“আগে ওকে বারবার দেখেছি
লালরঙের শাড়িতে
দালিম ফুলের মতো রাঙা
আজ পড়েছে কালো রেশমের কাপড়
আঁচল তুলেছে মাথায়…”
কিংবা
“বাসন্তী রঙ শাড়ি পড়ে ললনারা হেঁটে যায়…”
সেই রবীন্দ্রনাথের হারিয়ে যাওয়া প্রেমের মেয়েটা হোক অথবা বাঙালির কোনো উৎসবে নারী- বাঙালি মেয়েদের জীবনের কোনো আয়োজনই কি পূর্ণতা পায় শাড়ি ছাড়া? বিয়ে, বরণ বা বিদায়- কোথায় নেই শাড়ির ছোঁয়া? আসুন আজ জানি কিভাবে সেই সুপ্রাচীন কাল থেকে শাড়িকে জড়িয়ে গড়ে উঠলো ভারতীয় উপমহাদেশের এই ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি।
শাড়ি নিঃসন্দেহে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীনতম পোষাকগুলোর একটি ও বোধহয় একমাত্র জোড়া না লাগা পোষাক। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এটা কেবল আবেদনময়ী, জমকালো নৈমিত্তিক পোষাকই নয়, বরং হয়ে উঠেছে পোষাকশিল্পীদের অনবদ্য ক্যানভাস যেখানে তাঁতি, বুননশিল্পী ও নকশাকার সুতা, রং, নকশা ও চুমকি-পাথরের অনন্য খেলায় মেতে ওঠে।
বলা হয়ে থাকে যে, সুতা এবং কাপড় বোনার শিল্প ভারতবর্ষে এসেছিল মেসোপটেমিয়ান সভ্যতা থেকে। সিন্ধু উপত্যকার নারী-পুরুষ উভয়ের কাছেই সুতা বুনন বেশ পরিচিত ছিল। ভারতে সুতা প্রথম চাষ ও বুনন শুরু হয় খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে। ঐ সময় সুতায় যে রঙ ব্যবহার হতো, তা এখনো ব্যবহার করা হয়; যেমন- নীল গাছ বা হলুদ থেকে পাওয়া রং। আর রেশমী কাপড় বোনা শুরু হয় ২৪৫০-২০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে।
শাড়ির সর্বপ্রথম চিত্রায়ন পাওয়া যায় সিন্ধু প্রদেশের এক পুরোহিতের প্রস্তর মূর্তিতে। সিন্ধু উপত্যকার লোকেরা দীর্ঘ কাপড়ের টুকরা কোমরবন্ধ হিসেবে ব্যবহার করতো। সভ্যতার শুরুর ইতিহাস বলে কাপড় পরিধানের পদ্ধতি শুধু সিন্ধু সভ্যতা নয়, মিশর, সুমের ও আসিরিয়াতেও প্রচলিত ছিল। ঐসব শহরের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে যে মুদ্রা ও প্রস্তরমূর্তি পাওয়া গেছে, তা এই তথ্যই প্রমাণ করে।
আর্যরা যখন প্রথম দক্ষিণ ভারতের নদী অববাহিকায় আসে, তখন তারা তাদের সাথে এই ‘বস্ত্র’ বা ‘Vastra’ শব্দটা নিয়ে আসে। যদিও সংস্কৃত মতে এর অর্থ হলো কাপড় বা পোষাক, কিন্তু তারা তখন এই শব্দ দিয়ে প্রক্রিয়াজাত চামড়ার পরিধান উপযোগী আচ্ছাদনই বোঝাতো। এখানে আসার পর স্থানীয় অধিবাসীদের থেকে তারা প্রথম সুতায় বোনা লম্বা কাপড় পরিধানের অভ্যাস শুরু করে।
মূলত সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মাঝে প্রথম শাড়ির প্রচলন শুরু হয়। তারা মনে করতো সেলাইকৃত বা জোড়া দেওয়া কাপড় অপবিত্র। আবার এরকম একটা ধারণাও তাদের মধ্যে প্রচলিত ছিল যে, নাভিমূলই জীবন ও সৃষ্টির উৎস এবং তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তাই শাড়িতে তা উন্মুক্ত রাখা হতো। সিন্ধু এলাকার মহিলাদের এই কটিবন্ধ তখন নাম পায় নিভি (Nivi)। মহিলাদের এই কটিবন্ধ ভারতবর্ষে বহুল প্রচলিত শাড়ির অগ্রদূত। সিন্ধু সভ্যতার পরের বিভিন্ন মহাকাব্য থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে দেখা যায় পরবর্তীতে কাঁচুকি (Kanchuki) নামে এক টুকরা কাপড় শরীরের উপরের অংশে জড়িয়ে পরার প্রচলন নারীদের মধ্যে ছিল যা থেকে ব্লাউজের প্রচলন শুরু হয়।
পনের শতকের প্রথম দিকে পর্তুগালের এক পর্যটকের বর্ণনা থেকে জানা যায় তখন মেয়েদের সারা শরীরে রেশম বা সুতির কাপড় জড়ানো দেখা যেতো। প্রথম শ্রেণীর বিভিন্ন সাহিত্যকর্মে, বিশেষ করে বিভিন্ন মহাকাব্যে, নারীদের বর্ণনা দেয়া হয়েছে সোনা ও বিভিন্ন মণি-মুক্তা খচিত শাড়িতে।
পরবর্তীতে কাব্য-সাহিত্যের ক্রমোন্নয়নের শুরু থেকে অপার সুন্দর ভঙ্গিমায় শাড়ি পরিহিত নারীরা সাহিত্যের মূল উপাদেয় হওয়া শুরু করলো। ফলে তারা নিজেদের পোষাকেও সুতা ও নকশার, ধনীরা বিভিন্ন মূল্যবান পাথরের ব্যবহার চালু করে। তখন তারা অলংকার পরাও শুরু করে। এই সময় থেকেই শাড়ির আঁচল সৌন্দর্যের জন্য প্রাধান্য পাওয়া শুরু করে এবং সিল্ক আলাদা করে পরিচিতি পায়। পরবর্তীতে যেন এই কারুকাজ ও নকশার উন্নতি এবং সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্যই এই সেলাইবিহীন কাপড়ের দীর্ঘ পোষাক তিন খন্ডে বিভক্ত হয়- নীভি কোমর ও নিম্নাংশ জড়িয়ে থাকতো, কাচুকি উপরের অংশে থাকতো এবং শালের মতো দীর্ঘ কাপড়টাকে বলা হত উত্তরীয়, যা পরবর্তীতে ঘুরিয়ে সামনে আনার চল হয়। কারণ সবচেয়ে বেশি কারুকাজ এই অংশেই থাকতো। তখন মেয়েরা সামাজিক মর্যাদা অনুসারে নিজেদের শাড়িতে পাথর বা সুতার নকশায় ভরিয়ে তুলতো।
সাহিত্যের যুগ এবং পুরাণের যুগে মেয়েদের মধ্যে শাড়ির একটা অংশ মাথায় তোলার কোনো প্রচলন ছিলনা, বিশেষ করে ধর্মীয় ও সামাজিক কোনো নিয়মানুযায়ী তো নয়ই। তারা যদি কেউ তা করতো, তবে তা হতো পোষাকের কারুকাজ ফুটিয়ে তুলতে।
এরপর গ্রীকদের এবং ফরাসিদের প্রভাবে ভারতের সকল শ্রেণীর মেয়েদের শাড়ি পরার ধরণ এক প্রধান পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যায়। গ্রিকরা ততদিনে বেল্ট আবিষ্কার করেছে এবং তারা কোমরের কাছে জড়িয়ে কাপড় পরা শুরু করেছে। আর ফরাসিরা তখন তাদের দীর্ঘ কাপড়গুলো পরে কোমরের কাছে ঘাড়ের কাছে জড়ো করতো এবং কোমরবন্ধ ব্যবহার করতো। কাপড় পরার নতুন এই পদ্ধতি এই অঞ্চলের উঁচু শ্রেণীর মেয়েদের আকর্ষণ করে।
পরবর্তীতে ফরাসিদের আগমন ভারতের রাজপুতানা এবং গঙ্গার অববাহিকায় পাঞ্জাবের অধিবাসীদের শাড়ি পরার ধরণকে ব্যাপক প্রভাবিত করে। তখন থেকে তারা শাড়ির সাথে উপরের অংশের জন্যে ছোট ছোট জামা ব্যবহার করা শুরু করে। ঐ সময়ের বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে মাথুরা এবং অজন্তার মহিলাদের এমন পোষাক ব্যবহারের প্রমাণ ও বর্ণনা পাওয়া যায়। সাধু দায়ানেশ্বরের (১২৭৫-১২৯৬) লেখা গ্রন্থে ‘কান্দানাকি চোলি’ (Chandanachi Choli) জাতীয় শব্দের ব্যবহার থেকে বোঝা যায় যে, ব্লাউজ এই গত শতাব্দীরই প্রথমদিকের সংযোজন। ফরাসিরা এই এলাকায় নকশা ও কারুকাজের ক্ষেত্রেও নতুন অনেক ধরণ সংযোজন করে; যেমন- কাপড়ে মুক্তা ও বহুমূল্য পাথরের ব্যবহার।
এতো পরিব্যাপ্তির পরও শাড়ির ধরনের এই পরিবর্তন বেশ ধীরেই বলা যায়। শাড়ির এই পথ চলায় সবচেয়ে শেষ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এসেছে মোঘল শাসনামলে। আর সেখান থেকেই আধুনিক শাড়ি পরার পদ্ধতির আগমন। মোঘল ছেলেরা দীর্ঘ কোর্তা পরতো, সাথে সরু সালোয়ার। আর তাদের মোহময়ী সুন্দরী মেয়েরা পরতো অমূল্য সব অলংকার। এই সময়েই প্রথম শাড়ির শেষ অংশ আঁচল বা পাল্লু হিসাবে পরিচিত হয় এবং মহিলারা তা মাথা ঢাকতে বা ওড়না হিসাবে ব্যবহার করতে শুরু করে, যেহেতু সেই সময় মুসলিম শাসনাধীন অবস্থায় মহিলাদের মাথা ঢাকার রেওয়াজ চালু হতে শুরু করে। বর্তমানে শাড়ির যে দীর্ঘ আঁচল রাখা হয় এবং তা মাথা ও ঘাড়ে ঘুরিয়ে নেয়া হয়, তা ওই সময় থেকেই চালু হয়।
মোঘলদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং জীবনপদ্ধতি সাধারণ মানুষের জীবনে ব্যাপক প্রভাব রাখে। সেই সময় রাজপরিবারে ও বাইরে সালোয়ার কামিজের প্রচলন ঘটে, বিশেষ করে মোঘলদের আভিজাত্য এ দেশীয় ছেলেদের পোষাকে ব্যাপক পরিবর্তন আনে। তবুও শাড়ি ভারতবর্ষের নারী-হৃদয়ে আপন আসনে নিজ গর্বে সুপ্রতিষ্ঠিত থাকে। বর্তমানের শাড়ি আসলে প্রাচীনকালের ভারতের সেলাইবিহীন তিন কাপড়ের শাড়ি আর মোঘলদের আনা সেলাইকৃত কাপড়ের মিশ্রণ।
এভাবে শাড়ি দীর্ঘ পথ পেরিয়ে বর্তমানের মেয়েদের কাছে এসেছে। আর বর্তমানের শাড়ি পরার এই পদ্ধতিতে মূলত গ্রীক, ফরাসি ও মধ্য এশীয়দের প্রভাব জড়িয়ে আছে, রয়েছে শাড়ি তৈরীর পদ্ধতি, সুতার আর বুননের ধরনের মধ্যে ভিন্নতা। আর এই ভিন্নতার উপর ভিত্তি করে বহু সময় আগে থেকেই ভারতবর্ষের বিভিন্ন এলাকা বিভিন্ন ধরনের শাড়ির উৎপাদনের জন্যে বিখ্যাত; যেমন ঢাকাই জামদানী, কাশ্মিরী রেশমী সিল্ক, টাংগাইলের তাঁত বা মধ্য প্রদেশের মহেশ্বর শাড়ী। এই নামগুলো কেবল এগুলো উৎপাদনের মূল শহরের নাম থেকে আসেনি, বরং এসেছে বোনার কৌশল বা নকশার ভিন্নতা থেকেও। আর নতুন নতুন বোনার কৌশল, সুতার ভিন্নতা বা নকশার হরেক ধরনের সাথে তারা পরিচিত হয়েছে বিভিন্ন জাতির এদেশে আগমনের মাধ্যমে; যেমন- গুজরাট ও রাজস্থানের শাড়ি তৈরীর ধরনটা মূলত আসে মধ্য এশীয়দের হাত ধরে।
কর্ম, আরাম ও বিলাসিতায় এভাবেই বাঙালি নারীর সবার আগে প্রাধান্য পায় শাড়ি।যদিও শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে শাড়ি এদেশীয় খুকি থেকে বুড়ি সবার শোভা বৃদ্ধি করছে, তবুও এর অসাধারণত্ব ও দারুণ সৌন্দর্য সামান্যতম ম্লান হয়নি,বরং দিন দিন এর আকর্ষণ বেড়েছে, বিশ্বজুড়ে বাড়ছে আজও।
তথ্যসূত্র
১) mohr-mcpherson.com/indias-sari-origin-myth-and-beauty/
২) mohr-mcpherson.com/indias-sari-origin-myth-and-beauty/
৩) esamskriti.com/essay-chapters/THE-ORIGIN-OF-THE-SAREE-1.aspx
৪) en.wikipedia.org/wiki/Sari