নিঃসঙ্গতা নিয়ে কখনো খুঁটিয়ে ভেবে দেখেছেন? গানের কথায় ‘কেন এই নিঃসঙ্গতা’ ধাঁচের ভাবনা নয় কিন্তু! নিঃসঙ্গ থাকার প্রবণতা, বা কারণ, প্রভাব ইত্যাদি নিয়ে অনেকটাই ভাবার জায়গা আছে। তেমনই কিছু গঠনমূলক ভাবনার ফলাফল উঠে এসেছে এক জরিপে, যা আপনাকে নিঃসঙ্গতা নিয়ে অনেককিছুই জানাবে। এই যেমন, নিঃসঙ্গতা মানেই বয়স্ক মানুষের জীবনের অংশ, নিঃসঙ্গ মানুষেরা অসামাজিক হয়, এই জাতীয় ধারণাগুলো কতটা সঠিক আসলে?
বিবিসির পক্ষ থেকে ‘লোনলিনেস এক্সপেরিমেন্ট‘ নামে একটি জরিপ চালানো হয়েছিল অনলাইনে। বিশ্বব্যাপী প্রায় পঞ্চান্ন হাজার মানুষ অংশগ্রহণ করেছিল এতে। সেখানে উঠে এসেছে একাকিত্ব বিষয়ক বিভিন্ন তথ্য, যার কোনো কোনোটা হয়তো আপনাকে সত্যিই অবাক করে দেবে। সেগুলো জেনে নেওয়া যাক তবে।
কম বয়সীরা একাকিত্বে ভুগছে বেশি
একাকিত্বে ভোগা একজন মানুষের ছবি কল্পনা করুন। কী ভাসছে মনে? বেশিরভাগের মানসপটেই এমন একজনের ছবি ভাসবে, যিনি বার্ধক্যে পা রেখেছেন, এবং প্রায় একাই বসবাস করছেন। ব্যাপারটা অনেকটা সত্য। বুড়ো মানুষের খুব বেশি সঙ্গী নেই, তারা একলা সময় পার করার দায় মাথায় নিয়েই যেন বৃদ্ধ হয়।
বিবিসির এই জরিপেও দেখা যায়, ৭৫ বছরের ঊর্ধ্বে ২৭ শতাংশ অংশগ্রহণকারীই জানিয়েছেন, প্রায়ই তারা একাকিত্বে ভোগেন।কিন্তু, একাকিত্ব অনুভব করার পারদটা এখানে লক্ষণীয়ভাবে অল্প বয়স্কদের মাঝেই বেশি।
নিঃসঙ্গতা সবচেয়ে বেশি দেখা যায় ১৬-২৪ বছর বয়সের মানুষদের মাঝে, যাদের ৪০ শতাংশই জানিয়েছেন, তারা প্রায়ই একাকিত্বে ভোগেন। প্রশ্ন আসতে পারে, বিশাল সংখ্যক তরুণ কেন একাকিত্বে ভুগছে? হতে পারে, তারা তাদের সামান্য একাকীত্বকেও একটু বেশি বেশি করে প্রকাশ করতে চায়। লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, জরিপে অংশ নেওয়া বেশিরভাগ মানুষই জানিয়েছেন, তারা জীবনের তরুণ ও প্রাপ্তবয়স্কের সময়টায় বেশি একা বোধ করেছেন।
কাজেই এমন সিদ্ধান্তে আসা যাচ্ছে না যে, আধুনিক জীবনযাত্রার কারণে তরুণ প্রজন্ম একা হয়ে পড়ছে। বরং যেকোনো যুগেই এই হতচ্ছাড়া একাকিত্ব আসছে তারুণ্যের হাত ধরে। সদ্য প্রাপ্তবয়স্ক হবার এই সময়টা জীবনে নতুন গতি এনে দেয় ঠিকই, কিন্তু এতদিনের জীবনের যে চিরচেনা ছন্দ থাকে, তা যেন হারিয়েই যায় অনেকখানি।
একাকিত্ব ইতিবাচক
জরিপে অংশ নেওয়া মোট ৪১ শতাংশ মানুষ একা থাকার ব্যাপারটিকে ইতিবাচক ভাবছেন। প্রয়াত স্নায়ুবিজ্ঞানী জন ক্যাসোপ্পোর ধারণা অনুযায়ী, একাকিত্ব মানুষের জন্য অপ্রীতিকর হলেও ইতিবাচক হতে পারে। মানুষ সামাজিক দল গঠনের মাধ্যমেই জীবনযাপন করে থাকে। যদি কখনো সে একটি দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, তাহলে একা হয়ে পড়ার অনুভব তাকে নতুন দলের দিকে টেনে নেবে। সে নতুন বন্ধু বানাবে, অথবা পুরনো সম্পর্কগুলোকেই আবারো যত্ন করবে। এ বিষয়গুলো একজন মানুষের জন্য ইতিবাচক হতে পারে।
তবে নিঃসঙ্গতা দীর্ঘস্থায়ী হয়ে পড়লে তা যে কারো সার্বিক অবস্থার উপর বাজে প্রভাব রাখতে পারে। হতে পারে শারীরিক বিপর্যয়ের কারণও। বছরখানেক স্থায়ী হওয়া নিঃসঙ্গতাই নিয়ে আসতে পারে বিষণ্নতার ঝুঁকি। জরিপে অংশ নেওয়া একাকিত্বে ভোগা মানুষদের মাঝে ৩১ শতাংশ বলেছে, একাকিত্ব ইতিবাচক হতে পারে।
যোগাযোগের সক্ষমতা
প্রচলিত ধারণানুসারে, যে সকল মানুষ একাকিত্বে ভোগে, তারা বন্ধু বানাতে পারদর্শী হয় না। তারা সামাজিকতা রক্ষায় অদক্ষ। নিঃসঙ্গ একজন মানুষ সম্পর্কে এমন ধারণা হওয়াটা আসলে অস্বাভাবিকও নয়। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, বিবিসির এই নিঃসঙ্গতা বিষয়ক জরিপের ফলাফলে এমনটা দেখা যায়নি।
সামাজিক ভাব বিনিময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে আশেপাশের মানুষদের অনুভূতি বুঝতে পারা, যাতে সেই অনুযায়ী নিজের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা যায়। এই দক্ষতা যাচাইয়ের জন্য জরিপে অংশ নেওয়া মানুষদের কিছু চেহারা কিংবা চোখ দেখানো হয়, যেগুলো দিয়ে ঐ মানুষগুলোর ভেতরকার অনুভূতি নির্ধারণ করতে বলা হয়। ছবিতে দেখানো চেহারা বা চোখের ভাষা পড়ে তাদের বলতে হয়েছে, তখন ঐ মানুষেরা আসলে কী ভাবছিলো, তাদের মনের মধ্যে কী চলছিল। পরীক্ষা থেকে প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা যায়, নিঃসঙ্গতায় ভোগা মানুষ এবং স্বাভাবিক মানুষের পারফর্মেন্সে কোনো পার্থক্য নেই। অর্থাৎ দুই দলের মানুষই প্রায় অভিন্ন ফল দেখিয়েছে। আর তাই একা থাকা মানুষেরা সামাজিক যোগাযোগের ব্যাপারে আনাড়ি, এমন ধারণা অন্তত নিয়ে রাখা চলবে না।
শীত সবচেয়ে নিঃসঙ্গ সময় নয়
হিমের ঋতুকে বছরের সবচেয়ে একাকী সময় বলে ভাবা হয়, এই কথাটা কি জানতেন? এই দেশের প্রেক্ষাপট ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু বাইরের দেশের প্রেক্ষাপটে অনেকেই ভাবে, একাকিত্ব আর শীতকালের মাঝে গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আছে।
বড়দিন উপস্থিত হবার সময়টায় প্রায়ই বিভিন্ন দাতব্য সংস্থার প্রচারণা চলে। এরা একা বাস করা বয়স্ক মানুষদের সাহায্য করে। বড়দিনের উৎসব যেন একলা না কাটে কারো। ব্রিটিশ কৌতুকশিল্পী সারাহ মিলিকান বড়দিনে টুইটারে বেশ সফল হ্যাশট্যাগ #JoinIn প্রচারণা চালান, যাতে নিঃসঙ্গ বোধ করা মানুষেরা একে অপরের সাথে বার্তা বিনিময় করতে পারে।
কিন্তু জরিপে উঠে এসেছে ভিন্ন তথ্য। অনেকেই জানিয়েছে, শীত বছরের অন্যান্য সময়ের মতোই। অধিক নিঃসঙ্গ নয়। জরিপে অংশ নেয়া মানুষদের জিজ্ঞেস কর হয়েছিল, বছর এবং দিনের মধ্যে সবচাইতে একাকী বোধ করা সময়ের কথা। দুই-তৃতীয়াংশের বেশি মানুষই জানিয়েছে যে, শীতকালে বেশি নিঃসঙ্গ অনুভব করে না তারা। অল্প সংখ্যক মানুষ উত্তরে বেছে নিয়েছে শীতকাল, কিছু মানুষ বলেছে গ্রীষ্মকালের কথাও।
অধিক সহমর্মিতা
নিঃসঙ্গ থাকা মানুষেরা অন্য অনেকের চেয়ে বেশি সহানুভূতিশীল হয়। মানুষের দুঃখ-কষ্টের প্রতি তাদের অনুভূতি প্রখর। এই জরিপে মানুষের দুই ধরনের সহানুভূতি যাচাই করা হয়েছে- একটি মানুষের শারীরিক যন্ত্রণার প্রতি সহমর্মিতা এবং অন্যটি তাদের সামাজিক যন্ত্রণার প্রতি সহমর্মিতা। শারীরিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত কারো প্রতি অনুভূতি কী হয়, সমাজে কোনো কারণে অপদস্থ হওয়া বা বঞ্চনার শিকার হওয়া কারো প্রতি কোন ধরনের মনোভাব হয়- এসব পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে অংশগ্রহণকারীদের মাঝে।
নিঃসঙ্গ বোধ করা এবং না করা উভয় দলই শারীরিক যন্ত্রণায় ভোগা মানুষের প্রতি প্রায় সমান সহমর্মী মনোভাব দেখিয়েছে। কিন্তু, নিঃসঙ্গ মানুষেরা অন্যের সামাজিক কষ্টের প্রতি সহানুভূতি দেখানোয় এগিয়ে আছে। হতে পারে সেসব যন্ত্রণার সাথে তাদের নিজেদের গল্পও মিলে যায় বলেই!