আমাদের দেশীয় ফল হিসেবে পেঁপে পাওয়া যায় অহরহ। সুস্বাস্থ্য রক্ষায় এবং রূপচর্চায় পেঁপের গুণাগুণ অতুলনীয়। পেঁপের এসব গুণাগুণ ও কিছু পরামর্শ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে আমাদের আজকের লেখাটিতে।
পেঁপের বৈশিষ্ট্য
ফাইবারের উৎস
পেঁপে হলো ফাইবারের দারুণ একটি উৎস। আর ফাইবার কোলনে সেসব বিষাক্ত পদার্থ শোষণ করে যেগুলো ক্যান্সারের সম্ভাবনা বাড়ায়। ফাইবার সেগুলো শোষণ করে শরীর থেকে বের করে দেয়। পেঁপের উচ্চ মাত্রার ফাইবার হজম শক্তি বাড়ায় এবং ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।
ভিটামিন ও মিনারেলস
পেঁপেতে আছে প্রচুর ভিটামিন সি ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। এটি ক্ষত নিরাময়ে সাহায্য করে, অক্সিডেটিভ চাপের কারণে হওয়া ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায় এবং সাধারণত হওয়া অসুখ বিসুখ যেমন- কাশি, ঠাণ্ডার রোগগুলোর প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। এই ফলটি ভিটামিন এ ও বিভিন্ন মিনারেল যেমন ফসফরাস, আয়রন, পটাসিয়াম, কপার, ম্যাঙ্গানিজ, ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়ামের উৎস। ভিটামিন এ দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখে আর ফসফরাস হৃদপিণ্ডকে সুস্থ রাখে।
অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের উৎস
শুকনো পেঁপেতে যে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট আছে তা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং শরীর থেকে জীবাণু বের করে দেয়। এই ফলটিতে গাজরের চাইতে অধিক পরিমাণে বেটা-ক্যারোটিন রয়েছে।
পর্যাপ্ত পরিমাণে বায়োফ্ল্যাভোনয়েড
ভিটামিন পি হিসেবেও পরিচিত এই উপাদানটি শরীরে জৈবিক পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়া দেয়। এতে থাকা বায়োফ্ল্যাভোনয়েডগুলো ভাইরাস ও প্রাণনাশক রোগের প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে।
ত্বকের যত্নে পেঁপে
পেঁপেতে যে এনজাইম রয়েছে তা ত্বককে নিখুঁত করে তোলে। এছাড়াও এটি ত্বকের বিভিন্ন রকম দাগ কমায় এবং ব্রণ ও বলিরেখা হওয়ার প্রবণতা কমায়। ত্বকের যত্নে পেঁপের আরও কিছু গুণাগুণ নিচে দেওয়া হলো।
- ত্বকের ময়েশ্চারাইজার বজায় রাখতে সাহায্য করে। শুষ্ক ত্বকের জন্য পেঁপে অনেক উপকারী। পেঁপে চটকিয়ে তা ত্বকে ব্যবহার করলে ত্বক নরম ও কোমল হয়। পেঁপেতে থাকা এনজাইম ত্বকের শুষ্কতা ও রুক্ষতা দূর করে ত্বককে হাইড্রেটেড রাখতে সাহায্য করে।
- পেঁপের ফেস মাস্ক বানাতে দরকার ১ টেবিল চামচ চটকানো পেঁপে ও ১ চা চামচ মধু।
- প্রথমে পেঁপে ও মধু একসাথে মিশিয়ে নিন।
- এবার এই মিশ্রণটি মুখে লাগিয়ে ৩০ মিনিট অপেক্ষা করুন।
- এরপর ঠাণ্ডা পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে ফেলুন।
মুখের দাগ দূর করে
ব্রণ চলে গিয়েছে কিন্তু দাগ রয়ে গিয়েছে! এই সমস্যায় জর্জরিত মানুষের সংখ্যা কম নয়। যেকোনো ধরনের দাগ সহ ব্রণের দাগ ও ক্ষত খুব সহজেই মুছে ফেলার জন্য পেঁপে বেশ কার্যকরী। পেঁপেতে রয়েছে ত্বকের দাগ হালকা করার বিশেষ উপাদান। এছাড়াও রয়েছে বেটা-ক্যারোটিন, এনজাইম ও ফাইটোকেমিক্যালস্ যা ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ায়। এতে যে পেপেইন নামক এনজাইম আছে তা আলফা-হাইড্রক্সি এসিডের সাথে মিশে শক্তিশালী এক্সফোলিয়েটর হিসেবে কাজ করে এবং অকেজো বা নিষ্ক্রিয় প্রোটিন এবং ত্বকের মৃত কোষগুলোকে দ্রবীভূত করে। এতে ত্বক হয় নমনীয় ও মসৃণ।
এই ফেস মাস্ক বানাতে চাই ১ টেবিল চামচ পেঁপের রস ও কটন বল (তুলা)।
যা করতে হবে:
- তুলাগুলোকে পেঁপের রসে ভিজিয়ে নিন।
- এরপর যেখানে দাগ বা ক্ষত রয়েছে সেখানে লাগান।
- ১৫ মিনিট পর ঠাণ্ডা পানি দিয়ে মুখ পরিষ্কার করে ফেলুন।
ত্বকের দাগ দূর করতে নিচের পদ্ধতিটিও অবলম্বন করতে পারেন।
যা প্রয়োজন
- ১/৪ কাপ পেঁপের ক্বাথ
- ১ টেবিল চামচ মধু
- ১/২ চা চামচ লেবুর রস
যা করতে হবে
১। পেঁপে এমনভাবে চটকান যেন দানা দানা না থাকে।
২। এর সাথে লেবুর রস ও মধু ভালোভাবে মিশিয়ে নিন।
৩। প্রথমে ভালো করে মুখ ধুয়ে শুকিয়ে নিন।
৪। এরপর এই মাস্কটি মুখে লাগিয়ে ১৫-২০ মিনিট অপেক্ষা করুন।
৫। কুসুম গরম পানি দিয়ে এই মাস্কটির ওপর হালকাভাবে ম্যাসাজ করুন।
৬। এরপর ঠাণ্ডা পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।
৭। উজ্জ্বল ত্বক পেতে সপ্তাহে অন্তত একদিন এই মাস্কটি ব্যবহার করুন।
বলিরেখা কমাতে সাহায্য করে
পেঁপের খোসা ত্বকে বয়সের ছাপ দূর করতে সাহায্য করে। এর খোসায় যেসব এনজাইম রয়েছে সেগুলো ত্বক থেকে মৃত কোষ দূর করে। এছাড়াও এটি বলিরেখা ও দাগ দূর করতে সাহায্য করে।
যা প্রয়োজন
- পেঁপের খোসা
ব্যবহারের উপায়
১। পেঁপের খোসাটি দিয়ে পুরো মুখ ও ঘাড়ে ঘষা দিন।
২। ২০ মিনিট পর ঠাণ্ডা পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।
চোখের নীচের ও চারপাশের কালো দাগ দূর করে
কাঁচা পেঁপের ক্বাথ চোখের চারপাশের কালো দাগ দূর করার জন্য বেশ উপকারী। যেহেতু এতে প্রাকৃতিকভাবে ব্লিচিং করার উপাদান রয়েছে। তাই এটি সহজেই ত্বকের অবাঞ্ছিত দাগ দূর করতে সাহায্য করে।
যা প্রয়োজন
- ১/৪ কাপ চটকানো কাঁচা পেঁপে
যা করতে হবে
১। চটকানো কাঁচা পেঁপেটি চোখের কালো দাগের ওপর লাগিয়ে কমপক্ষে ১০ মিনিট অপেক্ষা করুন।
২। এরপর আঙুলের ডগা দিয়ে হালকাভাবে ঘষে পরিষ্কার একটি পাতলা কাপড় দিয়ে তুলে ফেলুন।
৩। কুসুম গরম পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।
৪। নিয়মিত করার ফলে চোখের নীচের ও চারপাশের কালো দাগ দ্রুত দূর হয়ে যাবে।
রোদে পোড়াভাব দূর করে
পেঁপেতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ ও সি। প্যাপেইন নামক এনজাইমের সাথে এই দুটি ভিটামিন মিশে ত্বকের রং হালকা করার চেষ্টা করে। নিচের এই পদ্ধতিটি কয়েকবার ব্যবহার করলেই ত্বকের রোদে পোড়াভাব কমে যাবে।
যা প্রয়োজন
- চার টুকরো পাকা পেঁপে
- ১ টেবিল চামচ কাঁচা হলুদ
- ১ টেবিল চামচ মধু
পদ্ধতি
১। পাকা পেঁপের টুকরোগুলো চটকে নিন।
২। এতে কাঁচা হলুদ ও মধু মিশিয়ে নিন।
৩। ঘন মিশ্রণ তৈরি করে নিন।
৪। মুখ পরিষ্কার করে লাগিয়ে ২০-৩০ মিনিট অপেক্ষা করুন।
৫। কুসুম গরম পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।
৫। স্বাস্থ্যসম্মত ও উজ্জ্বল ত্বক পেতে এই পেস্টটি সপ্তাহে অন্তত একদিন অবশ্যই ব্যবহার করুন।
চুলের যত্নে পেঁপে
লম্বা ও স্বাস্থ্যোজ্জ্বল চুল পেতে পেঁপের তুলনা নেই। পেঁপে দিয়ে কীভাবে চুলের যত্ন নেবেন তা জেনে নিন।
চুল বৃদ্ধিতে সাহায্য করে
পেঁপেতে রয়েছে ফলিক এসিড যা চুলের ফলিকলের সঞ্চলন বাড়িয়ে চুলের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। তাই ঘন ও স্বাস্থ্যোজ্জ্বল চুল পেতে প্রতিদিনের খাবার তালিকায় পেঁপে রাখতে অবশ্যই ভুলবেন না।
খুশকি নিয়ন্ত্রণ করে
যেকোনো হেয়ার প্যাকের সাথে পেঁপের বিচি ব্যবহার করে দেখুন! মাথার খুশকি একেবারেই চলে যাবে। খুশকির অন্যতম মূল কারণগুলোর মধ্যে একটি হলো ফাঙ্গাল ইনফেকশন। পেঁপের বিচিতে যে অ্যান্টিফাঙ্গাল উপাদান রয়েছে তা খুশকি নিয়ন্ত্রণ ও নিরাময়ে কাজ করে।
যা প্রয়োজন
- একটি পেঁপের অর্ধেকটা বিচি সহ
যা করতে হবে
- পেঁপের খোসা ছাড়িয়ে বিচি সহ একদম মিহি করে ব্লেন্ড করে নিন।
- এই প্যাকটি মাথার তালুতে ম্যাসাজ করে বাকিটুকু পুরো চুলে লাগিয়ে নিন।
- এক ঘণ্টা রেখে শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।
চুলের কন্ডিশনার হিসেবে কাজ করে
পেঁপে চুলে প্রাণ ফিরিয়ে আনে এবং চুলকে রাখে নরম ও হাইড্রেটেড। পেঁপেতে যে ভিটামিন এ আছে তা সিবাম তৈরিতে সাহায্য করে। সিবাম হলো শরীরের প্রাকৃতিক তেল এবং এটি চুলের কন্ডিশনার হিসেবে কাজ করে।
যা প্রয়োজন
- একটি পাকা পেঁপের অর্ধেকটা
- আধা কাপ টক দই
যা করতে হবে
১। পেঁপের বিচি ও খোসা ছাড়িয়ে ব্লেন্ড করে নিন।
২। এতে টক দই মিশিয়ে নিন।
৩। চুলের গোঁড়া থেকে শুরু করে আগা পর্যন্ত ভালো করে লাগিয়ে নিন।
৪। এক ঘণ্টা পর শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।
ফিচার ইমেজ: One Green Planet