কখনও কি আপনার মনে হয়েছে যে, জীবন অর্থহীন! আমরা সবাই জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে নিজেদের ব্যর্থ মনে করি। নিজেকে ‘গুড ফর নাথিং’ বলে মনে হয়। কেউ কেউ এই হতাশা কাটাতে না পেরে নিজের জীবনকে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেয়, আবার কেউ তাদের মূল্যবান জীবনকেই শেষ করে দেয়।
জীবনে চলার পথে আমাদের সবারই লাইফ লেসন বা জীবন শিক্ষার দরকার পড়ে। আমাদের চারপাশেই অনেক মানুষ আছেন, যারা জীবনের কঠিনতম সময়কে পাড়ি দিয়ে সফল মানুষ হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাদের এই কঠিনতম সময়ে পাওয়া শিক্ষাই তারা আমাদেরকে বিলিয়েছেন, জীবনে সফল হওয়ার পথ দেখিয়েছেন। তাদের এই উপদেশগুলোই বদলে দিয়েছে অনেকের জীবন। এরকম জীবন বদলে দেওয়া কয়েকজন কারিগরের কথা বলতে গেলে এ পি জে আবদুল কালাম এর নামও না এসে পারে না।
ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এবং পরমাণু বিজ্ঞানী এ পি জে আবদুল কালামের জীবন সম্পর্কে আমরা কম-বেশি সবাই জানি। দরিদ্র মুসলিম ঘরে জন্মগ্রহণ করা এই মনীষীর সংগ্রামী জীবনের কথা আর নতুন করে কিছুই বলার নেই। শুধুমাত্র মেধা আর পরিশ্রমের জোরে একজন মানুষ কীভাবে সাফল্যের চূড়ায় উঠতে পারে তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ উদাহরণ তিনি।
একাধারে বিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ, লেখক, জনসেবক, রাজনীতিবিদ, এবং স্বভাবতই তিনি ভারতের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ একজন নাগরিক ছিলেন। পেয়েছেন ভারতরত্ন সহ আরো অনেক সম্মানজনক পুরষ্কার। তাঁর আরেকটি পরিচয় হলো, তিনি একজন প্রেরণাদায়ক ব্যক্তিত্বও বটে। তাঁর লেখা বিভিন্ন বই এবং বক্তব্যে জীবনে সুখী হওয়ার জন্য অনেক উপদেশ দিয়ে গেছেন, যা মৃত্যুর পরও তাঁকে মানুষের মনে অমর করে রেখেছে। তাঁর তেমনই কিছু জীবন বদলে দেওয়া উপদেশ নিয়েই আমরা আলোচনা করব।
১. জীবনে ব্যর্থতার প্রয়োজন আছে। ব্যর্থতা আছে বলেই সাফল্যের এত স্বাদ
আমরা চাই আমাদের জীবনে শুধু সাফল্যই ঘিরে থাকুক। কিন্তু জীবনে কোনো ব্যর্থতা না থাকলে আমরা আমাদের সাফল্যের সত্যিকারের মর্মটা বুঝতে পারি না। ব্যর্থতা ছাড়া জীবনে সাফল্যের কোনো আকাঙ্ক্ষা থাকে না। আর আকাঙ্ক্ষা না থাকলে কোনো জিনিস পাওয়ার পরে সেটা কেউ উপভোগ করে না। একমাত্র ব্যর্থতাই আমাদের মধ্যে সাফল্যের তীব্র আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত করে দেয়, ফলশ্রুতিতে সফলতা হয়ে ওঠে আরো উপভোগ্য।
২. জীবন এবং সময়ই হলো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। জীবন শেখায় সময়কে ভালভাবে ব্যবহার করতে, সময় শেখায় জীবনের মূল্য দিতে
জীবন হলো মানুষের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। জীবনকে অলংকৃত করতেই আমাদের এত সাধনা, আমাদের সকল কর্ম এই জীবনকে ঘিরেই আবর্তিত হয়। এই জীবনই আমাদেরকে চলার পথ দেখায়, মানুষের সাফল্য মানেই জীবনের সাফল্য। আর এই জীবনের সাফল্যের অন্যতম কারণ হলো সময়ের যথাযথ ব্যবহার। মানুষের জীবন অনেক ক্ষুদ্র। এই ক্ষুদ্র জীবনেই মানুষকে অনেক কাজ করে যেতে হয়। এজন্য দরকার সময়ের সঠিক মূল্যায়ন। আর সময়ই বলে দেয় আমাদের জীবন কতটা ক্ষুদ্র। তাই এটা আমাদেরকে জীবনের গুরুত্ব বোঝায়। জীবন-শিক্ষা আর সময়ই পারে একজন মানুষকে সফল করতে।
৩. স্বপ্ন সেটা নয় যেটা তুমি ঘুমিয়ে দেখ, স্বপ্ন হলো সেটাই যেটা পূরণের প্রত্যাশা তোমাকে ঘুমাতে দেয় না
আমাদের জীবনে সাফল্যের সবচেয়ে বড় কারণ হলো আমাদের সাফল্য-স্পৃহা। আমরা সবাই-ই জীবনে সফল হতে চাই। এই আকাঙ্ক্ষাই আমাদেরকে স্বপ্ন দেখায়। আর স্বপ্ন আমাদের জীবন ও কর্মকে অনেকাংশেই পরিচালিত করে, যা আমাদের জীবনকে সাফল্যের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়।
৪. আমরা শুধু সাফল্যের কারণেই গড়ে উঠি না, আমরা ব্যর্থতার কারণেও গড়ে উঠি
হার-জিত নিয়েই আমাদের জীবন। সাফল্য নিঃসন্দেহে আমাদের জীবনকে অলংকৃত করে, আমাদের জীবনকে আরো সুন্দর করে তোলে। কিন্তু শুধু সাফল্যই আমাদের জীবনের একমাত্র উপাদান না। ব্যর্থতাও জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কারণ, ব্যর্থতাই আমাদেরকে সফল হওয়ার শিক্ষা দেয়। ব্যর্থতা আমাদেরকে সফল হওয়ার আকাঙ্ক্ষাকে বাড়িয়ে দেয়। ফলে, আমাদের পরিশ্রমের স্পৃহা অনেক বেড়ে যায়। আমরা জীবনকে নতুনভাবে গড়তে শিখি। জীবন গঠনের জন্য তাই কেবল সাফল্য নয়, ব্যর্থতারও প্রয়োজন আছে।
৫. সফলতার গল্প পড়ো না, কারণ তা থেকে তুমি শুধু বার্তা পাবে, ব্যর্থতার গল্প পড়ো, তাহলে সফল হওয়ার কিছু ধারণা পাবে
আমরা অনেকের সাফল্যের গল্প পড়ে থাকি অনুপ্রেরণা পাওয়ার জন্য। অন্যের সাফল্যগাঁথা হয়তো আমাদেরকে অনেক উদ্বুদ্ধ করে, কিন্তু আমাদেরকে কোনো লাইফ লেসন বা জীবন বিষয়ক শিক্ষা দিতে পারে না। বরং অন্যের ব্যর্থতা আমাদেরকে অনেক কিছুই শেখায়। অন্যের ভুলের ঘটনা আমাদেরকে তাদের মতো ভুল না করতে শিক্ষা দেয়। অন্যের সাফল্যের গল্পে তারা কীভাবে সফল হয়েছে সেটা আমাদের কাজে না-ও লাগতে পারে, কিন্তু তাদের ভুলগুলো আমাদেরকে সেই ভুল এড়িয়ে যেতে সাহায্য করবে।
৬. যদি তুমি পরাজিত হও, তাহলে হাল ছেড়ো না, কারণ সেটাই তোমার শেখার প্রথম পদক্ষেপ
আমাদের জীবনে ব্যর্থতা একটি স্বাভাবিক ঘটনা। যেকোনো কাজে ব্যর্থতা আসতেই পারে। তাই বলে হাল ছেড়ে দিলে হবে না। একবার ব্যর্থ হওয়া মানেই সেই কাজে আর সাফল্য আসবে না তা কিন্তু নয়। বরং আমাদের আগের ব্যর্থতা থেকে আমরা আমাদের ভুলগুলো বের করে সেটা শুধরে নিতে পারি, যেটা আমাদের পরবর্তী চেষ্টায় সাফল্য এনে দেবে।
৭. ব্যর্থতা কখনোই তোমাকে গ্রাস করতে পারবে না যদি তোমার সাফল্যের ভিত শক্ত হয়
আমাদের মধ্যে সবসময় একটি আত্মবিশ্বাস থাকা উচিত যে, আমিই পারব। আমি সফল হতে পারব। আমাদের মধ্যে সাফল্যের স্পৃহা থাকলে কোনো কিছুই আমাদেরকে আটকাতে পারে না। ব্যর্থতা কখনোই আমাদের জীবনকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারবে না যদি আমাদের লক্ষ্য দৃঢ় থাকে।
৮. জিতে গেছ বলেই বসে থেকো না, কারণ পরেরবার ব্যর্থ হলে আরো মুখ তোমার প্রথম সাফল্যকে ভাগ্য বলেই অভিহিত করার জন্য মুখিয়ে থাকবে
আমাদের জীবনে সাফল্যের পরে ব্যর্থতা আসতেই পারে। তাই কোনো কাজে একবার সফল হয়ে গেলেই সেটাকে গুরুত্বহীনভাবে ফেলে রাখা যাবে না, কারণ আজকে যে কাজে আপনি সফল হয়েছেন, আগামীকাল সেই একই কাজে আপনি ব্যর্থও হতে পারেন। তখন আপনার আশেপাশের মানুষ বলবে আপনার আগের সাফল্য শুধুমাত্র “ভাগ্যের জোরে” অর্জন করেছেন। তাই অপেক্ষা করা যাবে না, পরবর্তী সাফল্যের জন্য কাজ করতে হবে।
৯. জীবনে কঠিন বাঁধাগুলো আসে তোমাকে ধ্বংস করতে নয়, বরং তোমার ভেতরে লুকোনো অপরিমেয় শক্তি আর সম্ভাবনাকে অনুধাবন করাতে, বাঁধাগুলোকে দেখিয়ে দাও তুমিও কম কঠিন নও
ব্যর্থতা মানুষের জীবনে একটি খুবই সাধারণ ঘটনা। চলার পথে ব্যর্থতার মুখ দেখেনি এমন কোনো মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। আপাতদৃষ্টিতে ব্যর্থতা একটি দুঃখের ঘটনা হলেও আসলে ব্যর্থতা আমাদের জন্য এক অপার সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেয়। আমরা আমাদের ব্যর্থতা থেকে ভুলগুলো অনুধাবন এবং সেটা ঠিক করার সময়ই আমাদের নিজেদের অনাবিষ্কৃত প্রতিভা এবং সামর্থ্যকেই নতুনভাবে আবিষ্কার করি, যেটা আমাদের পরবর্তী জীবনে চলার পথকে আরো মসৃণ করে তোলে। তাই জীবনে চলার পথে বাঁধা আসলে আমাদেরকেও শক্ত হাতে সেটা মোকাবেলা করতে হবে।
১০. চিন্তা হলো মূলধন, উদ্যোগ দেখায় পথ, আর পরিশ্রমেই সমাধান
আমাদের জীবনে সাফল্য নিজে থেকে আসে না। যত রকম সাফল্য এবং সমাধান সবকিছুই আসে নিজের চিন্তা থেকে। মানুষের চিন্তাই মানুষকে সাফল্যের প্রথম পদক্ষেপটা ফেলতে সাহায্য করে। এরপরে আসে উদ্যোগ, যা আমাদের জীবনকে পথ দেখায়। এবং সবশেষে সঠিক পরিশ্রম ও সাধনাই আমাদের জীবনকে সফল করে তোলে। তাই চিন্তা, উদ্যোগ আর পরিশ্রম এই তিনের সমন্বয়েই জীবনকে অলংকৃত করা সম্ভব।
এ পি জে আবদুল কালামের গভীর জীবনদর্শন ও চেতনা আমাদের জীবনকে অনেক ক্ষেত্রে অনুপ্রাণিত করেছে। তাঁর এই উপদেশ এবং সাফল্য আমাদেরকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দেয়। তাঁর জীবনী এবং অমিয় বাণীসমূহের জন্য তিনি সারা বিশ্বের মানুষের কাছে একজন অনুসরণীয় ব্যক্তি হয়ে থাকবেন চিরকাল।
এ. পি. জে. আবদুল কালাম এর বই সমূহ দেখতে ক্লিক করতে পারেন নিচের লিংকে-