অরুণিমা চট্টোপাধ্যায় (ছদ্মনাম); ২৮ বছর বয়সী এই তরুণী পেশায় একজন গবেষক। স্নাতকোত্তর পর্যায় পর্যন্ত তুখোড় ফলাফল করে একটি খ্যাতনামা গবেষণা প্রতিষ্ঠানে যোগদান করতে বহু কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে তাকে। অবশ্য পড়ালেখা, ক্যাম্পাস জীবন, আর্থিক টানাপড়েন ইত্যাদি নিয়ে যতটা না তাকে পরিশ্রম করতে হয়েছে, তার চেয়ে বেশি যন্ত্রণার ছিল বিয়ের বিষয়টি। ‘বাঙালি নারী কুড়িতেই বুড়ি’- চলমান সময়েও এমন কথা তাকে শুনতে হয়েছে স্বজনদের কাছ থেকে। সম্প্রতি জার্মানির শীর্ষস্থানীয় একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফুল ফান্ডিং সমেত তিনি পিএইচডি ডিগ্রীর অফার পেয়েছেন। জার্মানি যাওয়ার কথা উঠতেই তিনি বাসায় এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলেন। তার এতগুলো বছরের শ্রমের বদলে অর্জিত সাফল্যকে কেউ অভিবাদন না জানিয়ে সবাই বরং চিন্তিত তার বিয়ে নিয়ে। জার্মানি চলে যাওয়ার কথা বাসায় জানালে পরিবারের সদস্যদের উত্তর ছিল,
বিয়ে করে তবেই তুমি জার্মানি যাচ্ছ। এর কোনো অন্যথা হচ্ছে না।
শাহরিয়ার ইকবাল (ছদ্মনাম)। ২৭ বছর বয়সী এই তরুণ পেশায় একজন ব্যাংকার। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই স্বপ্ন- তিনি ব্যবসা করবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষ থেকে তার তিল তিল পরিশ্রমে গড়ে ওঠা স্টার্টআপটি অতি সম্প্রতি বড় রকমের বিনিয়োগ পেয়েছে। একটি পূর্ণকালীন চাকরির পাশাপাশি একটি স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠা করে এই পরিমাণ বিনিয়োগ নিয়ে আসতে পারা যে কতটা কঠিন সেটি সম্ভবত তিনি ছাড়া কেউই জানেন না। তার এই অর্জনের কথা বাসায় জানাতেই পরিবারের দীর্ঘশ্বাস মাখা জবাব ছিল,
এত করে বললাম তবুও তুমি বিসিএস পরীক্ষাটা দিলে না। সেই নিজের জেদই বজায় রাখলে।
উপরের দুটো উদাহরণ শুধু একজন অরুণিমা বা একজন শাহরিয়ারের প্রতিনিধিত্বই করে না, বরং সহস্রাব্দ প্রজন্মের অধিকাংশের জন্য এটি অতীব সাধারণ চিত্র। এই প্রজন্মের সিংহভাগ সদস্যই এক অদ্ভুত দ্বিধান্বিত জীবনের ভেলায় ভেসে চলেছে। যাপিত জীবনের অনেকাংশেই তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত হয়ে এমন একটি জীবন বেছে নিতে বাধ্য হয় যেখানে নিজের নয়, বরং অন্যের পরামর্শের বাস্তবায়ন ঘটানোই সাফল্যের নামান্তর।
সমাজের ঠিক করে দেওয়া মাপকাঠি
প্রতিটি সমাজেই বহুকাল ধরে চলে আসা কিছু নির্ধারিত মাইলফলক থাকে। বাঙাল মুলুকে দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা রীতি হচ্ছে- ২৫ বছরের মাঝে বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করা, ২৮ বছরের মাঝে একটি সরকারি চাকরি জুটিয়ে নেওয়া, চাকরির বছরখানেকের মাঝেই বিয়েশাদির পর্ব সম্পন্ন করে ৩০ এর মাঝেই অন্তত একটি সন্তান নিয়ে ফেলা। আর্থসামাজিক অবস্থান, ধর্মীয় মূল্যবোধ, লিঙ্গ ইত্যাদি ভেদে এই রীতির কিছুটা হেরফের হলেও মোটের ওপর ব্যাপারটা এরকমই থাকে। এখানে লক্ষণীয় হলো- প্রতিটি বিষয়কে একটি সময়ের বেড়াজালে বেধে ফেলার চর্চা। অর্থাৎ, ২৫ এর মাঝে স্নাতক সম্পন্ন না হওয়া, ২৮ এর মাঝে চাকরি এবং ৩০ এর মাঝে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে না পারা সমাজের চোখে বিশাল ব্যর্থতা হিসেবে বিবেচিত হয়।
এই বিষয়গুলো কিন্তু কোনো লিখিত নিয়ম নয়। এমনও নয় যে এসবের ব্যত্যয় ঘটলে অন্যায় কিছু হবে। তথাপি এই প্রচলিত বিষয়গুলোকে আপ্তবাক্য ধরে জীবন পরিচালনা করার যে তুমুল সামাজিক চাপ তা অস্বীকার করার জো নেই। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে তথাকথিত এই মানদণ্ড প্রবাহিত হয়ে আসছে।
সমস্যা হচ্ছে যে- প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ সাধন, অর্থনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তন, রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের পালাবদল ইত্যাদি নানা কারণে প্রতিটি প্রজন্মের কাছে জীবনবোধ বদলে যায়। অর্জন, সাফল্য, লক্ষ্য ইত্যাদির সংজ্ঞায়ন পাল্টে যায়। আজ থেকে ৫০ বছর আগে সমাজে চাকরি পাওয়ার জন্য যে বয়সকে আদর্শ বলে বিবেচনা করা হতো, সেটির পেছনে সুনির্দিষ্ট কিছু কারণ ছিল। সেই একই কারণ ৫০ বছর পর আজকের বাস্তবতায় খাপ খাবে না- এটাই স্বাভাবিক। ফলত, চাকরি নিয়ে আজকের প্রজন্ম যা ভাববে এবং যেভাবে ভাববে সেটি অবশ্যই ভিন্ন কিছু হবে।
শিখন পদ্ধতি
মানবমস্তিষ্ক জন্মের পর থেকেই শিখতে শুরু করে। শেখা বলতে এখানে শুধু প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার কথা বোঝানো হচ্ছে না। ক্লার্ক ইউনিভার্সিটি ইন ম্যাসাচুসেটসের গবেষক জেফরি আর্নেট গবেষণা করেন এমার্জিং অ্যাডাল্টহুড নিয়ে। মানুষের শেখার পদ্ধতি ও বাস্তবায়নের প্রবণতা সম্পর্কে তিনি বলেন,
আমরা প্রতিনিয়ত শেখার একটি প্রক্রিয়ার মাঝে বসবাস করি। চারপাশের মানুষ যে ভাষায় কথা বলে, আমরা সেটি খুব দ্রুতই শিখে নিই, আশেপাশের মানুষ যেভাবে ব্যবহার করে সেগুলোকেই আমরা রপ্ত করি, সমাজের নানা রীতিনীতি আমরা বুঝে নিতে শিখি যে কোনটি আমাদের জন্য অনুমোদিত আর কোনটি নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা তা-ই করে থাকি যা আমাদের কাছ থেকে আশা করা হয়ে থাকে। খেয়াল করলে দেখা যাবে যে, আমরা এই বিষয়গুলোকে রপ্ত করে থাকার পরে নিজেরাও এগুলোকেই অনুসরণ করে থাকি যদিও সুনির্দিষ্টভাবে এগুলোর প্রণয়নের পেছনে কেউ দায়ী নয়। সত্যিকার অর্থে এগুলোর নিয়ন্ত্রণে কেউ নেই।
বিয়ে, সন্তান গ্রহণ, গাড়ি বাড়ি কেনা ইত্যাদির ক্ষেত্রে সাধারণত বাবা-মা ও আত্মীয়স্বজনরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের চেষ্টা করে থাকেন। এক্ষেত্রে একটি বিষয় লক্ষ্য করা উচিৎ যে, পশ্চিমা বিশ্বে বেবি বুমারস প্রজন্মের অধিকাংশই ২০ এর আশেপাশে বিয়ে করে ফেলেছিল এবং পরবর্তী কয়েক বছরের মাঝেই তাদের সন্তান গ্রহণ, বাড়ি-গাড়ির মালিক হয়ে যাওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলকগুলো অর্জিত হয়ে গিয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই সেই প্রজন্মের সন্তান হিসেবে অর্থাৎ সহস্রাব্দ প্রজন্মের যারা এখন ক্যারিয়ারে প্রবেশ করছেন বা শীঘ্রই করবেন তাদের কাছে বাবা-মার আশাও ঐ একই ধাঁচের। অথচ তারা এটুকু বুঝতে নারাজ যে- দীর্ঘ এতগুলো বছরে বৈশ্বিক আবহাওয়ায় পরিবর্তনের ঢেউ কম খেলা করেনি।
সহস্রাব্দ প্রজন্মের চিত্র
জেনারেশন জি বা সহস্রাব্দ প্রজন্ম চেষ্টা করছে তাদের পূর্ববর্তী প্রজন্মের স্টেরিওটাইপ থেকে বের হয়ে আসার। বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে তারা পূর্ব-নির্ধারিত মাইলফলকগুলো ছোঁয়ার তোয়াক্কা করছে না বললেই চলে। বিয়ের ক্ষেত্রে এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা তাদের বাবা-মা’র চেয়ে গড়পড়তা ৭ বছর পর বিয়ে করছে। এমনকি অনেকে অবিবাহিত অবস্থাতেও জীবন কাটাতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে। গত ৪ দশকে নারীদের প্রথমবারের মতো মা হওয়ার বয়স ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সহস্রাব্দ প্রজন্মের নারীরা তাদের বেবি বুমারস মায়েদের চেয়ে অধিক বয়সে প্রথম সন্তানের জন্ম দিচ্ছেন। মোটামুটিভাবে তারা ২৯ এর আশেপাশে প্রথমবারের মতো মা হচ্ছেন, এবং ক্ষেত্রবিশেষে তারও পরে সন্তান গ্রহণের কথা ভাবছেন। নিজস্ব বাড়ির মালিকানা অর্জনের ক্ষেত্রে এই প্রজন্ম তাদের পূর্ববর্তী দুই প্রজন্মের চেয়ে শতকরা ৮ ভাগ পিছিয়ে আছে।
যদিও পরিবারপরিজনের অত্যধিক চাপ এবং আশা আছে, তবে সহস্রাব্দ প্রজন্মের বৃত্ত ভাঙার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে শিক্ষার হার বৃদ্ধি পাওয়া। পূর্ববর্তী প্রজন্মের তুলনায় তাদের শিক্ষা গ্রহণের হার এবং শিক্ষাগত যোগ্যতা উভয়ই উল্লেখযোগ্য হারে বেশি। অর্থাৎ, যে বয়সে বেবি বুমারস প্রজন্ম নিজেদের যথেষ্ট শিক্ষিত ভাবতেন, সেই একই মাপকাঠি আর ধোপে টিকছে না তাদের সন্তানদের বেলায়। এছাড়াও বেবি বুমারস প্রজন্ম সত্যিই শিক্ষা গ্রহণের ব্যাপারে যে ধরনের ধারণা পোষণ করতেন, সেটিও পাল্টে গেছে তাদের সন্তানদের ক্ষেত্রে। শিক্ষাজীবন সম্পন্ন করার বয়সের পরিবর্তন এবং শিক্ষা গ্রহণের প্রতি পোষণকৃত ধারণা উভয়েরই বড় রকমের পরিবর্তন আসায় বিয়ের বয়স, সন্তান গ্রহণ, অর্থোপার্জন, সম্পত্তির মালিকানা ইত্যাদি সব বিষয়ের প্রতি সহস্রাব্দ প্রজন্মের ধ্যানধারণা বহুলাংশে পাল্টাচ্ছে এবং পাল্টাবে।
ঔচিত্যের অত্যাচার
উচিৎ শব্দটা একপর্যায়ে সত্যিই আমাদের জীবনে অভিশাপ হয়ে যায়। নিজস্ব স্বপ্ন, লক্ষ্য ইত্যাদি পূরণের মাঝে সমাজ যখন প্রতি মুহূর্তে এটা করা উচিৎ, ওটা করা উচিৎ এগুলো বলতে থাকে, তখন নিজেদের জীবনবোধের যে ধারণা সেটা ধোয়াটে হয়ে আসে। অভিজ্ঞতার মূল্য আছে অবশ্যই।
পূর্ববর্তী প্রজন্মের জীবন বিশ্লেষণ করে সেখান থেকে গুরুত্বপূর্ণ অনেক কিছুই শেখা যেতে পারে। তবে পরিবার, সমাজ ইত্যাদির চাহিদা মেটাতে গিয়ে নিজের স্বপ্ন যেন কালের গহ্বরে হারিয়ে না যায়, সেদিকে খেয়াল রাখা অবশ্যই জরুরি। আপনার জীবনে অর্জন, সুখ, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি ইত্যাদির মানদণ্ড আপনি নিজেই ঠিক করবেন, অন্য কেউ না। তাই আপনার কর্ম, আচরণ ইত্যাদিও হবে নিজস্ব চাহিদানুসারে। জীবনটা আপনার, আর তাই অবধারিতভাবে যাপনের রীতিটাও আপনারই।