মোস্তাফিজুর রহমান, বারাক ওবামা, মেরি কুরি, টম ক্রুজ- প্রত্যেকেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত এবং বিখ্যাত। চারজন সম্পূর্ণ ভিন্ন চার জগতের মানুষ হলেও চারজনের মধ্যে কিন্তু একটি মিল আছে। এরা প্রত্যেকেই এমন এক শ্রেণীর অন্তর্গত, যা পৃথিবীর সব মানুষের মাত্র ১০ শতাংশ নিয়ে গঠিত। পাঠকদের অনেকেই হয়তো তাদের মতো একই শ্রেণীর অন্তর্গত। অনেকেই হয়ত বুঝেও ফেলেছেন যে, এই দশ শতাংশ মানুষ হচ্ছে বামহাতি, অর্থাৎ তারা দৈনন্দিন জীবনে কাজ করার ক্ষেত্রে বাম হাতের উপর বেশি নির্ভরশীল। চারপাশের বেশিরভাগ মানুষ সাধারণ সব কাজে ডান হাত ব্যবহার করলেও বামহাতিরা ঠিক উল্টো। ফলে পৃথিবীর অনেক সমাজেই বামহাতিদের কিছুটা বাঁকা চোখে দেখা হয়। কিন্তু সকল বাঁধা পার করে প্রতি যুগেই রয়েছে বহু সফল বামহাতি। চলুন জেনে নেয়া যাক বামহাতিদের সম্পর্কে কিছু অজানা তথ্য।
বামহাতি কেন হয়
কোনো কিছু দেখার সময় মানুষ দুই চোখ একসাথেই ব্যবহার করে, কোনো কিছু শোনার সময়ও দুই কান একই সাথে ব্যবহার করে মানুষ। কিন্তু কাজ করার ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময়ই প্রয়োজন হয় এক হাতের। প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ বাম কানে বেশি শোনে, প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষ বাম চোখে বেশি দেখে। কিন্তু শোনা বা দেখার সময় একসাথে দুই চোখ বা কান ব্যবহার করে বলে আলাদা করে কোনো পার্থক্য চোখে পড়ে না। কিন্তু চোখে পড়ে বাম হাতে কাজ করার ক্ষেত্রে।
ঠিক কী কারণে মানুষ বামহাতি বা ডানহাতি হয় এর কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ এখনো আবিষ্কার হয়নি। জেনেটিক কারণে, হরমোনজনিত কারণে কিংবা গর্ভাবস্থায় গর্ভে ভ্রুণের অবস্থানের উপর নির্ভর করে কোন হাত বেশি শক্তিশালী হবে। এমনকি গর্ভাবস্থায় মায়ের বয়স, মানসিক এবং শারীরিক অবস্থার উপরও নির্ভর করে বলে ধারণা করা হয়। কোনোটিকেই একমাত্র কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা না হলেও জেনেটিক কারণকেই প্রধান কারণ হিসেবে মনে করা হয়।
প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হতো, কোন হাত শক্তিশালী হবে এর জন্য একটি মাত্র জিন দায়ী। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত এক পেপারে দেখা গিয়েছে, বামহাতি হবার পেছনে একটি জিন নয়, বরং এর পেছনে রয়েছে বেশ কিছু জিনের একটি নেটওয়ার্ক। আগে PSCK6 নামক একটি জিন বামহাতি হবার পেছনে রয়েছে বলে ধারণা করা হতো। নতুন আবিষ্কারে এই জিনের সাথে আরো বেশ কিছু জিন পাওয়া গিয়েছে যারা একসাথে দায়ী বামহাতি হবার পেছনে। বামহাতি হবার পেছনে অন্তত ৪০টি ভিন্ন ভিন্ন জিনের প্রভাব রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। আসলে মানুষের কোন হাত কেন অন্যটির থেকে বেশি শক্তিশালী হয় এর কোনো সুনির্দিষ্ট উত্তর এখনো পর্যন্ত অজানাই রয়ে গিয়েছে।
বামহাতিরা সংখ্যায় কম কেন?
মানুষের বাইরে অন্যান্য প্রাণী যেমন মেরু ভাল্লুক এবং শিম্পাঞ্জিদের মধ্যেও বামহাতি-ডানহাতি দেখা যায়। কিন্তু মানুষ ছাড়া অন্যান্য প্রাণীদের ক্ষেত্রে বামহাতি-ডানহাতির অনুপাত প্রায় সমান, প্রায় ৫০-৫০। কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে ডানহাতিদের সংখ্যা অনেক বেশি, প্রতি ১০০ জনের ৯০ জন, অর্থাৎ বামহাতি প্রতি ১০০ জনে মাত্র ১০ জন। মানুষের ক্ষেত্রে এই অসমতার জন্য মূলত দায়ী মানুষের একটি বিশেষ গুণ, যা অন্য প্রাণীদের নেই- ভাষা।
মস্তিষ্কের বাম অংশ নিয়ন্ত্রণ করে ভাষা কিংবা কথা বলার দক্ষতা। একইসাথে মস্তিষ্কের বাম অংশ নিয়ন্ত্রণ করে শরীরের ডান দিক। ফলে বেশিরভাগ মানুষ ডানহাতি হয়। অন্যদিকে খুব কম সংখ্যক মানুষের ভাষা দক্ষতা তৈরি হয় মস্তিষ্কের ডান দিকে, ফলে তারা বামহাতি হয়। অন্য প্রাণীদের মানুষের মতো কথা বলার দক্ষতা না থাকায় তাদের কোনো একদিক আলাদা করে শক্তিশালী হয়ে পড়ে না। ফলে তাদের বামহাতি-ডানহাতির অনুপাত থাকে সমান। তবে এর সাথেও জিনগত কিছু কারণ জড়িত রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু কোন কোন জিন দায়ী তা জানা না থাকায় এ ব্যাপারেও কোনো নিশ্চিত উত্তর পাওয়া যায় না।
বামহাতিদের নিয়ে কুসংস্কার
আমাদের দেশে ছোটবেলায় কেউ বাম হাতে কোনো কাজ করলে, তাকে নানাভাবে প্রভাবিত করা হয় যেন সে বাম হাতের পরিবর্তে ডান হাতে কাজ করে। অনেক ক্ষেত্রে শিশুদের মারধোরের ঘটনাও ঘটে। কিন্তু এ সমস্যা শুধু বাংলাদেশ কিংবা ভারতীয় উপমহাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশেই নয়, বরং ইউরোপ-আমেরিকার মতো উন্নত জায়গাতেও রয়েছে।
এককথায় বলতে গেলে বামহাতিদের প্রতিটি যুগে, প্রতিটি সমাজে দেখা হতো দুর্বল এবং অস্বাভাবিক হিসেবে। মধ্যযুগে ইউরোপে শুধুমাত্র বামহাতি হবার অপরাধে অনেককে জাদুকর মনে করা হতো এবং হত্যা করা হতো নির্মমভাবে। ইংরেজি ‘Left’ শব্দটির উৎপত্তি অ্যাংলো-স্যাক্সোন শব্দ ‘Lyft’ থেকে, যার অর্থ ‘ভাঙা বা দুর্বল’। অন্যদিকে ইংরেজি ‘Right’ শব্দটির অর্থ যেমন ‘ডান’, ঠিক তেমনই এই শব্দটি ‘সঠিক’ শব্দেরও প্রতিশব্দ। সামান্য একটি শব্দের অর্থেই বাম-ডানকে দুর্বল আর সঠিক হিসেবে ধরে নেয়া হয়েছে। বেশিরভাগ ইউরোপিয়ান ভাষার ক্ষেত্রেও বাম শব্দের প্রতিশব্দের উৎপত্তি হয়েছে এমন সব শব্দ থেকে যেগুলো ব্যবহৃত হয় খারাপ কিছু বোঝাতে। অন্যদিকে ডান শব্দের প্রতিশব্দগুলোর উৎপত্তি হয়েছে সঠিক কিংবা ভাল কোনোকিছু বোঝাতে।
শব্দের উদাহরণ আরো রয়েছে। ‘Sinister’ শব্দের অর্থ একসময় ছিল ‘বাম’, কিন্তু কালের পরিক্রমায় এর অর্থ পাল্টে খারাপ কিংবা অশুভ কোনো কিছুর সাথে জড়িত বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। বামহাতিদের অশুভ মনে করা থেকেই অর্থ পাল্টে এরকম হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। বিয়ের আংটি বাম হাতে পরার প্রচলন গ্রিক এবং রোমানদের থেকে চালু হয়েছে। তাদের ধারণা ছিল, বাম হাত শয়তানের কাজের সাথে জড়িত। আংটি দিয়ে শয়তানের প্রভাব দূর করা যায়, তাই আংটি বাম হাতে পরানো হতো।
বামহাতিদের সব যুগে, সব সমাজে অমঙ্গল, অশুভ লক্ষণ হিসেবে ধরা হতো। কোনো কোনো সমাজে শয়তানকে বামহাতি হিসেব মনে করা হতো। এ কারণে বামহাতিদের শয়তানের দোসর হিসেবেও চিহ্নিত করা হতো মধ্যযুগের ইউরোপে। প্রাচীনকালে বামহাতিরা অনেক সামাজিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতো।
বামহাতিরা কি ডানহাতিদের থেকে বেশি বুদ্ধিমান?
ঐতিহাসিক এবং সামাজিকভাবে বামহাতিরা কিছুটা নিগ্রহের শিকার হলেও বর্তমানে বামহাতিদেরকে গণিত, শিল্পকলা এবং জটিল সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে ডানহাতিদের থেকে বেশি বুদ্ধিমান মনে করা হয়। বিভিন্ন সময়ে পরীক্ষা চালিয়ে দেখা গিয়েছে বামহাতি পুরুষেরা ডানহাতি পুরুষদের থেকে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকে। কিন্তু একই ব্যাপারে মহিলাদের মধ্যে ডানহাতি বা বামহাতির কোনো আলাদা প্রভাব লক্ষ্য করা যায় না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বামহাতিরা ডানহাতিদের থেকে কিছুটা এগিয়ে থাকলেও, বামহাতিরা ডানহাতিদের থেকে সবদিক থেকেই বেশি বুদ্ধিমান- এমন কথার কোনো সুনির্দিষ্ট ভিত্তি নেই।
খেলাধুলায় বামহাতিদের সুবিধা
বুদ্ধিমত্তায় বামহাতিদের এগিয়ে থাকার ব্যাপারটি প্রতিষ্ঠিত না হলেও খেলাধুলায় বিশেষ করে ক্রিকেট, বেসবল, ফেন্সিং, টেনিসের মতো যেসব খেলা মূলত হাতনির্ভর, সেগুলোতে বামহাতিরা কিছুটা প্রাকৃতিক সুবিধা পেয়ে থাকে। উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক, একটি বল আপনার দিকে এগিয়ে আসছে, আপনি বলটিকে ব্যাট দিয়ে আঘাত করবেন। বামহাতিদের ক্ষেত্রে বলটি দেখা এবং সেটিকে আঘাত করা দুটি কাজই মস্তিষ্কের ডান অংশ নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু ডানহাতিদের ক্ষেত্রে বলটি আঘাত করা নিয়ন্ত্রণ করে বাম অংশ। ফলে ২০ মিলিসেকেন্ড (এক সেকেন্ডের এক হাজার ভাগের এক ভাগ) সময় নষ্ট হয় মস্তিষ্কের ডান অংশ থেকে বাম অংশে সংকেত যেতে। অনেক সময়ই এই মিলিসেকেন্ডের ব্যবধান হারজিত নির্ধারণ করে দেয়। একই রকম সুবিধা বামহাতিরা পায় ফেন্সিং কিংবা এরকম যেকোনো খেলায়।
ক্রিকেটের ক্ষেত্রেও বামহাতিরা একই সুবিধা ভোগ করে থাকে। বোলিং এর ক্ষেত্রে বামহাতি বোলাররা আরো কিছু সুবিধা পায়। যেমন বামহাতি বোলাররা, বিশেষ করে ফাস্ট বোলাররা, ডানহাতিদের থেকে ভিন্ন কোনে বল ছোঁড়ে, ফলে ডানহাতিদের জন্য সেটা খেলা কিছুটা কঠিন হয়। বামহাতি বোলারদের সাফল্যও এ কথারই প্রমাণ দেয়।
বামহাতিদের দৈনন্দিন জীবনের সমস্যা
বামহাতিরা সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়ে খুব সম্ভবত লেখতে গিয়ে। এমনিতেই বামহাতিদের দেখলেই অনেকে সবকিছু ছেড়ে তাদের লেখার দিকে তাকিয়ে থাকে। অনেকে তো আবার বলতেও পিছপা হয় না যে, “বাম হাতে লেখলেও লেখা কত সুন্দর”, যেন বাম হাতে লেখলে লেখা সুন্দর হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু। ডানহাতিরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বোঝে না যে, তাদের কাছে ডান হাতে লেখা যেমন স্বাভাবিক, বামহাতিদের কাছে ঠিক উল্টোটা স্বাভাবিক।
সেমেটিক ভাষাগুলোতে ডান থেকে বামে লেখতে হয় বলে বামহাতিদের সমস্যা হয় না বেশি, কিন্তু ল্যাটিন, ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষাগুলোতে বাম থেকে ডানে লেখতে সমস্যায় পড়তে হয় বামহাতিদের। বিশেষ করে নিচের ছবির মতো কোনো ক্লাসরুমে যদি পরীক্ষার সীট পড়ে, তাহলে প্রশ্ন পাবার আগেই বামহাতিদের একটা পরীক্ষা হয়ে যায়, কেননা এ ধরনের চেয়ারগুলো ডানহাতিদের সুবিধার্থে বানানো। কিন্তু বামহাতিদের লেখার ধরন আলাদা হওয়ায় তাদের পড়তে হয় বিশাল সমস্যায়। এছাড়া লেখার সময় পুরো হাতে কালি ভরে যাওয়াটা বামহাতিদের জন্য এক পর্যায়ে এতোটাই সাধারণ হয়ে যায় যে, অনেকে খেয়ালই করে না হাতে কালি ভরে রয়েছে।
সেনাদলেও বামহাতিদের সমস্যায় পড়তে হয় অস্ত্র নিয়ে। আধুনিক অস্ত্রগুলোর বুলেটের কার্তুজ বের হয় অস্ত্রের ডান দিকে দিয়ে। ডানহাতিরা সহজে এসব অস্ত্র ব্যবহার করতে পারলেও বামহাতিদের জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। কারণ বাম হাতে এসব অস্ত্র ব্যবহার করলে কার্তুজ মুখে এসে লাগে। ফলে বামহাতিদের হয় ডানহাতিদের মতো অস্ত্র ব্যবহার করতে হয় নতুবা আলাদাভাবে বামহাতিদের জন্য বানানো অস্ত্রের জন্য আবেদন করতে হয়। কিন্তু আলাদাভাবে বামহাতিদের অস্ত্র বেশিরভাগ সেনাবাহিনীতেই পাওয়া যায় না।
এছাড়াও কাঁচির মতো সামান্য একটি যন্ত্রেও বামহাতিদের সমস্যায় পড়তে হয়। এটি আসলে এমন এক সমস্যা যা বামহাতি না হলে বোঝানো সম্ভব না। ব্যাংকে বা কোনো অফিসের লাইনেও বামহাতিদের পড়তে হয় আরেক সমস্যায়। বেশিরভাগ সময় দেখা যায় কলম বাঁধা রয়েছে ডানদিকে, সেটা বামদিকে এনে বামহাতিদের ব্যবহার করাই সম্ভব হয় না অনেক সময়। গিটার, ভায়োলিন বা হারমোনিয়াম বাজানোও প্রথম দিকে বামহাতিদের জন্য অত্যন্ত কষ্টের হয়ে দাঁড়ায়। নিজে বাম হাতে বাজালেও শিক্ষক ডানহাতি হবার সম্ভাবনাই বেশি। ফলে প্রথমে শিক্ষক কী বলেন সেটা শোনা, বোঝা, দেখা এবং তারপর সেটাকে নিজের মতো উল্টে নেয়া- সবগুলোই করতে হয় চোখের পলকে, যা নবীন শিক্ষার্থীদের জন্য মোটেই সুবিধার নয়।
বামহাতিদের মানসিক সমস্যা
কিছু কিছু ক্ষেত্রে বামহাতিরা প্রাকৃতিক সুবিধা ভোগ করলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে উল্টো অনেক সমস্যারও মুখোমুখি হতে হয় তাদের। বিভিন্ন মানসিক সমস্যা, বিশেষ করে সিজোফ্রেনিয়ার মতো ভয়াবহ সমস্যার শিকার হতে হয় বামহাতিদের অনেক বেশি। মোট জনসংখ্যার মাত্র ১০% যেখানে বামহাতি, সেখানে সিজোফ্রেনিয়া রোগীদের শতকরা ৪০ ভাগই হয় বামহাতি! এ থেকেই বামহাতিদের ভয়াবহ পরিণতির কথা অনেকটা আঁচ করা যায়।
বামহাতিদের মানসিক ভারসাম্যের সমস্যাও বেশি হয় ডানহাতিদের থেকে। ডানহাতিদের থেকে বামহাতিদের ঘুমের সমস্যা হবার সম্ভাবনা বেশি থাকে। এছাড়া ডিসেলেক্সিয়া হবার সাথে বামহাতিদের জিনের মিল রয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে।
বিখ্যাত বামহাতিদের কথা
লেখা শুরুই হয়েছিল চারজন বিখ্যাত বামহাতিদের নাম দিয়ে। লেখার শেষে চলুন জেনে নেয়া যাক, আরো কিছু বিখ্যার বামহাতিদের কথা যারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে সফল হয়েছেন অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি।
খেলাধুলাতে বিশেষ করে ক্রিকেটে যেহেতু বামহাতিদের সহজে লক্ষ করা যায়, সেহেতু বামহাতি ক্রিকেটারদের কথা আলাদা করে বলার দরকার আছে বলে মনে হয় না। তবে একজনের কথা না বললেই নয়, যাকে অনেকেই সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে মনে করেন- শচীন টেন্ডুলকার। শচীন ডানহাতি ব্যাটসম্যান হলেও লেখা বা অন্যান্য কাজে তিনি বাম হাত ব্যবহার করেন।
খেলাধুলার বাইরের জগতে একটু ঘুরে আসা যাক। রাজনীতিবিদদের কথা বলতে গেলে অনেককেই পাওয়া যাবে, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টদের। বারাক ওবামা ছাড়াও বিল ক্লিনটন, জন এফ কেনেডি, রোনাল্ড রিগ্যান, হ্যারি ট্রুম্যানসহ মোট আটজন প্রেসিডেন্ট ছিলেন বামহাতি। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রাজপুত্র উইলিয়ামও একজন বামহাতি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুক্তরাজ্যকে নেতৃত্ব দেয়া প্রধানমন্ত্রী উইন্সটন চার্চিল ছিলেন বামহাতি। এমনকি নেপোলিয়ান বোনাপার্টও বামহাতি ছিলেন।
শিল্প-সংস্কৃতির জগতেও বামহাতিদের জয়জয়কার। বিখ্যাত চিত্রশিল্পী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি এবং মাইকেলেঞ্জেলো ছিলেন বামহাতি। হলিউড কাঁপানো ম্যারিলিন মনেরো, অ্যাঞ্জেলিনা জোলি, জুলিয়া রবার্টস, নিকোল কিডম্যান, মরগ্যান ফ্রিম্যান, হিউ জ্যাকম্যান, ব্রুস উইলস- এদের প্রত্যেকেই বামহাতি। বলিউডের অমিতভ এবং অভিষেক বচ্চন, করণ জোহর বামহাতি। হলিউডের বিখ্যাত পরিচালক ক্রিস্টোফার নোলানও একজন বামহাতি।
সংগীত জগতেও পিছিয়ে নেই বামহাতি তারকারা। গ্লেন ক্যাম্পবেল, কার্ট কোবিন, বব ডিলান, এমিনেম, জাস্টিন বিবার প্রত্যেকেই বামহাতি। ইতিহাসের অন্যতম সেরা সুরকার মোজার্টও একজন বামহাতিই ছিলেন। বিখ্যাত পিয়ানিস্ট এবং সুরকার লুডভিগ ভ্যান বিটোফেন ছিলেন বামহাতি।
ধনী হবার ক্ষেত্রেও পিছিয়ে নেই বামহাতিরা। পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি বিল গেটস নিজেও একজন বামহাতি। ভারতের শিল্পপতি রতন টাটাও এ দলের সদস্য। বিখ্যাত ফোর্ড অটোমোবাইলের প্রতিষ্ঠাতা হেনরি ফোর্ড ছিলেন বামহাতি। এছাড়াও বামহাতি ছিলেন সময়কে ভিন্ন চোখে দেখতে বাধ্য করা আলবার্ট আইনস্টাইন, বিবর্তন তত্ত্বের জনক চার্লস ডারউন ও বিখ্যাত লেখক মার্ক টোয়েন।
প্রতি ১০০ জনে যেখানে মাত্র ১০ জন বামহাতি, সেখানে চাঁদে পা রাখা প্রথম মানুষ একজন ডানহাতি হওয়াটাই পরিসংখ্যানগত দিক দিয়ে স্বাভাবিক। কিন্তু পরিসংখ্যানকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চাঁদে প্রথম পা রাখেন একজন বামহাতি- নীল আর্মস্ট্রং। অ্যাপেল ম্যাকের নকশা করা পাঁচজনের চারজনই ছিলেন বামহাতি! ল্যাটিন অক্ষর লেখার ক্ষেত্রে বামহাতিদের সমস্যার কথা আগেই বলা হয়েছে, আধুনিক টাইপিং এসে সে সমস্যা দূর করেছে। মজার ব্যাপার, টাইপরাইটের আবিষ্কারক ক্রিস্টোফার শোলস নিজেও একজন বামহাতি ছিলেন!
এত বিখ্যাত ব্যক্তিদের ভিড়ে কয়েকজন কুখ্যাত ব্যক্তির কথা না বললেই নয়। ইতিহাসের অন্যতম সেরা সিরিয়াল কিলার জ্যাক দ্য রিপার বামহাতি ছিলেন বলে ধারণা করা হয়। জ্যাক দ্য রিপার কখনো ধরা না পড়লেও তার খুন করা থেকে তার বামহাতি হবার লক্ষণ পাওয়া যায়। আল-কায়েদার প্রতিষ্ঠাতা ওসামা-বিন-লাদেনও একজন বামহাতিই ছিলেন।
একবিংশ শতাব্দী এসেও বামহাতি হবার কারণে মানুষকে অনেক বৈষম্যের শিকার হতে হয়। জোর করে বামহাতিদের ডানহাতি বানানো এখনো অনেক উন্নত দেশেও প্রচলিত রয়েছে, সেই সাথে প্রচলিত বিভিন্ন কুসংস্কার তো রয়েছেই। বামহাতিরা প্রতিদিন এমন কিছু সমস্যার সম্মুখীন হয় যেগুলো ডানহাতিদের কাছে হাস্যকর মনে হতে পারে কিংবা হাজারো সমস্যায় জর্জরিত পৃথিবীতে খুবই সামান্য মনে হতে পারে। কিন্তু একজন বামহাতি মাত্রই জানে সেগুলো কতটা বিরক্তিকর। কুসংস্কার, সামাজিক বাধা, দৈনন্দিন জীবনের সমস্যা- এসবের পরেও বামহাতিরা নিজ নিজ ক্ষেত্রে ঠিকই সফল হয়ে প্রমাণ করছেন যে, সংখ্যায় কম হলেও গুণে বামহাতিরা মোটেও কম নয়। বামহাতিদের জন্য একটি দিনও রয়েছে। প্রতি বছর ১৩ আগস্ট ‘বিশ্ব বামহাতি দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়ে থাকে।