২০০৯ সালে ২৩ বছর বয়সী মার্কিন তরুণী অলিভিয়া জুন সানফ্রান্সিসকোতে থাকা শুরু করেন। তার ক্যারিয়ার নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা ছিল না, কিন্তু তিনি শহরটা পছন্দ করেন। এর চেয়ে বড় কথা- এক আত্মীয়ের বাড়িতে ভাড়া ছাড়াই থাকতে পারেন।
নতুন জায়গায় এসে থাকাটা তার জন্য ছিল বেশ একাকিত্বের। কারণ, এখানে তার কোনো বন্ধু ছিল না। চাকরিতে না ঢোকা পর্যন্ত নতুন বন্ধু হওয়াও সম্ভব ছিল না। তিনি সময়টা টিভিতে সিরিয়াল দেখে কাটাতেন। মাঝে মাঝে জানালা দিয়ে দেখতেন তার বয়সী তরুণীরা দলবেধে খেতে কিংবা ইয়োগাতে যাচ্ছে। তিনি চিন্তা করতেন কীভাবে তাদের সাথে পরিচিত হতে পারবেন, কীভাবে তাদের মতো একজন হতে পারবেন। ভেতরে ভেতরে তিনি খুব নিঃসঙ্গ অনুভব করছিলেন। কিন্তু সেই অনুভব নিয়ে ভাবাও তিনি লজ্জার ব্যাপার মনে করছিলেন।
এখানে আসার এক মাস পর তিনি ওকেকিউপিড (OkCupid) অ্যাপের মাধ্যমে সেখানকার অন্য তরুণীদের সাথে বন্ধুত্ব করতে চান। কিন্তু এখানেও অনেকের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হন। এভাবে কয়েকজনের সাথে পরিচিত হন। ধীরে ধীরে কিছু বন্ধুও জুটিয়ে ফেলেন বাস স্টপ, স্থানীয় কফিশপের লাইন ও স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজে। কিন্তু তার কাছের কোনো বন্ধু পাচ্ছিলেন না। ২০১২ সালে ব্যাপ্তি আরো বাড়ানোর জন্য শহরের বিভিন্ন বারে মাসে একবার করে যাওয়া শুরু করলেন। এসব জায়গায় বিভিন্ন লোকের সাথে কথা বলে বুঝতে পারলেন- মানুষের মাঝে নিঃসঙ্গতা ও বিচ্ছিন্নতা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে।
২০১৫ সালে জুন চালু করেন হেই ভিনা অ্যাপ, যার মাধ্যমে নারীরা নতুন বন্ধু খুঁজে নিতে পারেন। এতে তিনি উৎসাহব্যঞ্জক সাড়া পান। কয়েকঘণ্টার মধ্যে এক হাজার নিবন্ধন হয়ে যায়। এক সপ্তাহের মধ্যে ব্যবহারকারীর সংখ্যা এক লাখ ছাড়িয়ে যায়। বর্তমানে অ্যাপটির ব্যবহারকারীর সংখ্যা দশ লাখেরও বেশি এবং ১৫৮টি দেশে কার্যকর রয়েছে।
বর্তমানে নিঃসঙ্গতা বা একাকিত্বকে মহামারি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। জনস্বাস্থ্য বিষয়ক আলোচনায় ধূমপান, স্থূলতা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কিংবা এইডসের মতো শারীরিক সমস্যাগুলোই গুরুত্ব পায়। বর্তমানে নিঃসঙ্গতার মতো মানসিক সমস্যাগুলো নিয়েও আলোচনা হচ্ছে। একইসাথে একাকিত্বকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠছে বাণিজ্যও। কোভিড মহামারির লকডাউনের সময়ে মানুষ আরো বেশি নিঃসঙ্গতা অনুভব করেছে পুরো বিশ্বজুড়েই। তবে কোভিডের আগে থেকেই এ মহামারি ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ছিল, বিশেষত উন্নত দেশগুলোতে।
যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি পাঁচজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির তিনজনই নিজেদের নিঃসঙ্গ মনে করেন। আশির দশক থেকে বর্তমানে সংখ্যাটি হয়ে গেছে দ্বিগুণ। অস্ট্রেলিয়াতে প্রতি দুজন নাগরিকের একজন সপ্তাহে অন্তত একদিন একাকিত্ব অনুভব করেন।
ইউরোপের অবস্থাও একই। জার্মানিতে দুই-তৃতীয়াংশ জনগণ মনে করেন, একাকিত্ব একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডাচ নাগরিকদের এক-তৃতীয়াংশই নিজেদের একা মনে করেন। প্রতি দশজনের একজনে এই সঙ্কট খুব তীব্র। সুইডেনের এক-চতুর্থাংশ নাগরিক জানিয়েছেন, তারা প্রায়ই একাকিত্বে ভোগেন। সুইজারল্যান্ডের প্রতি পাঁচজনে দুজন নাগরিক জানিয়েছে, তারা মাঝে মাঝে, প্রায়ই কিংবা সবসময় এমন অনুভব করেন।
যুক্তরাজ্যতে এ সমস্যা এত প্রকট হয়ে দাঁড়ায় যে, ২০১৮ সালে তারা একাকিত্ব বিষয়ক মন্ত্রণালয়ই প্রতিষ্ঠা করে ফেলে। ব্রিটিশদের প্রতি আটজন নাগরিকের একজনের কোনো কাছের বন্ধু নেই, যাদের ওপর তারা ভরসা করতে পারেন। ছয় বছর আগেও যা ছিল প্রতি দশজনে একজন। তিন-চতুর্থাংশ নাগরিক তাদের প্রতিবেশিদের নাম জানেন না। চাকরিজীবীদের ৬০ শতাংশই কর্মক্ষেত্রে একাকী অনুভব করেন, যেখানে তারা দিনের বেশিরভাগ সময় কাটান।
এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকাতেও পরিস্থিতি একইরকম। কোভিড মহামারিতে আরো অবনতি হয়েছে। যুক্তরাজ্যের মতো জাপানেও এ বছর একাকিত্ব মন্ত্রণালয় চালু করে। দেশটিতে একাকিত্বের দরুণ আত্মহত্যার হারও বেড়ে চলেছে।
তবে জাপান একাকিত্ব দূর করার উদ্ভাবনী উপায়ও বের করছে। ফ্যামিলি রোমান্স নামের একটি সাইটের মাধ্যমে দুধের শিশু থেকে শুরু করে স্বামী-স্ত্রী কিংবা আস্ত একটা পরিবারও ভাড়া করা যায় নির্দিষ্ট সময়ের জন্য।
আমাদের কাছে রোবটকে প্রেমের সঙ্গী হিসেবে ব্যবহার করা কিংবা ‘হার’ সিনেমার মতো শুধু কণ্ঠের প্রেমে পড়ার ধারণাও নতুন নয়। কিন্তু শুধুমাত্র সময় কাটানো কিংবা একাকিত্ব দূর করার জন্য ‘বন্ধু’ ভাড়া করা অদ্ভুতই লাগতে পারে। তবে উন্নত দেশগুলোতে গত দুই দশক ধরে এটা বেশ স্বাভাবিক হয়ে উঠছে।
জাপানের ফ্যামিলি রোমান্স থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ২০০৯ সালে আমেরিকান উদ্যোক্তা স্কট রোসেনবাম প্রতিষ্ঠা করেন ‘রেন্ট অ্যা ফ্রেন্ড’। এখানে নির্দিষ্ট ফি দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করে স্থান অনুযায়ী যেকোনো ‘বন্ধু’ নির্বাচন করা যায়। সাধারণত তারা ঘণ্টাপ্রতি ১০ ডলার করে নিয়ে থাকে। নতুন কোনো শহরে স্থান পরিবর্তন করে একাকিত্ব ভুগলে, কোনো অনুষ্ঠানে যেতে সঙ্গীর অভাব অনুভব করলে কিংবা থিয়েটারে মুভি দেখতে গেলে সঙ্গীর প্রয়োজন হলে সহজেই এখান থেকে বন্ধু নির্বাচন করা যায়। তবে এটা কোনো ডেটিং সাইট নয়। এসব বিষয়ে তাদের নিজস্ব নীতিমালা আছে।
হেই ভিনা কার্যক্রম শুরু করার পর ডেটিং সাইট বাম্বলের ব্যবহারকারীরা দাবি করতে থাকেন তাদের পক্ষ থেকে রোমান্টিক সম্পর্কের পাশাপাশি শুধু বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করার কোনো উপায় বের করতে। ২০১৬ সালে তাই তারা চালু করে ‘বাম্বল বিএফএফ’।
এসব ‘কৃত্রিম বন্ধু’ ভাড়া করার ব্যাপারে আছে বৈচিত্র্যও। নতুন মায়েদের জন্য অন্য মায়েদের সাথে বন্ধুত্বের জন্য আছে পিনাট। যারা একইরকম শখ আছে এমন বন্ধু খোঁজেন তাদের জন্য আছে মিটাপ। এছাড়াও বন্ধুত্ব তৈরিতে উৎসাহ দেওয়ার জন্য দক্ষিণ কোরিয়া তৈরি করেছে ফ্রিবো নামের একটি রোবট। যুক্তরাজ্যে অনেক ক্যাফে গড়ে উঠছে বন্ধুত্বে উৎসাহ দেওয়ার জন্য।
অর্থাৎ, বিশ্বজুড়ে একাকিত্বের মহামারির পাশাপাশি কৃত্রিম বন্ধুদের চাহিদাও বেড়ে চলছে। এটা আরেকটা বাণিজ্যের ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে তা কি আদৌ একাকিত্ব সমস্যার সমাধান আনতে পারে? না, এর দ্বারা স্থায়ী কোনো সমাধান হওয়া সম্ভব নয়। এটা কাজে আসতে পারে সাময়িকভাবে যারা একাকিত্বে ভুগছেন তাদের জন্য।
যেমন- নতুন শহরে আসলে বা নতুন কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করলে আমরা আগের জায়গার বন্ধুদের ফেলে আসি। তখন আমরা একাকিত্ব বোধ করলেও ধীরে ধীরে নতুন জায়গার মানুষদের পরিচিত হয়ে বন্ধুত্ব করে ফেলতে পারি। মাঝের এ সময়ের জন্য কৃত্রিম বন্ধুরা কাজে আসতে পারে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে যারা একাকিত্বে ভুগছেন, তাদের জন্য এটা আরো অবনতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
তাছাড়া একে কেন্দ্র করে নারী পাচার বা দেহব্যবসার মতো কর্মকাণ্ডও ঘটতে পারে। আর যারা কৃত্রিম বন্ধু হিসেবে কাজ করবেন, তাদেরও বন্ধু হিসেবে ‘অভিনয়’ করার দক্ষতা অর্জন করা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তবে এতে অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগও হচ্ছে। অন্তত এতে এটা নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে যে এই বন্ধুরা অর্থের জন্যই বন্ধুত্ব করতে এসেছে। এতে ছদ্মবেশী বন্ধুদের বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে।