ইঞ্জিনিয়ার ইউনিটকে নির্দেশ দিয়ে আসেন পথের বাধা সরিয়ে তারা যেন দ্রুতই অগ্রগামী বাহিনীর সাথে যোগ দেয়। পথে হালকা বাধা পাচ্ছিলেন। অনেকে ডালপালা ফেলে রেখেছে রাস্তায়। তবে সেগুলো নেহাত টোকার সমতুল্য ছিল বিশাল এই বাহিনীর সামনে।
এদিকে কুমিরা এসেই মুক্তিবাহিনীর একজনকে রেকি করতে পাঠিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন ভূঁইয়া। তিনি হাইওয়ের পাশের এক দোকান থেকে সিগারেট কেনার বাহানায় শত্রুদের গতিবিধি দেখে এসেছেন। মোটরসাইকেল নিয়ে দ্রুত ফেরত আসেন তিনি। পাক বাহিনী মাত্র ৪-৫ মাইল দূরে; সেনাদের ইউনিফর্মে কালো ব্যাজ ও বেল্ট আছে। ক্যাপ্টেন বুঝলেন, এরা ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের সেনা। যুদ্ধে এদের সুনাম আছে। তবে সেটাকে দুর্নামে পরিণত করতে হবে।
ক্যাপ্টেনের আদেশে গাছের গুড়ি দিয়ে ব্যারিকেড তৈরি করা হলো। সাথে রাস্তায় কিছু ইটও ছড়িয়ে রাখা হয়। সাধারণ মানুষ এসেও হাত লাগায়। মাত্র কয়েক মিনিটেই কাজ শেষ হয়ে যায়। অবাক হয়ে ক্যাপ্টেন ভূঁইয়া দেখলেন, তার ধারণা করা সময়ের আগেই ব্যারিকেড বানানোর কাজ শেষ। মানুষের মনে প্রতিরোধের তীব্র ইচ্ছাশক্তি দেখতে পেলেন তিনি।
এদিকে ব্যারিকেডের সামনে এসে থামে পাক বহর। ইকবাল শফি নিজে গাড়ি থেকে নেমে আসেন। তার সেনাদের দ্রুত ব্যারিকেড সাফ করার নির্দেশ দেন। কয়েকটা ট্রাক থেকে সেনারা নেমে আসে। কিছু সেনা এক হয়ে গাছের গুড়ি ঠেলতে শুরু করার সাথে সাথেই গুলি শুরু করে মুক্তিবাহিনী।
গুলি শুরুর সাথেই সাথেই ভীতসন্ত্রস্ত ব্রিগেডিয়ার রাস্তা থেকে দৌড়ে গিয়ে এক পাশে কাভার নেন। প্রাথমিক ত্রিমুখী হামলায় পাক বাহিনী হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। এত দ্রুত তারা বাংলার বুকে পাল্টা আঘাতের আশা করেনি। পাকবাহিনীও একটু পর গুলি শুরু করে। সাপোর্ট চেয়ে তারা নানা জায়গায় খবর পাঠায়। মুক্তিবাহিনীর সঠিক অবস্থান না বুঝে কিছুক্ষণ এলোমেলো ফায়ার করে পাকবাহিনী।
তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। মুক্তিবাহিনীর মেশিনগান ‘নিউট্রালাইজ’ (অকেজো) করার প্রয়াস ব্যর্থ হয়। প্রায় ২ ঘণ্টা ধরে যুদ্ধ চলে। ট্রেসার রাউন্ড (বিশেষ ধরনের গুলি যেটা ফায়ার করলে উজ্জ্বল আলোর ঝলকানি তৈরি হয়, যা অন্ধকারে এর গতিপথকে খালি চোখে দেখতে সাহায্য করে। এর ফলে রাতে লক্ষ্য ঠিক করা সহজ হয়)-এর আঘাতে শক্রর ৩টি ট্রাকে আগুন লেগে যায়। অনেক চেষ্টা করেও হানাদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান ভেদ করতে সক্ষম হয়নি। ফলে যুদ্ধের পরিস্থিতি মুক্তিবাহিনীর অনুকূলে থেকে যায়। এমতাবস্থায় পশ্চাদপসরণ করে পাকিস্তানি বাহিনী যক্ষ্মা হাসপাতালসহ আশপাশের পাহাড়ি এলাকায় প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করে। প্রায় ২ ঘণ্টা লড়াই করে অবশেষে সুসজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনী পরাজয় স্বীকার করে পিছু হটতে বাধ্য হয়। ফেলে যায় ২/৩ ট্রাক অস্ত্র ও গোলাবারুদ।
ব্রিগেডিয়ার শফি নিজের প্রাণ বাঁচানোর জন্য পাহাড়ের দিকে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটে যান। পাকিস্তানি সেনারা দলছুট হয়ে পড়ে। সেনাদের ওপর গ্রামবাসীর চোরাগোপ্তা হামলা তাদের আরও সন্ত্রস্ত করে তোলে। অচিন্তনীয় মাত্রার বিপর্যয়ে পড়ে পাকিস্তানি সেনারা।
সীতাকুণ্ড এলাকার বিভিন্ন মিল-ফ্যাক্টরির নিরাপত্তা বিভাগের অস্ত্র, বিভিন্ন ব্যক্তির লাইসেন্সধারী অস্ত্র, স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত কিছু অস্ত্রসহ দা, বাঁশের লাঠি, বোতল ভর্তি এসিড, পেট্রোল বোমা নিয়ে সাধারণ মানুষও পাকবাহিনীর মোকাবেলায় অংশ নেয়। স্থানীয় যুবক বাদশা মিয়া তার সঙ্গীদের নিয়ে পাকসেনা শিকারে বের হয়েছিলেন। কয়েকজন দলছুট সেনাকে দেখামাত্রই রামদা হাতে পাকসেনাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লে বেয়নেটের আঘাতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। কুমিরার যুদ্ধে তিনিই প্রথম শহীদ।
এদিকে অ্যামবুশে পড়ে ওয়্যারলেস সংযোগ বিচ্ছিন্ন হবার আগে ঢাকায় পাক হেডকোয়ার্টার এই বিপর্যয়ের খবর পৌঁছেছিল। ২৭ মার্চ সকালে ঢাকায় পাক জেনারেল অফিসার ইন-কমান্ড (জিওসি) টিক্কা খান নিজেই উদ্বিগ্ন হয়ে হেলিকপ্টার নিয়ে তাদের খুঁজতে বের হন। হেলিকপ্টারে গুলি লাগলে তারা ফেরত চলে আসে।
এই যুদ্ধে প্রাথমিকভাবে মুক্তিবাহিনী বিজয়ী হয়। প্রথম দিনের যুদ্ধ শেষে মুক্তিবাহিনীর সীমিত গোলাবারুদ প্রায় ফুরিয়ে আসে। ক্যাপ্টেন ভূঁইয়া গোলাবারুদ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম শহরে আসেন। কিন্তু নতুন করে অস্ত্র সংগ্রহ করতে পারেননি। শহরে থাকা পাক সেনাবাহিনীর ২০ বেলুচ রেজিমেন্টের হামলার শিকার হন কয়েকবার। তার গাড়ি এবং পাকবাহিনীর জিপের মধ্যে কয়েকবার ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে।
পরের দিন পেছনে থাকা কর্নেল শাহপুরের মর্টার বাহিনী এসে যোগ দেয়। সমুদ্রে গান বোট এসে গোলা নিক্ষেপ শুরু করে। ২৮ তারিখ আক্রমণ আরো তীব্র করে পাকবাহিনী। মুক্তিবাহিনী নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়। তবে তার আগে পাক বাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করে ছাড়ে।
মুক্তিবাহিনীর এক স্নাইপার নিখুঁত নিশানায় একটি গুলি উপহার দেন মর্টার বাহিনীর কমান্ডার কর্নেল শাহপুরকে। নিহত হয় কর্নেল। সব মিলে পাকবাহিনীতে ১৫২ জন বা তারও বেশি নিহত হয়। ধ্বংস হয়ে যায় পুরো একটি কোম্পানি!