বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা। সারাদিন অফিস করে এসে বাসে ঝুলতে ঝুলতে ভাবছেন আগামীকাল শুক্রবার, বেশ আরাম করে ঘুমাবেন। তখনই মনে পড়লো, গত সপ্তাহে ঠিক করেছিলেন শুক্রবার বারান্দার জন্য ফুলের টব কিনতে যাবেন! গেল সব আনন্দ মাটি হয়ে। ভাবলেন, না-ই বা গেলাম কাল। আগামী শুক্রবার যাব। ঠিক এভাবে ভাবতে ভাবতেই আমি, আপনি, আমরা সবাই আমাদের মূল্যবান কাজগুলোকে চরম নির্মমতায় অবহেলা করতে থাকি। ফলাফল- হতাশা আর দিনশেষে অপরাধবোধ।
ফুলের টব কেনা অবশ্যই কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ নয়, কিন্তু তাই বলে একে অবহেলা করলে আপনার দৈনন্দিন কাজের তালিকা তো আর আপনিই ছোট হয়ে যাবে না। কোনো দুশ্চিন্তা নয়। খুব সহজ ও ছোট ছোট অভ্যাসের মাধ্যমে আপনি নিমিষেই এই আলসেমি কাটিয়ে উঠতে পারবেন।
চলুন তাহলে দেখে নেয়া যাক কী কী করলে আপনি আপনার দিনের জেগে থাকা সময়ের সর্বোচ্চ ব্যবহারটি করতে পারবেন।
আছে কিছু কৌশল
প্রথমেই জানিয়ে দিই, কর্মক্ষমতা বাড়ানোর জন্য কিছু প্রমাণিত কৌশল রয়েছে, কেননা, কী করে দিনের একটু বাড়তি সময় বাগিয়ে নেয়া যায় সেই চেষ্টা বহু বছর আগে থেকেই চলে আসছে। ফলাফল হিসেবে উঠে এসেছে কিছু কৌশল, যেগুলোর মধ্যে তিনটি জনপ্রিয় কৌশল হলো পমোদরো কৌশল, আইজেনহাওয়ার কৌশল এবং ২ মিনিট কৌশল।
১) পমোদরো কৌশল
পমোদরো একটি বহুল জনপ্রিয় প্রোডাক্টিভিটি অ্যাপ। ফ্রান্সিসকো চিরিল্ল নামের এক ইতালীয় ভদ্রলোক এই পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। পমোদরো একটি ইতালীয় শব্দ, যার অর্থ একপ্রকার টমেটো সস, যা পাস্তার সাথে খাওয়া হয়। অর্থ সস হলেও পমোদরো টেকনিকের সাথে সসের সম্পর্ক নেই।
এটি একটি টাইমার, যা আপনাকে যেকোনো কাজ ২৫ মিনিট অন্তর বিরতি দিয়ে করতে সাহায্য করবে। চিরিল্ল তার রান্নাঘরের টমেটোর মতো দেখতে টাইমার থেকে এই পদ্ধতি আবিষ্কার করেন বলে এর নাম পমোদরো। পমোদরো একটি টাইম ম্যানেজমেন্ট অ্যাপ। অর্থাৎ আপনি দিনের কোন সময় কোন কাজ কতক্ষণ ধরে করবেন তা ঠিক করে দিবে এটি।
প্রতিটি কাজ বা প্রজেক্ট ২৫ মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী হয় এবং একে একটি পমোদরো বলে। ধরুন, আপনাকে একটি পুরো বই পড়ে শেষ করতে হবে। এক্ষেত্রে পমোদরো বলে, কোনো কাজ একটানা না করে থেমে থেমে করলে আমাদের মস্তিষ্কের ক্লান্তি দূর হয়। তো আপনাকে পুরো বই একটানা না পড়ে এর কিছু অধ্যায় ভাগ করে নিতে হবে। ধরুন, আপনি ঠিক করলেন আগামী ৩ ঘণ্টায় ৪টি অধ্যায় শেষ করবেন। এখন প্রতিটি চ্যাপ্টারের জন্য পমোদরো টাইমারে ২৫ মিনিট সময় ঠিক করুন। ২৫ মিনিট পুরো মনোযোগের সাথে পড়ুন। ২৫ মিনিট পর চ্যাপ্টারের যেখানেই পড়া শেষ হয়েছে সেখানেই থেমে যান। এরপরে একটি কাগজে ‘এক্স’ চিহ্ন আঁকুন। এটি খেয়াল রাখবে আপনি কয়টি ২৫ মিনিটের চক্র পার করলেন। ৩-৪টি ২৫ মিনিটের চক্রের পর একটি ৮-১০ মিনিটের বিরতি নিন। এভাবে ভাগ করে করে আপনি ক্লান্তি ছাড়াই পুরো বইটি শেষ করতে পারেন।
পমোদরো ব্যবহার করলে আপনার কাজগুলো অনেক দ্রুত হবে, কারণ তখন আপনি গুণে গুণে হিসেব করে সময় খরচ করবেন। এছাড়া যখন আপনি টাইমারটির সময় শেষ হতে দেখবেন তখন হাতে থাকা কাজটি আরও দ্রুত শেষ করার তাগাদা অনুভব করবেন।
তবে এর সীমাবদ্ধতাও কথা আছে। অনেকে মনে করেন, সবসময় চোখের সামনে একটি টাইমার ঝুলে থাকলে কাজে মনোযোগ আনা কঠিন হয়। তাছাড়া যদি আমাদের কাজগুলো ‘ফলাফলকেন্দ্রিক’ হয়ে যায়, তাহলে আমরা অন্য কাজ করবো না। যেমন- আপনার হাতে যদি ২৫ মিনিট না থাকে তাহলে হয়তো হেরে যাওয়ার ভয়ে আপনি ঐ কাজটি করবেনই না। তবে পমোদরোতে আপনি চাইলে আপনার নিজস্ব সুবিধামতো সময় বেঁধে দিতে পারেন। ২৫ মিনিটই হতে হবে, এমন নয়।
আইজেনহাওয়ার ম্যাট্রিক্স কৌশল
এই কৌশলটির নাম একজন বিখ্যাত ব্যক্তির নামানুসারে রাখা হয়েছে- ডুয়াইট ডি. আইজেনহাওয়ার। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৩৪ তম রাষ্ট্রপতি ছিলেন। আপনি জেনে অবাক হবেন, তিনি তার জীবনে একইসাথে কত বিচিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। রাষ্ট্রপতি হওয়ার আগে তিনি ছিলেন মার্কিন সেনাবাহিনীর একজন পাঁচতারকা আর্মি জেনারেল, ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্রপক্ষের হয়ে ইউরোপে সুপ্রিম কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেছেন এবং উত্তর আফ্রিকা, জার্মানি ও ফ্রান্সের আক্রমণে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। শুধু তা-ই নয়, তিনি ন্যাটোর সুপ্রিম কমান্ডার ছিলেন ও কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্টও ছিলেন!
যারা বলে অত্যধিক কাজের চাপে কিছুই করা হচ্ছে না, তাদের আইজেনহাওয়ারের কাছ থেকে শিক্ষা নেয়া উচিত। তার টাইম ম্যানেজমেন্ট এবং কর্মক্ষমতা নিয়ে সকলের বিস্ময়ের যেন শেষ নেই। কিন্তু কী করে তিনি এতকিছু করেও ব্যক্তিগত সময় বের করে গলফিংয়ে যেতে পারতেন সেটি কোনো গোপনীয় তথ্য নয়। তিনি তার কাজের সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে ৪টি শর্ত মেনে চলতেন। এগুলোকে একসাথে আইজেনহাওয়ার বক্স বা আইজেনহাওয়ার ম্যাট্রিক্স বলে।
শর্ত চারটি হলো-
১) জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ
যে কাজ আপনাকে এখনই করতে হবে, কারণ সামনে ডেডলাইন আছে। যে কাজ আপনার ফেলে দেয়ার কোনো সুযোগ নেই সেটি তখনই করুন।
২) জরুরি, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ নয়
ধরুন, আপনার বাসার পানির কল নষ্ট হয়ে কিছুটা পানি পড়া শুরু করেছে। এটি ঠিক করা অবশ্যই জরুরি। কিন্তু হাতে আগামীকালের অফিসের প্রেজেন্টেশনের চাপও আছে। কী করবেন? অবশ্যই আগে প্রেজেন্টেশনের কাজ শেষ করবেন এবং জরুরি কিন্তু আপাত কম গুরুত্বপূর্ণ কাজ পানির কল এর পরে ঠিক করবেন। (তবে যদি পানি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় তখন আবার সেটি জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়ে যাবে)।
৩) জরুরি নয়, তবে গুরুত্বপূর্ণ
ফেসবুকে এক বন্ধু সাহায্য চাইলো, কোনো জনগুরুত্বপূর্ণ খবর বের হলো, বসের ই-মেইল আসলো ইত্যাদি কাজ, যা এতটা জরুরি না, তবে গুরুত্বপূর্ণ সেগুলোর জন্য সময় রাখুন।
৪) জরুরিও নয়, গুরুত্বপূর্ণও নয়
কাজ করছেন আপনি, হঠাৎ মনে পড়লো গতকালের অসাধারণ ক্রিকেট ম্যাচের কথা বন্ধুকে জানাতে ভুলে গেছেন। অথবা এর চেয়েও অদরকারী কাজ, যেমন- সোশ্যাল মিডিয়া দেখা, ফোন করা ইত্যাদি থেকে বিরত থাকুন। কাজ শেষের সময়টুকু এসবের জন্য বরাদ্দ রাখুন।
এর মানে এই যে, নিশ্চয়ই আপনার সব কাজ সমান গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমারা প্রায়শ যে ভুলটি করি তা হলো ব্যস্ত হয়ে পড়ি আমাদের যাবতীয় ‘গুরুত্বপূর্ণ’ কাজ নিয়ে। কিন্তু এই পদ্ধতি, বলে আপনাকে কাজের গুরুত্ব বুঝে কাজকে ফেলতে শিখতে হবে। এটা যত না কাজ বাড়ানোর কথা বলে, তার চেয়ে বেশি বলে অপ্রয়োজনীয় কাজকে ফেলে দিতে। আপনার মূল্যবান সময়কে শুধু ঐসব কাজ করতে কাজে লাগান যা আপনার কাছে মূল্যবান বা যা আপনার কাজকে সহজ করবে, আপনার লক্ষ্যে আপনাকে পৌঁছতে সাহায্য করবে।
২ মিনিট কৌশল
আইজেনহাওয়ার ম্যাট্রিক্স কৌশল যদিও খুব সুন্দর করে গোছানো, একে সবসময় মেনে চলা কঠিন। কেননা কোনো কাজ কখন গুরুত্বপূর্ণ আর জরুরি হয়ে পড়ে তা বেশিরভাগই নির্ভর করে পরিস্থিতির উপর। তাই এর পরিবর্তে ব্যবহার করতে পারেন ছোট ও সবচেয়ে কম ঝামেলাযুক্ত এই ২ মিনিট কৌশল। এখানে সোজা কথা, “যে কাজ করতে ২ মিনিটের বেশি সময় লাগে না, তা মনে হওয়ার সাথে সাথেই করে ফেলুন।“
একজনকে ফোন করা দরকার? করে ফেলুন! রান্নাঘরে দু-চারটে এঁটো বাসন পড়ে আছে, মেজে ফেলুন! আপনার পোষা বিড়ালটিকে খাবার দিতে হবে? দিয়ে ফেলুন! তবে হ্যাঁ, এর কিছু নেতিবাচক দিক রয়েছে। সবসময় আমরা চলমান কাজ থামিয়ে উঠতে পারি না। সেজন্য ছোট কাজগুলোকে অন্য সময় করার জন্য কোথাও লিখে রাখুন।
কাজগুলোকে ব্যাচে ভাগ করুন
একটু ভাবলে আপনি বুঝতে পারবেন, আমরা দিনের বেশিরভাগ সময় প্রায় একইরকম কাজ করে থাকি। হুবহু না হলেও কাজগুলোর মধ্যে মিল রয়েছে। যেমন- রান্নাঘর গোছানোর সময়েই একইসাথে ঘরের অন্যান্য ধোয়ামোছার কাজ করে ফেলা। একটি গল্পের বইয়ের সাথে একই তালে একটি কাটখোট্টা বিষয়ের পরীক্ষার পড়াটা পড়ে নেয়া ইত্যাদি। এগুলো অবশ্য মাল্টিটাস্কিংয়ের পর্যায়ে পড়ে। কিন্তু এতে আপনার কাজ অনেক কম মনে হবে।
সহজ বনাম কঠিন
সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রথম কোন কাজটি করা উচিত? সহজ নাকি কঠিন? এই ব্যাপারে দ্বিমত রয়েছে। অনেকে বলেন, ঘুম থেকে উঠেই হয় আপনি দিনের সবচেয়ে কঠিন কাজটি করুন, নাহয় সবচেয়ে সহজ কাজটি। কঠিন কাজটি করলে আপনার মন সারাদিন চাপমুক্ত থাকার ফলে আপনি সময় নষ্টের জন্য হা-হুতাশ করবেন না। অন্যদিকে, দিনের সবচেয়ে সহজ ও ছোট কাজ দিয়ে যদি শুরু করেন, তাহলে আপনার মধ্যে কাজের একটি গতি তৈরি হবে।
কিন্তু আপনি কোন পথ বেছে নেবেন তা আপনার কাজের ধরন ও মানসিক অবস্থার উপর নির্ভর করে। অনেকে সকালে উঠে যারা কঠিন কাজ করতে চান না, তারা নাহয় সহজ কাজ দিয়ে শুরু করলেন। কানাডীয় লেখক ব্রায়ান ট্রেসি বলেন, সহজও না, কঠিনও না- দিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ দিয়ে সকাল শুরু করা উচিত।
এছাড়াও আরও অসংখ্য উপায় রয়েছে, যা দ্বারা আপনি খুবই অল্প পরিশ্রমে আপনার দিনের অনেকটা সময় কাজে লাগাতে পারবেন। কিছু ছোট ছোট টিপস হতে পারে-
- প্রতি রাতে আগামী দিনের গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো একটি প্যাডে লিখে রাখুন। চেষ্টা করবেন তালিকা যেন ৫-৬টি কাজের বেশি না হয়।
- আপনি যে রুমে বা টেবিলে কাজ করবেন তা যেন গোছানো ও পরিষ্কার থাকে। কাজ শুরুর আগে সব প্রয়োজনীয় জিনিস হাতের কাছে নিয়ে বসবেন।
- কাজের সময় মোবাইল সাইলেন্ট করে রাখুন, নয়তো আপনার ল্যাপটপ ও মোবাইলের ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে রাখুন। জরুরি ফোন আসলো কি না তা দেখার জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় ধরে রাখুন।
- চেষ্টা করুন পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুমানোর। রাত জেগে কাজ করার অভ্যাস যথাসম্ভব কমানোর চেষ্টা করুন।
- টিভি, সোশ্যাল মিডিয়া ইত্যাদিতে কম সময় দিন।
- মনে রাখবেন, আপনার সব কাজ পারফেক্ট হতে হবে না। যে কাজে বেশি পরিশ্রমের দরকার নেই তাতে অযথা সময় নষ্ট করবেন না।
বলা সহজ, করা কঠিন
উপরের ব্যাপারগুলো কম-বেশি আমরা সবাই-ই জানি, কিন্তু সমস্যা হয় এদেরকে মানতে গেলে। উপরের সব কৌশলই সবার জন্য নয়। আপনি আপনার লাইফস্টাইলের সাথে খাপ খায় এমন পদ্ধতিই বেছে নিন। যদি আপনি এগুলো নিয়মিত মানতে না-ও পারেন, তাহলে হতাশ হবেন না।।
এই কাজগুলোকে অভ্যাসে পরিণত করতে চাইলে আরেকটি বোনাস টিপস হলো, আপনার বাঁধা কাজগুলো দৈনিক ১ মিনিটের জন্য হলেও করুন। যত অলসই হোন না কেন, আমি জানি, ১ মিনিট আপনি বের করে নিতেই পারবেন!