সবাইকেই মাঝে মাঝে জীবনে বড় কোনো সিদ্ধান্তের মুখোমুখি হতে হয়। সিদ্ধান্তহীনতা আমাদের অসাড় করে দেয় তখন। কোনটা ভালো, কোনটা খারাপ- তা বুঝতেই তখন অনেক সময় লাগিয়ে দিই আমরা। এরপর হয়তো একসময় বাধ্য হয়ে একটি সিদ্ধান্তে আসি, কিন্তু সিদ্ধান্ত নেবার পরেও দেখা যায় সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে অনুশোচনা করতে থাকি। ভাবি, ভুলই বোধহয় করলাম! এবং এ ধরনের সিদ্ধান্তহীনতা আত্মবিশ্বাসও কমিয়ে দেয়। প্রত্যেকটি বড় সিদ্ধান্ত যেন আমাদের সত্ত্বা থেকে কিছু নিংড়ে নিয়ে যায় একটু একটু করে।
কিন্তু এই সিদ্ধান্তহীনতার সমস্যার খুব সহজ একটি সমাধান আছে। বড় কোনো সিদ্ধান্তের মুখোমুখি হলে আমরা যদি নিজেদের নির্দিষ্ট কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে উত্তরগুলো লিখে ফেলি, দেখা যাবে সিদ্ধান্ত নেয়াটা অনেক বেশি সহজ হয়ে গেছে। শুধু তা-ই নয়, পরবর্তীতে অনুশোচনা আসলেও সেই উত্তরগুলোর দিকে তাকালেই আমাদের মনে পড়ে যাবে, কেন আমরা এই সিদ্ধান্তটি নিয়েছিলাম। তখন আমাদের অনুশোচনাও কমে আসবে।
চলুন দেখা যাক ৯টি কার্যকরী প্রশ্ন, যেগুলো আপনাকে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করতে পারে।
১) কেন আপনি নিতে চাচ্ছেন এই সিদ্ধান্ত?
খুবই সরল একটি প্রশ্ন, কিন্তু দেখা যায় এর উত্তরই অনেকে স্পষ্টভাবে জানে না। মানুষ অনেক সময়ই আবেগের বশবর্তী হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। অনেক সময় একটি সিদ্ধান্ত নেয়, কারণ তার দেখা অন্যান্য সবাইও একই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এগুলোর কোনোটিই একজন সুবিবেচক লোকের কোনো বড় সিদ্ধান্ত নেবার কারণ হতে পারে না। কোনো একটি সিদ্ধান্ত নেবার আগে নিজেকে সুস্পষ্টভাবে জিজ্ঞেস করুন, কী উদ্দেশ্যে আপনি নিতে চাচ্ছেন এই সিদ্ধান্তটি। আপনি কী শিখবেন এখান থেকে, কী কী লাভ হবে আপনার। এই লাভগুলো আপনার কাছে অর্থবহ কি না। আপনার যদি উত্তরগুলো তেমন আকর্ষণীয় মনে না হয়, তবে সিদ্ধান্তটি না নেয়াই আপনার জন্য ভালো হবে।
২) এই সিদ্ধান্তটি নেবার কথা আপনি কতদিন ধরে ভাবছেন?
এই প্রশ্নটি আপনার সিদ্ধান্তটির সত্যিকার গুরুত্ব আপনার কাছে বেশ সহজেই তুলে ধরতে পারে। ধরুন, আপনার দুজন বন্ধু এসে আলাদাভাবে আপনাকে জিজ্ঞাসা করলো, তারা যদি বর্তমান পেশা ছেড়ে ব্যবসা শুরু করে, তবে কেমন হবে। দুজনকেই আপনি জিজ্ঞাসা করলেন, “কতদিন ধরে তুমি এই সিদ্ধান্ত নিয়ে ভাবছো?” একজন বললো, “গত দু’বছর।” আর আরেকজন বললো, “এই গতকালকে একটা সিনেমা দেখার পর এই আইডিয়াটা মাথায় এসেছে।” চিন্তা করুন তো, এই দুজনের প্রতি আপনার প্রতিক্রিয়া কতটা আলাদা হবে। স্বাভাবিকভাবেই যে বেশিদিন ধরে এই ব্যাপারটি নিয়ে ভাবছে, তাকেই আপনি বেশি ইতিবাচক উত্তর দিবেন।
সুতরাং কোনো একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে যদি আপনি অনেকদিন ধরে ভাবেন, তবেই বোঝা যাবে আপনার জীবনে সেই সিদ্ধান্তটি আসলেই গুরুত্বপূর্ণ। অগুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার আমাদের মস্তিষ্ক নিজে থেকেই মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দেয়। তাই বাহ্যিক কোনো ঘটনায় প্রভাবিত হয়ে তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত না নেয়াই ভালো।
৩) সিদ্ধান্তটি কি আপনাকে আপনার দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্যগুলোর দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে?
নিজেকে জিজ্ঞেস করুন, আজ থেকে ৫ বছর পরে আপনি নিজেকে কোথায় দেখতে চান? ১০ বছর পরে কোথায় দেখতে চান? এই লক্ষ্যগুলো লিখে ফেলুন। এবার ভাবুন, এই সিদ্ধান্তটি নিলে কি আপনি আপনার এই লক্ষ্যগুলোর থেকে দূরে সরে যাবেন, নাকি সেই পথেই এগিয়ে যাবেন? এই উত্তরটি খুঁজে বের করা আপনার সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
যেমন ধরুন, আপনি উচ্চশিক্ষার জন্য বাইরে যাবেন কি না, তা নিয়ে দোটানায় ভুগছেন। কিন্তু দশ বছর পরে আপনি চান একটি স্থিতিশীল চাকরি নিয়ে দেশে পরিবারের সাথে থাকতে। এক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্যের কথা বিবেচনা করলে আপনার জন্য সিদ্ধান্ত নেয়াটা সহজ হবে।
৪) আপনি কি সবগুলো বিকল্পকে বিবেচনা করেছেন?
বর্তমানে যে সিদ্ধান্তটি নেবার কথা ভাবছেন, তার অনেক বিকল্পও থাকতে পারে, যেগুলো আপনি বিবেচনা করেননি। যেসব বিকল্প আপনার মাথায় আসছে, সেগুলো লিখে ফেলুন। ভাবার চেষ্টা করুন, বর্তমান সিদ্ধান্তের তুলনায় সেগুলো আপনাকে বেশি সুবিধা দেয় কি না। যদি দিয়ে থাকে, তবে কেন আপনার এই বিকল্পের চিন্তা আগে মাথায় আসেনি? এই সবকিছুই লিখে রাখুন।
৫) এখনই কি সিদ্ধান্তটি নেবার শ্রেষ্ঠ সময়?
ভেবে দেখুন, সিদ্ধান্তটি এখন নিলেই ভালো হবে, নাকি এর থেকে ভালো কোনো সময় আপনার জন্য অপেক্ষা করছে? বর্তমান সময়টা আপনার এই সিদ্ধান্ত নেবার জন্য কেন সুবিধাজনক হতে পারে, তা লিখে রাখুন। অসুবিধাগুলোর কথাও লিখুন। যদি মনে হয় এখন না নিয়ে পরে নিলেই ভালো, তবে সেই ‘পরে’টা কবে? নিজেকে একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দিন।
৬) আপনার পূর্ব অভিজ্ঞতা আপনাকে এই সিদ্ধান্ত সম্পর্কে কী বলে?
যদি এখনো সন্দেহের মাঝেই ডুবে থাকেন, আপনার পূর্ব অভিজ্ঞতাকে কিছু দিকনির্দেশনা দেবার সুযোগ দিন। এ ধরনের বড় সিদ্ধান্ত কি আপনি আগে কখনো নিয়েছেন? সেগুলো নিয়ে আপনার জীবন এখন কোন পর্যায়ে এসেছে? আপনি কি সেসব নিয়ে সুখী? অসুখী হলে কোন ব্যাপারটি আপনাকে অসুখী করছে? এসব বিবেচনা করলে আপনার সিদ্ধান্ত নেয়াটা আগের থেকে কিছুটা সহজ হয়ে আসবে।
৭) সিদ্ধান্তটি আপনার উপর কীভাবে প্রভাব ফেলবে?
এই সিদ্ধান্তটি নিলে আপনার অনুভূতি কেমন হবে? মানুষের অনন্য একটি শক্তি হচ্ছে কল্পনাশক্তি। কল্পনা করুন যে, আপনি সিদ্ধান্তটি ইতোমধ্যে নিয়ে ফেলেছেন। কেমন অনুভূতি হচ্ছে এখন আপনার? একটু খুশি খুশি লাগছে? উত্তেজনাবোধ করছেন? তা-ই যদি হয়, তবে আপনি ঠিক পথেই আছেন। তারপর আরেকটু গভীরভাবে ভাবুন। কী কী পরিবর্তন আপনার জীবনে আসবে এ সিদ্ধান্তটি নেবার পর? কোনো পরিবর্তন কি আপনার অপছন্দ হচ্ছে? ব্যাপারগুলো লিখে ফেলুন। সিদ্ধান্তটি নেবার ক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এ উত্তরগুলো।
৮) সিদ্ধান্তটি অন্যদের উপর কীভাবে প্রভাব ফেলবে?
আপনার কি মনে হয় আপনার সিদ্ধান্তটি কারো ক্ষতি করতে পারে? কেউ আহত হতে পারে আপনার এই সিদ্ধান্তে? নিজেকে এ প্রশ্নের উত্তর দেবার সময় অবশ্যই শতভাগ সৎ থাকুন।
চলুন, বাস্তবতার মুখোমুখি হই। সবাইকে সুখী রাখা আসলে সম্ভব নয়। আপনার সিদ্ধান্তও সবার জন্য ভালো হবে, তার নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু আপনার সিদ্ধান্ত যেন অন্যদের উপর নেতিবাচক প্রভাব না ফেলে তার জন্য আপনার অবশ্যই চেষ্টা করা উচিত। দিনশেষে আপনি যেন নিজেকে বলতে পারেন, আপনার সর্বোচ্চ চেষ্টাই আপনি করেছেন।
৯) সিদ্ধান্তটি ব্যর্থ হলে তা মোকাবেলা কীভাবে করবেন?
আপনার সিদ্ধান্তের ফলাফল আপনার আশানুরূপ না-ও হতে পারে। সেক্ষেত্রে কী কী নেতিবাচক ব্যাপার ঘটতে পারে, তা লিখে ফেলুন। ভেবে দেখুন, সেগুলোর মুখোমুখি হতে আপনি পারবেন কি না। যদি মনে হয় পারবেন, চেষ্টা করুন কীভাবে সেই ব্যর্থতার মোকাবেলা করবেন তা-ও ভেবে রাখতে। আগে থেকেই এই ব্যাপারটি ভেবে রাখলে দেখবেন আপনার সিদ্ধান্ত নেয়া নিয়ে নিজের উপর চাপ অনেকাংশেই কমে গেছে।
বড় সিদ্ধান্ত মানেই যে তা নিয়ে ভীত হতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। জীবনে সঠিক বা ভুল ধ্রুব কোনো ব্যাপার নয়, আজকের প্রেক্ষাপটে যে সিদ্ধান্ত ভুল মনে হচ্ছে, আগামীকালের প্রেক্ষাপটেই তা সঠিক মনে হতে পারে। সুতরাং কোনো সিদ্ধান্ত শেষপর্যন্ত আশানুরূপ ফল না দিলে হতাশ হওয়াটা অযৌক্তিক। বরং সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্তে সেই শিক্ষাকে ব্যবহার করাই হবে একজন সুবিবেচকের কাজ।