বিদ্যার্জনের জন্য অনেকেই দূরদেশে চলে যান। তবে অনেক এলাকায় দূরত্ব না হলেও নিত্যদিন দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে বিদ্যার্জনে যায় অগণিত শিশুরা। নিজ গ্রামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না থাকায় যেতে হয় অন্যগ্রামে। কখনও অনেক পথ পেরিয়ে, কখনো বা দুর্গম পাহাড়, নদী, বন পেরিয়ে চলে শিক্ষার্জন। ইউনেস্কোর এক প্রতিবেদনে জানা যায়, বিশ্বের প্রায় ৫৭ মিলিয়ন শিশু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যায় না। এছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ ও প্রত্যন্ত এলাকায় যাতায়াত ব্যবস্থার অভাবে অনেকেই পড়াশোনা মাঝপথেই ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়, বঞ্চিত হয় শিক্ষার আলো থেকে। এসব প্রতিকূলতা পেরিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়েও অনেক শিশু যদিও বা স্কুলগামী হয়, তবে তাদের জীবনের কোনো নিরাপত্তা নেই। এমন কিছু ভয়ঙ্কর ও দুর্গম পথের স্কুলগামী বাচ্চাদের সম্পর্কে আমরা জানবো আজ।
লেবাক, ইন্দোনেশিয়া
শুধুমাত্র জ্ঞান আহরণের জন্য কেউ সাতসমুদ্র পাড়ি দেয়? ইন্দোনেশিয়ার লেবাকে বসবাসকারী স্কুলগামী ছোট ছেলেমেয়েগুলো নিত্যদিনেই অতিক্রম করে ভঙ্গুর, অনিরাপদ কাঠের এক ঝুলন্ত সেতু। সাইবেরাং নদীর উপর অবস্থিত ব্যবহারের অনুপযোগী এই সেতুটিই তাদের স্কুলে যাওয়ার একমাত্র পথ। অন্য পথগুলোতে তাদের বেশ দূরত্ব পায়ে হেঁটে অতিক্রম করতে হয় বলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কোনোরকম ঝুলে ঝুলে সেতু পার হয়েই তারা স্কুলে যায়। তাদের এই কর্মকান্ড সাতসমুদ্র পাড়ি দেওয়ার মতোই দুঃসাহসী। এই খবর দেশে সাড়া জাগালে ইন্দোনেশিয়ার সর্ববৃহৎ স্টিল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ও কিছু এনজিওর উদ্যোগে ব্রিজ তৈরি করে দেয়া হয়।
রিও নেগরো, কলম্বিয়া
এ যেন কোনো মুভির দৃশ্য, হাজার হাজার ফুট উপর দিয়ে রশির সাহায্যে নদীর একপাশ থেকে গতি নিরোধকের সহায়তায় পৌঁছে যায় অন্যপাশে। কিন্তু বাস্তবেও এর দেখা মেলে। না, কোনো সিনেমায় বা অ্যাডভেঞ্চারে নয়। কলম্বিয়ায় রাজধানী বোগোটা থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার ভেতরে অবস্থিত বনে কিছু পরিবারের বাস।
নদী পেরিয়ে লোকালয়ে আসার পদ্ধতিটা বেশ ভয়ংকর। রিও নেগরো নদীর দু’প্রান্ত সংযুক্ত একটি স্টিলের ক্যাবল দ্বারা। প্রবাহমান নদীর প্রায় ৪০০ মিটার উপরে অবস্থির এই ক্যাবলটি প্রায় ৮০০ মিটার দীর্ঘ। এই ক্যাবলেই ঝুলে নদী অতিক্রম করতে হয় বাচ্চাদের শিক্ষালয়ে যেতে। সেখানে ফটোগ্রাফার ক্রিসটোফের তোলা তাদের পথ অতিক্রমের একটি ছবি বেশ হৃদয়কাড়ে সকলের। ছবিটিতে দেখা যায়, এক ৬-৭ বছরের মেয়ে পুলির সাহায্যে এগিয়ে যাচ্ছে। তার একহাতে রয়েছে গাছের ডাল দিয়ে তৈরি গতিরোধক বস্তু। গতিবেগ ঘন্টায় প্রায় ৫০ কিলোমিটার, যা যে কারো মনকেই ভীতসতস্ত্র করে তুলবে। তবে এখানেই শেষ নয়। মেয়েটার অপর হাতে একটি বস্তা দেখা যায়, সেখানে ছিল তার ছোট ভাই।
ঝাং জিওয়ান, দক্ষিণ চীন
সরু বাঁশের মই বেঁয়ে প্রায় ৮০০ মিটার উচু পাহাড় অতিক্রম করতে হবে একদিন স্কুলে পৌঁছাতে। অন্য পথ ধরলে আরো হাঁটতে হবে ঘন্টা চারেক। তাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মই বেঁয়ে ওঠাটাই তাদের কাছে সহজ মনে হয়, যদিও নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থাই নেই তাদের। দক্ষিণ চীনের ঝাং জিওয়ানে এভাবেই প্রতিদিন স্কুলে যায় সেখানকার বাচ্চারা। অভিভাবকদের সর্বদাই বাচ্চাদের জীবন নিয়ে চিন্তা করতে হয় সেখানে। এভাবে পথ পেরোতে সম্পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে এগোতে হয়, একটু এদিক ওদিক হলেই পা পিছলে একদম খাঁদে পড়ার আশঙ্কা। তারপরও নিরাপত্তাহীনভাবে ভয়ংকর পরিস্থিতি মোকাবেলা করেই চলছে তাদের শিক্ষার্জন।
পিলি, চীন
শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে অবগত হলে দূরবর্তী গ্রামের প্রায় ৮০ জন ছাত্রছাত্রীকে বোর্ডিংয়ে ভর্তি করেন তাদের অভিভাবকেরা। গ্রাম থেকে বোর্ডিংয়ে যেতে বাচ্চাদের পাড়ি দিতে হয় প্রায় ১২৫ মাইল দীর্ঘ পথ। যার অধিকাংশ সুউচ্চ পাহাড়ে বরফ কেটে বানানো সরু পথ। কিছু পথে রয়েছে বরফশীতল নদী, কোথাও ভাঙা তক্তাওয়ালা ব্রিজ। পাহাড়ঘেরা পথ অতিক্রমের সময় রয়েছে প্রায় ৬৫০ ফুট উঁচু চেইন ব্রিজ।
বিপদসংকুল এ পথে নেই কোনো নিরাপত্তার সরঞ্জাম। এত দীর্ঘ পথ অতিক্রমে তাদের সময় লাগে প্রায় ২ দিন। পথেই রাত্রিযাপন, পথেই জীবন বাজি রেখে এগিয়ে চলা; শুধুমাত্র নিজেকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে ৬-১৫ বছর বয়সী এ ছেলেমেয়েরা প্রতিনিয়তই এমন পরিস্থিতি মোকাবেলা করে এগিয়ে চলেছে।
ম্যানিলা, ফিলিপাইন
স্কুলে যাওয়ার একমাত্র পথ একটি নদী, কিন্তু নদী পার করতে নেই ব্রিজ বা নৌকা। ফিলিপাইনের ম্যানিলায় স্কুলগামী বাচ্চাদের নদী পেরোনোর একমাত্র উপায় টায়ার। প্রচন্ড বর্ষায় সেই পথও বন্ধ হয়ে যায় তাদের জন্য। বই-খাতা পানি থেকে বাঁচাতে পলিথিনের সাহায্য নিতে হয় তাদের। যেকোনো সময়ই দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, তাই প্রস্তুতিও রাখতে হয়। কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করে গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ ছেলেমেয়েকে মাঝপথেই ছেড়ে দিতে হয় স্কুল। ইউনিসেফের রেকর্ড অনুযায়ী, ফিলিপাইনে মাত্র ৬২ শতাংশ শিক্ষার্থী স্কুলজীবন শেষ করতে সক্ষম হয়।
মিনহ হোয়া, ভিয়েতনাম
প্রায় ১৫ মিটার চওড়া ও ২০ মিটার গভীর নদীতে সাঁতার কেটে প্রতিদিনই পার হয়ে যেতে হয় অপর প্রান্তে। না, কোনো সাঁতার শেখার স্কুলের ঘটনা নয় এটা। ভিয়েতনামে মিনহ হোয়া গ্রামের বাচ্চাদের কাছে এটা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এভাবে নদী পেরিয়েই তাদের যেতে হয় স্কুলে। এটা যেন খুব সাধারণ ব্যাপার তাদের কাছে। স্কুল ব্যাগে বইয়ের সাথে পরিধেয় জামাকাপড় পলিথিনে মুড়ে সাঁতরে পার হয় নদী। অপর প্রান্তে গিয়ে ভেজা জামা পাল্টে ব্যাগের শুকনো কাপড় পরে তারা যায় স্কুলে। পলিথিনে মোড়া ব্যাগগুলোই দীর্ঘ নদীপথে তাদের ভাসিয়ে পাড়ে পৌঁছাতে বিশেষভাবে সাহায্য করে।
কিলাংক্যাপ, ইন্দোনেশিয়া
যাতায়াতের একমাত্র পথ চিহেরাং নদীর ব্রিজ ভেঙে যাওয়ায় বিকল্প ব্যবস্থা হিসাবে একটি বাঁশের পাটাতনের সাহায্যেই নদী পার হচ্ছে সেখানের বাচ্চারা স্কুলে যাওয়ার জন্য। ২০১৩ সালে ব্রিজটি ভেঙে গেলেও কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় মেরামত হয়নি ব্রিজটি। তাই তারপর থেকে বাঁশের এই ঝুকিপূর্ণ ভেলাই তাদের যানবাহন।
চেরাপুঞ্জি, ভারত
পৃথিবীর বিপদজনক সেতুর তালিকায় অন্যতম ভারতের মেঘালয় রাজ্যের চেরাপুঞ্জি গ্রামে অবস্থিত গাছের শেকড়ের সেতু। সেখানে বসবাসকৃত নৃগোষ্ঠীর সদস্যরা গাছের শিকড়কে এমনভাবে বাড়তে দিয়েছেন যা নির্দিষ্ট দিকে বেঁকে ব্রিজের মতো তৈরি করে। স্থানীয়দের মতে, সেগুলো লম্বায় ৩০ মাইলের মতো হয়ে থাকে।
এই ব্রিজগুলো ‘জীবন্ত সেতু‘ নামে পরিচিত। কিছু কিছু সেতু প্রায় ১০০ বছরের পুরনো। দুর্গম পথের কারণে ব্রিজ তৈরির উপকরণও সেখানে পাঠানো সম্ভব নয়। তাই শিকড়ের তৈরি এই ব্রিজ পাড় হয়েই প্রতিদিন ছোট ছেলেমেয়েদের স্কুলে যেতে হয়। সাধারণ অবস্থাতেই এই শিকড়ের উপর হাঁটা বেশ কষ্টসাধ্য। এছাড়া মেঘলয় বিশ্বের অন্যতম বৃষ্টিপাতের এলাকা হিসেবেও পরিচিত। ফলে সেতুগুলো প্রায়ই পিচ্ছিল থাকে, যা অতিক্রম করা বাচ্চাদের জন্য আরো বিপদজনক হয়ে ওঠে।
শিক্ষার্জন এদের কাছে সত্যিই যেন সাধনার মতো। নিজেকে আলোকিত করতে জীবনের ঝুঁকি নিয়েই এগিয়ে চলে। এই বাচ্চাদের না আছে কোনো নিরাপত্তার সরঞ্জাম, না কোনো বিকল্প পথ। অনিরাপদ, ভয়ংকর এসব রাস্তাই তাদের নিয়ে যায় গন্তব্যে। তাই তাদের কাছে এটাই স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। সুন্দর, নিরাপদ পথের কথা হয়তো তাদের চিন্তারও বাইরে। সবসময় দুর্ঘটনার আতংক, জীবন বিপর্যয়ের হাতছানি নিয়েই তারা বড় হয়। তারপরেও থেমে নেই ক্ষুদে সাহসীদের পথচলা।
ফিচার ইমেজ- photoblog.nbcnews.com, kid101.com, heguardian.com, amusingplanet.com