ওজন বৃদ্ধি যেমন একটি সমস্যা, তেমনই মুখের মেদ বৃদ্ধিও একটি সমস্যা। এতে অস্বস্তি তো হয়ই, পাশাপাশি ঘটে সৌন্দর্যহানি। একেকজন মানুষের শারীরিক গড়ন এবং গঠন একেকরকম। কারোর মুখের গড়ন হয়তো পাতলা, কারো আবার ভারী। কোনোটাই কিন্তু খারাপ নয়। তবে মুখের অতিরিক্ত চর্বি বা মেদ সৃষ্টি করে অস্বস্তি। এর থেকে মুক্তি পাওয়া আসলে খুব একটা কঠিন কাজ নয়। তবে সহজও নয় একেবারে।
নিয়মিত কিছু অভ্যাস আর অনুশীলন দিতে পারে মুখমণ্ডলের অতিরিক্ত চর্বির হাত থেকে মুক্তি। আসুন জেনে নেওয়া যাক তেমনই কিছু অভ্যাসের কথা, যা প্রাকৃতিকভাবেই আপনার শরীরকে সুস্থ রাখার পাশাপাশি কমাবে মুখমণ্ডলের মেদও।
স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস
সুস্থ ও সুন্দর দেহের জন্য সঠিক, পুষ্টিকর এবং পরিমিত খাদ্যাভ্যাসের কোনো বিকল্প নেই। শরীরের বিভিন্ন অংশের, বিশেষ করে মুখমণ্ডল এবং গলদেশের বাড়তি মেদ নিয়ন্ত্রণে, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। প্রতিদিনের খাদ্যতালিকা থেকে প্রয়োজনের অধিক ক্যালরি বাদ দিতে হবে। এক্ষেত্রে একদিনে হুট করে অনেকখানি ক্যালরি বাদ না দিয়ে ধীরে ধীরে ক্যালরির পরিমাণ কমিয়ে আনতে হবে। শর্করা এবং আমিষ বাছাইয়েও হওয়া চাই মনোযোগী। বিশেষ আঁশসমৃদ্ধ শর্করা এবং উদ্ভিজ্জ ও কম চর্বিযুক্ত আমিষ যেমন আপনার স্বাস্থ্যকে নিয়ন্ত্রণ করবে, তেমনই মেদহীন হবে আপনার মুখমণ্ডল ও গলদেশ।
খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দিতে হবে ভাজাপোড়া ও প্রক্রিয়াজাতকৃত খাবার। এ ধরনের খাবার যে শুধু শরীরে অতিরিক্ত মেদই জমায় তা নয়, বরং সৃষ্টি করে হৃদরোগ, ক্যান্সারসহ নানাবিধ রোগ। অতিরিক্ত লবণ বা টেস্টিং সল্ট ব্যবহার করা হয় এমন খাবারও এড়িয়ে চলা উচিত। কেননা সোডিয়াম মুখের ফোলা ভাব বৃদ্ধি করে। এছাড়াও খেতে পারেন প্রচুর পরিমাণে শাকসবজি ও মৌসুমি ফল। আঁশসমৃদ্ধ, বিশেষ করে যেসব সবজি ও ফলে জলীয় অংশের পরিমাণ বেশি, সেগুলো বেশি করে খাওয়া উচিত।
পর্যাপ্ত পানি পান
পর্যাপ্ত পানি পান করলে একদিকে যেমন শরীর সুস্থ ও সতেজ থাকে, তেমনি ওজনও থাকে নিয়ন্ত্রণে। তাছাড়া পর্যাপ্ত পানি শরীর থেকে বর্জ্য এবং টক্সিনের মতো দূষিত পদার্থ বের করে দিতে সাহায্য করে।
পর্যাপ্ত পানি পান না করা হলে শরীর পানিশূন্য হয়ে পড়লে অনেক সময় মুখ ফুলে যেতে পারে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দৈনিক কমপক্ষে ৬৪ আউন্স (প্রায় ২ লিটার) পানি পান করা উচিত। পর্যাপ্ত পানি শুধু যে আপনার ত্বক এবং চুলকেই ভালো রাখবে তা নয়, বরং আপনার সমস্ত শরীরকে সতেজ রাখবে দিনভর।
পর্যাপ্ত ঘুম
শরীরকে নিয়ন্ত্রণের আরেক মোক্ষম উপায় হলো পর্যাপ্ত ঘুম। আমাদের সবার মধ্যে একটি প্রচলিত ধারণা আছে যে, প্রয়োজনের অতিরিক্ত ঘুম মুখের ফোলাভাব বৃদ্ধি করে। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষই যে বিষয়টি খেয়াল করেন না তা হলো অপর্যাপ্ত ঘুমও মুখের ফোলাভাবের জন্য দায়ী। কেননা ঘুম কম হলে ক্লান্তিতে আমাদের মুখমণ্ডলে ফোলাভাব চলে আসে।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, অপর্যাপ্ত ঘুম ওজন বৃদ্ধির পেছনে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাই প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দৈনিক কমপক্ষে ৭-৮ ঘন্টা ঘুমানো উচিত। শরীরকে সুস্থ রাখতে চাইলে একেক দিন একেক সময়ে নয়, বরং চেষ্টা করুন নিয়মিত একটি নির্দিষ্ট রুটিনে ঘুমানোর।
নিয়মিত শারীরিক অনুশীলন
সত্যি বলতে কি, আপনার শরীরের ওজন যদি নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারেন, তাহলে মুখমণ্ডলের মেদ বৃদ্ধি পাবে সেটাই স্বাভাবিক। তাই শরীরের ধরণ বুঝে প্রতিদিন নির্দিষ্ট কিছু সময়ের জন্য শারীরিক ব্যায়াম করতে পারেন। এতে করে যেমন শরীরের রক্তসঞ্চালন ভালো হবে, তেমনই শরীর থাকবে ছিমছিমে, মেদমুক্ত।
শারীরিক অনুশীলনের জন্য প্রতিদিন রুটিন করে একটি নির্দিষ্ট সময় বেছে নিতে পারেন। আপনার শরীরের ওজন যদি খুব বেশি না হয়, তবে প্রতিদিন ৩০-৪৫ মিনিট ব্যায়াম হতে পারে আদর্শ। এক্ষেত্রে হালকা শারীরিক কসরতের পাশাপাশি বেশ খানিকটা সময় দ্রুত হাঁটলেও ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে।
এছাড়াও কারো কারো ক্ষেত্রে শারীরিক অবস্থা স্বাভাবিক হলেও গালে ফোলাভাব দেখা যায়। এক্ষেত্রে মুখমণ্ডলের বেশ কিছু অনুশীলন রয়েছে যা মেদ ও ফোলাভাব কমাতে সাহায্য করে।
ফেসিয়াল ওয়ার্মআপ
মুখমণ্ডলের পেশীগুলোকে ওয়ার্ম আপ করানোর খুব সহজ এবং মজার একটি অনুশীলন রয়েছে। মেরুদণ্ড সোজা করে বসুন। এবারে ইংরেজী I, O, E, A উচ্চারণ করার চেষ্টা করুন। প্রতিটি বর্ণ বেশ কয়েকবার করে করুন। এটা বেশ ভালো কাজে দেয়।
ফিশ ফেস
এই অনুশীলনটি করার সময় ঠোঁটগুলোকে অনেকটা মাছের মতো করতে হয় বলে অনুশীলনটির এরকম নাম। আপনি টিভি দেখার সময় বা গান শুনতে শুনতে বা ঘরের অন্য যেকোনো কাজ করতে করতে এই অনুশীলনটি করতে পারেন। প্রথমে আপনার ঠোঁটগুলোকে সরু করে অর্থাৎ মাছের ঠোঁটের মতো করে গালকে মুখের ভিতরের দিকে টেনে নিন। এভাবে ধরে রাখুন ৩০ সেকেন্ড। এই প্রক্রিয়ার ১০বার পুনরাবৃত্তি করুন। দিনে অন্তত দুবার অনুশীলনটি করতে পারেন।
ফুঁ দেওয়া
প্রথমে মেরুদণ্ড সোজা রেখে বসুন। এরপর যতদূর সম্ভব মাথা পেছনের দিকে হেলিয়ে দিয়ে ছাদের দিকে মুখ করুন। এবার ঠোঁট সামনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে মুখ গোল করে ১০ সেকেন্ড ধরে ফুঁ দিন। টানা ১০ বার প্রক্রিয়াটির পুনরাবৃত্তি করুন। এই অনুশীলনটি গালের এবং গলদেশের মেদ কমাতে সাহায্য করে।
জিহ্বা দিয়ে নাক ছোঁয়া
প্রথমে সোজা হয়ে বসুন। না, আপনাকে জিহ্বা দিয়ে নাক ছোঁয়ার মতন প্রায় অসম্ভব কাজটি করতে হবে না। তবে জিহ্বা দিয়ে নাক ছোঁয়ার চেষ্টা করতে হবে যতদূর আপনি পারেন। এই প্রচেষ্টাটি ৫ বার করুন। এই অনুশীলন মুখমণ্ডলের পেশীকে টানটান করতে সাহায্য করে।
গাল ফোলানো
এই অনুশীলনে লম্বা শ্বাস নিয়ে মুখের মধ্যে বাতাস আটকে রাখতে হয়। প্রথমে লম্বা শ্বাস নিন। এবার আপনার ডানগালের দিকে আটকে রাখা বাতাস ঠেলে দিন, এরপর ঘড়ির কাটার দিকে অর্থাৎ যথাক্রমে উপরের দিকে, বাম গালে এবং থুতনির দিকে বাতাস ঠেলে দিন। প্রতিটি স্থানে বাতাস কমপক্ষে ৫ সেকেন্ড রাখুন। এই অনুশীলন আপনি সারাদিন যেকোনো সময়ে যেকোনো জায়গায় বসেই করতে পারেন। এতে গালের রক্তসঞ্চালন বৃদ্ধির পাশাপাশি চর্বিও কমে।
চুইংগাম চিবানো
নিয়মিত চুইংগাম চিবালে চোয়ালের এবং গালের মাংশপেশীর বেশ ভালো ব্যায়াম হয়। কেননা এতে করে গালের রক্তসঞ্চালন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয় বিধায় মেদ বা চর্বি জমতে পারে না এবং ফোলাভাবও অনেকটাই কমে আসে। তবে হ্যাঁ, চুইংগামটি অবশ্যই সুগারফ্রি বা চিনিবর্জিত হতে হবে।
নিচের ঠোঁট এবং চোয়ালের অনুশীলন
সোজা হয়ে বসুন। এবারে মাথা স্বাভাবিক অবস্থায় রেখে নিচের ঠোঁট উপরের দিকে এবং চোয়ালের নিচের অংশ সামনে দিকে ঠেলে দিন। ১০-১৫ সেকেন্ড এই অবস্থা ধরে রাখুন। পরপর ১০ বার এই অনুশীলনটি করুন। এতে মুখের পেশি সুগঠিত হয়।
এছাড়াও ইন্টারনেট ঘাঁটলে এমন আরো বহু অনুশীলন পাবেন যা মুখমণ্ডলের চর্বি কমাতে সাহায্য করে। তবে যে অনুশীলনই করুন না কেন, একদিন-দুদিনে কখনোই ফল পাওয়া যাবে না। এক্ষেত্রে নিয়মিত অনুশীলনই আপনাকে দিতে পারে একটি মেদবর্জিত মুখমণ্ডল। তাছাড়া যারা মুখমণ্ডলের গড়ন পাতলা দেখাতে চান তারা দুটি উপায় অবলম্বন করতে পারেন।
১) মেকআপ: মুখের ধরণ এবং গড়ন বুঝে প্রসাধনী ব্যবহারের মাধ্যমে মুখমণ্ডলকে সাময়িকভাবে তীক্ষ্ণ অবয়ব দেওয়া যায়।
২) চুলের কাটিং: চুল কাটার সময় দেখুন কোন কাটটি আপনার মুখমণ্ডলের সাথে মানানসই। কিছু কিছু কাট আছে যা আপনার মুখমণ্ডলের গড়নকে ভারী দেখায়। সেগুলো এড়িয়ে চলাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। উপরন্তু যে কাটগুলোতে মুখমণ্ডলের গড়ন পাতলা দেখায় সে ধরনের কাট বেছে নিতে পারেন।
কিছু অভ্যাস এবং অনুশীলন আপনার মুখের অতিরিক্ত ফোলাভাবকে কমাতে সাহায্য করতে পারে। তবে কখনো কখনো কোনো কোনো রোগ বা ঔষধের প্রভাবেও মুখ ফুলে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করা উচিত। আরেকটি ব্যাপার, আজকাল অনেকে সৌন্দর্য বর্ধনের আশায় ব্যয়বহুল প্লাস্টিক সার্জারির দ্বারস্থ হন। এর আগে একবার ভেবে নিন, এটা আপনার আদৌ ঠিক কতটা উপকার করছে এবং এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কী কী হতে পারে।
প্রতিটি মানুষই তার মতো করে সুন্দর। তাই এমন কিছু করবেন না যা আপনার নিজস্বতাকেই বদলে দেবে। তার চেয়ে বরং কসমেটিক সার্জারির বদলে বেছে নিতে পারেন সুষম খাদ্যাভ্যাস কিংবা অনুশীলনের মতো প্রাকৃতিক উপায়গুলো, যা একাধারে নিরাপদ এবং ফলদায়ক।
ফিচার ইমেজ সোর্স: healthtips