চলতি বছরের অর্ধেকেরও বেশি সময় চলে যাচ্ছে, তবু করোনা মহামারি বিশ্ববাসীর পিছু ছাড়েনি। জীবন সম্পর্কে ছোট-বড় অসংখ্য শিক্ষা এ মহামারি আমাদের ইতোমধ্যেই দিয়েছে এবং দিচ্ছেও। জীবনের প্রতি আমাদের মনোভাব কিংবা এক কথায় বললে, আমাদের প্রত্যেকের জীবন দর্শন অনেকখানি বদলে দিয়েছে ঘটনাবহুল ও চলমান এই অবস্থা। ‘নিউ নরমাল’, ‘আইসোলেশন’, ‘কোয়ারেন্টিন’, ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’, ‘লক ডাউন’ ইত্যাদি মুখে মুখে উচ্চারিত কিছু শব্দবন্ধের সাথে আমরা অনেকেই বোধ করি প্রথমবারের মতো পরিচিত হতে পেরেছি।
ওয়ার্ক ফ্রম হোম বা ঘরে বসে কাজ করার আইডিয়াটির প্রতি প্রায় সকলেরই প্রতিক্রিয়া ছিল- “এ তো মশাই সুখের খবর!” হ্যাঁ, এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বেশ কিছু প্রভাবশালী সংস্থার গবেষণায় অফিসে গিয়ে কাজ করার কিছু সীমাবদ্ধতা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। তবে মুদ্রার অন্য পিঠটি এবারে ধীরে ধীরে প্রকাশিত হতে শুরু করেছে। বাসায় বসে কাজ করলে অনেক ক্ষেত্রেই প্রাত্যহিক জীবনের বিশৃঙ্খলা মানসিক চাপ তৈরি করতে পারে, যার প্রভাব লক্ষ করা যায় কাজের গুণগত মানের ওপর। অর্থাৎ, প্রাথমিকভাবে যে মহামারিকে ভাবা হচ্ছিল এক পশলা ছুটির আমেজ কিংবা একঘেয়ে জীবনে মুক্তির স্বাদ, সেটিই এখন এর ভিন্ন রূপ প্রদর্শন করছে আমাদের।
পরিপাটি বনাম এলোমেলো জীবনযাপন
মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত মনোবিজ্ঞানী ক্যাথলিন ভোস ও তার সহকর্মীরা কর্মক্ষেত্রের শৃঙ্খলা এবং কর্মদক্ষতার মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে একটি গবেষণা করেন। ব্যাপক আকারের গবেষণাকাজ পরিচালনার জন্য মূলত ধারাবাহিকভাবে একাধিক সম্পর্কিত ছোট ছোট পরীক্ষা সম্পন্ন করা হয়। একদল চাকরিজীবীদেরকে একটি প্রশ্নমালা দেওয়া হয়। তাদের মাঝে দু’টি ভাগ ছিল- একদল তাদের প্রশ্নপত্রটি পূরণ করেছিলেন সাজানো-গোছানো, পরিষ্কার, পরিপাটি কোনো টেবিলে বসে আর অন্য দলটি অফিসের অগোছালো, নোংরা, বাতিল কাগজপত্রে ভর্তি পরিবেশের মাঝে প্রশ্নপত্রটি পূরণ করেছিলেন।
এরপর তাদেরকে একটি তহবিলে যেকোনো অঙ্কের টাকা দান করতে বলা হয় এবং চকলেট অথবা আপেলের মাঝে যেকোনো একটিকে হালকা খাবার হিসেবে গ্রহণ করার সুযোগ দেওয়া হয়। দ্বিতীয় দলের তুলনায় প্রথম দলের স্বেচ্ছাসেবী মনোভাব বেশি প্রকাশ পায় এবং প্রথম দলের সদস্যরা চকলেটের তুলনায় আপেল বেছে নেওয়াকেই পছন্দ করেছিলেন।
এ সিরিজের ভিন্ন একটি গবেষণায় পিংপং বলের বিকল্প ব্যবহার নিয়ে কাজ করা হয়। দু’টি দলই সমান সংখ্যক আইডিয়া প্রদান করতে সক্ষম হলেও গবেষকদের মাপকাঠিতে দ্বিতীয়, অর্থাৎ বিশৃঙ্খল পরিবেশে কাজ করা সদস্যদের আইডিয়াগুলো ছিল অনেক বেশি সৃজনশীল ও প্রভাবশালী। পরিপাটি কাজের পরিবেশ মানুষকে ভদ্র এবং নিরাপদ থাকতে উৎসাহ প্রদান করে। অন্যদিকে এলোমেলো পরিবেশ মানুষকে স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়ার উদ্দেশ্যে তার সৃষ্টিশীলতাকে বৃদ্ধি করে।
মানবমস্তিষ্ক এলোমেলো পরিবেশ ও প্রকরণের প্রতি কীভাবে সাড়া প্রদান করে, তার ওপর একটি পরীক্ষা চালানো হয় প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে। নিউরোসায়েন্স অ্যান্ড সাইকোলজির অধ্যাপক সাবিন ক্যাস্টনার ২০০৮ সালে গবেষণাটি পরিচালনা করেন। এফএমআরআই বা ফাংশনাল ম্যাগনেটিক রিজোনেন্স ইমেজিংয়ের মাধ্যমে তিনি কিছু নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে মস্তিষ্কের স্ক্যান করেন। প্রতিটি স্ক্যান চলাকালে অংশগ্রহণকারীদেরকে একটি রাস্তার ছবি দেখিয়ে তাদেরকে একটি নির্দিষ্ট কিছুর (একটি গাড়ি বা একজন মানুষ) প্রতি মনোযোগ দিতে বলা হচ্ছিল। স্ক্যানগুলোতে প্রতিবারই দেখা যায়, মস্তিষ্কের চিন্তন দক্ষতা, আবেগানুভূতি, মনোযোগ, কার্যকর স্মৃতি ইত্যাদির কেন্দ্র ফ্রন্টাল কর্টেক্সকে দারুণভাবে উদ্দীপিত হতে। প্রাপ্ত ফলাফল থেকে গবেষকরা দেখেন, অংশগ্রহণকারীরা সুনির্দিষ্ট একটি বস্তুকে প্রক্রিয়াজাত করার চেয়ে মনোযোগ দিতে বেশি সচেষ্ট ছিল। অর্থাৎ বাস্তব জীবনে হোক বা ছবিতেই হোক, বিশৃঙ্খলা মানুষের মস্তিষ্ককে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে।
আমরা মনোযোগ যখন একটি সুনির্দিষ্ট বিষয়ের উপর দিতে চাই, তখন এর চারপাশের পরিবেশের উপর নির্ভর করে আমাদের মনোনিবেশ করার সক্ষমতা। চারপাশের বিভিন্ন বিশৃঙ্খলা সরিয়ে ফেললে তখন একাধিক বিষয়, মনোযোগের কেন্দ্র হওয়ার প্রতিযোগিতায় মেতে উঠতে পারে না। ২০১১ সালের একটি গবেষণায় ক্যাস্টনার লক্ষ করেন যে, বাসায় কিংবা কর্মক্ষেত্র যারা সবসময় পরিপাটি, সাজানো-গোছানো রাখেন, তাদের কাজে মনোযোগ ক্ষমতা অধিক হয়ে থাকে, দীর্ঘ সময়ের জন্য তারা একটি কাজে অখণ্ড মনোযোগ দিতে পারেন এবং সর্বোপরি তাদের কর্মক্ষমতা বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দৃষ্টিগোচর করা সম্ভব হলে আমাদের চিন্তন ক্ষমতার উপর চাপ কম পড়ে এবং আমাদের কার্যক্ষম স্মৃতির পরিমাণ হ্রাস পায়।
ঘরে বসে কাজ এবং বিভ্রান্তি
ফিলাডেলফিয়াতে কর্মরত নিউরোলজিস্ট এবং অকুপেশনাল মেডিসিন স্পেশালিস্ট হানাহ ম্যাকলেন সংসার আর কাজ সামলানোর অভিজ্ঞতা ব্যাখ্যা করতে একে রীতিমতো ‘যুদ্ধে অবতীর্ণ’ হওয়ার সাথে তুলনা করেছেন। মহামারিতে বাসায় বসে কাজ করা যে সে অর্থে ততটা মধুর অভিজ্ঞতা নয়, সেটি তিনি খুব স্পষ্টভাবে অনুধাবন করতে পেরেছেন। এর সমাধানের উদ্দেশ্যে তিনি স্নায়ুবিজ্ঞানকে কাজে লাগাচ্ছেন। ঘরে বসে কাজ করতে হলে আপনাকে অনেক বেশি বিভ্রান্তির (distraction) সম্মুখীন হতে হবে। ম্যাকলেনের ভাষায়,
ঘরে বসে কাজ করতে বসলে আপনার মাথায় হাজারটা চিন্তা ঘুরপাক খাওয়া খুবই স্বাভাবিক, আপনার মন ক্ষণে ক্ষণে নানান চিন্তায় ব্যস্ত হয়ে পড়বে এবং কাজের দিকে মন না দিয়ে আপনি নিতান্তই অপ্রয়োজনীয় অন্যান্য বিষয় নিয়ে ভাবনার ফাঁদে আটকা পড়বেন। হয়তো ঘরের মেঝেতে অ্যাকুরিয়াম থেকে লাফিয়ে পড়া মাছ দেখবেন, যা অতি দ্রুত পরিষ্কার করা জরুরি। হয়তো আপনার জামা-কাপড়ের বেহাল দশা দেখে সেটা গোছগাছ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়বেন। এই সমস্ত ছোটখাটো কাজ করতে করতে আপনি নিজের অজান্তেই মানসিকভাবে ক্লান্ত হয়ে যাবেন এবং হয়তো এমন সব চিন্তা বা কাজ করবেন, যেগুলোর কোনোটিই দরকার নেই।
এসব নানান বিভ্রান্তি থেকে দূরে অবস্থান করে নিজের মূল দায়িত্বে মনোনিবেশ করতে না পারলে কাজের চাপ দিনে দিনে শুধু বেড়েই যাবে এবং ঘরে বসে কাজ করাটা হিতে বিপরীত হতে বেশিক্ষণ লাগবে না।
শৃঙ্খলাবদ্ধ হওয়ার উপায়
একটি সুনির্দিষ্ট কাজে গভীরভাবে দীর্ঘ সময়ের জন্য মনোযোগী হওয়ার জন্য নিজের মানসিক নিয়ন্ত্রণ থাকা চাই শতভাগ। কাজ করতে বসার আগেই কাজের সময়টুকু ঠিক করে নিন। এতে করে আপনি মানসিকভাবে নির্ধারিত সময়ের আগেই প্রস্তুত হয়ে গেলেন কাজের জন্য। কাজ শুরু করার কিছুক্ষণ আগেই কাজের সামগ্রিক পরিবেশটি সাজিয়ে নিন যতটা সম্ভব হয়, যাতে করে জায়গাটির সাথে আপনি আত্মিকভাবে সুসংবদ্ধ হতে পারেন।
এতে করে কোনো বিভ্রান্তিও আপনার সামনে থাকবে না এবং আপনি আপনার মূল কাজের প্রতি আপনার পূর্ণ মনোযোগ দিতে পারবেন। যদি অজস্র চিন্তার মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলেন, তাহলে মনে যেকোনো অপ্রয়োজনীয় চিন্তা আসামাত্রই সেটিকে কাগজে লিখে রাখুন, এতে করে চিন্তাটি জট জট পাকানোর সুযোগ পাবে না। মাইন্ডফুলনেস চর্চা করতে পারেন। মাইন্ডফুলনেসের মূল বার্তাটি হচ্ছে অতীত বা ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তায় মেতে না থেকে বর্তমান, অর্থাৎ তাৎক্ষণিক এ মুহূর্তে কী ঘটছে, তা নিয়ে ব্যস্ত থাকা। মাইন্ডফুলনেস চর্চা করতে পারেন ধ্যান, হাঁটা, যোগাসন ইত্যাদি নানা কিছুর মাধ্যমে।