তাসখন্দ থেকে ঢাকা (পর্ব–২): বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং সোভিয়েত ভূরাজনীতি

১৯৭০ সালে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানভিত্তিক পাকিস্তান আওয়ামী লীগ বিজয় লাভ করে, কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তান–নিয়ন্ত্রিত পাকিস্তানি সামরিক সরকার এবং পশ্চিম পাকিস্তানভিত্তিক পাকিস্তান পিপলস পার্টি আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানায়। এর ফলে ১৯৭১ সালের মার্চে পূর্ব পাকিস্তানে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয় এবং ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সশস্ত্রবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে একটি রক্তক্ষয়ী সামরিক অভিযান শুরু করলে পূর্ব পাকিস্তান ‘বাংলাদেশ’ হিসেবে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ আরম্ভ হয়।

সোভিয়েত ইউনিয়ন অস্বস্তি এবং শঙ্কার সঙ্গে এই পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে। এই যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের লাভের কোনো সম্ভাবনাই ছিল না, বরং ক্ষতি হওয়ার সমূহ আশঙ্কা ছিল। মস্কো আওয়ামী লীগের প্রতি সহানূভূতিশীল ছিল, কিন্তু পাকিস্তান দ্বিখণ্ডিত হোক বা পূর্ব পাকিস্তানকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের যুদ্ধ শুরু হোক, এটা চাইছিল না, এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকেও তারা সমর্থন দিতে আগ্রহী ছিল না। এর পেছনে বেশ কিছু কারণ ছিল।

প্রথমত, ১৯৬৬ সালের তাসখন্দ চুক্তির পর থেকে এবং বিশেষত ১৯৬৯ সালের চীনা–সোভিয়েত সীমান্ত যুদ্ধের পর থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করছিল। ভারতকে চীনের বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষ হিসেবে গড়ে তোলা এবং পাকিস্তানকে চীনের প্রভাব বলয় থেকে দূরে সরিয়ে আনা ছিল মস্কোর লক্ষ্য। এজন্য ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে শান্তি বজায় রাখা মস্কোর জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ছিল এবং এই উদ্দেশ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৬৬ সাল থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় ‘মধ্যস্থতাকারী’ ও ‘নিরাপত্তা ব্যবস্থাপকে’র ভূমিকা পালন করছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ সহজেই ভারত–পাকিস্তান যুদ্ধে রূপ নিতে পারত এবং এই পরিস্থিতির যাতে উদ্ভব না ঘটে সেজন্য মস্কো পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি আরো উত্তেজক করে তোলার পক্ষপাতী ছিল না।

১৯৬৬ সালে তাসখন্দে পাকিস্তানি রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী এবং সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী আলেক্সেই কোসিগিন; Source: Russia Beyond

দ্বিতীয়ত, সাধারণভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন তৃতীয় বিশ্বের জাতিগুলোর স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন করত। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ কোনো ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে সংঘটিত হচ্ছিল না, বরং তৃতীয় বিশ্বেরই একটি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। এজন্য মস্কো প্রাথমিক পর্যায়ে পূর্ব পাকিস্তানের যুদ্ধকে একটি স্বাধীনতা সংগ্রাম হিসেবে নয়, বরং ‘পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে যুদ্ধ’ এবং ‘বিচ্ছিন্নতাবাদ’ হিসেবে বিবেচনা করেছিল।

তৃতীয়ত, সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৬০–এর দশকের শেষদিকে পাকিস্তানের সঙ্গে একটি চলনসই সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল এবং ১৯৭১ সালের প্রারম্ভে সোভিয়েত–পাকিস্তানি সম্পর্কে গুরুতর কোনো সমস্যা ছিল না। পশ্চিম পাকিস্তান সোভিয়েত ইউনিয়নের নিকটবর্তী হওয়ায় (ওয়াখান করিডোর নামে পরিচিত আফগানিস্তানের একটি সরু অঞ্চল সোভিয়েত তাজিকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানকে পৃথক করেছিল) মস্কোর কাছে পূর্ব পাকিস্তানের চেয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক গুরুত্ব অনেক বেশি ছিল এবং পাকিস্তানে সোভিয়েত অর্থনৈতিক তৎপরতার সিংহভাগই কেন্দ্রীভূত ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। এমতাবস্থায় মস্কো পূর্ব পাকিস্তানের ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ আন্দোলনকে সমর্থন করে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটাতে আগ্রহী ছিল না।

চতুর্থত, মস্কোর আশঙ্কা ছিল যে, পূর্ব পাকিস্তানকে কেন্দ্র করে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে পাকিস্তানে সামরিক শাসন দীর্ঘায়িত হবে, ভারতে ডানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো শক্তিশালী হবে, ভারত ও পাকিস্তান উভয়ই দুর্বল হয়ে পড়বে, এবং যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে তাতে প্রত্যক্ষ চীনা হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা দেখা দেবে। এর ফলে দক্ষিণ এশিয়ায় সোভিয়েত প্রভাব হ্রাস পাবে। এজন্য মস্কো পূর্ব পাকিস্তানের ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’দের সমর্থন দিয়ে দক্ষিণ এশিয়াকে অস্থিতিশীল করতে প্রস্তুত ছিল না।

সোভিয়েত নেতা লিওনিদ ব্রেঝনেভের সঙ্গে সিরীয় রাষ্ট্রপতি হাফেজ আল–আসাদ। স্নায়ুযুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন সিরিয়াসহ বিভিন্ন আরব রাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলেছিল; Source: The American Mag

পঞ্চমত, ১৯৫০ ও ১৯৬০–এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন বিভিন্ন আরব (মিসর, সিরিয়া, আলজেরিয়া, সুদান, ইরাক ও দক্ষিণ ইয়েমেন) ও অনারব (আফগানিস্তান, গিনি, নাইজেরিয়া প্রভৃতি) মুসলিম রাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলেছিল এবং অন্যান্য আরব রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে আগ্রহী ছিল। এসময় পাকিস্তান ছিল জনসংখ্যার দিক থেকে মুসলিম বিশ্বের বৃহত্তম রাষ্ট্র এবং পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করার প্রচেষ্টায় সোভিয়েত ইউনিয়ন জড়িত থাকলে এই রাষ্ট্রগুলো সেটি নেতিবাচকভাবে দেখত। পূর্ব পাকিস্তান সংক্রান্ত নীতি গ্রহণের সময় মস্কোকে এই বিষয়টিও মাথায় রাখতে হয়েছিল।

ষষ্ঠত, পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব মস্কোপন্থী কমিউনিস্টদের হাতে ছিল না এবং আওয়ামী লীগ ও সোভিয়েত ইউনিয়ন পরস্পরের প্রতি ক্ষেত্রবিশেষে সহানুভূতিশীল হলেও একদিকে যেমন মস্কোপন্থী বাঙালি কমিউনিস্টদের সাথে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক ভালো ছিল না, অন্যদিকে তেমনি মস্কোও আওয়ামী লীগকে একটি ‘বুর্জোয়া’ ধনিক শ্রেণির দল হিসেবেই দেখত। তদুপরি, সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবির প্রতিবেদন থেকে মস্কো জানত যে, পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণের সিংহভাগ রক্ষণশীল মুসলিম এবং তাদের অভিজাত সম্প্রদায় সাধারণভাবে পশ্চিমাপন্থী। এরকম একটি অঞ্চল স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হলে সেখানে মস্কোর প্রভাব কতটুকু থাকবে সেটি নিয়েও সোভিয়েত নেতাদের মনে সন্দেহ ছিল।

সপ্তমত, পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করার প্রচেষ্টায় সোভিয়েত ইউনিয়ন সরাসরি জড়িত থাকলে পাকিস্তানের দুই ঘনিষ্ঠ মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের সরাসরি সংঘাত হওয়ার আশঙ্কা ছিল। সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে অগুরুত্বপূর্ণ পূর্ব পাকিস্তানে প্রভাব বৃদ্ধির অনিশ্চিত আশায় মস্কো এত বড় ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত ছিল না, অন্তত যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে।

১৯৭০–এর দশকে ভারতে পিকিংপন্থী কমিউনিস্টদের একটি মিছিল; Source: Telegraph India

এবং অষ্টমত, পূর্ব পাকিস্তান একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হলে সেটি যে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাবাধীন হবে এরকম কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। পূর্ব পাকিস্তানে পিকিংপন্থী কমিউনিস্টরা সক্রিয় ছিল এবং স্বাধীন বাংলাদেশে এরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পারলে সেটি হত মস্কোর জন্য বড় একটি সমস্যা। বাংলাদেশ চীনের প্রভাব বলয়ের অন্তর্ভুক্ত হলে এটি ভারতের উত্তর–পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোর বিচ্ছিন্নতাবাদীদের জন্য এবং পশ্চিমবঙ্গ ও অন্যান্য প্রদেশে সক্রিয় পিকিংপন্থী কমিউনিস্টদের জন্য একটি নিরাপদ ঘাঁটিতে পরিণত হতে পারত। সেক্ষেত্রে ভারত অভ্যন্তরীণ গোলযোগের কারণে দুর্বল হয়ে যেত এবং ভারতকে চীনের বিরুদ্ধে সামরিক প্রতিপক্ষ হিসেবে গড়ে তোলার সোভিয়েত পরিকল্পনা ব্যাহত হতো।

এমতাবস্থায় পূর্ব পাকিস্তানে মস্কোর উদ্দেশ্য ছিল ত্রিমুখী। এগুলো হলো– যত দ্রুত সম্ভব পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যার একটি শান্তিপূর্ণ ও রাজনৈতিক সমাধানের ব্যবস্থা করে সম্ভাব্য ভারত–পাকিস্তান যুদ্ধ রোধ করা ও দক্ষিণ এশিয়ায় স্থিতিশীলতা বজায় রাখা, পাকিস্তান যদি একত্রিত থাকে সেক্ষেত্রে পাকিস্তানের ওপরে সোভিয়েত প্রভাব অটুট রাখা এবং বাংলাদেশ যদি স্বাধীন হয় সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের ওপরেও সোভিয়েত প্রভাব বিস্তার করা।

পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পাঁচ দিন পর ১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ মস্কোয় সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির ২৪তম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। এই কংগ্রেসে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক লিওনিদ ব্রেঝনেভ উল্লেখ করেন যে, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধের সম্ভাবনা এতদঞ্চলের শান্তির জন্য হুমকি। এর দুদিন পর ১৯৭১ সালের ২ এপ্রিল সোভিয়েত রাষ্ট্রপ্রধান নিকোলাই পদগর্নি পাকিস্তানি রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খানের কাছে একটি চিঠি লেখেন। চিঠিতে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণের ওপর পাকিস্তানি সৈন্যদের অত্যাচার বন্ধ করার এবং পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যাটি শান্তিপূর্ণ ও রাজনৈতিকভাবে সমাধান করার আহবান জানান। তার এই পরামর্শটিকে যেন পাকিস্তানের ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়ে’ হস্তক্ষেপ হিসেবে না দেখা হয় সেটিও তিনি তার চিঠিতে উল্লেখ করেন।

সোভিয়েত রাষ্ট্রপ্রধান নিকোলাই পদগর্নি পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি সৈন্যদের নিষ্পেষণ বন্ধের আহবান জানিয়ে পাকিস্তানি রাষ্ট্রপতিকে চিঠি দিয়েছিলেন; Source: সংগ্রামের নোটবুক

প্রত্যুত্তরে ইয়াহিয়া খান সোভিয়েত রাষ্ট্রপতিকে লেখা একটি চিঠিতে উল্লেখ করেন, পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যার জন্য ‘খোলাখুলি ও নির্লজ্জ ভারতীয় হস্তক্ষেপ’ দায়ী এবং সোভিয়েত ইউনিয়নসহ কোনো রাষ্ট্রই নিজ সীমানার ভেতরে রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ সহ্য করে না। বস্তুত, ইয়াহিয়ার জবাবের ভাষা ছিল খানিকটা কড়া এবং পাকিস্তানি সরকার মনে করেছিল, পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যার প্রতি সোভিয়েতদের মনোভাবে ভারতের প্রতি সোভিয়েত পক্ষপাতিত্ব প্রকাশ পেয়েছে।

এরপর থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন পূর্ব পাকিস্তানের যুদ্ধ সম্পর্কে পাকিস্তান ও ‘বাংলাদেশে’র মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করে। পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যার একটি রাজনৈতিক সমাধানের জন্য পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে মস্কো পাকিস্তানে কর্মরত সোভিয়েত অর্থনৈতিক ও কারিগরি উপদেষ্টাদের প্রত্যাহার করে নেয়। সোভিয়েত রাষ্ট্র–নিয়ন্ত্রিত প্রচার মাধ্যমে আংশিকভাবে পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণের দুর্দশা এবং লক্ষ লক্ষ বাঙালি শরণার্থীর উপস্থিতির কারণে ভারতে সৃষ্ট আর্থ–সামাজিক সমস্যাগুলো সম্পর্কে প্রচার চালানো হতে থাকে। কিন্তু অন্যদিকে, এসময় সোভিয়েত সরকার সরাসরি পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকে।

১৯৭১ সালের এপ্রিল থেকে মে মাসের মধ্যে পাকিস্তানি সৈন্যরা সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে, কিন্তু এই নিয়ন্ত্রণ নিরঙ্কুশ ছিল না, কারণ পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে গেরিলা আক্রমণ অব্যাহত থাকে। এর প্রত্যুত্তরে পাকিস্তানি সৈন্যরা সাধারণ জনগণের ওপর অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়, যার ফলে লক্ষ লক্ষ শরণার্থী পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। বর্ষাকালে বাংলাদেশি গেরিলারা পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে যে আক্রমণগুলো চালায়, যথোপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও পর্যাপ্ত অস্ত্রশস্ত্রের অভাবে সেগুলো সাধারণভাবে ব্যর্থ হয় এবং ১৯৭১ সালের জুনের শেষদিকে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী দাবি করে যে, তারা বাংলাদেশি গেরিলাদের বর্ষাকালীন আক্রমণ প্রতিহত করে দিয়েছে। এসবের মধ্যে বাঙালি শরণার্থীদের ভারতে পলায়ন অব্যাহত থাকে।

১৯৭১ সালে প্রায় এক কোটি বাঙালি শরণার্থী ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল; Source: Dawn

সোভিয়েত ইউনিয়ন এসময় পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিল। ১৯৭১ সালের ১ মে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র ‘প্রাভদা’য় (Правда) ‘সঙ্কট ও এর ফলাফল’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয় এবং এতে পূর্ব পাকিস্তানে চলমান হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে সোভিয়েত ইউনিয়নের উদ্বেগের কথা উল্লেখ করা হয়। নিবন্ধটিতে পূর্ব পাকিস্তানে চলমান সঙ্কটকে ‘পাকিস্তানের জনসাধারণের স্বার্থের জন্য হুমকি’ এবং ‘এশিয়া ও সমগ্র বিশ্বের শান্তির জন্য বাধাস্বরূপ’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

১৯৭১ সালের ৬–৮ জুন ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং মস্কো সফর করেন। তার সফর শেষে সোভিয়েত–ভারতীয় যৌথ বিবৃতিতে পাকিস্তানকে ভারতে শরণার্থী প্রবেশ রোধ করা, পূর্ব পাকিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা এবং শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করার আহবান জানানো হয়৷ উল্লেখ্য, পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি সামরিক অভিযান শুরুর পর থেকেই ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সীমিত মাত্রায় সমর্থন করে আসছিল এবং পূর্ব পাকিস্তানকে ‘পূর্ববঙ্গ’ হিসেবে সম্বোধন করত। কিন্তু সোভিয়েত–ভারতীয় বিবৃতিতে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করা হয়।

১৯৭১ সালের ৯ জুন সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী কোসিগিন মস্কোয় একটি নির্বাচনী প্রচারণামূলক অনুষ্ঠানে পাকিস্তানি সরকারকে অনতিবিলম্বে ভারতে অবস্থানরত বাঙালি শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির আহবান জানান। সোভিয়েত পত্রিকা ‘প্রাভদা’ ও ‘ইজভেস্তিয়া’য় বাঙালি শরণার্থীদের দুর্দশা সম্পর্কে বিশদ বিবরণ প্রচারিত হয় এবং এই সমস্যার সমাধানের জন্য পূর্ব পাকিস্তানকে নিরাপদ করে তোলার দাবি জানানো হয়। বলা বাহুল্য, এসব পদক্ষেপ পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের পূর্ব পাকিস্তানি নীতিতে কোনো পরিবর্তন আনেনি, কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি নীতি সম্পর্কে মস্কো যে ক্রমশ অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে, সেটি ইসলামাবাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী কোসিগিন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন; Source: Sputnik News

অবশ্য ১৯৭১ সালের জুনের শেষদিকে কোসিগিন মস্কোয় পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূতকে এই বলে আশ্বস্ত করেন যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন পূর্ব পাকিস্তানে চলমান সমস্যাকে পাকিস্তানের ‘অভ্যন্তরীণ ব্যাপার’ হিসেবে বিবেচনা করে। অর্থাৎ, তখন পর্যন্ত মস্কো পাকিস্তান দ্বিখণ্ডিত করার পক্ষপাতী ছিল না, কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যা সমাধানে ইসলামাবাদের ব্যর্থতা তাদেরকে অসহিষ্ণু করে তুলছিল।

১৯৭১ সালের জুলাইয়ে বাংলাদেশি যোদ্ধারা তাদের বর্ষাকালীন অভিযানের ব্যর্থতার পর পুনর্গঠিত হয় এবং পাকিস্তানি সৈন্যদের ওপর আক্রমণ অব্যাহত রাখে। কিন্তু পাকিস্তানি সৈন্যরা পূর্ব পাকিস্তানের শহরাঞ্চল ও কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলগুলো নিজেদের দখলে রাখতে সক্ষম হয় এবং বাঙালি জনসাধারণের বিরুদ্ধে তাদের সন্ত্রাস সৃষ্টির অভিযান অব্যাহত থাকে। এর ফলে পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে শরণার্থী প্রবেশের হার বৃদ্ধি পেতে থাকে। একজন ভারতীয় সমরবিশারদের মতে, পাকিস্তানি সশস্ত্রবাহিনী ইচ্ছে করেই বাঙালি জনসাধারণের ওপরে অত্যাচার–নির্যাতন অব্যাহত রেখেছিল, যাতে লক্ষ লক্ষ বাঙালি (বিশেষত বাঙালি হিন্দুরা) পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে যেতে বাধ্য হয় এবং পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা সামগ্রিকভাবে হ্রাস পায়। তাঁর মতে, পাকিস্তানি সামরিক সরকারের মূল উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যাকে পশ্চিম পাকিস্তানের জনসংখ্যার সমান করে ফেলা, যাতে পাকিস্তানে বাঙালিদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা বিলুপ্ত হয়।

কিন্তু তখনো সোভিয়েত ইউনিয়ন পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হিসেবে দেখতে আগ্রহী ছিল না এবং পাকিস্তানের রাষ্ট্রকাঠামোর অভ্যন্তরেই পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যা সমাধানে আগ্রহী ছিল। ১৯৭১ সালের এপ্রিলে পাকিস্তানের ওপরে চাপ সৃষ্টির জন্য যেসব সোভিয়েত উপদেষ্টাকে মস্কো প্রত্যাহার করে নিয়েছিল, জুলাইয়ে তাদেরকে আবার পাকিস্তানে প্রেরণ করা হয়। এসময় কলকাতা–কেন্দ্রিক অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগ নেতা (এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী) আব্দুস সামাদ আজাদকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সোভিয়েত সমর্থন আদায়ের উদ্দেশ্যে মস্কোয় প্রেরণ করা হয়, কিন্তু সোভিয়েতরা তাকে শীতলভাবে গ্রহণ করে এবং কোনোরকম সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিতে অস্বীকৃতি জানায়। সোভিয়েত রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের প্রেরিত পত্রও মস্কো গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়, কারণ এটিকে পাকিস্তান নিশ্চিতভাবে পূর্ব পাকিস্তানের ‘বিচ্ছিন্নতাবাদীদের’ প্রতি সোভিয়েত সমর্থনের চিহ্ন হিসেবে বিবেচনা করত।

১৯৭১ সালের জুলাইয়ে বাংলাদেশি রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের চিঠি গ্রহণ করতে মস্কো অস্বীকৃতি জানিয়েছিল; Source: Sri Lanka Guardian

কিন্তু ১৯৭১ সালের জুলাইয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একটি ‘কূটনৈতিক বিপ্লব’ ঘটে, যা মস্কোর সমস্ত হিসেব–নিকেশ পাল্টে দেয়। এই বিপ্লবটি হলো মার্কিন রাষ্ট্রপতির জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা (এবং পরবর্তীতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী) হেনরি কিসিঞ্জারের চীন সফর। ১৯৭১ সালের ৯–১১ জুলাই কিসিঞ্জার অত্যন্ত গোপনে পিকিং সফর করেন, চীনা প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং ১৯৭২ সালের বসন্তকালে মার্কিন রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সনের চীন সফরের জন্য আমন্ত্রণপত্র সংগ্রহ করেন। এর মাধ্যমে চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দাঁতাত (Dentente) শুরু হয় এবং তাদের এই মৈত্রী ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে। আর এই মৈত্রী স্থাপনের ক্ষেত্রে উভয় পক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী বা বার্তাবাহকের ভূমিকা পালন করেছিল উভয়ের সাধারণ মিত্র পাকিস্তান।

চীনা–মার্কিন মৈত্রী মস্কোর জন্য যথেষ্ট খারাপ খবর ছিল, কিন্তু মস্কোর দক্ষিণ এশীয় মিত্র ভারতের জন্যও এটি মোটেই সুসংবাদ ছিল না। এসময় ভারত পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত শরণার্থীদের সমস্যা সমাধানে বৃহৎ শক্তিগুলোর (বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের) সমর্থন লাভে আগ্রহী ছিল, কিন্তু ঠিক এই সময়ে পাকিস্তানের মধ্যস্থতায় চীনা–মার্কিন মৈত্রী নয়াদিল্লিতে উদ্বেগের সৃষ্টি করে। ১৯৬২ সালের চীন–ভারত যুদ্ধে ভারতের পরাজয়ের পর থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে চীনের বিরুদ্ধে অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করেছিল, কিন্তু চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে স্থাপিত মৈত্রীর ফলে পরবর্তীতে চীনের সঙ্গে সম্ভাব্য কোনো যুদ্ধে আর ভারতের পক্ষে মার্কিন সমর্থন লাভের কোনো সম্ভাবনা রইল না। তদুপরি, পাকিস্তানের সঙ্গে সম্ভাব্য যেকোনো যুদ্ধে চীনের হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা আরো প্রকট হয়।

এই সিরিজের প্রথম পর্ব পড়তে ক্লিক করুন নিচের লিঙ্কে:

১) তাসখন্দ থেকে ঢাকা (পর্ব–১): বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং সোভিয়েত ভূরাজনীতি

This is a Bengali article about Soviet geopolitics in the Bangladeshi War of Independence.

References:

1. Mizanur Rahman Shelley, "Emergence of a New Nation in a Multi-Polar World: Bangladesh (4th Expanded Edition)," Dhaka: Academic Press and Publishers Library, 2007.

2. J. A. Naik, "India, Russia, China and Bangladesh," New Delhi: S. Chand, 1972.

3. Ghulam Wahed Choudhury, "The Last Days of United Pakistan," Bloomington: Indiana University Press, 1974.

4. Lachhman Singh, "Indian Sword Strikes in East Pakistan," Ghaziabad: Vikas Publishing House Pvt. Ltd., 1979.

5. Devendra Kaushik, "Soviet Relations with India and Pakistan (2nd Edition)," New Delhi: Vikas Publishing House Pvt. Ltd., 1974.

Source of the featured image: Russia Beyond

Related Articles

Exit mobile version