ব্র্যাডলে ওয়েন্স, একজন স্বনামধন্য প্রাতিষ্ঠানিক মনোবিজ্ঞানী। ২০১৩ সালে ব্রিগাম ইয়ং বিশ্ববিদ্যালয়ে ওয়েন্স ও তার সহকর্মীরা একটি গবেষণা পরিচালনা করেন। গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত ছিলেন ম্যানেজমেন্ট কোর্সে অংশগ্রহণকারী ১৪৪ জন স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থীবৃন্দ। গবেষণার বিষয়টি ছিল অত্যন্ত চমৎকার- নম্রতা! অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীবৃন্দের ওপর এক বছর সময় নিয়ে অনুসন্ধানী এই কাজটি সম্পন্ন করা হয়। ছাত্র-ছাত্রীদের সাফল্য নিরূপণ করার ক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাস, আত্মমর্যাদাবোধ, বুদ্ধি, মেধা ইত্যাদির তুলনায় সম্পূর্ণ অনালোচিত নিয়ামক নম্রতা কতটা দায়ী- তা নিয়েই ছিল পুরো গবেষণাটি।
মানুষের একটি সহজাত প্রবণতা হচ্ছে, সে তার নিজের নম্রতাবোধ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা রাখে না। কেউ হয়তো নিজেকে বেশিই নম্র বলে দাবি করছে, আবার কেউ হয়তো প্রশংসনীয় পর্যায়ের নম্র হয়েও সেটিকে স্বীকার করছে না। এই সমস্যাটিকে সমাধান করার জন্য গবেষণাটির নকশা করা হয় এমনভাবে, যেন প্রত্যেকের নম্রতাবোধ সম্পর্কে মূল্যায়ন করবে তারই সহপাঠীরা। অর্থাৎ, নিজেকে বিচার করার ঝামেলাটি রইল না আর। কিছু বক্তব্যে এবার নিজের বন্ধু সম্পর্কে সুচিন্তিত মতামত দেওয়ার পালা। বক্তব্যগুলো ছিল:
- সে তার নিজের কাজ সম্পর্কে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অন্যের প্রতিক্রিয়া জানতে আগ্রহী, এমনকি যদি সেটি যথেষ্ট চাঁছাছোলাও হয়।
- কোনো কিছু সম্পর্কে তার অপারগতা সে খোলাখুলিভাবে স্বীকার করতে প্রস্তুত।
- সুনির্দিষ্ট কোনো বিষয়ে তার চেয়ে অন্য কেউ অধিক পারদর্শী হলে বা সুস্পষ্ট ধারণা পোষণ করলে সেটি সে উদারভাবে স্বীকার করতে সক্ষম।
বছর শেষে আশ্চর্যজনক এক ফলাফল হাতে পেলেন গবেষকরা। পুরো সময়টা জুড়ে যারা সবচেয়ে বেশি নম্র ছিলেন, তারাই কর্মদক্ষতার দিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে আছেন। অন্যদিকে যারা নিজেদের সম্পর্কে অনেক উচ্চ ধারণা পোষণ করেছিলেন, তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তুলনামূলক কম সাফল্যের দেখা পেয়েছেন। সকল বুদ্ধিবৃত্তিক মাপকাঠির তুলনায় নম্রতাবোধ সাফল্যের ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষেত্রে সন্দেহাতীতভাবে অনেক বেশি কার্যকর বলে প্রমাণিত হলো। আমরা প্রায়ই বলে থাকি যে, অমুক ব্যক্তি ‘গিফটেড’ বা জন্মগতভাবেই মেধাবী। এসব অভিধা থেকে যারা বঞ্চিত, তাদের ক্ষেত্রে নম্রতাবোধ সবচেয়ে বেশি কার্যকর।
নম্রতার বিচারে যারা এক ধাপ এগিয়ে ছিলেন, তারা হয়তো বছরের শুরুটা দারুণ করতে পারেননি, তবে ধীরে ধীরে নিজেদের সীমাবদ্ধতা, দুর্বলতা, ব্যর্থতা, ত্রুটিগুলোকে উদারচিত্তে স্বীকার করে নেওয়ার মাধ্যমে তারা নিজেদের একটি ক্রমবর্ধমান উন্নতি সাধন করতে পেরেছিলেন। অন্যদিকে যারা তুলনামূলক কম নম্রতা প্রদর্শন করেছিলেন, তাদের কর্মদক্ষতার লেখচিত্র ছিল অনেকটাই স্থবির। সামগ্রিক কোনো সম্প্রসারণ তাদের ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায়নি। অর্থাৎ, শিক্ষকদের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে নম্র শিক্ষার্থীরা শিক্ষা গ্রহণে অধিকতর তৎপর।
নেতৃত্বের ক্ষেত্রে ভদ্রতাবোধের সংজ্ঞায়ন
ভদ্রতাবোধ; একজন অধিনায়কের মাঝে এই গুণটির উপস্থিতি থাকার অর্থ এই না যে, তার মাঝে আমিত্ববোধ কিংবা উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকবে না কোনোভাবেই। একজন পথপ্রদর্শক তখনই তার সেরা রূপে আবির্ভূত হন, যখন তিনি নিজের উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে প্রতিষ্ঠান বা দলের অন্য সকলের মাঝে সম্পূর্ণ সফলতার মাধ্যমে সঞ্চারিত করতে সক্ষম হন।
শুধুমাত্র ব্যক্তিস্বার্থে কাজ না করে দলীয় স্বার্থকে নিজের একান্ত বলে বিবেচনা করার এই উদারচেতা দর্শন- এটিই তাকে অগ্রণী ভূমিকা পালনের ক্ষেত্রে অনন্য স্থান করে দেয়। অসাধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন একজন দলনেতা শুধু নিজের অর্জন, সাফল্য ইত্যাদির কথা ভাবেন। অন্যদিকে একজন ভদ্রোচিত দলনেতা প্রতিষ্ঠানের সকলের স্বার্থকে এক বিন্দুতে কেন্দ্রীভূত করে সকলকে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করেন। একজন প্রভাবশালী পথপ্রদর্শক নিজেদের ভুল স্বীকার করতে প্রস্তুত থাকেন, যেকোনো কাজের সাফল্যকে সকলের সম্মিলিত প্রয়াস হিসেবে বিবেচনা করেন এবং সবসময় অন্যের কাছ থেকে শিখতে উৎসাহী হয়ে থাকেন। নেতৃত্বে ভদ্রতার মহিমান্বিত উপস্থিতি কর্মরত ব্যক্তিদের সর্বোচ্চ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে, কর্মক্ষেত্র সম্পর্কে অধিকতর সন্তুষ্টি প্রদান করে এবং সমূহ বিপর্যয়ের ঝুঁকি কমায়।
ভদ্রতা বা নম্রতাবোধ বলতে প্রাতিষ্ঠানিক মনোবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে কী বোঝানো হয়ে থাকে? নেতৃত্বের ক্ষেত্রে ভদ্রতাবোধের পরিব্যাপ্তি হলো:
- আত্মসচেতনতা
- নিত্য-নতুন আইডিয়ার প্রতি উদারচেতা মনোভাব
- যেকোনো ধরনের প্রতিক্রিয়ার প্রতি সহনশীল মনোভাব
- অন্যের দুর্বলতা ও সামর্থ্যের দিকগুলোকে চিহ্নিত করার প্রয়াস
- সকলের অবদানকে যথাযথভাবে তারিফ করা
নম্রতা কেন এতটা জরুরি?
কোনো প্রতিষ্ঠানের শীর্ষস্থানীয় একজন ব্যক্তির মাঝে নম্রতাবোধের উপস্থিতি তাকে নিজস্ব সীমাবদ্ধতা, অদক্ষতা, চিন্তার ফাঁকফোকর ইত্যাদিকে ইতিবাচকভাবে দেখতে সহায়তা করে। প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ মুনাফার জন্য তিনি একাই যথেষ্ট নন- এই বোধটুকু তাকে অন্যদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে উৎসাহিত করে।
নিজস্ব দায়িত্ব সম্পাদনের পাশাপাশি তিনি যখন নেতার আসনে বসেন, তখন সকলকে কথা বলতে, আইডিয়া শেয়ার করতে, পরস্পরের প্রতি গঠনমূলক মন্তব্য প্রদান করতে উৎসাহিত করেন। এর ফলাফলকে তুলনা করা যায় ট্রিকল ডাউন ইফেক্টের সাথে। সকলের সুষম অংশগ্রহণমূলক সংস্কৃতি পুরো প্রতিষ্ঠান বা দলের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। একটি প্রতিষ্ঠানের সর্বত্রই যখন সকলে সৎ সাহসের সাথে নিজেদের সর্বোচ্চটুকু দিতে প্রস্তুত থাকেন, তখন সেই প্রতিষ্ঠানের সাফল্য অনেকটাই অনিবার্য। দলের প্রত্যেক সদস্যের মাঝ থেকে সর্বোচ্চ নিবেদনটুকু নিংড়ে বের করে নিয়ে আসার জন্য দলনেতার নম্রতাবোধের কোনো বিকল্প নেই। ভুল হলে তিনি নিজেই দায়িত্ব নিয়ে সেটি স্বীকার করে সমাধানের লক্ষ্যে সকলকে তাড়া দেন, আবার সাফল্যের পরম মুহূর্তে বিচ্ছুরিত আলোর তিনিই মূল উৎস হন।
নম্রতার হাত ধরে আসে আরও কিছু বাড়তি পাওনা
একজন নেতা বা নেতৃত্বের সুস্পষ্ট বা আদর্শ কোনো সংজ্ঞায়ন কখনোই সম্ভব নয়। মানুষের কাজের ধরন, চিন্তার পদ্ধতি, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা, বিচক্ষণতা ইত্যাদি নানা কিছু দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নেতৃত্বের রকমফের হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির মাঝে নম্রতার উপস্থিতি তাকে সকলের অন্তর্ভুক্তির দিকে ধাবিত করে। সকলের সমান অংশগ্রহণে যখন সাফল্য ধরা দেয়, তখন প্রত্যেকে নিজের পাশাপাশি অন্যের প্রতি কৃতজ্ঞতা পোষণের অনির্বচনীয় আনন্দ লাভ করে। আত্মকেন্দ্রিক এই পৃথিবীতে অন্যের অবদানকে খোলা মনে স্বীকার করে নেওয়ার মতো চমৎকার বিষয় বোধ করি খুব কমই আছে। নিজের পেশা, কাজ, সহকর্মী এবং সর্বোপরি জীবনের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকার যে মহৎ গুণ- সেটাকে খাটো করে দেখার কোনো সুযোগ নেই।
ব্যবসাকে বলা হয়ে থাকে কিছু পাওয়া আর কিছু হারানোর এক দুর্দান্ত খেলা। ব্যবসার ক্ষেত্রে কোনো একটি ক্ষতিই সম্পূর্ণ ক্ষতি হিসেবে বিবেচিত হয় না। সর্বাধিক ক্ষতির মাঝেও ন্যূনতম যে শিক্ষণীয় বিষয়টি লুকিয়ে থাকে, তা শুধুমাত্র একজন নম্র নেতার পক্ষেই খুঁজে আনা সম্ভব। যেকোনো ব্যর্থতাকে বিচারকের দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখে একজন শিক্ষানবিশের জায়গা থেকে দেখার যে চর্চা, সেটিই একটি প্রতিষ্ঠানকে সাফল্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। অবশেষে সাফল্য ধরা দিলে একজন নেতা ভদ্রোচিত উপায়ে এটিই বলতে শেখান যে, আজকের অর্জন মূলত অতীতের সকল ঠিক-ভুল, ভালো-মন্দ, বিচক্ষণতা-অদূরদর্শিতার উৎকৃষ্ট সম্মিলন। সব মিলিয়ে দিনশেষে তাই সবাই দৃপ্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করতে পারে, “বিজনেস ইজ আ গুড স্পোর্ট”।