শিশুর জন্মের পর থেকেই বাবা-মা তাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। কীভাবে বড় করবে, কীভাবে কথা বলা শেখাবে, কীভাবে পড়তে শেখাবে, কীভাবে লিখতে শেখাবে– এরকম আরো কত চিন্তা-ভাবনা যে মাথায় ঘুরপাক খায়। এতসব শেখাতে গিয়ে বাবা-মায়েদের অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। হওয়াটাই স্বাভাবিক। শিশুরা তো আর বড়দের মতো করে চিন্তা করতে পারে না। কিছু বললেই তারা চট করে বুঝে ফেলতে পারবে না। তাদের কাছে পুরো পৃথিবীটা নতুন। তারা চায় পৃথিবীটাকে একদম নতুন করে নিজেদের মতো করে শিখতে।
একটি শিশু যখন ৫-৬ বছর বয়সী হয়, তখন মা-বাবা তাকে স্কুলে দেয়ার কথা চিন্তা করে। তবে এর আগেই ঘরে তাকে কিছু শিক্ষা নিতে হয়। এই শিক্ষাকে বলে স্কুলপূর্ব শিক্ষা। মূলত পরিবার থেকেই এই শিক্ষা পেয়ে থাকে শিশুরা।
শিশুদের শিক্ষার দুটি ধাপ থাকে। শিক্ষাবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে, স্কুলে যাওয়ার আগেই শিশুরা তার চারপাশের পরিবেশ থেকে কিছু শিক্ষা নিয়ে যায়। এটি তাকে স্কুলের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সাথে মানিয়ে নিতে সাহায্য করে। বাচ্চারা স্কুলে যাওয়ার আগে পরিবেশ এবং পরিবার থেকে যে শিক্ষা নেয়, তা হলো প্রাথমিক জ্ঞান। এটি তার সম্পূর্ণ মেধা বিকাশের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটিকে শিশুর প্রগতিশীল উন্নয়নের অংশ হিসেবে ধরা হয়। নিচের ছবিটি দেখলেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে।
বুঝতেই পারছেন শিশুর মেধার ও মননের পূর্ণ বিকাশের জন্য স্কুলপূর্ব শিক্ষা সুষ্ঠুভাবে হওয়া কতটা জরুরি। এই শিক্ষার উপরই শিশুর প্রাথমিক চিন্তা ও বুদ্ধির বিকাশ নির্ভর করে। এখন জানা দরকার আপনার শিশুর জন্য স্কুলপূর্ব শিক্ষার ব্যবস্থা কীভাবে করতে পারবেন।
রঙ নিয়ে খেলা
সব শিশুই রঙ নিয়ে খেলতে পছন্দ করে। তাদের জীবনটাই তো রঙিন! কিন্তু কোনটা কোন রঙ তা শেখানো হলো এক ঝামেলা। এর জন্য কী করতে পারেন? বাচ্চাদেরকে ক্ষতিকর নয় এমন কিছু রঙ কিনে দিন। এগুলো দিয়ে কী করতে হয় তা দেখিয়ে দিন এবং কোনটা কোন রঙ তা বলে দিন। কিন্তু তারা তো সহজে এগুলো বুঝতে পারবে না। সেজন্য নিচের মজার উপায়টি দেখুন।
এজন্য আপনার লাগবে কয়েকটি পেপার রোল, বিভিন্ন রঙিন কাগজ, কয়েকটি ছোট প্লাস্টিকের বাটি, বিভিন্ন রঙিন বল আর পেপার রোল ঝুলানোর জন্য সুতা। পেপার রোলগুলো রঙিন কাগজ দিয়ে মুড়িয়ে নিন। তারপর ঝুলিয়ে দিন। বাচ্চাদের শিখিয়ে দিন কোনটা কোন রঙ। একটা বল দেখিয়ে বলুন এটা সবুজ রোলটিতে ফেলো। তখন তারা রঙ চিনে ঠিক জায়গায় বলটি ফেলতে পারছে কিনা দেখুন। এভাবে তাদের খেলাও হবে আবার রঙও শেখা হবে।
সংখ্যা পরিচিতি
বাচ্চাদের পড়ালেখা শেখানোর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো তাদের সংখ্যার সাথে পরিচয় করানো। একটি প্রশ্ন বড়রা প্রায়ই বাচ্চাদের করে থাকে।
– বাবু, তোমার বয়স কতো?
– ৫ বছর।
এই ৫ বছর বলতে পারার জন্য তাকে বিভিন্ন মানের সংখ্যার সাথে পরিচিত হতে হয়। এখন, তাকে কীভাবে এসব সংখ্যার সাথে পরিচয় করানো যায়? বাজারে সংখ্যার আকৃতিতে বানানো রাবার বা প্লাস্টিকের খেলনা কিনতে পাওয়া যায়। সেগুলো দিতে পারেন। আপনার শিশু সেগুলো নিয়ে খেলবে এবং বিভিন্ন সংখ্যার সাথে পরিচিত হবে। এছাড়াও তাকে প্রতিদিন একটি করে সংখ্যামানের সাথে পরিচয় করাতে পারেন। যেমন, প্রথম দিন শেখালেন ১টি বিড়াল, ১টি গাড়ি। দ্বিতীয় দিন শেখালেন ২টি হাত, ২টি চোখ। এভাবে শেখালে শিশুর জন্য শেখাটা সহজ হবে।
অক্ষর পরিচিতি
– বাবু তোমার নাম লিখো তো।
শিশুকে তার নাম লেখার আগে তো তাকে অক্ষর চিনতে হবে। কিন্তু সে তো আর এত সহজে চিনতে পারবে না। চেনার মাঝে আনন্দ না থাকলে সে চেনাটা সহজও হবে না তার জন্য। শিশুদের পড়ালেখা শেখানোর মধ্যে সবচেয়ে কঠিন সম্ভবত এই অক্ষর চেনানো। এই কাজটিকে সহজ করার জন্য সংখ্যা চেনানোর মতো করেই বিভিন্ন আকৃতির অক্ষর কিনে আনতে পারেন। শিশুদের জন্য ‘অক্ষরলিপি’র বিভিন্ন বই কিনে আনতে পারেন। বাচ্চাদের সময় দিয়ে একটি একটি করে অক্ষরের সাথে পরিচয় করান এবং সেই অক্ষর দিয়ে কী কী শব্দ বানানো যায় তা দেখান।
এগুলো তো ধরাবাধা নিয়ম। মজা করে শেখানোর কী ব্যবস্থা করা যায়? সহজ কিছু পদ্ধতি আছে। তাদের সাথে অক্ষর মেলানোর খেলা খেলুন। একটি বক্সে একটি অক্ষর লিখুন আর কয়েক টুকরো কাগজে সেই অক্ষরের কয়েকটি শব্দ লিখে রাখুন। শব্দের বদলে বিভিন্ন ছবি ব্যবহার করলে আরো ভালো। এবার আপনার সন্তানকে বলুন সেই বক্সে এই অক্ষরের শব্দগুলো কিংবা ছবিগুলো রাখতে। সে ঠিকমতো রাখতে পারছে কিনা দেখুন। এভাবে মজার ছলে নতুন অক্ষরের পাশাপাশি নতুন শব্দও শিখতে পারবে।
ছড়ায় ছড়ায় ছন্দের পরিচতি
বাজারে বিভিন্ন ছড়ার বই পাওয়া যায়। এগুলো কিনে এনে আপনার শিশুকে বিভিন্ন ছন্দের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে পারেন। ছন্দের সাথে আশেপাশের জিনিসকে চিনতে বাচ্চারা বেশ পছন্দ করে। বিভন্ন ছন্দ বাচ্চাদের মাথায় বেশ সহজেই গেঁথে যায়। আর শিশুবয়সে শেখা কোনো জিনিস আমরা সাধারণত অনেকদিন মনে রাখি, সহজে ভুলি না। তাই ছড়ার ছন্দের সাথে বাচ্চাদের আশেপাশের জিনিসের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়াটা বেশ কার্যকর একটি উপায়।
বিভিন্ন আকৃতি চেনানো
বাচ্চারা সবসময়ই বিভিন্ন আকৃতি নিয়ে খেলা করে মজা পায়। এজন্য তাদের আঁকতে দিলে তারা সবসময় পাঁচ কোনাকার তারা, বৃত্ত, ত্রিভুজ, চতুর্ভূজ এগুলো বেশি আঁকে। তাই তাদেরকে অবশ্যই বিভিন্ন আকৃতির সাথে পরিচয় করাতে হবে। সেগুলো আপনি তাকে মজার সাথেই করাতে পারেন।
কাগজ কেটে বিভিন্ন আকৃতি তৈরি করতে পারেন। চাইলে বাজার থেকে বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিকের তৈরি আকৃতি কিনে আনতে পারেন। অথবা চাইলে আপনার শিশুকে তার অন্যান্য বন্ধুদের সাথে বালুর উপর ছেড়ে দিতে পারেন। এভাবেই সে খেলার ছলে বিভিন্ন আকৃতির সাথে পরিচিতি লাভ করবে।
অরিগামি
ছোটবেলায় সকল করা কাজের মধ্যে মজার একটি কাজ হলো অরিগামি। কাগজ ভাজ করে বা কেটে নৌকা, বিমান, ফুল, পাখি, ব্যাঙ ইত্যাদি বানানো হলো অরিগামি। প্রথমে এগুলো বানানো অনেক কঠিন মনে হলেও কাজটা কিন্তু বেশ মজার। এর মাধ্যমে আপনার শিশুর বুদ্ধি আর চিন্তাশক্তি দুটোই বৃদ্ধি পাবে।
শুধু তাই না। বাচ্চারা তাদের খেলার উপকরণও নিজেরা তৈরি করে নিতে পারবে। এই জিনিসগুলোই তাদের সৃজনশীলতা বাড়ায় এবং বিভিন্ন জিনিস জানতে আগ্রহী করে তোলে।
বাচ্চাদের কাছে শেখানোর এই বিষয়গুলো যতটা আনন্দদায়ক করে তোলা যায়, ততই ভালো। এর ফলে তাদের কাছে সবকিছু সহজ মনে হবে। আর বাচ্চারাও সবসময় নতুন কিছু শেখার জন্য উদগ্রীব থাকে। তাই তাদের আগ্রহের কথা মাথায় রেখে তারা যেন তাদের শৈশবটাকে সুন্দরভাবে উপভোগ করতে পারে, সেদিকে আমাদের নজর দেয়া উচিত।
Feature image: NeuroNet Learning