চিরায়ত গ্রামবাংলার শান্ত পরিবেশ। মনের সুখে ঢেঁকিতে ধান ভেনে চলেছে ছোট্ট এক কিশোরী। হঠাৎই পর্দা অন্ধকার হয়ে গেল, দূর থেকে ভেসে আসা সৈন্যদের বুটের শব্দ ক্রমেই বাড়তে থাকল। শিয়াল-কুকুরগুলো ডেকে চলল একাধারে, মাঝখানে থেকে থেকে মেশিনগান থেকে ছোঁড়া বুলেটের সাঁই সাঁই শব্দ। ভোর হতে দেখা গেল, সেই শান্ত গ্রামবাংলার দৃশ্যপট পরিবর্তন হয়েছে নিমেষেই, কাকের তীক্ষ্ণ আর্তনাদ জানান দিল- ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে সব।
মুক্তিযুদ্ধের আসল ফুটেজ দিয়ে তৈরী প্রামাণ্যচিত্র ‘স্টপ জেনোসাইড’-এর শুরুটা এভাবেই করেছিলেন বাংলাদেশের কালজয়ী চলচ্চিত্র নির্মাতা জহির রায়হান। শরণার্থী হিসেবে লক্ষ লক্ষ মানুষ যখন ভারতের দিকে পা বাড়াচ্ছে, তখন সেই যুদ্ধকালীন কঠিন মুহূর্তেও গণহত্যার বাস্তব চিত্র বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে দিতে প্রামাণ্যচিত্র তৈরির সাহস দেখিয়েছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার একমাসের মধ্যেই পরিকল্পনা করা ১৯ মিনিট ২০ সেকেন্ডের এই প্রামাণ্যচিত্র প্রস্তুত করতে জহির রায়হান সময় নিয়েছিলেন একমাসেরও কম।
পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম জঘন্য এই গণহত্যা প্রামাণ্যচিত্রে ফুটিয়ে তুলতে এরপর একে একে হাজির করা হলো পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পরিচালিত গণহত্যার নির্মম বাস্তব আলোকচিত্র। টাইপরাইটারে খটাখট শব্দে প্রতিধ্বনিত হলো জাতিসংঘের মানবাধিকারের কপি, ধ্বংসস্তূপের মধ্যে পড়ে থাকা অসংখ্য ছিন্নভিন্ন লাশ বুঝিয়ে দিল, পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মানবাধিকারের আসল রূপ।
সেলুলয়েডের ফিতায় এরপর দেখা গেল হাজার হাজার শরণার্থীকে ভারতের দিকে ছুটতে। প্যাঁচপ্ঁযাচে কাদার মধ্যে হারিয়ে যাওয়া পা দুটোকে কষ্ট করে বারবার টেনে ওঠাতে থাকল একটু নিরাপদ আশ্রয়ের আশায়। ইয়াহিয়া খানের আদেশে সোনার বাংলায় তাণ্ডব চালানো পাকিস্তানি সেনাদের কাছ থেকে পালানোর জন্য এই পা দুটোই ভরসা তাদের। কাদায় আটকে যাওয়া পা যেন রূপকার্থে যুদ্ধের ভয়াবহতায় হতবুদ্ধি হয়ে আটকে পড়া সাধারণ মানুষেরই প্রতিফলন ঘটিয়েছে।
তবে ভারতের শরণার্থী শিবিরেও ঠাঁই মেলা ভার হয়ে পড়েছে। আশ্রয়ের আশায় বাংলাদেশ থেকে ছুটে আসা জনমানুষের চাপ সামলাতে না পেরে দেখা দিয়েছে খাদ্যসংকট, পরিচ্ছন্নতার অভাবে ছড়িয়ে পড়েছে রোগ-বালাইয়ের মড়ক। এমনই এক পরিস্থিতিতে এক বৃদ্ধাকে দেখা গেল শরণার্থী শিবিরে ইতস্তত ঘোরাফেরা করছেন সাহায্যের আশায়, নিরীহ বাঙালির আশ্রয়হীন রূপকে জহির রায়হান চিত্রিত করেছেন এভাবেই।
পাকিস্তানি সৈন্যদের বর্বরতার উন্মত্ত রূপ প্রকাশ করতে পর্দায় এবার হাজির হলো এক মেয়ে। খুলনায় মেয়েটির বাবার দোকানে লুটপাট চালিয়েও ক্ষান্ত হয়নি তারা, মেয়েটিকে একাধারে ধর্ষণ করার পর তার বাবা-মাসহ পরিবারের সবাইকে গুলি করে মেরেছে তারা। সবকিছু হারিয়ে মেয়েটির চোখে এখন তাই শুধুই শূন্যতা আর অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে।
এরপর দৃশ্যপটে হাজির হলেন এক ব্যক্তি, একে একে ঘোষণা করলেন- ইয়াহিয়া খান কীভাবে ইতিহাসের কুখ্যাত শাসকদেরকে ছাড়িয়ে গিয়েছেন। নাদির শাহ, তৈমুর লং, মাহমুদ গজনী, মুসোলিনি আর হিটলারের চেয়েও বেশি নৃশংসতা বাংলাদেশের মানুষের ওপর দেখিয়েছেন ইয়াহিয়া খান, আর তার প্রতিটি কথার সত্যতা জানাতে দেখানো হলো গণহত্যার চিত্র। ফরিদপুরে নির্বিচারে হত্যা করা ২৫৩ জনের লাশ কিংবা বুড়িগঙ্গার পূর্বতীরে প্রায় ৬ হাজার মানুষকে মুহূর্তের মধ্যে নিঃশেষ করে দেওয়ার আলোকচিত্র আর্তচিৎকার করে মানবাধিকার কোথায়, তার প্রশ্ন তোলে।
স্টপ জেনোসাইডের অন্যতম বড় বৈশিষ্ট্য ছিল ভয়েস ওভারে ‘স্টপ’ শব্দটির পুনরাবৃত্তি। জহির রায়হানের সহকারী আলমগীর কবিরের কণ্ঠেই ধ্বনিত হয়েছে গণহত্যার বাস্তব চিত্র, আর প্রতিবার তার ‘স্টপ’ শব্দটি উচ্চারণের সাথে সাথে ভিডিওচিত্র থেমে যাওয়া প্রামাণ্যচিত্রের নামটিকেই সার্থক করে তুলেছে।
ওদেরকে খুঁজে বের করতে অসুবিধা হয়নি। দিগন্ত বিস্তৃত আধমরা মানুষের চলমান মিছিল সহজেই চোখে পড়ে। দেহের শক্তি নিঃশেষ, তবু ওদের চলতে হয়। স্টপ।
তারা তাদের মাথায় তাদের শেষ সম্বল নিয়ে হেঁটে চলেছে। স্টপ।
মাত্র কয়েকদিন আগেই এই শরণার্থীরা নিজেদের চোখে নৃশংসতা দেখে এসেছে। স্টপ।
শরণার্থী শিবিরেও সেই বৃদ্ধা কিংবা কিশোরীর অবস্থা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ‘স্টপ’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন পরিচালক। মূলত ‘স্টপ’ শব্দটির দ্বারা বাংলাদেশিদের উপর এই অকথ্য নির্যাতন ও গণহত্যা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন জহির রায়হান। অন্যদিকে, ‘স্টপ’ শব্দটির উপর জোর দিয়ে বক্তব্যের অন্যান্য বাক্যে সঠিক শব্দচয়নের মাধ্যমে দর্শকের একেবারে মর্মে আঘাত করতে সফল হয়েছেন আলমগীর কবির।
ভিয়েতনামের মাই লাই গণহত্যায় লেফটেন্যান্ট উইলিয়াম ক্যারি দোষী হলেও তার পক্ষে মার্কিন প্রেসিডেন্টের দাঁড়ানোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন জহির রায়হান। প্রশ্ন তুলেছেন, যারাই এই মানবাধিকারের রক্ষক, তাদের হাতেই কেন প্রতিবার এই অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে? প্রামাণ্যচিত্রটিতে জহির রায়হানের ব্যক্তিগত আদর্শও প্রতিফলিত হতে দেখা যায়।
পরিবারের হাত ধরেই বামধারার রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন জহির রায়হান। বড় দুই ভাই-বোন শহীদুল্লাহ কায়সার এবং নাফিসা কবিরের হাত ধরেই বামধারায় হাতেখড়ি হয় তার। আর তারই ছাপ পড়েছে ‘স্টপ জেনোসাইড’-এও। প্রামাণ্যচিত্র শুরুই হয়েছিলো রুশ বিপ্লবের প্রধান ভ্লাদিমির লেনিনের নিম্নোক্ত উক্তি দিয়ে,
যারা স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য আলাদা হওয়ার অধিকার দাবি করে, তাদেরকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে অভিযুক্ত করা, বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকারকে পারিবারিক ব্যবস্থা ধ্বংসের নামান্তর বলে অভিযোগ করার মতোই নির্বুদ্ধিতা এবং অসততা।
কলকাতায় থাকা অবস্থাতেও কিউবা আর পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন চলচ্চিত্র তাকে আরো বেশি প্রভাবিত করে স্টপ জেনোসাইড তৈরি করার জন্য। বিশেষ করে কিউবান চলচ্চিত্রকার সান্তিয়াগো আলভারেজের কাজের প্রকট ছাপ দেখা যায় জহির রায়হানের কাজে। ফিদেল ক্যাস্ট্রো চে গ্যেভারার মৃত্যুর ঘোষণা দেওয়ার আগে মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই বিভিন্ন বিপ্লবের ফুটেজ সম্পাদনা করে তৈরি করা হয়েছিল ‘হাস্তা লা ভিক্টোরিয়া সিয়েম্প্রে’। স্টপ জেনোসাইডেও জহির রায়হান তার ব্যতিক্রম ঘটাননি। প্রামাণ্যচিত্রে গণহত্যা ও বাংলাদেশিদের দুর্দশা যেভাবে চিত্রিত করা হয়েছে, তার কোনোটিই নকল কিংবা পরিকল্পিত দৃশ্যায়ন নয়। বরং প্রতিটি আলোকচিত্র ও ভিডিওচিত্রই সরাসরি গ্রহণ করা হয়েছে বাস্তব অবস্থা চিত্রিত করতেই।
এপ্রিল থেকে শুরু করে মে মাস পর্যন্ত শরণার্থী শিবিরগুলোতে গিয়ে স্টপ জেনোসাইডের জন্য ফুটেজ সংগ্রহ করতে থাকেন জহির রায়হান। আলমগীর কবিরের সহায়তায় একমাসের মধ্যেই শেষ করে ফেলেন সম্পাদনার কাজ, এবং ঐ মাসেই প্রকাশিত হয় সমগ্র বিশ্ব জুড়ে। স্টপ জেনোসাইড প্রকাশ হওয়ার পর বাংলাদেশের গণহত্যা নিয়ে রাতারাতি সাড়া পড়ে যায়। স্টপ জেনোসাইডের উদ্দেশ্য নিয়ে জহির রায়হান কলকাতার এক পত্রিকার সাক্ষাৎকারে বলেন,
আমি জহির রায়হান। আমি কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত নই। আমি কেবল একজন লেখক এবং চলচ্চিত্রকার। কিন্তু আমি বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় দেখেছি। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, আমি কিছু পাকিস্তানি মিলিটারিদের একটা অপারেশনের সময় একটা মুভি ক্যামেরা হাতে রাস্তায় চলতে দেখতাম। তারা মানুষ গুলি করে মারার পর সেই মুভি ক্যামেরা দিয়ে মৃত লাশগুলোর ভিডিও চিত্র নিত। ঘরবাড়ি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়ার পর সেগুলোর ভিডিও চিত্র নিত। তারা কিছু বাঙালিকে একত্র করে একটা দোকান লুট করতে বাধ্য করে।
নিজেদের মুভি ক্যামেরা দিয়ে তারা সেই লুট করার ভিডিও চিত্র ধারণ করে। এরপর আমি শুনেছি এবং পরে নিজে দেখেছি যে তারা এই ধারণকৃত অংশগুলো এডিট করে। এই ইডিট করা ভিডিওগুলো প্রেসে ছেড়ে দিয়ে বলে যে, বাঙালিরা অবাঙালিদের হত্যা করা শুরু করেছে। এই অরাজক ও বিভ্রান্তিমূলক পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য তাদের (মিলিটারিদের) রাস্তায় নামতে হয়েছে। এটি ছিল পুরোপুরি একটা মিথ্যা বানোয়াট কথা।
তবে প্রামাণ্যচিত্রের কোথাও বঙ্গবন্ধু কিংবা আওয়ামী লীগের নাম না আসায় ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে কলকাতায় থাকা আওয়ামী নেতৃবৃন্দ মহল। তবে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ এই প্রামাণ্যচিত্রের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরেছিলেন, বুঝতে পেরেছিলেন, এর মাধ্যমে সমগ্র পৃথিবীর নৈতিক সমর্থন পাওয়া সহজ হবে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীও প্রামাণ্যচিত্রটি দেখে এতটাই ব্যথিত হন যে তিনি তার চলচ্চিত্র বিভাগকে ‘স্টপ জেনোসাইড’ কিনে নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছিয়ে দেওয়ার আদেশ দেন।
স্টপ জেনোসাইডের পর জহির রায়হান আরো একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেন বাংলাদেশের জন্ম নিয়ে, নাম ‘অ্যা স্টেট ইজ বর্ন’। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর বাংলাদেশে ফিরে এসে জানতে পারেন, তার বড় ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারকে ধরে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা। এক রহস্যময় ফোনকল পেয়ে বড় ভাইকে খোঁজার জন্য ৩০ জানুয়ারি মিরপুরে ছুটে যান জহির রায়হান, কিন্তু আর ফিরে আসেননি। আর এভাবেই শেষ হয় সঙ্গম (১৯৬৪), জীবন থেকে নেওয়া (১৯৭০) কিংবা কাঁচের দেওয়াল (১৯৬৩)-এর মতো কালজয়ী ছবি উপহার দেওয়া এই সম্ভাবনাময় চলচ্চিত্রকারের জীবন।
স্টপ জেনোসাইড শুধু একটি প্রামাণ্যচিত্র নয়, মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিচালিত গণহত্যার একটি অসামান্য দলিলও বটে। আর এই গণহত্যাকেই সেলুলয়েডের ফিতায় আবদ্ধ করে বিশ্ববাসীকে নাড়া দিতে চেয়েছিলেন তিনি।