পৃথিবী সত্যিই ঢের বদলেছে। জলবায়ুর পরিবর্তন, নিত্যনতুন প্রযুক্তির অবতারণা, মানবজাতির জীবনযাত্রার বদল সবই ঘটে চলেছে অবিরাম। জীবনটাকে চালিয়ে নেয়ার জন্য কাজ চাই, আর ক্রমাগত বদলে চলা পৃথিবীতে কাজের জায়গাও বদলাচ্ছে পাল্লা দিয়ে। চাকরি, ব্যবসা, কাজ বলতে এসবই বোঝেন এমন মানুষ এখনো প্রচুর আছে। কিন্তু আসলেই কি তাই? যুগের সাথে সামান্য তাল মিলিয়ে চলা যেকোনো মানুষই কিন্তু এমন বাক্য শুনলে কিঞ্চিৎ হাসবেন। কেননা কর্মক্ষেত্র এখন আর অফিস কিংবা কলকারখানার দেয়ালের মাঝে সীমিত নেই, আর এই পরিবর্তন এসেছে অনেক বছর ধরেই।
কর্মোদ্যম জনশক্তির বেশ বড় একটা অংশ মুক্ত কর্মক্ষেত্রে জীবিকা নির্বাহ করতে স্বচ্ছন্দ বোধ করছেন। ফ্রিল্যান্সিং বলা হয় যেটাকে, অর্থাৎ একজন ব্যক্তি নিজের সুবিধা মতন জায়গা থেকেই সম্পন্ন করতে পারেন তার কাজ, অফিসে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। অনলাইন জগতে এরকম কর্মক্ষেত্র সংখ্যায় প্রচুর, আর বর্তমানের প্রযুক্তিনির্ভর সময়ে এই রকম কাজের ক্ষেত্র বেড়েই চলেছে। সেই সাথে বাড়ছে কাজে আগ্রহী মানুষ। এছাড়াও উদ্যোক্তা হিসেবে কর্মজীবন গড়ছেন যারা, তারাও অফিসের রুটিনবাঁধা জীবন থেকে মুক্ত। কিন্তু ভাবার বিষয় হচ্ছে, অফিসের রুটিন থেকে মুক্তি পেয়ে কি খুব একটা লাভ হচ্ছে তাদের? নাকি রুটিনবিহীন কাজের এই জীবনটাই সবকিছু আরো অগোছালো করে তুলছে, সমস্যার সৃষ্টি করছে ব্যক্তি জীবনেও? এসব নিয়ে ভাবার কারণ আছে বটে!
দৃশ্যকল্প-১
রিয়াদ বেশ কয় বছর ধরেই ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করছেন। কম্পিউটার বিদ্যায় প্রকৌশলী হিসেবে পড়ার পাট চুকিয়ে কিছুদিন চাকরি করেই আর ভালো লাগেনি সেই জীবন। তারপর থেকে চলছে ফ্রিল্যান্সিং। ভেবেছিলেন জীবনটা মুক্ত থাকবে, সময়ের হিসাবনিকাশ নিজের কাছেই থাকবে কেবল। দশটা-পাঁচটার ভোঁদৌড় তার পোষাবে না! এখন রিয়াদের রাতেও কাজ, দিনেও কাজ, কখন যে তার অবসর নিজেও ভেবে পান না! একেকটা প্রকল্পের কাজ শেষ করে কয়টা দিন ছুটিতে থাকেন ঠিকই, কিন্তু তখন শরীর কেবলই বিশ্রাম চায়। ঘুরতে যাওয়া, পরিবারকে নিবিঢ়ভাবে কিছুটা সময় দেয়া, হয়ে উঠছে কিছুই। তবে কি চাকরি বাদ দিয়ে মুক্ত কর্মজীবী হওয়াটা ভুল হলো তার?
দৃশ্যকল্প-২
দোলন একজন অনলাইন উদ্যোক্তা। দেশিয় শাড়ির আয়োজন নিয়ে তার পথচলা। অনলাইন পেজটাকে বেশ সাজিয়ে-গুছিয়ে নিয়েছেন দুই বছরে। তাঁতির কাছে শাড়ি বুনতে দেয়া, সুতি শাড়িতে নিজের নকশায় ব্লকের কাজ করানোর পাশাপাশি ইদানিং কাজের পরিসর বাড়াতে হ্যান্ডপেইন্টিং করানোও শুরু করেছেন শাড়িতে। কিন্তু কাজের সাথে পাল্লা দিয়ে অসুবিধাও বাড়ছে তার। দীর্ঘ সময় অনলাইনে কাটানো হচ্ছে, বসে থাকা হয় একটানা, এসবের পরিণাম হিসেবে দেখা দিচ্ছে নানা শারীরিক অসুবিধাও। অথচ কাজটাই তো এরকম!
অফিসের বাইরে, বিশেষ করে বাড়িতে থেকেই নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছেন যারা, তাদের কর্মজীবন অপেক্ষাকৃত সহজ দেখালেও পুরো বিষয়টা অতোটা সহজ নয়! একটানা কাজের চাপে শারীরিক ও মানসিক সমস্যা তাদেরও হয়ে থাকে। কাজের বাঁধাধরা সময় না থাকায় অনবরত কাজ করে যাওয়ার অভ্যাস তৈরি হয়, নিজের প্রতি খামখেয়ালি থাকার সুযোগ বেড়ে যায় অনেক বেশি, আর এগুলো মোটেও ভালো ফল বয়ে আনে না। এই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে সেসকল মুক্ত কর্মজীবীদের জন্য টুকিটাকি পরামর্শ যা তাদের নিজেদের যত্নে অবশ্যই করণীয়। মুক্তভাবে কাজ করা অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের নানা পরামর্শ নিয়ে সাজানো মূল প্রতিবেদনটি থেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি তুলে আনা হয়েছে এখানে।
নিজেই বেঁধে দিন কাজের সময়সীমা
যেহেতু আপনি বাড়িতে থেকেই কাজ করছেন, সময়ের ব্যাপারটা মাথায় না রাখাই স্বাভাবিক। একটা কাজ নিয়ে দুপুরে বসেছেন, নাওয়া-খাওয়া শিকেয় তুলে সন্ধ্যা পার করেও বসেই আছেন সেটা নিয়ে। কাজ তো হচ্ছে ঠিকই কিন্তু শরীরটা যে বিগড়াচ্ছে, সে খেয়াল আছে? অফিসে যাচ্ছেন না, সময়ের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করছেন, খুব ভালো বিষয়। কিন্তু এই স্বাধীনতা যেন আপনাকে অন্যান্য দিকে বিপর্যস্ত না করে ফেলে সেটা নিশ্চিত করুন। গোটা দিনটাই কাজে ডুবে থাকা খুব ভুল একটা চর্চা। অফিসের মতনই নিজের কাজের সময়সীমা নির্ধারণ করুন তাই।
নির্ধারণ করুন কর্মবিরতির নির্দিষ্ট সময়টুকুও। একটানা বসে থেকে কাজ করা যে শরীরের পক্ষে ভালো নয়, তাও কি নতুন করে বলতে হবে? প্রতিটা কর্মদিবসের শুরুতে আধা ঘন্টার সময় দিন নিজেকে, যেসমস্ত কাজ সেদিন করবেন সেগুলো নিয়ে ভাবনাচিন্তা গুছিয়ে নিন, এটা বেশ সাহায্য করে কাজে।
শরীরচর্চা চাই নিত্য
মুক্ত কর্মজীবী যারা, আক্ষরিক অর্থেই শুয়েবসে কাজ করার অভ্যাস তৈরি হয় তাদের। ক্লায়েন্টের সাথে খুব জরুরি মিটিংটাও তারা সেরে নেন বিছানায় আয়েশি হেলান দিয়ে। খুব সুবিধা তাইনা? এর হাত ধরে রাজ্যের অসুবিধাও আসছে কিন্তু! এহেন শুয়েবসে কাটানো জীবনযাত্রায় আপনার শরীরে বাসা বাঁধতে পারে অনেক রোগবালাই। শরীর সুস্থ রাখতে তাই নিত্যের জীবনযাত্রায় রাখুন কিছু শরীরচর্চা। হোক সেটা কোনো ব্যায়াম, অথবা স্রেফ কিছুদূর হেঁটে আসা। তাছাড়া রোজ বাইরে হাঁটতে যাওয়ার অভ্যাস করলে কাজের কারণে ঘরে থাকার প্রবণতাও কিছুটা কমবে।
মধ্যাহ্নভোজনের বিরতি
মধ্যাহ্নভোজন, মানে বুঝেছেন তো? দুপুরের পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্যগ্রহণের প্রক্রিয়ার কথা বলা হচ্ছে, নাকেমুখে কোনোমতে খাবারের কণা গুঁজে দেয়া নয়! সময়ের চিন্তা ভুলে কাজ করতে করতে সবই ভুলে বসবেন না। দুপুরের খাবারের জন্য প্রয়োজনের সময়টুকু রাখুন প্রতিদিন। কাজের টেবিল থেকে দূরে বসে শান্তিতে আহার করুন।
দিনের অর্থপূর্ণ সূচনা
সকালে দিন শুরু করার সময়টাকে অর্থপূর্ণ বানান। যেহেতু তারপরের গোটা দিনটা আপনি প্রায় নিজেকেই ভুলতে যাবেন, তাই ব্যস্ত দিন শুরু করার আগে কিছুটা সময় নিজের জন্য নিন। দিনের এই ভাগে সেসব কাজ রাখুন যা আপনাকে মানসিক প্রশান্তি দেবে। সেটা হতে পারে ছাদে কাটানো খানিকটা সময়, কিংবা যোগব্যায়াম, গান শোনা, এমন যেকোনো কিছুই।
কাজ করার নির্দিষ্ট জায়গা
পুরো বাসাকে কর্মক্ষেত্রে পরিণত করার সিদ্ধান্ত মোটেও ভালো কিছু নয়। বিছানায় ছড়িয়েছিটিয়ে আছে কাগজপত্র, খাবারের টেবিলে ল্যাপটপ, এমন চিত্র একটা সুন্দর কাজের পরিবেশে মানায় না। বাসা থেকে কাজ পরিচালনা করার ক্ষেত্রে ব্যক্তিজীবন আর কর্মজীবন দু’টোই মিলেমিশে আরো অগোছালো হয়ে যায় গোটা জীবন! আর তাই এই দুইয়ের মাঝে রেখা টানতে হয় নিজেকেই। সময়ের ক্ষেত্রে যেমন, কাজ করার জায়গার ক্ষেত্রেও ঠিক তাই করা প্রয়োজন। নিজের কাজ করার পক্ষে উপযোগী নির্দিষ্ট জায়গা বেছে নিন বাসায়। আরাম করার আর কাজ করার জায়গা আলাদা রাখাটা খুব জরুরি। ঘুমোতে যাওয়ার সময় ইন্টারনেটকে ছুটি দিন, ল্যাপটপ রেখে আসুন কাজের টেবিলেই।
চলমান থাকুক জীবন
বাড়ি বসে কাজ করার সুযোগে নিজেকেই বাড়ির মতন অচল ভাবতে শুরু করবেন না! অফিসে যাচ্ছেন না, সেই যাতায়াত থেকে মুক্তি পাচ্ছেন, তাই বলে স্থবির হয়ে যাচ্ছেন না কিন্তু। কাজ নিয়ে বসলেন তো বসেই রইলেন, এ ভারী বদ অভ্যাস! একটু হেঁটেচলে বেড়ান। পুরো দিনজুড়ে চলাফেরার মাঝেই রাখুন নিজেকে। একটানা টেবিলে বা সোফায় বসে কাজ করতে থাকলে নানা রকম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়বেন এক সময়। প্রতি আধ ঘন্টা অন্তর বিরতি নিয়ে একটু হাঁটুন, বা অন্য কাজ করুন। মাংসপেশি আর রক্তপ্রবাহকে সচল থাকতে সাহায্য করুন।
তৈরি থাকুন বাইরে যেতেও
বাড়ি বসে কাজ করার আরেক সুবিধা, এবং পরবর্তীতে বাজে অভ্যাসে পরিণত হওয়া আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে আলুথালু বেশ। ঘুম ভেঙ্গে হাতমুখ ধুয়ে নাস্তাটা করে কিংবা না করেই কাজ শুরু করছেন, গায়ে অগোছালো পোশাক, কখনো কখনো গোটা দিনটাই সেই বেশে পার হচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে এটাকে সুবিধা মনে হলে এই অভ্যাস কিন্ত আপনার কর্মোদ্যমে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। অভিজ্ঞরা এক্ষেত্রে পরামর্শ দিচ্ছেন অফিসে যাওয়ার মতোই তৈরি হয়ে কাজ শুরু করতে। অতোটা বাড়াবাড়ি মনে হলে অন্তত কিছুটা তো মেনে চলুন, চেষ্টা করুন নিজেকে পরিপাটি রাখতে। তৈরি থাকুন প্রয়োজনে দ্রুততম সময়ে বাইরে যাওয়ার জন্যে।
পর্যাপ্ত ঘুম চাই
এমন অগোছালো কর্মীদের জীবনযাত্রায় ঘুমের ব্যাঘাত ঘটবে, সেটাও অবধারিত! সেটা ঠিক করতে হবে কঠোরভাবে। ঘুমানোর নির্দিষ্ট সময়ে খুব জরুরি না হলে কাজকে টেনে নিয়ে যাবেন না। খেয়াল রাখা চাই, কর্মোদ্যম বজায় রাখার স্বার্থে সবার আগে একটা সুস্থ শরীর প্রয়োজন। আর পর্যাপ্ত ঘুম, সঠিক খাদ্যাভ্যাস এগুলো বাদ দিয়ে সুস্থতার আশা তো করা যাবে না। বাকি জীবন কাজই বা চলবে কীভাবে?