ছোটবেলায় আমেরিকার প্রথম প্রেসিডেন্ট ‘জর্জ ওয়াশিংটন’ অথবা গালিভার্স ট্রাভেলস বইয়ের লেখক জোনাথন সুইফ্টের ছবি দেখে প্রায়ই তাদের বিচিত্র ধরনের চুলের সজ্জা সম্বন্ধে ভাবতাম। এতদিন বাদে সেই কৌতূহলী মনের অদ্ভুত সেই জিজ্ঞাসা নিয়েই আজকের লেখা। আজকে জানা যাক, মহামারি থেকে উদ্ভূত, সতেরো শতকের সামাজিক মর্যাদার বিভক্তি সৃষ্টিকারী, উপনিবেশিক শোষণের প্রতীক ‘পরচুলা’ সম্বন্ধে।
পরচুলাকে ফ্যাশন ট্রেন্ড হিসেবে আবির্ভূত করার পেছনে একটি প্রধান প্রভাবক সিফিলিস, যা ছিল চতুর্দশ শতকের একটি ভয়াবহ যৌনব্যাধি। ইতালির ডাক্তার ও কবি জিরোলামো ফ্রুকাস্ত্রো এর নামকরণ করেছিলেন সিফিলিস, যাকে বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘ফরাসি রোগ’। তিনি এ বিষয়ে একটি কবিতাও লিখেছিলেন, যার নাম ‘অ্যা শেফার্ড নেমড সিফিলিস’ (A shepherd named Syphilis)। এই কবিতায় সিফিলিস নামের একজন রাখাল ছিল। প্রচন্ড খরার কারণে তার গোষ্ঠীর সবাই অনাহারে মৃত্যুবরণ করে, তখন সে চন্দ্র ও সূর্য দেবতাকে তার জ্ঞাতিদের মৃত্যুর জন্য দায়ী করে ও খারাপভাবে দেবতাদের সম্বোধন করে। ফলশ্রুতিতে, দেবতারা রুষ্ট হয়ে পৃথিবীতে সৃষ্টি করেন ভয়াবহ এক মহামারি ‘সিফিলিস’।
এটি তখনকার দিনে এত ভয়ানক একটি অসুখ ছিল যে, এতে আক্রান্ত হলে নিশ্চিত মৃত্যু অথবা নিশ্চিত অঙ্গহানি। ১৭০০ সালের দিকে সিফিলিসের চিকিৎসায় একটি নতুন ধারা যুক্ত হয় পারদ ব্যবহারের মাধ্যমে। ১৯৪০ সালে পেনিসিলিন আবিষ্কারের পূর্ব পর্যন্ত এই পারদের প্রয়োগই সিফিলিসের চিকিৎসায় একমাত্র কার্যকরী ছিল। তবে এই পারদ চিকিৎসা একদিকে যেমন ছিল কষ্টদায়ক, অপরদিকে ছিল বিভিন্ন রকমের পার্শপ্রতিক্রিয়া যুক্ত।
পারদ চিকিৎসার ফলে সিফিলিস ভালো হলেও তাতে ক্ষয় হয়ে যেত আক্রান্তদের নাক বা বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ অঙ্গ। এছাড়াও শরীরের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য ছোট ছোট গুটি বসন্তের মতো আকৃতি তৈরি হতো এবং মাথার বিভিন্ন স্থানে খন্ড খন্ডভাবে চুল উঠে যেত, এমনকি মাথার ত্বকেও ঘা হত। সিফিলিসের প্রচুর প্রাদুর্ভাবে স্বাভাবিকভাবেই মাথায় চুল না থাকলে সমাজের দৃষ্টিতে একজনকে হেয় হতে হতো। এভাবেই সিফিলিস রোগের হাত ধরে পরচুলা পেয়ে যায় উচ্চশ্রেণীর সমাজে প্রবেশের টিকেট। বিশেষ ধরনের এই ইউরোপিয়ান পরচুলাগুলোকে বলা হয় Peruke।
পরচুলার আরও অতীত ইতিহাস জানতে প্রথমে আমাদের তাকাতে হবে প্রাচীন মিশরের দিকে। ৩,০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের মিশর বিজয় পর্যন্ত পুরোটা সময় জুড়েই সমগ্র পৃথিবীতে অন্যতম ছিল মিশরীয় সভ্যতা। যুদ্ধ, রাজনীতি, শিক্ষা ব্যবস্থা, বিজ্ঞান চর্চা, ধর্মীয় নীতি ও নাগরিক জীবন প্রতিটি বিষয়ই যেন ছিল অত্যন্ত নিখুঁত ও আলাদা। মিশরের পুরোনো দিনগুলোতে এই পরচুলা ছিল নারী ও পুরুষ উভয়ের পরিষদের অন্যতম অনুষঙ্গ। মিশর কিন্তু বরাবরই উষ্ণ আবহাওয়ার দেশ। ফলে তীব্র সূর্যের তাপ, সংক্রামক চর্মরোগ থেকে মাথা বাঁচাতে ও কুটকুটে উকুনের কামড় থেকে রক্ষা পেতে তারা মাথা কামিয়ে ফেলত।
কিন্তু সুন্দর চুল কে না ভালোবাসে! তাই চুলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে তারা পরচুলা উদ্ভাবন করে। সেসময় পরচুলাগুলো মানুষের চুলসহ বিভিন্ন উদ্ভিদজাত তন্তু ব্যবহার করে তৈরি করা হত, যা ছিল শুষ্ক আবহাওয়ার জন্য একেবারেই উপযোগী। এই পরচুলাগুলো তারা অনেকটা টুপির মতো করে মাথায় ব্যবহার করত। তবে একটা বিষয় নিশ্চিত করে বলা যায় যে, প্রাচীন মিশরীয়রা বাহ্যিক আকর্ষণের বিষয়ে ছিলেন খুব সচেতন। তাইতো দৈনন্দিন ব্যবহারের পাশাপাশি মৃত্যুর পরও তাদের কবরে স্থান পেত তাদের ব্যবহৃত এই পরচুলাগুলো। মিশর ছাড়াও সেসময়ের রোমান ও গ্রীক সভ্যতার লোকদের মধ্যে পরচুলা ব্যবহারের ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায়। যারাই যে সময় এটি ব্যবহার বা প্রচলন ঘটিয়ে থাকুক না কেন ইউরোপিয়ানদের সতেরো শতকের পরচুলাগুলো কিন্তু ইতিহাসের পাতায় একটি বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছে তাদের বৈচিত্র্য ও অভিজাত্যের গুণে।
তারপরও পশ্চিমী এই জনপ্রিয় ফ্যাশন ধারা কিন্তু পূর্বের দেশগুলো তেমন একটা আত্মস্থ করতে পারেনি। প্রাচীন ভারত উপমহাদেশে সেসময় মহিলাদের মাথায় থাকত লম্বা চুল আর ভারতীয় পুরুষরা সৌন্দর্যের চেয়ে যাপিত জীবনের আর্থিক উন্নতি সাধনেই ছিলেন অধিক মনোযোগী। প্রাচ্যে প্রচুর ব্যবহার না থাকলেও জাপানের ‘গেইশা’দের বিভিন্ন সাজসজ্জার জন্য ছিল পরচুলার প্রয়োজনীয়তা।
১২০০ সালের দিকে পাশ্চাত্যে খ্রিস্টধর্মের আধিপত্য বৃদ্ধির সাথে সাথে মহিলারা খোলা চুলের চেয়ে মাথায় স্কার্ফ ব্যবহারকেই বেশি সম্মানজনক মনে করতেন আর পুরুষদের জন্য ফ্যাশন-চর্চাকে সেসময় উগ্রবাদীতার পর্যায়ে ধরা হতো। ফলে, পরচুলা হারিয়ে ফেলে তার আভিজাত্য ও প্রয়োজনীয়তা। কিন্তু রেনেসাঁর সূচনা সাথে সাথেই মধ্যযুগের সমাজ ব্যবস্থা ও জীবনযাপনে পরিবর্তন আসতে শুরু করে। ফলে নিয়ম-নীতির গ্যাঁড়াকলে আটকে থাকার চেয়ে মানুষ দৃশ্যমান ও মানসিক নতুনত্বর দিকে ছুটতে থাকে।
তখনকার ইউরোপেও মহিলাদের পাশাপাশি পুরুষদেরও লম্বা চুলের প্রতি আকর্ষণ ছিল। মাথাভর্তি ঘন লম্বা চুল যেন পুরুষদের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ রূপের পরিচায়ক ছিল। কিন্তু সিফিলিসের কারণে চুল ঝরে যাওয়ার ফলে সমাজ ব্যবস্থায় উঁচু শ্রেণী ও নিচু শ্রেণীর বিভেদ আরো দৃশ্যমান হতে থাকে। কারণ নিচু শ্রেণীর লোকেরা অর্থের বিনিময় তাদের সৌন্দর্য বর্ধনের ক্ষমতা না রাখলেও, উঁচু শ্রেণীর মানুষজন অর্থ দিয়ে লুকাতে চাইতেন সিফিলিসের কুৎসিত চিহ্ন।
১৬০০ সালের দিকে ইউরোপ জুড়ে ব্যবহার হলেও পরচুলাকে জনপ্রিয় করে তোলেন ফরাসি রাজা ষোড়শ লুই। মাত্র ১৭ বছর বয়সে অত্যধিক মাত্রায় তার মাথার চুল উঠে যেতে থাকে। যদিও এটি নিশ্চিত করে বলা যায় না যে, তিনি সিফিলিসে আক্রান্ত হয়ে চুল হারিয়ে ছিলেন। ফলে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে ও সামাজিক মর্যাদা রক্ষার্থে তিনি নিজের জন্য অত্যন্ত সুন্দর ও অভিজাত একটি পরচুলা তৈরির সিদ্ধান্ত নেন। ঐতিহাসিকদের মতে, তিনি প্রায় ৪৮ জন পরচুলা প্রস্ততকারককে নিযুক্ত করেছিলেন এই ব্যক্তিগত মাস্টারপিস তৈরিতে।
পরবর্তীতে, ষোড়শ লুই-এর গোত্রীয় ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় চার্লস এবং রানী প্রথম এলিজাবেথও পরচুলা ব্যবহার করতে শুরু করেন। স্বাভাবিকভাবেই আপামর জনসাধারণ রাজকীয় রীতিনীতি অনুকরণ করে থাকে। ফলে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের রাজাদের এই পরচুলা ব্যবহার ব্যাপক হারে সমগ্র ইংল্যান্ডের পরচুলা পরিধানের একটি শতাব্দী সূচিত করে। বহুল প্রচলিত এই ফ্যাশন অনুষঙ্গটির জন্য লোকজনদের গুনতে হতো উচ্চমূল্য। সাধারণ লোকজন যে পরচুলা ব্যবহার করতেন সেগুলোর একেকটির দাম ছিল প্রায় ২৫ শিলিং, যা সেসময়ে লন্ডন শহরে বসবাসকারী লোকদের গড় সাপ্তাহিক রোজগার ছিল। আর কোঁকড়ানো বড় ও লম্বা পরচুলাগুলো যা আমরা ছবিতে অভিজাতদের মাথায় দেখি, সেগুলোর একেকটির মূল্য ছিল প্রায় ৮০০ শিলিং বা আরো বেশি।
ফরাসি অভ্যুত্থানের সাথে সাথেই এই পরচুলাকে বুর্জোয়া সমাজের প্রতীক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ফলে ফ্রান্সে পরচুলার ব্যবহার বন্ধ হয়ে যায়। অপরদিকে, ১৭৯৫ সালে ইংল্যান্ডের উইলিয়াম পিট পরচুলায় ব্যবহৃত পাউডারের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করলে ইংল্যান্ড থেকেও বিদায় নেয় জনপ্রিয় এই বেশটি।
তবে এই পরচুলাকে কেবলমাত্র মহামারি লুকানোর চিহ্ন হিসেবে বিবেচনা না করে একটি সামাজিক স্তরবিন্যাসের প্রতীক হিসেবেও বলা যায়। কারণ পরচুলার উচ্চমূল্য কেবলমাত্র স্বল্পসংখ্যক মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের মধ্যেই এর ব্যবহার সীমাবদ্ধ রেখেছিল। আবার প্রাচীন মিশরেও রাজকীয় বংশধররা ছাড়া আপামর জনসাধারণের পরচুলা ব্যবহারের অনুমতি ছিল না। এছাড়াও সতেরো বা আঠারো শতকের দিকে ফ্রান্স, ইংল্যান্ড এবং আমেরিকা সমগ্র পৃথিবীতে উপনিবেশিক শোষণের রাজত্ব কায়েম করেছিল। যাতে করে শাসকদের সাদা চামড়া ও কোঁকড়ানো বড় পরচুলাগুলো সেসময়ে ছিল সমাজের শোষক শ্রেণীর প্রতিকৃতি।
শেষমেশ মহামারি বা সামাজিক শোষণ অথবা রাজকীয় পরিচ্ছদ ধারা, যেটাই বলা হোক না কেন, মধ্যযুগ পেরিয়ে বর্তমান যুগে পরচুলা করে নিয়েছে নিজের অবস্থান। অন্ধকার অতীত ফেলে, পরচুলা এখন ইনস্টাগ্রাম সেলিব্রেটি থেকে শুরু করে সরকারি দপ্তরের টেকো বড়বাবু সবাইকেই বন্ধু করে নিয়েছে।