আমাদের দেশে স্টার্টআপ শব্দটি বর্তমানে দারুণ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে তরুণদের কাছে। মূলত সমাজে বিদ্যমান নানান রকমের সমস্যার সমাধানে বা প্রয়োজন মেটাতে যখন এক বা একাধিক উদ্যোক্তা সীমিত পুঁজি নিয়ে একেবারেই নতুন ও ভিন্নধর্মী কোনো ব্যবসা শুরু করে, সেটিকেই বলা হয় স্টার্টআপ।
আজকের সময়ের স্টার্টআপের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, এই ব্যবসার সাথে গভীর যোগাযোগ রয়েছে আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তির, এর উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠছে বেশিরভাগ স্টার্টআপ। সাম্প্রতিক কিছু দৃষ্টান্ত দেখুন, দেখা যাবে, তরুণদের সব নতুন উদ্যোগই কিন্তু মূলত প্রযুক্তিনির্ভর।
সে কারণেই, বছর দুয়েক আগে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ (আইসিটি) আয়োজন করেছিল ‘স্টার্টআপ চ্যালেঞ্জ ২০১৭’ নামের একটি প্রতিযোগিতা। সেই প্রতিযোগিতায় বিজয়ী নির্বাচিত হয়েছিল মোট ২০টি উদ্ভাবনী প্রকল্প। বিজয়ীরা আর্থিক সহায়তা ছাড়াও পেয়েছিল গাজীপুরের কালিয়াকৈর বঙ্গবন্ধু হাইটেক পার্ক ও যশোরে শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কে কাজের সুযোগ।
আজকের লেখায় আমরা কথা বলব সেই প্রতিযোগিতারই প্রথম স্থান জিতে নেওয়া, অর্থাৎ সেরাদের সেরা প্রকল্পটির ব্যাপারে। কী ছিল সেটি? এটি ছিল ট্রাক ভাড়া করা বা ভাড়া দেওয়ার একদমই নতুন ও যুগোপযোগী এক উদ্যোগ, যার নাম ‘ট্রাক লাগবে’।
‘ট্রাক লাগবে’ মূলত দুই অসামান্য প্রতিভাবান উদ্যোক্তা, এনায়েত রশিদ ও মীর হোসাইন ইকরামের মস্তিষ্কপ্রসূত উদ্ভাবন। তাদের লক্ষ্যটা ছিল খুবই সাধারণ অথচ কার্যকরী। সেটি হলো, দেশের যেকোনো জায়গা থেকে, যেকোনো সময় পণ্য পরিবহনের জন্য প্রয়োজনীয় ট্রাক, পিকআপ ও কাভার্ড ভ্যান মানুষের হাতের নাগালে নিয়ে আসা এবং এ সংক্রান্ত যাবতীয় ঝক্কি-ঝামেলার অবসান ঘটানো। আর সে উদ্দেশ্য নিয়েই তারা তৈরি করেন ‘ট্রাক লাগবে’ নামক অ্যাপটি।
এই অ্যাপটির কার্যপদ্ধতি অনেকটা রাইড শেয়ারিং বা পার্সেল অ্যাপগুলোর মতোই। যখন কোনো পণ্য প্রেরকের ট্রাকের প্রয়োজন হবে, তখন তিনি অ্যাপের মাধ্যমে তার চাহিদার কথা জানিয়ে দেবেন। এরপর সেই চাহিদার বিবরণ পৌঁছে যাবে আশেপাশের ট্রাক মালিকদের কাছে। এরপর আগ্রহী ট্রাক মালিক বা চালকরা তাদের কাঙ্ক্ষিত ভাড়ার কথা জানাবেন। সব ঠিকঠাক হলে পণ্য প্রেরক সেই অ্যাপ দিয়েই ভাড়া করে নিতে পারবেন ট্রাক।
আজকের সময়ে এমন একটি অ্যাপের প্রয়োজনীয়তা যে ঠিক কতটা, তা নিশ্চয়ই আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। মালামাল স্থানান্তর বা পরিবহনের জন্য প্রায় সময়ই আমাদের প্রয়োজন হয় ট্রাক বা পিকআপ ভ্যানের। কিন্তু প্রয়োজনের সময় অন্য যেকোনো জিনিসের মতোই, হাতের নাগালে এগুলো পাওয়াটাও ভীষণ কষ্টকর হয়ে যায়। এছাড়া ট্রাক স্ট্যান্ডে যাওয়া-আসার ঝামেলা, পরিচিত ট্রাক ড্রাইভারদের ফ্রি না পাওয়া ইত্যাদি নানা কারণেও ট্রাক ভাড়া করার এই বিষয়টি পীড়াদায়ক হয়ে দাঁড়ায়। এধরনের যাবতীয় সমস্যার সহজ সমাধান সম্ভব ‘ট্রাক লাগবে’ অ্যাপটির মাধ্যমে।
তাছাড়া ট্রাকে পণ্য তুলে দেওয়ার পরও কি হাফ ছেড়ে বাঁচার উপায় আছে? তখন আবার নতুন এক চিন্তা মনের কোণে উঁকি দিতে থাকে, ট্রাকচালক ঠিক ঠিক পণ্য পৌঁছে দেবে তো! এই চিন্তা থেকেই মুক্ত রাখবে ‘ট্রাক লাগবে’ অ্যাপটি। কেননা অ্যাপের সকল ট্রাক ড্রাইভার ও তাদের গাড়িগুলো নিবন্ধিত। ফলে পণ্যের পরিবহন হয় একদম নিরাপদে।
এর মানে দাঁড়াচ্ছে, পণ্য পরিবহন বা মালামাল স্থানান্তরের ক্ষেত্রে যত রকমের সমস্যা হতে পারে, সবগুলোরই সমাধান নিয়ে এসেছে ‘ট্রাক লাগবে’ অ্যাপটি। যদি জানতে চাওয়া হয় এর কার্যকারিতার মূল রহস্য কোনটি, সেটি হবে এর উদ্যোক্তাদের একদমই সোজাসাপ্টা অথচ অব্যর্থ দর্শন। তারা একসাথে অনেক কিছু করার চেষ্টা করে সাধারণ মানুষকে ভড়কে দেননি। তারা ট্রাক মালিক ও সেবাগ্রহীতা দুই পক্ষের মধ্যে একটি সংযোগ স্থাপনের মাধ্যম হিসেবে কাজের চেষ্টা শুরু করেছিলেন, এবং সেই কাজটি যথাযথভাবে করার কারণেই মানুষের বিশ্বাস ও আস্থা অর্জন করে চলেছেন।
‘ট্রাক লাগবে’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এনায়েত রশিদ এ প্রসঙ্গে বলেন, “আমরা এমন একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছি, যার মাধ্যমে ট্রাক চালক বা মালিকের সাথে পণ্য প্রেরকের এক ধরনের যোগাযোগ তৈরি হবে। ট্রাক ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের জীবনমান উন্নয়ন করাই আমাদের মূল লক্ষ্য।”
এই উদ্যোগটির বয়স এখন আড়াই বছর। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে প্রাথমিকভাবে শুরু হয় এর পরিকল্পনা ও নির্মাণকাজ। ২০১৭ সালের জুন মাসে ‘স্টার্টআপ চ্যালেঞ্জ ২০১৭’ প্রতিযোগিতায় জয়ের ফলে এর অগ্রগতি আরও ত্বরান্বিত হয়, এবং সে বছরই জুলাই মাসে অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহারকারীদের জন্য এটির পরীক্ষামূলক (বেটা) সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এরপর ২০১৮ সালের আগস্টে অ্যাপটির নতুন সংস্করণ আসে গুগল প্লে স্টোরে। একই বছর সেপ্টেম্বরে ঢাকার আইসিটি টাওয়ারে আনুষ্ঠানিকভাবে অ্যাপটির বাণিজ্যিক যাত্রা শুরুর ঘোষণা দেওয়া হয়। সেই যাত্রার এক বছর পেরোতে না পেরোতেই পণ্য পরিবহনের একটি নির্ভরযোগ্য সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে খ্যাতি পেতে শুরু করেছে ‘ট্রাক লাগবে’। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম আয়োজিত প্রতিযোগিতায় দেশের ১৬৮টি কোম্পানির মধ্য থেকে ‘ট্রাক লাগবে’ জিতে নিয়েছে ‘বেস্ট টেকনোলোজি ইনোভেশন’ পুরস্কার।
বর্তমানে এই অ্যাপের সাহায্যে ছোট পিকআপ ভ্যান থেকে শুরু করে মাঝারি বা বড় আকারের খোলা ট্রাক এবং কাভার্ড ভ্যান ভাড়া করা যাচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, এখানে পাওয়া যাচ্ছে কনটেইনারবাহী প্রাইম মুভার।
আর যদি শহরের ভেতরেই খুব দ্রুত পণ্য পরিবহনের প্রয়োজন দেখা দেয়, ‘ট্রাক লাগবে’র ‘এক্সপ্রেস’ সার্ভিসের মাধ্যমে অ্যাপ দিয়েই মুহূর্তে যে কেউ ডেকে নিতে পারবেন তার সবচেয়ে কাছে থাকা মিনি ট্রাক কিংবা পিকআপ। মাত্র ক’দিন আগেই ঢাকার সর্বোত্র শুরু হয়েছে এই নতুন ‘এক্সপ্রেস’ সুবিধা। এক্সপ্রেস সার্ভিস নিশ্চিত করছে –
১। তাৎক্ষণিক বুকিং
২। নির্দিষ্ট রেট এবং
৩। সুরক্ষিত ডেলিভারি
সেবাগ্রহীতাদের সর্বোচ্চ গুণগতমান নিশ্চিত করতে মূলত দুটি বিষয়ের উপর গুরুত্বারোপ করছে অ্যাপটি। একটি হলো নির্ভরযোগ্যতা এবং অন্যটি স্বচ্ছতা। ২৪ ঘণ্টা পরিবহন সুবিধা, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পরিবহন সেবা এবং অ্যাপের আভ্যন্তরীণ বিশেষ লোড ম্যাচিং প্রযুক্তির মাধ্যমে যেকোনো শিপমেন্টের জন্য সঠিক ট্রাক খুঁজে দিয়ে নির্ভরযোগ্যতা নিশ্চিত করছে ‘ট্রাক লাগবে’। অন্যদিকে স্বচ্ছতার লক্ষ্যে ‘ট্রাক লাগবে’-তে প্রাপ্ত সকল ট্রাক যাচাইকৃত ও রেজিস্টার্ড। এছাড়া সকল পণ্য প্রেরকেরই ভেরিফিকেশনের ব্যবস্থা করেছে তারা। সেইসাথে সেবাগ্রহীতারা যেন সম্ভাব্য সবচেয়ে কম মূল্যে সেবা লাভ করতে পারে, সে বিষয়ে সবসময় সজাগ নজর থাকে ‘ট্রাক লাগবে’র উদ্যোক্তাদের।
এ তো গেল সেবাগ্রহীতাদের প্রাপ্ত বিভিন্ন সুবিধার কথা। কিন্তু ‘ট্রাক লাগবে’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা যেমনটি বলেছিলেন, ট্রাক ব্যবসার সাথে জড়িত সকলের জীবনমানের উন্নয়নও তাদের লক্ষ্য। সেটি কীভাবে হবে? একটু মাথা খাটালেই মিলবে এ প্রশ্নেরও উত্তর।
অ্যাপটির মাধ্যমে শুধু সাধারণ মানুষই যে তাদের কার্যোদ্ধার করতে পারছেন তা নয়, পাশাপাশি ট্রাক ব্যবসায়ীরাও খুব সহজেই খুঁজে পাচ্ছেন তাদের সেবাগ্রহীতা। তাছাড়া পণ্য বা মালামাল পরিবহনের জন্য অনেক সময় ট্রাক নিয়ে দূর দূরান্তে, এমনকি দেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলেও যেতে হয়। কিন্তু সেখানে নতুন কোনো সেবাগ্রহীতা না পাওয়ায়, কিংবা স্থানীয়দের সাথে তেমন চেনাজানা না থাকায়, ফিরতি পথে খালি ট্রাক নিয়েই আসতে হয়। ফলে বৃথা শ্রম ও টাকার অপচয় ঘটে। কিন্তু এখন যেহেতু এই অ্যাপের মাধ্যমে দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে অনলাইনেই সেবাগ্রহীতা পাওয়া যাচ্ছে, তাই ট্রাকচালক ও কর্মীদের শ্রমটাও বৃথা যাচ্ছে না। তারা যেমন বাড়তি কিছু আয়ের সুযোগ পাচ্ছে, তেমনই ক্ষতির বদলে লাভ হচ্ছে ট্রাক মালিকদেরও।
সব মিলিয়ে ট্রাক মালিক, চালক, কর্মী থেকে শুরু করে সেবাগ্রহীতা, সকলের জীবনকেই আরও সহজ করে দিচ্ছে ‘ট্রাক লাগবে’। দেশি একটি স্টার্টআপের কাছ থেকে এমন উন্নত ও আন্তর্জাতিক মানের পরিষেবা লাভের সুযোগ আমাদের জন্য সত্যিই দারুণ আনন্দের একটি ব্যাপার।